প্রতিভা সরকারের লেখনীর একটা বড় ব্যাপ্তি আছে। সমাজ বিজ্ঞান তার একটা বড় অংশ। ইংরিজিতে যাকে বলে এমপ্যাথি, সে তাঁর লেখাতে খুঁজে পাই। তার সঙ্গে আছে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। ফলে তাঁর লেখার একটি নিজস্ব ঘরানা তৈরি। 'নিয়মগিরির গান' সেইরকম একটি আশ্চর্য লেখা। অনিতা অগ্নিহোত্রীর 'মহাকান্তার' যেমন একটি সম্ভ্রম জাগায়, অনেক অনেক অজানা তথ্য উঠে আসে, উঠে আসে নতুন জীবনবোধ, জীবনচর্চা, উপলব্ধির স্তর, প্রতিভা সরকারের ' নিয়মগিরির গান' ও তেমনি। তুলনা করা হয়তো অযাচিত। কিন্ত নিয়মগিরি বলেই প্রসঙ্গটি এসে গেল। বক্সাইট আন্দোলন রুখে দেওয়া আদিম উপজাতি, ডোঙ্গরিয়া কন্ধেরা। বন থেকে খাদ্যবস্তু আহরণ করেন তাঁরা। ঝার্ণিয়া। মানে ঝর্ণার প্রহরী।কী অপূর্ব নাম। এই তো সময় ঝর্ণাকে পাহারা দেবার। কর্পোরেট বিশ্ব প্রকৃতিকে গিলে ফেলবার জন্য প্রস্তুত। কিন্ত কন্ধরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। তাঁদের আছে ভেষজ চিকিৎসা। ডোঙ্গারিয়াদের অস্তিত্বের লড়াইয়ের কথা জানিয়েছেন প্রতিভা। নিয়মগিরি সুরক্ষা সমিতি কেন 'মাওবাদী' আখ্যা পায়? হায় ভারতবর্ষ! আমরা আবার ঐতিহ্য সংরক্ষণ করার কথা বলি! পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে কর্পোরেটায়নের চাপে আর ডোঙ্গারিয়াদের লড়াই থাকছে অব্যাহত। নিষ্পক্ষ থাকা যাবে না। আদিবাসীরা মূলচ্যুত হবেন আর ভারতবর্ষ গাইবে সাম্যের গান, এ সম্ভব নয়। অতএব এই লেখা অবশ্যপাঠ্য।
কোচি কোদাগু কলকাতা। বড়ো বাঁধগুলি বন্যা হলে বিপর্যয় ডাকে। উন্নয়নের অপর নাম অনেকসময় ধ্বংস। তার কারণ পূর্ব নির্ধারিত কোনো প্ল্যানিং নেই।টাকা লুঠপাট আছে। নদীর স্বাভাবিক চলন থাকবে। বন্যাও থাকবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে নয়। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে। এ খুব প্রয়োজনীয় কথা। বাস্তব।উন্নয়নকে কিছু পিছু হটতে হবে। নাইরোবির নিদর্শন এসেছে তাই। জলাজমি বুজিয়ে বহুতল নির্মাণ আর পরিবেশবিরোধী উন্নয়নের কর্মসূচি যে ধ্বংস ডেকে আনছে, সে কথা বুঝতে হবে মানুষকে।
আলোর আধিক্য। অতি প্রাসঙ্গিক। প্রকৃতির আলো দেখছে না মানুষ। বিকেল হতে না হতে পার্কে আলো জ্বলে। অপ্রয়োজনীয় আর চড়া আলো বাদ দিতে হবে-- চড়া আলো মানুষের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। বাস্তুতন্ত্রের পক্ষেও। বেশ কিছু পরিবেশ ও শারীরবিজ্ঞানের প্রসঙ্গ এনেছেন প্রতিভা। কৃত্রিম আলোতে অভ্যস্ত মানুষ জানেই না কত বড় ক্ষতি করে চলেছে সে সভ্যতার।
বিশনইদের কথা এসেছে 'মরুবিজয়ী' প্রবন্ধতে। মরুভূমির বাস্তুতন্ত্রের কাহিনি। কাহিনিই বটে। প্রতিভার গল্প বলার ধরনটি সহজ। তাই বিজ্ঞান বা বাস্তুতন্ত্রে হোঁচট খেতে হয় না। ধর্ম অর্থে যে আত্মিক ও নৈতিক উন্নতি, পরিবেশের কল্যাণ, পরিবেশ ভাবনা, প্রতিভা বিশনইদের কথা বলতে গিয়ে তাই স্মরণ করিয়েছেন। সলমান খানদের যম বিশনইদের ভারতবর্ষের মানুষ চিনুক। জানুক ধর্মের প্রকৃত অর্থ।
হোপ ও পনির গল্প। আবারো কর্পোরেট বিপুল মুনাফা। যা লুঠ করছে অরণ্য, জল, ভূমি।কর্পোরেট নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ প্রতিভার লেখার ছত্রে ছত্রে। হোপ। ওরাংওটাং। আর পনি। তার কথা শুনলে ভয় হয়। এই মানুষ? পনিকে যারা যৌনবস্তু হিসেবে ব্যবহার করেছিল! এর থেকে বিকৃত কিছু আছে নাকি! ওরা ওটাং, প্রসাধনী, পামতেল আর চকোলেট। বিড়াল, রুমাল আর চশমা নয়।
পরিবেশ বান্ধব হও। বিশ্বের শিশুদের বাঁচাও। শিশুরা চাইছে কার্বন এমিশন কমিয়ে আনা।রাজনীতি আর পুঁজিবাদের বিকট চাল পরিবেশকে নষ্ট করছে। গ্রেটা থানবার্গ, সবুজ শুক্রবার আর পরিবেশ আন্দোলন জয়যুক্ত হোক। লেখক বড় দরকারি বিষয় নিয়ে লিখেছেন।
অতিমারী একদিনে তৈরি হয় না।বাঘজান। তৈলকূপ। আগুন লেগে মরে যাচ্ছে বিরল প্রজাতির প্রাণী।পাখ- পাখালি। ক্রমাগত জ্বলছে তৈলকূপ। আর পরিবেশ মন্ত্রক আরো নতুন কূপ খননের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছেন। ডেভেলপমেন্টাল প্রোজেক্টগুলি আসলে ঘাতক। লকডাউনের সময় তারা আরো সক্রিয়। ভাইরাসের জন্ম হবেই। বৃক্ষহীন, নদীহীন উন্নয়নের কথা পড়ে শিউরে উঠতে হয়। দেশের প্রাচীনতম অরণ্য ধ্বংসের পারমিট বার হয়ে গেল। এর নাম অগ্রগতি! আর কত রেললাইন চাই মানুষের। এ-সব খুব গভীর ভাবনা ও প্রতিরোধের বিষয়।
অতিমারীকালে কয়লা ব্লক নিলামে উঠেছে। এলিফ্যান্ট করিডরকে নষ্ট করে উন্নয়ন হবে। ভিডিও কনফারেন্স করে অনুমোদিত হয়েছে অরণ্য ধ্বংস। অপ্রতিম ও অপূর্ব অরণ্য অঞ্চল নিয়ে মাথা ঘামাবে না সরকার ও কর্পোরেট। সমস্ত বিরল প্রজাতির প্রাণী শেষ হয়ে যাক। মানুষের কিছু এসে যায় না। মূর্খের স্বর্গ।
রাট হোল মাইনিং। লকডাউনের মধ্যেও খনন হয়েছে । কয়লার লোভ। চাসনালা রিপিটেড। অপরিকল্পিত মাইনিং এর ফলে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিবেশ। বৃষ্টি কমে গেছে চেরাপুঞ্জি ও মৌসিনরামে। বাতাসে দূষণ।জলে অ্যাসিড। ঝর্ণা প্রস্রবণহীন।
নদী চুরি হচ্ছে কাশ্মীরে। বালি মাফিয়া আর পরিবেশ লুন্ঠনের ঘৃণ্য চক্রান্ত। প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে ব্যবসা করা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। প্রমোদ উদ্যান তৈরি হচ্ছে পর্যটনের নামে। বরং 'ইয়ারো আনভিজিটেড' থাকলে ছিল ভালো। প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ লুঠ হচ্ছে। হোক। ভূমিপুত্র সংখ্যালঘু হচ্ছে। হোক ! পরিযায়ী পাখি আসছে না। না আসুক ! আমাদের উন্নয়ন আছে।
প্রতিটি প্রবন্ধ সুলিখিত। সুচিন্তিত। বিশেষ করে লকডাউনের কালে যেভাবে দ্রুত রচিত হয়েছে ধ্বংসের প্ল্যান , তা নিয়ে সরব লেখক। ক্ষয়রোগ ধরা কয়লা পাহাড় কাঁদছে। শেষ হয়ে যাচ্ছে পুরুলিয়া জয়ন্তিয়া।
অতিমারী ও করোনা নিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ আছে। ইবোলা।জিকা। নিপা। করোনা। লোভ আর রোগের উৎস সন্ধান।
করোনা, রাজনীতি ও সমাজনীতি নিয়ে শেষ অংশের প্রবন্ধগুলির জন্যও লেখককে ধন্যবাদ।
প্রতিভা কুড়ুলকে কুড়ুল বলেন। সরকার ও কর্পোরেটের মিলিজুলি আঁতাত খুলে দিতে তাঁর দ্বিধা নেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উন্নয়নের নামে যে অরণ্য ধ্বংস, বন্য প্রাণ হত্যা চলছে, নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে প্রকৃতির স্বাভাবিকত্ব,তার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন তিনি। প্রতিবছর উৎসবের সময় ভাবি, এত অতিরিক্ত আলো কেন, এত শব্দ কেন। নেহাতই কিছু মানুষের কর্মসংস্থান হবে এই আতিশয্যের ফলে, সে বড় ছেলেভুলানো কথা। তাঁদের কর্মসংস্থান অন্যভাবেও হতে পারে।প্রাকৃতিক বনভূমি, পর্বতাঞ্চল, সমুদ্র তটে গজিয়ে উঠছে বাজার সংস্কৃতি।ঐতিহ্যের নামে প্রসার পাচ্ছে পুঁজিবাদ। কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের মিলিত উদ্যোগ এ সব থামিয়ে দিতে পারতো। অথচ পারেনি। সত্যি। যা কিছু ব্যক্তিগত তাইই রাজনৈতিক। তাই লকডাউনে ত্রাণের বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। কেরল কোথায়, কিভাবে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থাকে কার্যকরী করেছে , তাও বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
সহজ এবং সরল ভাষাতে কোন জটিলতা নেই। এত আন্তরিক উপলব্ধি আছে যে বক্তব্যের গভীরে পৌঁছাতে অসুবিধে হয় না।ফেডেরাল সিস্টেমের অভাবে লকডাউনের ওঠাপড়া, পরিযায়ী শ্রমিকের বিপদ, সমস্ত সাম্প্রতিক ঘটনাকে বিশ্লেষণ করেছেন।যেহেতু যুক্তিবদ্ধ এবং তথ্যসমৃদ্ধ লেখা, তদুপরি স্বল্প পরিসরের তাই পড়তে এবং মনোসংযোগ করতে অসুবিধে নেই।
পরিবেশ আমাদের বাঁচিয়ে রাখে।অথচ আমরা পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি না। প্ল্যাস্টিক ব্যবহার করে মানুষ ভাবে, এই একটাতে আর কীই বা ক্ষতি হবে ! আর সত্যি কথা এই যে রাষ্ট্র সহায়ক না হলে ব্যক্তি মানুষ কিছু করতে পারে না, প্রতিবাদ ছাড়া।
আইন পাশ হওয়া আর কার্যকরী হওয়ার মধ্যে যে আকাশপাতাল পার্থক্য, তাও প্রতিভা লিখেছেন। করোনা -- সতী তাই একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। মেয়েদের আর্থ সামাজিক অবস্থান এখনো নারী স্বাস্থ্যের পরিপন্থী। মেয়েরা শুধু সেবা করে যাবে, সেবা পাবে না? খুব দরকারি প্রশ্ন যা বারবার করে যাওয়া দরকার। অযত্নের প্রথাগুলিকে আঙুল তুলেছেন। আর কে না জানে অযত্নের মেয়েরা সারাজীবন রোগগ্রস্ত থেকেও সেবা করে।আর এই করোনাকাল তাদের নিংড়ে নিয়েছে। সবাই তো আর ' তাসের ঘরে' নায়িকা হতে পারে না।
তবে করোনা সতী যেমন আছে, করোনা অসতীও তেমন আছে।দুই-ই দেখেছি। ম্যালনিউট্রিশন হল কমন ফ্যাক্টর। হেলিকপ্টার থেকে যে পুষ্পবৃষ্টি হল, তাতে কয়েকলাখ টাকার পিপিই কেনা হয়ে যেত।এটাই পরম সত্যি। ট্রেনিং এরও সেফটি ইকুইপমেন্ট ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীরা লড়ে গেছেন। এও ঘটমান বাস্তব।
প্রতিভা সরকারের লেখা অতি তীক্ষ্ণ। খুব বেসিক ঘাপলা গুলোতে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন।জনসচেতনতা আর সৃষ্টিমুখী আন্দোলন ফিরে আসুক।হননকাল শেষ হবে। উন্নয়নের বিপদ মানুষ বুঝে গেছে। এবার চাই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ।
শক্তিশালী লেখক। অরণ্যের অধিকারের উত্তরাধিকারের শপথ নিয়ে তাঁর লেখা।
কর্পোরেট আর দুর্নীতির চাপে ক্লিষ্ট পৃথিবী অসন্তুষ্ট। শুধু সব দোষ ভাইরাস বলে হবে না। আগে মানুষের দোষ দেখো।কীভাবে নির্ধন করেছে সে পৃথিবীকে।মুনাফা লুঠবার উন্মত্ত ভোগবাসনায় আর তার নাম দিয়েছে উন্নয়ন।
প্রয়োজনবিশেষে এই প্রাণঘাতী উন্নয়ন বন্ধ হোক। মুনাফাবাজদের স্বার্থে খাল কেটে কুমির আনা কর্পোরেট দেশকে খোকলা করে দিচ্ছে।
প্রতিভা সরকারের লেখনী সেই ঘাপলাবাজির রাজনীতিকে ঘাড় ধরে উন্নয়নের ধ্বংস দেখিয়ে দিয়েছে।
আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা রইল বইটির জন্য।
প্রতিভাদিকে ভালোবাসা।