আগে ছেলেরা বিয়ে করত আর মেয়েদের বিয়ে হত। মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই নানারকমের রাজপুত্রের গল্প শুনিয়ে চাগিয়ে দেওয়া হত। সে নাকি পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে আসবে। সঙ্গে বলা হত যে মেয়েরা আধ হাত ঘোমটা টেনে দশভুজার মতো সংসারের সব কাজ করবে; সেবা করবে। যেন বিবাহেই তাদের মোক্ষ। আর ছেলেদের পছন্দ ছিল টুকটুকে বউ। “টুকটুকে বউ আনবে আমার ভাই / গলা ছেড়ে গান গেয়ে যাই”।
এখন অবশ্য বাইক একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছে।
তখনকার দিনে কারুর বিয়ে না হলে মনে করা হত যে সে হতভাগ্য; তার জীবনের আর কোনও মানেই নেই। বিবাহিত কুলীনদের মধ্যে সে ম্লেচ্ছ! আবার কুলীন ব্রাহ্মণেরা একগাদা বিবাহ করতেন। কমল কুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রার কথা মনে পড়ছে।
এখন অবশ্য আবার যারা ‘একবার’ বিয়ে করেছেন তাদেরকে অবাক চোখে দেখেন ‘চার-পাঁচবার’ বিবাহ করা মানুষজনেরা।
বিয়েতে গায়ে হলুদ একটা বিরাট ব্যাপার। সেইরকমই এক বিয়েতে বরকে হলুদ মাখাচ্ছে। একজন ইওরোপীয়ান গেস্ট ব্যাপারটা খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিলেন। শেষে নিজেকে আর সামলাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, “হোয়াই হি হ্যাজ বিন স্মিয়ারিং উইথ স্পাইস? টারমেরিক, অয়েল?”
একজন উত্তর দিলেন, “হি হ্যাজ বিন ম্যারিনেটেড ফর রোস্টিং”।
আবার বিয়ের বাসর ছিল একটা আইটেম নাম্বার। মনে আছে গনশার বন্ধু, তিলুর বিয়েতে স্ত্রী আচার দেখতে গিয়ে তাদের কী অবস্থা হয়েছিল। গুপ্ত জিজ্ঞাসা করেছিল যে স্ত্রী আচার! সেটা আবার খেতে কেমন? টকটক, ঝালঝাল না মিষ্টিমিষ্টি? সে চেখে দেখতে চায়। শেষে চোর সন্দেহে মেয়ের বাড়ির লোকেদের তাড়া খেয়ে একজন উঠেছিল গাছে, আর বাকিরা চাঁদের আলোয় মাঠ ভেবে পানা পুকুরে গিয়ে চোবানি খেয়েছিল।
মিস প্রিয়ংবদায় গল্পের নায়ককে বিয়ে করাতে গিয়ে মেয়ে সাজতে হয়েছিল ভানুর চরিত্রটিকে। আবার ‘এই করেছ ভাল’ সিনেমায় এক অদ্ভুত উইল করে গেছিলেন বিবাহযোগ্যা দুই মেয়ের মামা। ব্যাপারটা এমন যে মেয়েরা সেই উইল মোতাবেক সম্পত্তির অধিকারী হবেন তখনই, যদি তারা দুজন পুরুষকে বোকা বানিয়ে বিবাহ করতে পারেন। বুঝুন কারবার!
‘হংস মিথুন’ সিনেমায় দেখলাম দুই যুযুধান বয়স্ক উকিলের মাঝে পড়ে একটা প্রেমের সম্পর্ক কীভাবে যেন ভেস্তে যাচ্ছিল। তারপর দেখলাম সেই দুই উকিলকে কেলোর কীর্তি চিঠির প্যাঁচে ফেলে কীভাবে যথাক্রমে তাদের ছেলে ও মেয়ের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্ককে বিবাহে পরিণত করা হল। গল্পটি দারুণ। চিত্রনাট্য ও পরিচালনা পার্থপ্রতিম চৌধুরী।
সমরেশ বসুর ‘অবশেষে’ উপন্যাস থেকে হওয়া সিনেমা ‘মৌচাকে’ আমরা দেখতে পাই কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের নানা রকমের কৌতুকপূর্ণ আচরণ (যদিও অরবিন্দবাবু চিত্রনাট্যে বেশ কিছু পাল্টে ছিলেন)। আবার ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় দেখি কীভাবে নিজের দিদির হবু বরকে তারই বোন নির্লজ্জভাবে কব্জা করে নিল।
‘আসা যাওয়ার মাঝে’ সিনেমায়, যেটি ইতালো কালভিনোর গল্প থেকে নেওয়া, দেখতে পাই কীভাবে অর্থনৈতিক চাপে পড়ে স্বামী যাচ্ছেন রাতে কাজ করতে আর বউ দিনের বেলা। ফলে তাদের সামান্যই হয়ত দেখা হচ্ছে একই ছাদের নীচে থেকেও। অর্থনৈতিক নানান কেলেঙ্কারি এমনভাবে একটা দেশের মেরুদন্ড ভেঙে দেয় যে সেই দেশের পরিবার গুলোর মধ্যে সহজ সম্পর্ক, দাম্পত্যের মধ্যেকার সহজ সম্পর্ক যায় হারিয়ে।
বিয়েতে মদ্যপান একটা আবার ব্যাপার। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের বরযাত্রী, বাসর যা নিয়ে ‘বিবাহ অভিযান’ সিরিয়াল হয়েছিল সেখানে তিলুর বাবা, বাবার বন্ধুরা এবং পুরোহিত মশাই সব ছিলেন মদের নেশায় চুর। তাতে মেয়ের বাড়ির লোকের সঙ্গে ‘ভদ্দরলোক’ ‘ভদ্দরলোক’ নিয়ে এমন ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল যে তিলুর বাবার ঘোষণা করেছিলেন যে বরকে তিনি উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেবেন না। আবার পরক্ষণেই কেঁদে ফেলে বলেছিলেন, “ইসস! আজ যদি বাবা বেঁচে থাকত”। স্ত্রী আচার দেখতে গিয়ে যে ক্যাডাভ্যারাস কান্ডটা হয়েছিল তার উল্লেখ তো আগেই করেছি। তারপর ওদের চিহ্নিতকরণের জন্য পুরোহিতকে ডেকে আনলে উনি নেশার ঘোরে ওদেরকে চিনতেই পারলেন না। আর আজকাল সবই ‘মদভাত’ হয়ে গেছে।
আগে বিয়েতে একদল বরযাত্রী অন্য বিয়েতে হামেশাই ঢুকে যেত! ফলে কেলেঙ্কারি ও মজা- দুইই ঘটত। এ যুগেও তেমন ঘটনা দেশগাঁয়ে বা কংক্রীটের জঙ্গলে ঘটে কিনা জানা নেই।
আগে স্বামী বা স্ত্রীকে সম্বোধন করতে ওগো, হ্যাঁগো, গো ইত্যাদি বলা হত। এখন অবশ্য নাম ধরে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে সোনা, বাবু, হাবি, হানি ইত্যাদি নানা সম্বোধনে ভূষিত করা হয়।
আচ্ছা, এই ‘হাবি’ কি হাবি-জাবির হাবি? জানি না বাবা!
যাইহোক, ‘মোহনবাগানের মেয়ে’ সিনেমাতে উৎপল দত্তের চরিত্র আবার তার বউকে আদর করে ডাকতেন ‘অন্দরমহল’। তিনি আবার তার হবু বউমার এক অদ্ভুত ক্রাইটেরিয়া ধার্য করেছিলেন। মেয়েকে শিক্ষিত, দেখতে শুনতে ভাল তো হতেই হবে, তবে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল যে হবু বউকে হতে হবে মোহনবাগানের সাপোর্টার! না হলে তিনি নাকি ছেলের বিয়েই দেবেন না। বোঝো কান্ড!
বিবাহকে আগে বলা হত – ‘দিল্লী কা লাড্ডু। যো খায়া উও পস্তায়া; যো নেহি খায়া, উওভি পস্তায়া’। তবে এখন ওসব লাড্ডু না খেয়েও লাড্ডু খাওয়া যায়!
একসময় প্রেম করে বিয়ে ব্যাপারটাকে সমাজ মেনে নিতে পারত না। এখন আবার প্রেম না করলে সমাজে মান থাকে না। যারা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করছেন তাদেরকে অবাক চোখে দেখা হয়, যেন তারা কোনও প্রাগৈতিহাসিক জন্তু।
তবে ভারতের অনেক জায়গায় কিন্তু এখনও ভিন্ন জাত বা ধর্মে বিবাহকে মেনে নেওয়া হয় না এবং এর ফলে যে কী ঘটতে পারে সেটা আমরা বেশ কিছু সাহিত্য এবং সিনেমায় দেখেছি এবং কাগজেও পড়েছি।
তবে এখন শুরু হয়েছে বিবাহ বহির্ভূত প্রেম।
শোনা যাচ্ছে যে আগামী দিনে বিবাহ প্রতিষ্ঠানটি নাকি অচিরেই তার মাহাত্ম্য হারাবেন। এই নিয়ে চলছে তর্ক বিতর্ক। হয়তো তখন বিয়ে করেছে শুনলেই লোকে নাক সিঁটকাবে। বলবে, “এহ! প্রান্তিক”।
তবুও আমাদের ভারতবর্ষের সমাজে সেসব আসতে ঢের দেরী। এখানে কিছু রাজ্যে দেহ এবং মন নিয়ে জোর চর্চা যেমন চলছে, আবার অনেক রাজ্যে ‘পতী পরম গুরু’ ব্যাপারটাই এখনও প্রবাহমান। বিবাহ- সংসার – সন্তান ইত্যাদি।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তার এক গল্পে লিখেছিলেন যে সংসার হল অনেকটা সর্ষে পেষাইয়ের মতো। বেশি বেটেছ কী তেতো হয়ে যাবে। মানে টিউনিং ঠিক না হলেই বেসুরে বাজবে।
আগে পুরুষদের দ্বারা নারী নির্যাতন যেমন হয়েছে, তেমনি ছিল তাদের পুড়িয়ে মারার মতো জঘন্য সব অপরাধ। ফলে সরকার আইন এনেছেন। এখন আবার কিছু পুরুষরা বউয়ের অত্যাচারে নাজেহাল হয়ে গিয়ে তৈরি করেছেন ‘পীড়িত পতি পরিষদ’। তবে সমস্ত ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে যে নির্যাতিত হচ্ছেন সভ্য এবং ভদ্র নারী ও পুরুষেরা।
তবে এই শতাব্দী বা সহস্রাব্দের শুরু থেকে একটা নতুন বিষয় চোখে পড়ছে। সেটা হল একজনের সঙ্গে বিয়ে করে বিয়ের রাতেই আবার অন্য আরেকজনের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে আগেও ছিল; কিন্তু সেটা ছিল বিয়ের আগে পালানো। এখন হয়েছে বিয়ের পরে পালানো।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। মেয়ের দাদু ছিলেন পুলিশ। তাই মেয়ের বাবা বিয়ে ঠিক করল একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে । বিয়ে তো ধুমধাম করে হল। বরযাত্রীরাও আয়েশ করে খেয়ে দেয়ে নতুন বউকে আশীর্বাদ করে গেলেন। কিন্তু সকালে উঠে সেই বর মানে মাননীয় পুলিশ অফিসার ভদ্রলোক দেখলেন যে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী তাকে ‘ইস্ত্রী’ করে দিয়ে অন্য একজন পুরুষের সঙ্গে ‘ভাগল বা’। ভাগ্যিস সেই বিয়েতে আমার নেমন্তন্ন ছিল না। কারণ এইরকম ঘটনা শোনবার পর খাবারই হজম হত কীনা সন্দেহ।
আবার বিবাহিত মহিলারাও নতুন করে প্রেমের আগুণে নিজেদেরকে কাবাব বানিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। আবার মেয়েকে বিয়ে করে শাশুড়ির সঙ্গে প্রেম জমে যাচ্ছে বরের। কবেই তো রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন –“প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে / কে কখন ধরা দেবে কে জানে”।
আমাদের সমাজে সেই সেই নারীকেই ভাগ্যবতী বলে ধরা হয় যাদের বর তাদের খুব খেয়াল রাখেন; খুব কেয়ার করেন। এদেরকে আবার অন্য মেয়েরা কিন্তু হিংসে করেন। আবার ছেলেরা সেইসব ছেলেদের ঈর্ষা করেন যাদের বউ তাদেরকে রোজগার করে এনে খাওয়ান; শখ আহ্লাদ মেটান।
চ্যাপলিনের ‘মঁসিয়ে ভের্দু’ সিনেমায় বা হ্যাডলি চেজের ‘ডবল সাফ্ল’ উপন্যাসে আবার আমরা দেখতে পেলাম যে বউয়ের নামে একটা বিরাট অঙ্কের ইনশিওরেন্স করে তাকে অন্য জগতে পাঠিয়ে সেই টাকা হস্তগত করার গল্প। এখন আবার উল্টোটাও ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
আবার একালে অনেকেই একবার বিবাহ করে আবার বিবাহের কল পেতে হয় সেই মেয়েকে পাচার করে দিচ্ছে, নয়তো তার থেকে টাকা, সোনা ইত্যাদি হাতড়ে চম্পট লাগাচ্ছে। আবার NRI বরের ভেক ধরেও চলছে প্রতারণা। সুতরাং, সাধু সাবধান!
আগে একবার বিয়ে হয়ে গেলে ভালো লাগুক ছাই না লাগুক সেই সম্পর্ককে বয়ে বেড়াতে হত। তারপর সমাজে ডিভোর্সের প্রাবল্য লেগে গেল। ফেবুতে আবার দেখলাম যে একটা পোস্ট। সেখানে ‘শুভ বিবাহ বিচ্ছেদ’-এর আইনসম্মতভাবে এবং দুজনের সম্মতিতে ডিভোর্সের জন্য নেমন্তন্ন করার কার্ড ছাপানো হয়েছে।
শেষ লাইনে লেখা হয়েছে – ‘ঐ দিন দয়া করে নব বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের মুক্তজীবন কামনা করে প্রীতিভোজে অংশ নিয়ে বাধিত করবেন’। খুবই অভিনব চিন্তা সন্দেহ নেই।
বিবাহের জন্য আগে ছিলেন ঘটক। তারা বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে সুলক্ষণা ও বিবাহযোগ্যা মেয়ে এবং রোজগেরে ছেলে খুঁজে খুঁজে বেড়াতেন। এখন আবার হয়েছে ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট। খালি ক্লিকের অপেক্ষা।
দেখা যায় এখন কেউ বিয়ে করার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছেন তো কেউ বিয়ে করে হাঁপিয়ে উঠেছেন। বলা হয় ‘ভাগ্যবানের বউ পালায়’। কারণ বউ পালিয়ে গেলে আবার পুরুষ দ্বার পরিগ্রহ করতে পারবেন।
এখন আবার বলা হচ্ছে ‘ভাগ্যবতীর বর পালায়’। কারণ তাহলে বউ খোরপোষ আদায় করতে পারবেন এবং অন্য একজনকে আবার বিবাহ করতে পারবেন।
তবে সমস্যা হয় সন্তানদের।
তবে অনেক মহিলা বা পুরুষ এখনও সমাজে রয়েছেন যাদের বর বা বউ পালিয়ে বা মারা গেলেও তারা তাদের সেই ভালবাসাকে আঁকড়ে ধরে বাকি জীবন অতিবাহিত করছেন।
নারী ও পুরুষ একবার বিবাহের পর ডিভোর্স করে পরে পুনরায় আবার দুজনে বিবাহ করার ঘটনাও সমাজে আছে। এখানে আমার লিজ টেলর এবং রিচার্ড বার্টনের কথা মনে পড়ছে।
তবে এখানে এমন একজনের কথা দিয়ে লেখা শেষ করবো যে তার হবু বউকে খুবই ভালবাসেন। এবং ভালবাসেন বলেই বউয়ের মত মতোই বিবাহের আয়োজন করেছেন।
বর বাঙালি; উচ্চ শিক্ষিত। নাম জীব্রাম চক্রবর্তী। আর তার পছন্দের পাত্রীটি আবার রাশিয়ান। সেই রাশিয়ান হবু বউয়ের বাবা আবার অ্যামেরিকান আর কাকা থাকেন ইজ়রায়েলে। তা বউয়ের বাড়ির লোকজনও কিছু আয়োজন করেছেন। বাকিটা তারা ছেড়েছেন হবু বরের জন্য।
সেই হবু বর বিয়ের আগে একটা চিঠি টাইপ করছেন। পাঠাবেন স্থানীয় থানা থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র দপ্তরে –
এখন সেই হবু বর যে থানায় থাকেন সেখানে আধিকারিক হিসেবে বদলি হয়ে এসেছেন ‘শোলে’ সিনেমার সেই জেলার সাহেব। হবু বর লিখছেন -
মাননীয় আধিকারিক,
শোলে সিনেমার ভূতপূর্ব জেলার সাহেব
(অমুক থানা)
মহাশয়,
শুনলাম আপনাকে জেলার থেকে আমাদের থানার ভার দিয়ে বদলি করা হয়েছে। জানি না এটা প্রোমোশন না ডিমোশন। তবে ‘মোশন’ যে একটা আছে সেটা বুঝতে পেরেছি। আমি সিনেমাটি ৩৬ বার দেখেছি। আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই।
আমি জীব্রাম চক্রবর্তী। আমি আমার হবু বউকে খুব ভালবাসি। আমি চাই তার জীবন খুশিতে ভরিয়ে দিতে। প্রি ওয়েডিং ফটোশুটে আমরা হাওয়াই দ্বীপে গেছিলাম। আহ! যা দারুণ আনন্দ হয়েছে না কী বলবো আপনাকে। আপনিও পারলে একবার হাওয়াই দ্বীপে ঘুরে আসবেন। হ্যাঁ, হাওয়াই চটি পরেই ঘুরবেন না হয়।
যাই হোক, আমার হবু শ্বশুর যেহেতু অ্যামেরিকান, তাই বরযাত্রীরা ঠিক করেছেন যে তারা বোয়িং ৭৩৭-এ করে আসবেন। তবে হবু শ্বশুর শুনছি একটা ফাইটার প্লেনে এখানে ল্যান্ড করবেন। আবার আমার হবু কাকা শ্বশুর ইজ়রায়েলে থাকেন। ফলে তিনি আবার EL AL-এ করে আসবেন।
আমরা এখানে একটা বড় মাঠে অনুষ্ঠান করবো বলে কর্পোরেশন কতৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। বুঝতেই তো পারছেন যে এটা একটা প্রোটোকলের ব্যাপার; গমকল বা চালকলের ব্যাপার নয়। ভেবেছিলাম যে হিটলারের পুরনো বাঙ্কারে বিবাহের অনুষ্ঠানটি করবো; কিন্তু উনিজী বলেছেন যে দেশের অর্থ যেন দেশেই থাকে। আর এখানে বিদেশি অর্থও আসবে। ফলে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে(!)।
মহাশয়, আগেই লিখেছি যে আমি আমার হবু বউকে খুবই ভালবাসি। আর আজকাল বিবাহে দেদার বাজি, পটকা ইত্যাদি ফাটানো চলছে। দূষণের তোয়াক্কা আর কেউ করছে না। আর আমি কিন্তু একবারই, মানে জন্ম জন্মান্তরের মতো বিবাহ করতে চাই; বার বার বিবাহ এবং ডিভোর্স আমার ভাল লাগে না। তাই হবু বউয়ের অনুরোধে বিয়েতে আমি গোটাকয়েক ‘স্কাড মিসাইল’ ফাটাতে চাই। হ্যাঁ, স্কাড মিসাইল। এই মিসাইলগুলো আমার হবু বউ যোগাড় করে আনবেন। প্লিজ একটু দেখবেন স্যার।
যদিও শুনেছি সোভিয়েত আমলের সেই পুরনো মিসাইলগুলো নাকি ফাটে নি। কেন ফাটেনি সেটা জানি না। আমরা দরদাম করে কিনেছি। তবে আবার বলাও যায় না, যদি ফেটে যায়! তাই সতর্কতা অবলম্বন জরুরী।
আমার হবু শাশুড়ি অবশ্য চায়না থেকে কিছু হায়নার অর্ডার করেছেন। উনি রাশিয়ায় লাফিং ক্লাব চালান বলে বিবাহে হায়নার হাসি শুনতে চান। কারণ রাশিয়ায় আবার অনেকে নাকি হাসিয়া ফাঁসিয়া গিয়েছেন। পুতিনের আমলে মানুষ হাসতেই ভুলে গেছেন। বুঝতেই তো পারছেন যে আমি আমার হবু বউকে খুবই ভালবাসি।
প্ল্যান হয়েছে যে আমার কাকা শ্বশুর এবং বাকি বরযাত্রী আবার বিমানবন্দরে নেমে সামরিক ট্যাঙ্কে করে বিবাহ আসরে আসবেন। রাশিয়ান T-90 ট্যাঙ্কগুলো জাহাজে করে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেগুলোও পুরনো; ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে। কারণ এত আমাদের সাধ্য কোথায়? আমি মাননীয় ফোর্ট উইলিয়াম কর্তৃপক্ষকেও একটি চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ করেছি যেন তারা কিছু মাননীয় মেকানিক মহাশয়দের পাঠানোর ব্যবস্থা করেন কারণ মাঝরাস্তায় সেগুলো আবার বসে গেলে জ্যামজট হতে পারে।
আমি নিজে অবশ্য বুলডোজারের কথা বলেছিলাম। কিন্তু শুনলাম যে সেগুলো আবার বুলডোজার বাবা আর বুলডোজার মামা নাকি নিয়ে নিয়েছেন।
আমরা নানা মতের সঙ্গে ডিজিটাল মতেও বিবাহ করবো। তাই খাইবার পাস থেকে কিছু মানুষ এসে আমাদেরকে সাইবার মতে বিবাহ দেবেন।
আমি সঙ্গে কিছু ওয়াশিং মেশিনও অর্ডার দিয়েছি। কে জানে কে আবার বরের দল থেকে বউয়ের দলে বা উল্টো দিকের দলে নাম লেখাতে চাইবেন। তারও মেকানিকের বন্দোবস্ত করে রেখেছি কারণ মেশিনগুলো আবার পুরনো। কেউ যদি দল পাল্টাতে গিয়ে আবার মেশিনের মধ্যে আটকা পড়ে যান, তাহলে একটা কেলেংকারিয়াস ব্যাপার হবে।
ভারতীয় অভ্যাগতদের অ্যাকাউন্টে ১৫ টাকা করে সম্মান-দক্ষিনা দেব বলে ঠিক করেছি। আমাদের সাধ থাকলেও সাধ্য কোথায়? শুনেছি যে তারা ১৫ লাখ করে টাকা না পেয়ে খুবই ব্যাথিত।
বিবাহ উপলক্ষ্যে ম্যাজিক শো এর আয়োজন করেছিলাম যার মুখ্য আকর্ষণ ছিলেন রাশিয়ার মাননীয় প্রেসিডেন্ট। উনি আবার মানুষ হাওয়া করবার ম্যাজিকটা ভালই দেখান। কিন্তু তিনি আসবেন না।
সঙ্গে মাননীয় অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট মহাশয়কেও অনুরোধ করেছি যে কীভাবে কর্পোরেটদের নিয়ে ঘর্পোরেট ম্যাজিকটি দেখানো যায় তার নিদর্শন আমাদের দেখাতে। আবার কীভাবেই বা নিজে গতবার ক্ষমতায় থাকার সময় দেশের বিভিন্ন সংস্থাকে বিদেশী মুদ্রার লেনদেন আইন করে বন্ধ করে নিজের সংস্থাগুলোকে বিদেশি মুদ্রায় কলাগাছ বানানো যায় সেই ভেল্কিও তাঁকে দেখাতে অনুরোধ করেছি। তাছাড়া তাসের ম্যাজিক মানে ট্রাম্প করেও উনি দেখাবেন।
ব্রিজ খেলার আসর বসবে; অকশন আর কন্ট্রাক্ট। সেখানে কিন্তু কেউ ‘নো ট্রাম্প’ কল করতে পারবেন না।
ব্যাঙ্কের টাকা মেরে যারা হাওয়া হয়ে গেলেন তারা আবার অনলাইন আমাদের বিবাহ উৎসব দেখতে চেয়েছেন। গোদী মিডিয়ার সঙ্গে এই ব্যাপারে যোগাযোগ করা যাবে কিনা যদি সাজেশন দেন খুব উপকার হয় স্যার।
কিঞ্চিৎ বাজনার আয়োজনও করা হয়েছে। ঢাক। চড়াম চড়াম করে ঢাক বাজবে। অতিথি অভ্যাগতদের প্রথমেই দেওয়া হবে নকুল দানা। বিবাহ আসরের জায়গায় জায়গায় উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকবে। সঙ্গে দেওয়া হবে জাতীয় কেলেঙ্কারির ওপর সাইক্লোস্টাইল করা বই। সঙ্গে ভেনুর আশেপাশে কিছু হেলে পড়া ফ্ল্যাটের বন্দোবস্ত করবেন প্লিজ স্যার। বিদেশের অতিথিরা পিসার হেলানো মিনার দেখেছেন; তাদের কাছে এই হেলে পড়া ফ্ল্যাট একটা অভিনব ব্যাপার হবে সন্দেহ নেই।
বিয়েতে খাদ্য হিসেবে রেশন, যে পাচার হল, তার থেকে চাল, গম, আটা ইত্যাদি আনা হয়েছে। সঙ্গে শহরতলীর বেশ কিছু খাটালের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের থেকে দুধ নেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। দুধ সস্তাতে পাওয়া গেছে কারণ তখন আবার গোরুগুলো পাচারের মাঝপথে দুইয়ে নেওয়া হয়েছিল কিনা।
তবুও প্রথমে দেখে নেওয়া হবে যে সেই দুধে সোনা বা মনা আছে কিনা? ‘সোনা’ বা ‘মনা’ থাকলে তাকে আলাদা করে রাখা হবে। তারপর পায়েস বানানো হবে। সমস্তটাই হবে পাচারের কয়লায়। সঙ্গে অন্যান্য খাবারের বন্দোবস্তও করা হয়েছে মানে কাঁচামাল কিনে রাখা হয়েছে। নলবন থেকে চুরি যাওয়া মাছ সস্তায় কিনেছি।
তবে পায়েস ছাড়া বাকি খাবার অভ্যাগতরা নিজেরা নিজেদের খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী নিজেরাই রান্না করে খাবেন। খরচ কমানোর জন্যই এই অভিনব ব্যাপারটি আমি করেছি।
মিষ্টি হিসেবে ‘জলভরা লাড্ডুর’ কথা ভেবেছি, যা হাতে নিলেই ফট করে ফেটে যাবে। না, জলভরা সন্দেশের রিস্ক নিই নি। আপনার মতামত জানতে চাইছিলাম। যদি অন্য কিছু মিষ্টির কথা বলেন।
পরশুরামের ‘বিবাহ বিভ্রাট’ গল্প পাঠ দিয়ে বিবাহ অনুষ্ঠান শুরু হবে। তারপর সুকুমার রায়ের ছড়া। নাহ, এপাং ওপাং ঝপাং আমরা রাখছি না। বলা যায় না, ছড়া শুনে টপাং করে কেউ আবার কাউকে গাঁট্টা না মেরে বসেন। দুঃখিত।
তারপর থাকছে আন্তন চেকভের ‘দ্য প্রোপোজাল’ নাটক। এগুলোতে অভিনয় করবেন স্কুল মাস্টারের চাকরি কেনা মাস্টারেরা।
এরপর মনোরঞ্জনের জন্য ‘মেরা নাম জোকার’ বলে একটি যাত্রাপালার আয়োজনও রাখা হয়েছে। ভিআইপি গেস্ট হিসেবে ‘বাবু বিসলারি’ এবং ‘বাবুরাও গণপত রাও আপ্টে’ মহাশয়দেরও নিমন্ত্রণ জানিয়েছি। যাত্রাপালা চলবার সময় বাবুরাও মহাশয় মাঝেমধ্যে বলে উঠবেন, “আরে! উঠা লে রে বাবা! উঠা লে! মেরে কো নেহি রে বাবা! উন সব জোকার লোগোঁ কো উঠালে”।
আপনাকেও আমি নিমন্ত্রণ জানাই। আপনাদের সহযোগিতা, সাহায্য ও আশীর্বাদে আমাদের নতুন পথ চলা যাতে সহজ হয় তার জন্য প্রার্থনা করবেন।
ও হ্যাঁ, আসবার সময় ইনস্পেকটর ওয়াগমারেকেও আনবেন কিন্তু। শুনেছি তিনিও এখন আমাদের থানাতেই আছেন।
ইমেল দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনা করবেন।
ধন্যবাদ
ইতি প্রপিতামহ শ্রী শিবরাম চক্রবর্তীর স্নেহধন্য প্রপৌত্র জীব্রাম চক্রবর্তী।
সিসিঃ স্বরাষ্ট্র দপ্তর (ইত্যাদি, ইত্যাদি)
সেই থানার ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক মানে শোলের সেই প্রাক্তন জেলার ইমেলটি পড়বার জন্য একজন অফিসারকে ডাকলেন যাতে তাকে হিন্দি তর্জমা করে কী লেখা আছে সেটা জানানো হয়। তিনি শুনলেন, তারপর মুখ গম্ভীর করে বললেন, “যত্তসব। দিমাগ সাঠিয়া গ্যায়া হোগা ইস্কা। এক বীরু আউড় জয় কো লেকর কিত্না পড়িশান থা ম্যায়! দো হল্কট! ওয়াহা সে তবাত্লা লেকড় আয়া তো ইয়ে জীব্রাম! ইয়ে নয়া চিড়িয়া কৌন হ্যায় রে বাবা! সব কো বুলাও”।
সবাইকে ডাকা হল। তারপর সবাইকে অর্ডার দিলেন, “সিপাহী লোগ, আধে ওয়াহা যাও; আধে ইয়াহা যাও; আউর বাকি, মেরে সাথ আও। শাদী মে স্কাড মিসাইল আউর T90 ট্যাঙ্ক! হা হা! ম্যায় ‘মোশা’ কী জমানে কা জেলার র র র…”।
অসাবধানে চলতে গিয়ে পা পিছলে পড়লেন আমাদের বেচারা প্রাক্তন জেলার সাহেব।