"আদ্যাশক্তি মহামায়া" বা "দুর্গা দুর্গতিনাশিনী" এইসব নামে ছবি হত এককালে। আরো অনেক ছবিতেই মা দুর্গা থাকতেন। মাটির মূর্তির পেছন থেকে জলজ্যান্ত মা দরকারে অদরকারে আসতেন। কিছুটা আবছা মনে আছে। কারণ সেইসময় আলেয়া সিনেমা নামে একটি হল ছিল আর দিদু ম্যাটিনি শো' তে নাতনীকে নিয়ে আদ্যাশক্তির শক্তি দেখতে যেতেন। আমার কিন্তু মনে আছে "অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি"। তনুজা গরদ পরে বেশ বাংলার বধূ হয়ে পিদিম জ্বালাচ্ছেন, গ্রামের লোক ঘরে আগুন লাগাচ্ছে, অ্যান্টনি বাইরে বাইরে কবিগান করে বেড়াচ্ছেন। দুর্গাপূজা এই ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না। একটা ইস্যু ছিল। যে ফিরিঙ্গির বাড়িতে তার একদা বাঈজী এখন বধূ দুর্গাপূজার আয়োজন করতে পারে। এটা, এখন মনে হয় একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈপ্লবিক ঘটনা। দুর্গাপূজার একটা বিশাল সামাজিক দিক আছে। একটা প্রিজম যেন। অনেক অনেক আলোর বিচ্ছুরণ। তার কিছুটা অ্যান্টনি সাহেবের দুর্গাপূজার আয়োজনে ধরা পড়ে। তাও প্রায় একক আয়োজন। সেটা কতদূর সম্ভব জানি না। মানে কে তাঁকে প্রতিমা গড়ে দিল? কেই বা জোগাড় দিল এই বিশাল পূজার? তবু না হয় গল্পের খাতিরে মানা গেল যে স্বামী স্ত্রী মিলে একটা যেন আনন্দোৎসব করছেন, ঘটনা তো আসলে উত্তমকুমার।
তাই আর কোনো প্রশ্ন নয়। একা একাই দুর্গাপূজার জোগাড় হয়ে যাক।
এরপরে বাঙালির চিত্তে নিতি নৃত্যে যে ছবিতে দুর্গাপূজা একটা ঝমঝমাটি জমজমাটি চেহারাতে দেখা দিল, সেটা হচ্ছে "অনুসন্ধান"। মাঝে এটা ওটা এসেছে, হিট হয়েছে। যে নামগুলো নিয়ে লোকে হে হে করে হেসেছে, আবার পান চিবিয়ে দেখেও এসেছে যেমন সিঁদুর (চেটে গেল ইঁদুর বলেওছে) তাতে হিট ডায়ালগগুলো এখন ইউটিউবের মুখবন্ধ : "আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি মা!"
বাংলা সিনেমা ভুল বুঝতে পেরেও ভাঙবে তবু মচকাবে না। "বলো দুর্গা মাঈকী" নামেও নাকী একটা ছবি হয়েছে! ঢাকের তালে বলে একটা গান শুনতে পাই মাঝেমাঝেই। তবে যে কথা বলছিলাম, "অনুসন্ধান" একটা বিগ ব্রেক। অমিতাভ বচ্চন বাংলা ছবি করলেন। বাংলা বললেন। "আমি বলছিলাম কী" বাক্যবন্ধ সুপার ডুপার হিট হল এবং তিনি ঢাক বাজিয়ে মায়ের সামনে নাচলেন। রাখী আনন্দর সিল্ক শাড়ি পরে পরে দাঁড়িয়ে রইলেন। কালীরামের ঢোল ফাটল। দুর্গাঠাকুরের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই লোকে বচ্চনবাবুকে বেশি দেখল, আমজাদ খানকে বেশি দেখল। তাঁরও এটি প্রথম বাংলা ছবি। বাংলা বোল। অর্থাৎ মহামায়া কেন্দ্রিক ছবি থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গাপুজাকে একটা এলিমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করার জায়গা তৈরি হল।
"অনুসন্ধান" একটা ব্যাপার ছিল। তাতে দুর্গাপূজার আয়োজন বাঙালিয়ানা বোঝানোর জন্য যতটা, তার থেকে বেশি বচ্চনসাহেবের নাচ দেখানোর জন্য।
এই ছবির কিছুটা পরে পরেই রিলিজ হল অপর্ণা সেনের "পরমা"। এইখানেই দুর্গাপূজার একটা জার্নি শুরু হল যেটার ভিত গেঁড়ে দিয়েছিলেন অবশ্যই সত্যজিত রায়। কাজেই ভালো লাগা ছবিগুলোর কথাই বলা যাক। অসুর, ভাসুর, সিঁদুর নিয়ে লেখার কিছু নেই।
"জয় বাবা ফেলুনাথ" ছবিতে দুর্গাপূজা একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকল। দৃশ্যায়ণ, প্লট এবং রহস্য কাহিনী নির্মাণে দুর্গাপূজা জড়িয়ে আছে এই ছবিতে। ছবির শুরুতে, টাইটল শেষ হতেই ফুটে উঠছে প্রতিমা নির্মাণ। দেবী সজ্জিত হচ্ছেন। বৃদ্ধ শিল্পী রুকুকে শোনাচ্ছেন দেবীর জন্মকাহিনী। যেহেতু ছোটদের ছবি এবং চলচ্চিত্র একটি গণমাধ্যম, নিপুণ গল্পোচ্ছেলে কী অপূর্ব আঙ্গিকে দেবীদেরর বাহনরা পরিচিত হচ্ছেন। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা। সরস্বতীর বাহন হাঁস। ক্যামেরা সরছে সেইমত। পুরাণের গল্প বলে চলেছেন শিল্পী আর রুকু কথা বলছে দু একটা, সে যতটুকু জানে। মা দুগ্গার বাহন হল সিংহ। ব্যস। রহস্যের কী নোট দেওয়া হয়ে গেল। এরপর অপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। বনেদী বাড়ির দুর্গাপূজা। বাহন। শিল্পী। রুকু। তারপরে ক্লোজাপে দেবীর মুখ। রঙবিহীন। মাটির মূর্তি। অথচ দেবী। তারপর গাড়ির হর্ণের সঙ্গে সঙ্গেই একটা দুর্দান্ত লং শটে প্রতিমার সম্পূর্ণ চালি দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার প্যাসেজের একদিকে দুর্গাপ্রতিমার কাঠামো। অন্যদিকে রুকু খড়খড়ি দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে কে এলো। দৌড়ে গিয়ে জানাচ্ছে, ডাকু গন্ডারিয়া। ভালো আর মন্দর দ্বন্দ্ব এখানেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে আর দুর্গাপুজা একেবারে অস্থিমজ্জাতে মিশে যাচ্ছে ছবির সঙ্গে। বুনিয়াদ তৈরি হয়ে গেল এখানেই। দেবীর শুভ শক্তির পাশাপাশি তৈরি হল মগনলালের হুমকি, আমাকে না দিলে, আমি নিয়ে নিই। নির্লোভ, সরল শশীবাবুর বিপ্রতীপে লোভী মগনলাল মেঘরাজ। এবং তারপরেই দিনের ঝকঝকে আলো। বারাণসীর রাস্তা। সাইকেল রিক্সা দুটি পাশাপাশি এবং লালমোহনবাবুর টুকটুকে লাল স্যুটকেস।
ফেলুদা যখন সেক্রেটারি বিকাশের সঙ্গে ঘোষাল বাড়ি দেখেশুনে, ছাতে রুকুর সঙ্গে কথা বলে নিচে নামছেন, সেদিন চতুর্থী। লালমোহনবাবু আর তোপসেকে নিয়ে ফেলুদা প্রতিমা নির্মাণ দেখছেন। সঙ্গে বিকাশ। আইরনিক্যালি রঙ শুরু হয়েছে এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই শশীবাবু রঙ করছেন মহাদেবের সাপটিকে। ফেলুদা জানতে চাইছেন ষষ্ঠীর আগেই রঙ শেষ হবে তো? আর প্রতিমার ব্যাকগ্রাউন্ডে আমরা দেখছি শশীবাবুর অসাধারণ প্রোফাইল। আরেকবার শশীবাবুকে দেখা যাচ্ছে দুর্গাপূজার অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। চক্ষুদান। একটি ছোট টুলের ওপর উঠে চোখের মণি আঁকছেন তিনি। কিন্ত দৈবীশক্তির চেয়েও এখানে বেশি চোখে পড়ে মানুষের শক্তি। শশীবাবুকে ধরে টুল থেকে নামিয়ে নিচ্ছে তরুণতর প্রজন্মের প্রতিমার গহনাশিল্পী। সত্যজিতের মিথ রচনা হয় এইভাবে। সুনিপুণ টানে মানুষের গল্পে।
আর চক্ষুদানের পরেই শশীবাবু টুল থেকে নেমে দেখতে পেলেন গণেশ। এও যেন দৈবীশক্তির কাজ!
এরপরেই মগনলালের সুপারিকিলারের ছুরির ঘায়ে শশীবাবু খুন হলেন। মৃত্যুর আগে বলে গেলেন সিং। মা দুগ্গার বাহন মিশে গেল প্লটে। আধা ভিলেন বিকাশকে যখন বন্দুক ধরে চ্যালেঞ্জ করছে ফেলুদা, তখন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে পূজার বাজনা। মন্দরা শাস্তি পাচ্ছে। আর ষষ্ঠীর বোধন যখন চলছে, তখন উল্টোদিকে দরজা দিয়ে গটমট করে হেঁটে আসছেন সপারিষদ ফেলুদা। রহস্য সমাধান হয়ে গেছে। পুজোর বাজনা আর ফেলুদার জয়ের বাদ্য এক হয়ে গেছে। এই প্রথম বোধকরি বাংলা ছবিতে এত দক্ষভাবে দুর্গাপূজা মিশে গেল। অথচ কোথাও এতটুকু বাড়তি আড়ম্বর নেই। বাড়তি সেন্টিমেন্ট নেই। লোকদেখানো আদিখ্যেতা নেই পুজো নিয়ে। সমস্তটাই বনেদীয়ানার লাবণ্য আর শ্রীতে মাখামাখি। সঙ্গে রহস্য।
অপর্ণা তাঁর "পরমা" ছবিতে, খুব ইনটেনশনালি দুর্গাপূজা আবহ আনলেন। চাতালে পুরুষদের আড্ডা। রাহুলের ফোটোগ্রাফি। মেয়েদের কুটনো কোটা সব থাকলো বাড়ির পুজো বোঝাতে। কেন্দ্র থাকলো রাখী গুলজারের মুখখানি। কাহিনীর ডিম্যান্ডকে গুরুত্ব দিয়ে অপর্ণা এই কাজটা করেছেন বলেই মনে হয়। ছবির শুরুতে ক্লোজাপে দেবীর মুখ। রাহুল রায়ের ফোটোগ্রাফিতে পূজার প্রসাদ। আল্পনা। প্রদীপ। ব্যাকগ্রাউন্ডে মন্ত্রোচ্চারণ। পুজোর মিষ্টি কোথায় রাখা হবে, এই প্রশ্নের উত্তরে রাখীর মুখ ফিরিয়ে তাকানো ও রাহুলের ফোকাসিং।থিম ঢুকতে থাকে। একের পর এক দায়িত্ব। বড়তরফের সঙ্গে দেখা করা, শাশুড়িকে ওষুধ খাওয়ানো, কোন গাড়ি যাবে ঠিক করা। পরমা দশভূজা। এবং দশভূজার অন্যনাম পরমা।
এটাও ফোকাসড যে বাড়ির মেয়েরা যখন পুজোর কাজ করছেন, পুরুষরা বেসিক্যালি আড্ডা দিচ্ছেন। ট্র্যাডিশনাল মাতৃমূর্তিকে পূজা করে যাওয়া এবং মেয়েদের ওপর মাল্টি টাস্কিং চাপিয়ে সুখী বনেদীয়ানার বাতাবরণ তৈরির পিতৃতান্ত্রিক প্রথা স্পষ্ট। বাকী ছবি জুড়ে আছে দেবীত্বর খন্ডন। সত্যজিতের দেবী যেখানে থেমে গেছে, স্কিৎজোফ্রেনিক হয়ে গেছে, সেইখানে অপর্ণার পরমা শুরু হচ্ছে। অপর্ণা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মননশীলতায় ছেদন করে যান দশভূজার কনসেপ্ট। দেবীত্ব আর সতীত্বর চাপিয়ে দেওয়া নর্মস। বড় বৌমা, মা, জ্যেঠিমা, কাকীমার বাইরে গিয়ে পরমা নারী হয়ে ওঠে। নিজের জন্য বাঁচতে শেখে। এই ছবিতে দুর্গাপূজার আইরনি ও পুনর্নিমর্মাণ প্রবল।
এরপরে এল তরুণ ঋতুপর্ণর হাত ধরে "হিরের আংটি"। কী নেই পুজোর এই ছবিতে? ঋতুপর্ণ পুজোকে সাজাতে শুরু করলেন। দুর্গাপুজো ঋতুপর্ণর ছবিতে একটা আলাদা চরিত্র। তাঁর ছাঁচ, গড়ে, নির্মাণ, অলংকার সব বড় নান্দনিক। আলাদা। একেবারে আলাদা। বিদেশ থাকা আসা মেজ ছেলে, বৌ আর তিন্নি, বনেদী বাড়ির কর্তা আর সেই সত্যজিতের ঘরানার ঠাকুর বানানোতে ঋতুপর্ণ আরো একটু সাজ বৃদ্ধি করলেন।
বাঙালির মন আপ্লুত করার সমস্ত এলিমেন্ট থাকলো। গ্রাম। বনেদী জমিদারবাড়ি। যৌথ পরিবার। এমন বাড়ির কর্তা বসন্ত চৌধুরি ছাড়া আর কেই বা হতে পারেন! কুস্তিগির ছোটভাই। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো গৃহভৃত্য। আহ্লাদী এন আই মেজো ভাই বউ। মুনমুন সেন দিব্য ফিট ইন করে গেছিলেন। যেন টেলর মেড রোল। আটপৌরে বড় বউ শকুন্তলা বড়ুয়া। পুকুর হাঁস। ছিঁচকে চোর সুনীল মুখোপাধ্যায়। ডাকাতের দল। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাসকে একেবারে জমজমাট করে দিলেন ঋতুপর্ণ, মাঝখানে থাকল দুর্গাপূজা। তিন্নি শিখল যে চটি খুলে মন্ডপে উঠতে হয়। আর ঢাকি ও তার ছেলেকে নিয়ে মাস্টারস্ট্রোক দিলেন ঋতুপর্ণ। শিশুপুত্রকে খাইয়ে দিচ্ছে ঢাকি। এই ছোট্ট দৃশ্যের মধ্যে দুর্গাপূজার অনেকখানি ধরা থাকল। নিশ্চিত সে মাতৃহীন শিশু। মাতৃমূর্তির সামনে বাঙালিঘরের এই অপত্যস্নেহটুকু চিরকালীন হয়ে রইলো। দেবী সজ্জিত হতে থাকলেন। এখানেও ষষ্ঠী থেকে শুরু করে কাহিনীর সঙ্গেই জড়িয়ে থাকলো পুজো আর রহস্য রোমাঞ্চ।
মহিষাসুরমর্দিনীর এত অপূর্ব ব্যবহার আগে কী বাংলা ছবি দেখেছে? ভোর নয়। সাক্ষাৎ উষাকাল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর গলা শোনা যাচ্ছে।
মায়ের মুখটি প্রতিভাত হল পর্দাতে। ঠিক "জাগো মা" বলার সঙ্গেই চিক উঠল মায়ের সামনে থেকে। মায়ের মুখ ধরা পড়লো ক্লোজাপে। বারদালানে প্রতিমার রঙ শুরু হয়েছে। রঙের থালার পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে বকমবকম পায়রা। এমনকী ছিঁচকে মিষ্টি চোরটিও বড় আকুলভাবে ঘুমাচ্ছে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ মন্ত্র পড়ে চলেছেন।
বড়কর্তা ঘুম ভেঙে মশারির নিচেই প্রণাম করছেন ইষ্টদেবতাকে। বাড়ির অলিন্দে পায়রারা ঘোরাঘুরি করছে। তারপর জানালার রঙিন কাঁচ ফোকাস করে ক্যামেরা নিচে নামল। মশারির নিচে ঘুমাচ্ছে আমাদের নায়ক হাবুল। ঠিক আমাদের মতোই সে মহিষাসুরমর্দিনী শুনতে শুনতে ঘুমায়। ঘুম থেকে মা তুলে দিলে বলে, আমায় ডাকোনি কেন। বনেদীয়ানা, বাঙালিয়ানা, বনেদী আটপৌরে, এন আর আই এফেক্ট মিশিয়ে একটা জম্পেশ পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল প্রথম পনেরো মিনিটেই। আর বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় টাইম স্পেস এলিমেন্ট তৈরি হল। পূজা আসছে। নদীতীরে কাশ ফুটেছে।
ছবিটা শুরু চোরের স্বপ্ন দিয়ে। তারপরে কর্তা আর ভৃত্যের কথোপকথন। এ হল তিরিশ বছরের পুজো। এবছর পুজো কী হবে? না সব ছেড়ে কর্তা চলে যাবেন! ভৃত্য যাবেন না। যেখানে কাশ ফুটেছে সেখানে ঘর বেঁধে থাকবেন। তারপরেই টাইটল ফুরোতে না ফুরাতে পিতৃ পক্ষের শেষে মহিষাসুরমর্দিনীর আবহ। পুজো এলেই "হীরের আংটি" মনে পড়ে, এটাই ঋতুপর্ণর কৃতিত্ব।
এরপরে ঋতুপর্ণ "উৎসব" তৈরি করেন দুর্গাপূজার প্রেক্ষাপটে। আবার বনেদী বাড়ির ঘরোয়া পূজা ফিরে এলো এবং শুধু ফিরে এলো নয়। এমনভাবে এল যে ফিল্মে একটা ট্রেন্ড হয়ে গেল দুর্গাপূজার ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি করা। (যেটা অদক্ষ হাতে ক্লিশে এবং এখন জগঝম্প হয়ে গেছে)
"উৎসব" আর একটা ল্যান্ভমার্ক ছবি। পুজো একটা সামাজিক উপলক্ষ। যে উপলক্ষ্যে সবাই পুরোনো বাড়িতে ফেরে। প্রবাসী ছেলে ফেরে।বিবাহিত মেয়ে ফেরে। সমস্যা আর যন্ত্রণার বোঝা মাথায় নিয়ে ফেরে। মা যেন প্রাচীন বাড়িটি। সবাইকে আশ্রয় দিচ্ছেন। এই ভূমিকায় ছিলেন মাধবী মুখোপাধ্যায়। উৎসব মানে দুর্গাপূজা। মা আর সন্তানেরা। আধুনিক সন্তানেরা ফিরেছে তাদের বেদনা বহন করে। তিরিশ থেকে একেবারে জাম্পকাটে দেড়শো। "হীরের আংটি" র তিরিশ বছরের পুজো নয়। দেড়শো বছরের পুরোনো পুজো, যাতে সেইসময় হাজার টাকার বাজী পুড়তো, দু হাজার মানুষ খেতে, জর্মানি থেকে মায়ের গয়না আসতো। ন্যারেটিভে চরিত্রের ক্যামেরা ধরা ও টাইটল কার্ডের ফাঁকে ফাঁকে এইসব তথ্য গ্ল্যামারাস করে তোলে ছবিকে। এও জানা যায় এই বাড়ির পুজোর বাসন সত্যজিতের দেবী ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। "জয় বাবা ফেলুনাথ" স্টাইলে এখানেও বাড়ির বাচ্চাদের তথ্য জুগিয়ে যান প্রতিমা শিল্পী। লক্ষ্মীর সঙ্গে গণেশের ভাইবোন সম্পর্কের পরেই কিন্ত ঋতুপর্ণ ভাঙতে থাকেন। মামাতো মাসতুতো ভাইবোনের প্রেম, পারু- শিশির এবং পরবর্তী প্রজন্মে তার ছায়া আস্তে আস্তে ফুটে উঠতে থাকে। একান্নবর্তী পরিবার। বালকেরা বসে বসে ঠাকুর বানানো দেখে। তারা জানতে পারে একচালা মানে একটা চালের নিচে সবাই মিলে থাকা। কিন্ত চালা মানে কুঁড়েঘর নয়! সত্যজিতের ছবির আদল, তবে আরো জটিল সাংসারিকতাতে প্রবেশ করেন ঋতুপর্ণ। তাই নকল নয়। ভাগের মা এখানে বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব পাচ্ছেন। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে গেছে কবেই।
উমাকে বেশ কয়েকটি নারী চরিত্রের মধ্যে ভাঙলেন ঋতুপর্ণ। বড়বৌ দুর্গা। আটপৌরে। সমস্তকিছু সহ্য করা, সহ্য করতে বলা নিপাট ভালোমানুষ। অলকানন্দা রায়ের চোখের নিচে ভাঁজ পরা সংসারী মুখখানিতে গভীর মায়া। বৃহৎ পরিবারে লুচি ভাজা, কুটনো কোটা, সজনে ডাঁটা কাটার নিখুঁত নৈপুণ্যের সঙ্গে এই চরিত্রে সামাজিক সহবাসের লাবণ্যটুকু মিশে আছে। তিনি সর্বংসহা উমা হয়ে ছোটবোন কেয়ার তার বরের সঙ্গে অশান্তি মিটিয়ে নেবার কথা বলছেন। তিনিই বলছেন বাড়ি বিক্রি হবার হলে কেউ আটকাতে পারবে না, আর যদি না হবার হয়, তবে একটি ইঁটও কেউ বিক্রি করতে পারবে না। বনেদী দুর্গাপূজার আড়ম্বরের আড়ালে চলছে বাড়ি বিক্রির টেনশন, পারুল আর শিশিরের সম্পর্ক নিয়ে পারুলের মনে অশান্তি। একুশ বছরের ছেলের মা কেও সন্দেহ করেন তাঁর স্বামী প্রাক্তন পিসতুতো ভাই, প্রেমিক ভাইয়াকে নিয়ে। পারুল খুব ভয় পায়। যদি তার ছেলে জয় আর আর তার দাদার মেয়ে শম্পার প্রেম হয়! ওদের একসঙ্গে ওঠাবসা চায় না সে। সরিয়ে দেয়। কিন্ত বড় বৌয়ের কথা যেন ধ্রুব সত্য। যা হবার তাই হয়। জয় আর শম্পার অনুচ্চারিত প্রেম ধরা থাকে অষ্টমীর সন্ধিপূজাতে। অমলধবল গানে। পারুল চিরকালের কষ্ট পাওয়া উমা আর শম্পা হল তরুণী উমা।
বর যদি নেশাসক্ত হয়, তবে উমা অন্নপূর্ণা হতে পারেন বটে, তবে এই ছবির কেয়া জ্বলেপুড়ে মরে। পুজোর মধ্যে অরুণ আর কেয়ার অশান্তি ছবির অনেকটা জুড়ে। কেয়া যেন এককালে ছিল সেই যোগিণী উমা, যে অরুণকান্তি রূপে ভুলে ছবি আঁকিয়ে রাজনীতি করা ছেলেটির গলায় মালা দিয়েছিল। দশমীর সন্ধেতে তার মন খারাপ। সে জানে তার বিয়েটা ভেঙে যাবে। বড়বৌ সিঁদুর খেলার থালা নিয়ে ডাকতে আসেন। থালার ওপরে কুরুশের ঢাকনিটি চোখে পড়ে। অরুণ যখন জ্বর নিয়ে ফেরে, তখন কেয়ার পরনে গরদ। জয় ক্যামেরাতে। একেবারে পরমা ছবির মতো। জয়কে দিয়ে বলিয়ে নেন পরিচালক।
পরমার আদলে এখানেও আছে মেয়ে বউদের বারান্দায় বসে কুটনো কোটা আর গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দুর্গোৎসবের পর্ব। পারুল গোয়েন্দার মত নজর রেখে যায় শম্পা আর জয়ের দিকে। ভাইয়া আর সঁইয়ার খেলা চলতে থাকে। মেজ বৌ দাপটে উমা, যাকে সবাই অহংকারী ভাবে। ঋতুপর্ণ ফ্ল্যাট চরিত্র তৈরি করেন না। এই অহংকারী বউটির মধ্যেও একটা স্পষ্ট দিক আছে। এই দুর্গাটি কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। সে জানিয়ে দেয় যে তার একটি বাপের বাড়ি আছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সে ফিরবে কারণ তারও বাপের বাড়ি আছে। সে এও বলে সমস্যাকে ফেলে রাখলে হয় না, তাকে অ্যাড্রেস করতে হয়। এই আপাত রুক্ষ, অহংকারী বধূটি, যে কীনা কাজের লোক সঙ্গে করে পুজোবাড়িতে এসেছে, বাড়ির অন্যান্য মেয়ে বউরা যখন সাংসারিক কাজে ব্যস্ত তখন সে ড্রায়ার দিয়ে শ্যাম্পু করা চুল শুকায়, নেইলপলিশ পরে, তার অন্তরটি তত কঠিন নয়। একটি অন্তঃসলিলা আছে। ঋতুপর্ণ নারীদের বড় চমৎকার বোঝেন। এই ছবিটিতে দুর্গাপূজা ও পারিবারিক চালচিত্র একেবারে মিলেমিশে গেছে। দুর্গার কতরূপ এই বাড়ির মেয়ে বৌদের মধ্যে ছড়িয়ে!
প্রতিটি নারীচরিত্র তার নিজের কথা বলেছেন। বড় বৌ ছাড়া সবাই। অনেক দুর্গা। শম্পা তার পিসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে আবার সরে আসছে। জয় কখনো উন্মুখ, কখনো উদাসীন। যখন দেখা হচ্ছে পারুল আর শিশিরের, তখনও বোঝা যাচ্ছে অতন্দ্র প্রহরীর মত প্রেম জেগে আছে, পারুলের সরে যাবার সমস্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। আর ঠিক তখনই ভেসে আসছে শম্পার গান, অমল ধবল পালে লেগেছে...যদিও তখন রাত। দশমীর প্রণাম, কোলাকুলি..অরুণ ফিরছে মূলস্রোতে। কেয়া অরুণ নতুন করে ভাবছে। আইরনিক্যালি মেজবৌয়ের নাম মণিকা।শুনলেই কেমন মণিমালিকার কথা মনে পড়ে। তিনকন্যার মণিমালিকা। গহনার লোভে যে মৃত্যুর ফাঁদে পা দিয়েছিল। ঋতুপর্ণর মণিকা বরকে বলে, প্রয়োজনে তার সমস্ত গয়না আছে, যদিও বর তাকে জানায়নি যে দুমাস মাইনে হয়নি, অফিসে তালা।
একদিকে পুজো আরেকদিকে বাড়িবিক্রি। ব্যক্তিগত টেনশন। মাধবী বাড়ির গৃহিণী। দশভূজা হয়ে সামলাতে পারছেন না সব। আবার সামলাচ্ছেন। মাতৃমূর্তির আভিজাত্য তাঁকে সুষমামন্ডিত করেছে। কেয়া ভয় পাচ্ছে।যদি অরুণের সঙ্গে আবার অশান্তি হয়। অরুণ বলছে ভাসানের পরে প্রতিমার কাঠামো তুলে আনার কথা। বাকী থাকে বাতাস আর জল। রিসাইক্লিং প্রসেসে বছর ঘুরতে আবার পুজো হয়। কনস্ট্রাকশন, ডিকনস্ট্রাকশন। একটি ভালাবাসাবাসির দৃশ্যের সঙ্গেই এই কথোপকথনে সামাজিক আর সাংসারিক চালচিত্র নতুন মানে নিয়ে আসছে। অরুণ জীবনানন্দ পড়া শিব। এই যে কেয়া আর অরুণ বিচ্ছেদে যাচ্ছে না, বরং কেয়া তার বাবার বাড়িতে অরুণকে নিয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করছে, একতলায় গ্রামের বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখানোর পরিকল্পনা করছে, এবং এই প্রস্তাবটি অরুণের দেওয়া, এটার মধ্যেও অনেক স্তর আছে।
বাপের বাড়ি। উমার বাপের বাড়ি। দুর্গার বাপের বাড়ি। মেয়ে বাপের বাড়ি কয়েকদিনের জন্য আসে। তারপর শ্বশুরবাড়ি চলে যায়, দুর্গাপূজার মধ্যেই এই মিথটি ডিকনস্ট্রাকশন করছেন ঋতুপর্ণ। পারুলের বাপের বাড়ি আসা নির্ভর করে তার বরের অনুমতির ওপরে, কিন্তু কেয়া অরুণ কেয়ার মায়ের সঙ্গেই থাকতে আসছে। অরুণ প্রথাগত চাকরি নয়, একটি ভিন্ন উদ্যোগ ভাবছে। সেখানে কেয়া সম মর্যাদাতে কাজ করবে। মাধবী অভিনীত চরিত্রটি আদি দুর্গা। কেয়া যখন বলে যে অরুণ এখনকার নোংরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসছে, জননী বলেন, নোংরামি কখন ছিল না? তাঁর স্বাধীনতাসংগ্রামী স্বামীর সময়েও ক্ষমতার লোভ ছিল, হিংসা ছিল। প্রাচীনা মায়ের এই আধুনিক রূপ রিকনস্ট্রাকশনের একটি বড় দিক।
আরেকটি অসাধারণ মহিষাসুরমর্দিনীর প্রয়োগ আছে "সব চরিত্র কাল্পনিক" ছবিতে।
রাধিকা ট্যুওর থেকে ফিরে দেখছে বন্ধুদের নিয়ে খেলা দেখতে মত্ত ইন্দ্রনীল। অথচ জামশেদপুর থেকে ফোনে আসা খবর দিতে সে ভুলে গেছে, যে রাধিকার মায়ের মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, তিনি হসপিটালাইজড।
রাধিকার প্রোফাইল দরজা খুলে সিটিং এরিয়াতে উঁকি দিচ্ছে। যেন দুর্গা দেখছেন এই অদ্ভুত হৃদয়হীন আচরণ। আশ্চর্য সংবেদনশীলতার খেলা খেলতে জানতেন ঋতুপর্ণ।
রাধিকার জামশেদপুরের বাড়িতে তার প্রেমিক ও সে। পুজোর আবহ।
- আজ লাঞ্চে কী মেনু?
- ভোগ। পাড়ার ক্লাবের।
রাধিকা জানলা বন্ধ করছে। খড়খড়ি দেওয়া প্রাচীন জানলা। সাদা পর্দার ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছে শরতের রোদ। পুজো। অন্দরসজ্জা খেয়াল করলে দেখা যায় একপাশে পটচিত্রে প্রাচীন দুর্গা। পুত্রকন্যাসমেত।
ঋতুপর্ণ আরেকটি কাজ করেছেন। বাড়ির মেয়েদের পুজোর সাজ। মমতাশংকর হালকা হলুদ তাঁতের শাড়িতে, অলকানন্দা রায় ঘরোয়া লালপেড়ে শাড়িতে, ঋতুপর্ণা রঙিন ধনেখালিতে বাঙালিনীর চিরকালীন সাজে এসেছেন "উৎসবে"। আর বাঙালী তরুণীর সেরা সাজটি সেজেছেন অর্পিতা পাল। জরিপাড়, বুটিদার লালপেড়ে সাদা শাড়ি, এলোখোঁপা ঘাড়ের কাছে, ছোট টিপ, সরু ঘড়িতে অপরূপা। আর "সব চরিত্র কাল্পনিক ছবি" তে চওড়া পাড়ের তাঁতের শাড়িতে দীর্ঘাঙ্গিণী বিপাশা বসু। শ্যামলা পায়ে আলতা, নুপূর, অমন দেবীতুল্য সৌন্দর্য্য, পা ধোওয়ার দৃশ্যে, আর কী দেখেছি !
সত্যজিতের ছবি বা ঋতুপর্ণর ছবি বহুবার, বহুবার.....। মানে বারবার। আবারো দেখবো হয়তো। সুজয় ঘোষের "কাহানি" একবার দেখেছি। চমৎকার ছবি। কিন্ত দুবার হয়তো দেখা হবে না। কৌশিক গাঙ্গুলির "বিসর্জন" ও হয়তো দুবার দেখে ওঠা হবে না। তবু এই দুটি ছবির কথা না বললেই নয়।
"বিসর্জন" কৌশিক গাঙ্গুলির ছবি। চমৎকার ছবি। প্রথমেই জয়া আহসানের শাঁখা পলা চুড়ি পরা হাত। হাতে সিঁদুরখেলার থালা। নৌকায় সপরিবারে মা কৈলাসে চললেন। ভাসানের গান বাংলাদেশের পটভূমিতে। সঙ্গে দোহারের গান, কী দুগ্গি দেখলাম দাদা! প্রথমেই ছবি জম জমাট। সঙ্গে জয়া আহসানের অমন রূপ, তায় সিঁদুর মাখা মুখ। বাঙালিণীর আর্কিটাইপ। তারপর ফ্ল্যাশব্যাকে বাংলাদেশের গ্রামের বিধবা পদ্মা, জমিদার গণেশ মন্ডল আর হঠাৎই এসে পড়া স্মাগলার নাসিরের গল্প, যদিও আবীর চট্টোপাধ্যায় ঐ চরিত্রে বড্ড বেশি সোফিস্টিকেটেড, সোবার। কিন্ত কথা অন্যদিকে নেবো না। শুধু পুজো আর দুর্গা।
এরপরেই নদীতীর। বৈধব্যের বেশে জয়া। প্রতিমার পড়ে থাকা কাঠামো গতানুগতিক ভাবে। আর কাদায় পড়ে থাকা নাসির। কাদা ধুলে বেরিয়ে আসে ভারতের জাতীয় পতাকা। আর মা দুগ্গার মতো মুখে জল দিয়ে নাসিরের প্রাণ বাঁচায় পদ্মা। দুর্গার প্রাণদায়িনী রূপ। নাসিরকে নিয়ে আসে নিজের কুটিরে যেখানে বৃদ্ধ শ্বশুরের সঙ্গে তার বাস। নাসির আর পদ্মার অকথিত সম্পর্কের ছবি বিসর্জন। আর গণেশ মন্ডল হিসেবে অসামান্য কৌশিক গাঙ্গুলি। পদ্মা প্রেমে পড়ে নাসিরের। ছবির দুর্গা সে। নাসিরের প্রাণ বাঁচাচ্ছে মিলিটারির নজর থেকে। নিজেকে বাঁচাচ্ছে গণেশের কাছ থেকে। নাসির তাই এখন তার আত্মীয়। সুভাষদা। তাকে বাঁচাতে গণেশকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে পদ্মা। বিসর্জন হচ্ছে একটি নীরব প্রেমের। ঘুমের ওষুধ খেয়ে পদ্মা বলছে,
ব্যাটাছেলের কোনো কিছুতে দোষ নাই, না? মাইয়ালোগে করলেই দোষ?
দুর্গার নবরূপ। নিজের অস্তিত্ব রাখতে হবে।
- তুমি তো চইল্যা যাইবা। আমারে তো বাঁইচা থাকতে হইবো।
মেয়েদের বেঁচে থাকা, একা, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতা ছাড়া বড় কঠিন। পদ্মা শরীরে নাসিরের সন্তান ধারণ করে গণেশকে বিয়ে করে। এই অলক্ষ্যে ঘটে যাওয়া প্রেমের মৃত্যু এবং পুনর্বিবাহিত পদ্মার সালাঙ্কারা দুর্গাস্বরূপ মুখ, শিশুপুত্রের পিঠে নাসিরের মতো চিহ্ন, সবকিছুই এক ট্র্যাজেডির উপলব্ধি ঘটায়, গণেশ মন্ডল ট্র্যাজিকমিকে অতুলনীয়।
"কাহানি" তে আমরা পাই প্রাণঘাতিণী দুর্গাকে। লালপাড় সাদা গরদ, শাঁখা পলা সিঁদুর, বিসর্জন আর সিঁদুরখেলার আবহ এইছবিতেও। তবে সেটা কলকাতা শহরে। এখানে বিদ্যা বালানের বুদ্ধিদীপ্ত মুখটি। বরের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে অন্তঃস্বত্তা নারীর নিখুঁত অভিনয় করা মেয়েটি যখন ক্ল্যাইম্যাক্সে পেটের নকল গর্ভ ছুঁড়ে আত্মরক্ষা করে চুলের কাঁটা বিঁধিয়ে দিচ্ছে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তর পায়ে, কাঁধে, তখন বাজছে বিসর্জনের বাজনা আর দর্শক উত্তেজনায় টানটান হয়ে বসছেন। অবিশ্বাস্য তবু চমৎকার, চমকপ্রদ, চাঞ্চল্যকর।
তানভীর মোকাম্মেলের ছবি "চিত্রা নদীর পাড়ে" একটি অসাধারণ কাজ। পুজো হচ্ছে হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক সমস্যার মধ্যে এবং ধর্ষিত হচ্ছে একটি হিন্দু মেয়ে। দশমীর দিন। প্রতিমার মুখ আর ধর্ষিত মেয়েটির মুখ। একটি অতুলনীয় প্রতিস্থাপন।
"চিত্রা নদীর পাড়ে" একটি বারবার দেখার মতো ছবি যার কেন্দ্রে একটি হিন্দু পরিবার। একাত্তরের ভাষা আন্দোলন এবং মিনু নামক বালিকাটির তরুণী জন্মের কাহিনী। দুর্গাপূজার সময় মুসলমান এলাকাতে কিছু মানুষের দুর্গাপূজা। একেবারে আটপৌরে ঢং। কোথাও এতটুকু বাড়তি গ্ল্যামারাইজেশন নেই। একেবারে দেশজ আবহে মাতৃমূর্তি মনে গেঁথে যায়। ধর্ষনের পরে ভেসে থাকা নারীমুখ বেদনাবাহী হয়ে ওঠে ক্রমশই।
সৃজিত মুখার্জির "উমা" দুর্গাপূজা নিয়েই তৈরি শুনেছি। তবে সম্পূর্ণ দেখে উঠতে পারি নি। যেমন দেখতে পারিনি, শুনেছি পুজোকেন্দ্রিক ছবি, "অসুর"। সেখানে অসুরের নয়া কনসেপ্ট আছে কীনা জানিনা। "দুর্গেশগড়ের গুপ্তধনে" বিশাল জাঁকালো দুর্গাপুজা, একেবারে চূড়ান্ত গ্ল্যামারাস জমিদারবাড়ির পুজো, ডিটেকটিভ গল্প, রহস্য রোমাঞ্চ এবং হচ্ছে-হচ্ছে-মিষ্টি প্রেমের প্লট। মন্দ না। তবে অরিন্দম শীলের "দুর্গা সহায়" একটি বহুমাত্রিক ছবি। অবস্থা পড়ে আসা অভিজাত বাড়ির ছবি স্পষ্ট ধরা। নেই নেই করে অনেক আছে। আছে দুর্গা সহায় নামক পরিচারিকাটির আগমন, যে আসলে চোর। পুজোকেন্দ্রিক এই ছবিটি নতুন ধরনের। দেখতে ভালো লাগে নব দুর্গার আত্মরক্ষার বিভিন্ন কৌশল, বেঁচে থাকা আর বাঁচানোর বিবিধ আয়োজন।
তবে দুর্গা যদি শক্তির প্রতীক হন, রক্ষার প্রতীক হন, তবে আমার চোখে শ্রেষ্ঠ মাতৃবন্দনার বাংলা ছবি "মেঘে ঢাকা তারা" তে সুপ্রিয়া চৌধুরীর মুখ। পিছনে ধাড়ার বেড়ার দেওয়াল যেন চালচিত্র। সে সকল প্রাণীকে বাঁচিয়ে রাখে মাতৃস্নেহে। আরেকবার মাতৃমূর্তি এনে দেন ঋত্বিক যখন বঙ্গবালার মুখের দিকে তাকিয়ে গেয়ে ওঠেন, কেন চেয়ে আছো গো মা, মুখপানে? এই দৃশ্য অধিক শ্রেষ্ঠ মাতৃবন্দনা আমি দেখিনি। বাংলা ছবি আর মাতৃবন্দনা বললে আমার "যুক্তি তক্কো আর গপ্পো" র কথাই মনে পড়ে। দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠ কানে বাজে… কেন চেয়ে আছো গো মা!