মালদায় "চিত্রাঙ্গদা"। খুব সুন্দর কোরিওগ্র্যাফি ও পরিচালনা শ্রুতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের। অন্বেষা সুন্দরভাবে বলেছিলেন তাঁর ইচ্ছার কথা।
আমি মেয়েদের ইচ্ছার কথা ভাবছিলাম। চিত্রাঙ্গদার ইচ্ছার কথা। ফেবু উত্তাল হয়ে আছে শাড়ি ও মমতাশঙ্কর নিয়ে। দামিনী বসুর আর্টিকল তুলে নিচ্ছে নামী পত্রিকা। আমি ক্লাসে গিয়ে উলস্টোনক্রাফ্ট আর বোভ্যায়া পড়াই।
গ্রীয়র, তালপাড়ে মোহান্তিও পড়াই। তারপর মেহেন্দি সেরেমনি বা সঙ্গীতে নিমন্ত্রণ পাই। এই শহরে কুড়িবছর হল নাটক নিয়ে কাজ করি। সেটা মানতে এখনো অনেক মানুষের অনেক অসুবিধে। জানতেও।
যাউকগা।
বলছিলাম চিত্রাঙ্গদার কথা।
মণিপুররাজ(তৎকালীন উড়িষ্যা)-য়ের ইচ্ছায় চিত্রাঙ্গদা অস্ত্রশিক্ষা করলেন। অর্থাৎ পুত্রসন্তানের ইচ্ছা ছিল। হয়নি। তাই মেয়ে ছেলের ভূমিকা পালন করলো। বেশ। তার মানে মণিপুররাজের আর ছেলেমেয়ে হয়নি। দ্বিতীয় বিবাহও করেননি। মণিপুরদুহিতা বীরত্বযাপন শিখলেন। তারপর অর্জুনকে দেখে দুম করে প্রেমে পড়ে গেলেন। অর্জুন অমন টমবয় দেখে মজলেন না। ব্রহ্মচর্যটর্য বলে কাটিয়ে দিলেন। রাজকুমারী বুঝলেন মনোহরণের দীক্ষা তাঁর হয় নাই। অতএব ফ্রাস্ট্রেশন। ডিপ্রেশন। মনখারাপের দিস্তা। তাপ্পর ধরুন কসমেটিক সার্জারি করে, গ্রুমিং নিয়ে লাস্যময়ী চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের মনোহরণ করলেন।
দিব্যি প্রেমের জোয়ার এলো। সুন্দরী দেখে অর্জুন সেলিবেসি জলাঞ্জলি দিয়ে দেবেন, এ আর নতুন কথা কি? অর্জুনের তো স্বভাবই ঐ। কতজন এলো আর গেলো।
অন্তত পঞ্চাশবার দেখা এই নৃত্যনাট্য দেখতে দেখতে ভাবছিলাম রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর দূরদৃষ্টির কথা। অর্জুন কিন্তু বেশিদিন রূপসী চিত্রাঙ্গদার প্রেমে মজে থাকতে পারলেন না। এতো লাস্যে ক্লান্তি এলো। অবসাদ এলো। বিরক্তি এলো নিজের ওপর। এ কি করে সময় নষ্ট করছেন তিনি? তারপর গ্রামের মানুষের কাছে শুনেছেন রাজকুমারীর কথা। স্নেহে তিনি মাতা। সুন্দরী চিত্রাঙ্গদার সামনেই তিনি প্রকাশ করছেন রাজকুমারিকে দেখার ইচ্ছা। এই হল পুরুষের অধিকার। উলস্টোনক্রাফ্ট বলছেন, যতোই রং ঢং করে পুরুষের মন ভোলাও, দুদিন না হোক দুবছর পরে কর্মবীর মুখ ফেরাবেন। অন্য কেউ। অন্য কোন নারী। অর্জুনের অভিষ্ট। রুশো বলেছিলেন, মেয়েদের জন্মই পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্য। সুরূপা চিত্রাঙ্গদা ঠিক তাইই ভাবলেন। তারপর দেখলেন নারীর ললিত লোভন লীলায় সখা ক্লান্ত। তাঁর অন্য নারী চাই। কুৎসিৎ কুরূপ হোক। চেঞ্জ ইজ মাস্ট। তারপর আবার মদন। আবার পরিবর্তন। আবার কুরূপা ফিরলেন স্বমহিমায়। এইবার তাঁর শর্ত দিলেন চিত্রাঙ্গদা। দেবী বানানো চলবে না। সামান্যা বানানোও চলবে না। পাশে রাখতে হবে।ইত্যাদি।
খেয়াল করলে এটি পুরো সেক্সুয়াল পলিটিক্স। যে অর্জুনের অবহেলাতে চিত্রাঙ্গদা লাস্যময়ী হলেন, সেই অর্জুনের ইচ্ছেতেই আবার স্বরূপে ফিরলেন তিনি। তবে চিত্রাঙ্গদার ইচ্ছে কোথায়? বাবা আর প্রেমিকের ইচ্ছের মধ্যে স্যান্ডউইচড মেয়েটির নিজের ইচ্ছে কোথায়?
মেয়েদের কি নিজের ইচ্ছে থাকে?
এই যে চিত্রাঙ্গদা যুদ্ধবিদ্যা শিখলেন, এ তাঁর পিতৃইচ্ছা। লাস্য শিখলেন। অর্জুনের ইচ্ছা। আবার বীরাঙ্গনা রূপে যে ফিরলেন, সেও তো অর্জুনেরই ইচ্ছা। সে মেয়েকে বিয়ে করে, গর্ভবতী করে আবার তো চলে গেলেন অর্জুন অন্যত্র। What about her own will?
দ্রৌপদীর দুঃখের কথা তবু পড়া যায়। কিন্তু উলুপী বা চিত্রাঙ্গদা? এঁরা কি নিয়ে থাকলেন বাকি জীবন?
সেক্সুয়াল পলিটিক্সের গোড়ার কথাটা রবীন্দ্রনাথ ধরে দিয়েছেন। শেষটা বলেননি।
উলস্টোনক্রাফ্ট বারবার বল্লেন পারস্পারিক শ্রদ্ধার কথা। মনোরঞ্জনে শ্রদ্ধা নেই। আছে ছলনা। রবীন্দ্রনাথ তাকে দূর করে দিয়েছিলেন। ছলনা সরিয়ে সত্য সামনে এলো। তবে সে পুরুষের সত্য। স্নেহ আর বীরত্বের বাইনারি বজায় থাকলো।
উলস্টোনক্র্যাফ্টও বাইনারি ধরেই থাকলেন। নারীর বিশ্ব। পুরুষের বিশ্ব। সেখানে ভালো বউ আর ভালো মা হয়ে ওঠার জন্য নারীর শিক্ষা। তার বেশি চাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবু তিনিই বলেছিলেন মেয়েদের লাস্য ছেড়ে শক্তপোক্ত হতে। শ্রদ্ধা অর্জন করার শক্তিটুকু যেন থাকে মেয়েদের। লক্ষ্মী মেয়ে, লক্ষ্মী বউ আর স্নেহময়ী মা হয়ে থেকে মেয়েরা মানুষ হতে পারে না।
আমরা এখনো ততটুকুও অর্জন করিনি। যে হারে ভাত কাপড়ের মোহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ওটা যে রোম্যান্স না, ওটা যে ঐতিহ্যের নামে আসলে একটা গভীর ডমিনেশনের প্রতীক, সেটাই শিক্ষিত মেয়েরাও বোঝে না। তাদের অভিভাবকরাও বোঝেন না। এমতাবস্থায় ম্যারিটাল রেপ, পদবী বদল, শাড়ির আঁচল বা মি টু, সব খুব অবান্তর।
যৌন আধিপত্য নানা স্তরীয়। কে যে কাকে সুবিধে দেয় আর কে সুবিধে নেয়, বোঝা দায় বাইরে থেকে। বিস্তর ন্যাকাপনা করে, ক্লিভেজ বা কেশরাশি ব্যবহার করে কাজ হাসিল করা মেয়েদের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। পোশাক যখন স্টাইল স্টেটমেন্ট তখন তার মাহাত্ম্য আলাদা। তখন বিকিনি সুন্দর। স্প্যাগেটি টপ সুন্দর। হটপ্যান্ট সুন্দর। আবার আপাদমস্তক ঢাকা মধুবালাও সুন্দর। কিন্তু কোনটা স্টাইল স্টেটমেন্ট আর কোনটা সিডাকশন স্টেটমেন্ট সেটা তো বুঝতে হবে। মেয়েরা বোরখা বা বিকিনি, দুইই পুরুষের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য, ফেভার পাওয়ার জন্য পরিধান করলে গন্ডগোল আছে। চিত্রাঙ্গদার কেস। সে নিজের অজান্তেই পুরুষের মনোরঞ্জন করছে। উল্টোটা বলতে পারেন। পুরুষ কি নারীর মনোরঞ্জন করেন না? মিলিন্দ সোমানকে নিয়ে ফ্যান্টাসাইজ করা মেয়ের সংখ্যা কম! কিন্তু তিনি মনোরঞ্জন করেও, নিজেকে অবজেক্টিফাই করেও ভিক্টিম হবেন না।
এখনো অর্থনীতি, সমাজনীতি মানে "নীতি" ব্যাপারটাই, ইনক্লুডিং রাজনীতি পুরুষের হাতে। তাই স্বীকৃতি দেওয়ার অধিকার নারী, ইন জেনেরাল এখনো পেয়ে ওঠেননি।
খেলার দুনিয়া হোক, বা শিল্প, যৌন নিগ্রহের হোতা পুরুষ।
নারীও নিগ্রহকারী হতে পারেন তবে পরিসংখ্যান বলে তাঁরা সংখ্যায় কম। এই লেখা লিখলেই কিছু তাড়নাকারী রে রে করে আসবেন, মেয়েরা কি কম পাজি হয়! বলে। যখন সিডাকশনের খেলা চলে, এবং দু পক্ষই সমান আগ্রহী থাকেন, তখন তাকে ধর্ষণ বলা চলে না। কেন চিত্রাঙ্গদার রেফারেন্স টানলাম আশা করি বোঝা গেল। অর্জুন সিডাকশন জানতেন না এমন নয়। চিত্রাঙ্গদা সাধ করে শিখলেন। বাস্তবে এই খেলাগুলো ভিন্ন রূপ ধারণ করে। একশ্রেণীর মেয়ে সিডাকশনের মই বেয়ে তরতর করে সাফল্যের শিখরে উঠে যান। একদল ভয়ে চুপ করে থাকেন। চেপে যান সিম্পলি। কেউ কেউ মি টুর অভিযোগ আনেন।
কিন্তু মানুষটি যখন সত্যিই ধর্ষক, তখন যে খেলাটা চলে সেটা নোংরা। বিকৃত। যার জন্য শিল্প সংস্কৃতি খেলার জগতে প্রিডেটররা সদর্পে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াতে পারে। কোথাও না কোথাও পুরুষতন্ত্র তাদের মেনে নেয়। "ভুল করে করে ফেলেছিল" বলে। প্রশ্রয় দেয় চমৎকারভাবে।
বছরে তিরিশবার শ্যামা, শাপমোচন আর চিত্রাঙ্গদা দেখা প্রজন্ম আমরা। এখনও তাই "চিত্রাঙ্গদা" দেখতে গিয়ে মাথার মধ্যে ভাবনা ঘুরঘুর করে। মমতাশঙ্কর মনে হয় খুবই অসহায়ভাবে পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথা বলে ফেলেন। আমাদের ব্যক্তিজীবন কিন্তু সমাজের নানা স্তর সম্পর্কে খুব সচেতন। মুখে এক কাজে আরেক।
সেখানে মেয়েরা এখনো ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারেনি। সেকালে সখীরা থাকতো। এখন অনসূয়া প্রিয়ংবদাও নেই। "মেয়েদের ইচ্ছা" সমাজ অথবা পুরুষচালিত, শাসিত হয়েই ঘুরপাক খাচ্ছে। ডাকসাইটে অভিনেত্রী পর্যন্ত বলেন, মরার আগে সব বলে যাবো সাংবাদিকদের। এখন বলতে পারবো না ।
কালজয়ী শিল্প নানারকমভাবে ভাবায়। বৈশাখ এসে যাচ্ছে। মনে আছে? ইচ্ছে...সেই তো চালাচ্ছে