কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে। দেশ বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ যাচ্ছেন কুম্ভস্নান করতে। সবাই যাচ্ছেন পুণ্য অর্জন করতে। দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ বহু নেতামন্ত্রীকেই ইতিমধ্যেই ত্রিবেণী সঙ্গমের হাঁটু জলে ডুব দিতে দেখা গেছে এবং আরও কাউকে কাউকে হয়তো দেখা যাবে। বাদ যাননি শিল্পপতি, বলিউড এবং টলিউডের পরিচিত মুখেরাও। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, এই কুম্ভস্নানকে কেন্দ্র করে যে এতো মানুষের সমাগম, তা বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্ম সম্মেলন। তার মধ্যে নানান দুর্ঘটনার খবর এসেছে। কখনো আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে, আবার কখনো পদপিষ্ট হয়ে বহু মানুষের মৃত্যুর খবরও এসেছে। সরকার মৃত্যুসংখ্যা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু একবারও স্বীকার করেনি, তাঁদের প্রশাসনিক অব্যবস্থার কারণে এবং মান্যগণ্য ব্যক্তিদের জন্য পুলিশের ব্যবস্থা করার জন্যেই সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
তথ্য দেওয়া হচ্ছে যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই ৫৫ কোটি মানুষ ইতিমধ্যেই এই কুম্ভের জলে স্নান করেছেন। ব্যবসা ছাড়িয়েছে ৩ লক্ষ কোটি টাকার। এতো কিছুর পরেও কিন্তু বেশ কিছু প্রশ্ন উঠছে। রাজনীতি তো শুরু হয়েইছে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন এটা মহাকুম্ভ নয় এটা মৃত্যুকুম্ভ। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন শঙ্করাচার্য, তবুও তাঁর এই বক্তব্যকে ঘিরে বাংলার প্রধান বিরোধী দল রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো রাজনৈতিক কারণে এই কুম্ভমেলার অব্যবস্থা এবং সেখানে যেতে গিয়ে দিল্লি স্টেশনে পদপিষ্ট হয়ে মানুষের মারা যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঐ কথা বলেছেন, কিন্তু আরও একটা বিষয় সম্প্রতি সামনে এসেছে। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে বলা হয়েছে ঐ কুম্ভের জল পান করা তো দূর অস্ত, তা স্নানেরও অযোগ্য। শুধু এই সংস্থাই নয়, কেন্দ্রীয় গ্রীন ট্রাইবুনালও বলেছে, ঐ ত্রিবেণী এবং সঙ্গমের জলে দূষণের মাত্রা অনেক বেশী। এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পরেই নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
কোনও বেসরকারি বা বিদেশী কোনও সংস্থা নয়, কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ কিংবা গ্রীন ট্রাইবুনাল যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ সংস্থা ফলে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি এই রিপোর্টের বিরোধিতা করতে পারেননি, কিন্তু তিনি বলেছেন বিরোধীরা এই কুম্ভমেলার জন্য ‘হিন্দু’ সমাবেশকে বদনাম করতেই এই সমস্ত রিপোর্ট এখন সামনে আনছেন। জলে কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার মাত্রা যা দেখা গেছে তাতে স্পষ্ট হয়েছে মানুষ ও পশুর মল আছে। একইভাবে বায়োমেডিক্যাল অক্সিজেন ডিম্যান্ড (বিওডি)-র মাত্রা দেখে বোঝা যাচ্ছে ওই জল স্নানের উপযুক্ত নয়। কুলকুচি করার জন্য মুখে নেওয়া তো আরও বিপজ্জনক। বিওডি দেখে বোঝা যায় যে জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনের কতটা ব্যাকটেরিয়া গিলে ফেলছে। জলে বিওডি'র মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার বেশি থাকলে বোঝা যায় দূষণের পরিমাণ বেশি। নদীর জল স্নানের উপযুক্ত তখনই মনে করা হয় যখন প্রতি লিটার জলে বিওডি'র মাত্রা হবে ৩ মিলিগ্রামের কম। কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ যে রিপোর্ট গ্রীন ট্রাইবুনালে জমা করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে ১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ৫টার হিসেবে সঙ্গমের জলে বিওডি'র মাত্রা ৫.০৯ মিলিগ্রাম। ১৮ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫ টায় এর মাত্রা ছিল ৪.৬ মিলিগ্রাম। এদিন সকাল ৮ টায় সঙ্গমে সেই মাত্রা ছিল ৫.২৯ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ নির্ধারিত মাত্রার থেকে প্রায় দ্বিগুন। কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত এই তথ্য মানতে নারাজ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ। আদিত্যনাথ সহ হিন্দুত্ববাদী নেতারা আস্থা, ভক্তির নামে কেন্দ্রীয় সরকারী প্রতিষ্ঠানের তথ্যকে খারিজ করার চেষ্টা করছেন।
১৯৯০ সালে সত্যজিৎ রায় একটা ছবি তৈরী করেছিলেন ‘গণশত্রু’। হেনরিক ইবসেনের নাটক, ‘এনিমি অফ দি পিপল’ অবলম্বনে বানানো সেই ছবির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ঘটনাচক্রে ছবিটি বাংলার একটি ছোট শহরের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৈরী করা হলেও আজকের কুম্ভমেলার জলদূষণ সংক্রান্ত বিষয় সামনে আসার পরে মনে হচ্ছে, ছবিটা আজও কত প্রাসঙ্গিক। চিকিৎসক অশোক গুপ্ত (সৌমিত্র চ্যাটার্জি) একটি শহরের হাসপাতালের প্রধান। তাঁর ছোট ভাই, নিশীথ (ধৃতিমান চ্যাটার্জি), ছিলেন একটি মন্দিরের ট্রাষ্টি বোর্ডের মাথা এবং একজন শিল্পপতি। মন্দিরটিও ছিল একটি বড় পর্যটক আকর্ষণের বিষয়। ডঃ গুপ্ত দেখতে পাচ্ছিলেন শহরে শহরে মহামারী হচ্ছে এবং তিনি বুঝতে পারছিলেন ত্রুটিপূর্ণ পাইপ-বিছানোর কারণে মন্দিরের জল দূষিত হয়েছে এবং তা পান করেই মানুষ অসুস্থ হচ্ছেন। তিনি তাঁর ভাই নীশিথকে এই বিষয়ে সতর্কও করেন। নীশিথ সহ অন্যান্য শিল্পপতিরা এবং ঐ মফস্বল শহরের কর্মকর্তারা এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন যে ঐ পবিত্র জল মহামারীর কারণ হতে পারেনা। তাঁরা মেরামত করার জন্য মন্দির বন্ধ করতে অস্বীকার করে। ডঃ গুপ্তা মানুষকে সতর্ক করার জন্য সংবাদপত্রে একটি নিবন্ধ লিখতে চান, কিন্তু ক্ষমতাবানদের চাপের মুখে সম্পাদক তা প্রকাশ করতে রাজি হননি। কোনো বিকল্প না পেয়ে, ডঃ গুপ্তা একটি জনসভার আয়োজন করে সেটিও নাশকতার অজুহাত দেখিয়ে বাতিল করা হয় এবং তাঁকেই জনগণের শত্রু ঘোষণা করা হয়।
আজকে হয়তো ঐ ছবির মতো কোনও ডঃ গুপ্তা নেই, কিন্তু যাঁরাই আজকে কুম্ভের জলকে স্নানের এবং পান করার অনুপযুক্ত বলছেন তাঁদের দিকেই যোগী আদিত্যনাথ আঙুল তুলছেন। সঙ্গীত পরিচালক বিশাল দাদলানি যোগী আদিত্যনাথকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন যদি ঐ জলের কোনও সমস্যা না থাকে, তাহলে তিনি এবং তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যরা যেন ঐ জল পান করে দেখান। চিকিৎসক এবং বৈজ্ঞানিকরা যে জলকে মুখে তোলার অযোগ্য বলছেন, সেই জল পান করলে কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আসলে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জানেন আমাদের দেশের মানুষেরা অন্ধকার কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন এবং তাঁদের কাছে খুব সহজেই ধর্মের নামে এই সমস্ত বিষ পান করানো যায়। তিনি এবং বিজেপির মাথারা এটা বোঝেন মানুষকে যদি এইসমস্ত কিছুতে ব্যস্ত রাখা যায়, তাহলে প্রাথমিক চাহিদা অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের দাবী করা থেকে বিরত করা যায় সাময়িকভাবে। সমস্যাটা হচ্ছে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে যাঁকে গণশত্রু বানানো হয়েছিল, বাস্তবের মাটিতে এইরকম অনেক চিকিৎসক হয়তো আছেন কিন্তু তাঁদের কথা কে শুনছে? কেই বা বুঝছে, যুক্তিবাদীদের কথা? রামকৃষ্ণ একবার তাঁর এক ভক্তকে বলেছিলেন, ভক্ত হবি, তা বলে বোকা হবি কেন? সবাইকে ধর্মের মোহে আবিষ্ট করে রেখে ধর্ম ব্যবসায়ীরাই আজকে রাজনৈতিক জগতেরও মাথা হয়ে উঠেছেন, তাঁরাই যে আসল গণশত্রু, তাঁরাই যে মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন তা কে বোঝাবে সাধারণ মানুষকে?