কলকাতার একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের বার্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। তিন থেকে দশ বছরের বাচ্চাদের আঁকা, লেখা এবং ছবিতে সমৃদ্ধ একটি সুন্দর পত্রিকা। প্রথম কিছু পাতা উল্টাতেই চমক, অন্তত বাচ্চাদের আঁকা ছবি দেখলেই বিষয়টি নজরে পড়বে। প্রতিটি পাতায় অন্তত একটি করে পদ্ম ফুলের ছবি, সঙ্গে অন্য ছবিও আছে। সেইগুলোর মধ্যেও ফুলের ছবি, অন্য ফুল। বিষয়টা সহজ চোখে দেখলে হয়তো এমনকিছু নয়, কিন্তু তাও বিষয়টি সম্পর্কে কিছু কথা বলা জরুরী।
পদ্ম আমাদের জাতীয় ফুল, সেটা আমরা অনেকেই জানি, কিন্তু পদ্ম যে একটি রাজনৈতিক দলেরও নির্বাচনী প্রতীক, সেটা হয়তো অনেক বেশি মানুষ জানেন। ছোটদের ঐ পত্রিকায় পদ্ম ছাড়া অন্য যে ফুলের ছবি বাচ্চারা এঁকেছে, সেই ফুলের সঙ্গে আবার অন্য আরো একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতীকের সঙ্গে অদ্ভুত সাদৃশ্য। বিষয়টি শুধু ছবি হলে একরকম ছিল, কিন্তু যেহেতু বাচ্চারা এঁকেছে, তাই এই সম্পর্কে কথা বলা জরুরী। বাচ্চারা এমনিতে যা দেখে, তাই তাঁদের মনে গেঁথে যায়। শিক্ষিকারা হয়তো বাচ্চাদের ফুলের ছবি আঁকতে বলেছেন, কিন্তু বাচ্চারা ঐ ছবিই এঁকেছে, যা তারা বিভিন্ন রাস্তাঘাটে, বিভিন্ন ফ্লেক্স, ব্যানার, দেওয়ালে দেখছে এবং প্রতিনিয়ত দেখে চলেছে। যাঁরা মনস্তত্ব নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা ভালো বলবেন হয়তো এই বিষয়ে, কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অনেকে বলতে পারেন, সবকিছুতে রাজনীতি দেখতে নেই, কিন্তু এই পত্রিকা দেখার পরে এবং সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে জি-২০ সম্মেলনের যে প্রতীক উদ্বোধন করা হয়েছে, তা দেখে যে কোনও সাধারণ মানুষের মনে যদি এই প্রশ্নটা আসে, তাহলে কি নিজেদের নির্বাচনী প্রতীকের প্রভাব আরো গভীরে প্রবেশ করানোর এটাও একটি প্রক্রিয়া? বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালে জি- ২০ গঠিত হয়। দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়াতে সেই সময়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার যে প্রভাব পড়েছিল, তা থেকে মধ্য আয়ের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক স্থিরতা দিতে এই জি- ২০ র সূচনা। প্রতিবছর এই জি- ২০ র সভাপতিত্ব বদলায়। ঘটনাচক্রে এই বছর ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখ থেকে ভারত এই সভাপতিত্বের দায়িত্ব পেয়েছে। গতবছর এই দায়িত্ব ছিল ইন্দোনেশিয়ার। যে দেশ এই সভাপতিত্ব পায়, তাঁরা তাঁদের দেশে সারা বছর জুড়ে বিভিন্ন সম্মেলন সংগঠিত করে, ভারতও করবে, তারপর আগামী বছর সেপ্টেম্বর মাসে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা একত্রিত হবেন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে, এই সমস্ত বিষয়ে খুঁটিনাটি আলোচনা করতে।
এই বছর যে প্রতীককে মান্যতা দেওয়া হয়েছে, তা থেকেই বিতর্কের সূত্রপাত। প্রতীকটিতে একটি পদ্ম ফুলের ওপরে, আমাদের পৃথিবীকে দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এই প্রতীককে আরো বিশ্লেষণ করে বলেছেন ‘একটাই পৃথিবী, একটাই পরিবার এবং একটাই ভবিষ্যৎ’। বিরোধীরা অভিযোগ করেছেন, এই প্রতীকে পদ্ম ফুল রাখার একটাই অর্থ, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করা। এমন কথাও বলা হয়েছে, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর কাছে প্রস্তাব এসেছিল, কংগ্রেসের পতাকাকেই জাতীয় পতাকা করার, কিন্তু তিনি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শাসকদলের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে, ১৯৫০ সালেই তো ভারতের জাতীয় ফুল হিসেবে পদ্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এই নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই।
এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, গতবছর ইন্দোনেশিয়া যখন সভাপতিত্বের দায়িত্বে ছিল, তখন তাঁরা যে প্রতীককে সরকারী সিলমোহর দিয়েছিলেন, তার মধ্যে কি তাঁদের দেশের শাসকদলের কোনও রাজনৈতিক প্রতীক ছিল, উত্তর অবশ্যই না। তাঁদের প্রতীকের অর্থ ছিল, কোভিড পরবর্তীতে একসঙ্গে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে চলা। আর এই বছর যখন ভারত এই দায়িত্ব পেয়েছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পদ্ম’ নাকি আশার কথা বলে, যে কোনও পরিস্থিতিতে, তা সে কোভিডের মতো কঠিন হলেও এই ‘পদ্ম’ আশার আলো দেবে। আশার আলো দেখতে পাওয়া যাবে কী না, তা ভিন্নতর বিতর্ক কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে যে আশার আলো দেখতে পাওয়া যাবে এবং যে এই প্রতীকের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা পাবে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ। শুধু নির্বাচনী সুবিধা নয়, এই প্রতীকের মধ্যে দিয়ে যে দীর্ঘস্থায়ী একটা ছাপ ফেলা যাবে, সেই বিষয়েও শাসকদল নিশ্চিত।
আজকের সময়টা দৃশ্যের। কে কীরকমভাবে ভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করছেন, কে কিরকম দৃশ্য তৈরি করছেন, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এই যে দুটি রাজ্যে নির্বাচনের ফলাফল এসেছে, একটিতে বিজেপি জয়ী হয়েছে, অন্যটিতে কংগ্রেস। এছাড়াও অবশ্য আরো একটি নির্বাচন হয়েছে, দিল্লি পুরসভার নির্বাচন, যেখানে জয়ী হয়েছে আম আদমি পার্টি। যদিও যে দুটো রাজ্যে বিধানসভা ভোট হয়েছে, সেই তুলনায় এই পৌরসভা নির্বাচনের গুরুত্ব অনেকটাই কম, কিন্তু প্রচার যেভাবে হয়েছে, তা দেখে একবারও মনে হয়নি, এই নির্বাচনের ফলাফল এতোটুকু কম গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত এই শাসকদলের কাছে। যেদিন থেকে এই তিনটি নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে, সেদিন থেকে শাসকদল এমনভাবে প্রচার করছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন গুজরাটের নির্বাচনে জয়লাভের খবরটাই একমাত্র খবর, হিমাচল প্রদেশে হারটা বা দিল্লির পৌরসভা নির্বাচনের হারটা অত্যন্ত নগণ্য একটি বিষয়। সেই জন্যেই কি তাঁদের নির্বাচনী প্রতীককে হয়তো জি-২০ র প্রতীক হিসেবে দেখানোর প্রক্রিয়া?
কিছুদিন আগে বাংলায়, ‘বন্দে ভারত’ এক্সপ্রেস ট্রেনটির উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বাংলায় আসার কথা ছিল। সেই কারণে, সারা শহর তো বটেই, সারা রাজ্যে বিভিন্ন জায়গায়, নরেন্দ্র মোদীর ছবি সহ কাটআউট দাঁড় করানো হয়েছিল। শুধু প্রধানমন্ত্রীর ছবিই নয়, শাসকদলের বড় মেজো ছোট সহ নানান নেতার ছবি সহ কাটআউট এখনো শোভিত হচ্ছে কলকাতার রাজপথে, যাতে কোথাও স্বাগত জানানো হয়েছে, ধন্যবাদ জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে, এবং সেই বিজ্ঞাপনে নানান জায়গায় পদ্মও আছে। এই ছবিগুলোতে নিশ্চিত জাতীয় ফুল হিসেবে পদ্ম নেই, আছে, শাসকদলের নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে। যতই মোড়ক দেওয়া হোক না কেন, শাসকদল জানে, কি প্রক্রিয়ায় তাঁদের নির্বাচনী প্রতীককে আরো জনপ্রিয় করে তুলতে হয়। কি প্রক্রিয়ায়, একজন শিশুর মনের গভীরে ঐ ছবি গেঁথে দেওয়া যায়, যাতে ভবিষ্যতে তাঁরা যখন বড় হবে, তাঁদের হৃদয়ে শুধু একটি রাজনৈতিক দলই থাকে। হয়তো ঘটনাচক্রে ঐ ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলটিতে বাচ্চারা অজান্তেই ঐ ‘পদ্ম’ এঁকেছে, কিন্তু সত্যিই কি বিষয়টি কাকতালীয়?