প্রতি রাতের গপ্প - স্থান নির্বিশেষে
রাত ৯ টায় বাড়িতে বাড়িতে বিভিন্ন সংবাদ চ্যানেল এ মানুষ বসে পড়েন প্রাইম টাইমের আলোচনা / বিতর্কের নৌটঙ্কি দেখতে। দাড়ি চুমরিয়ে সাজান স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী মোল্লা সাহেব আক্রমণ করবেন হিন্দু ধর্মের বিশ্বাসীদের আর হিন্দুদের স্বঘোষিত ঠিকাদাররা চিৎকার করবেন মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষজনদের বিরুদ্ধে। আর তার মধ্যে ভয়ঙ্কর উত্তেজনার অভিনয় করবেন দেশপ্রেমিক সঞ্চালক, কাউকে কথা বলতে না দিয়ে চিল্লাতে থাকবেন। প্রায় ঘণ্টা টাক চলবে এই চূড়ান্ত অশ্লীল নাটক, একটা কথাও বোঝা যাবে না শুধু শোনা যাবে চিৎকার। অবশ্য যার জন্য এত কিছুর আয়োজন তার দেখা পাওয়া যাবে কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর। আপনি শিখে যাবেন কোন সাবান মাখলে আপনার চামড়া হবে মাখনের মত মসৃণ, কোন তেলে চুল গজাবে টাকে বা কোন কোচিং নিলে আপনার সন্তান সড়াত করে পৌঁছে যাবে কোনো এক আইআইটি র শ্রেণী কক্ষে। আলোচনার শেষে জম্পেশ করে রাতের খাওয়াটা খেয়ে, নিশ্চিন্তে ঘুম এবার। ঠিক তো? নাকি ওই যে বিষের বন্যায় ভাসছিলেন এক ঘন্টা ধরে তার রেশ রয়ে যাবে মনের মধ্যে? হাতের কাছে একটা বিধর্মীকে পেলে তার মুণ্ডুটা ধড় থেকে আলাদা না করতে পারলেও ঘা কতক দিতে পারতাম - গোছের একটা ভাব নিয়ে কিছুক্ষণ বিছানায় এপাশ ওপাশ করবেন না তো? পরের দিন, এই বিষ আমরা অনেকেই বয়ে নিয়ে যাই, জেনে বা না জেনে, স্কুলে, কলেজে, কর্মস্থলে, হাটে, বাজারে, বাসে, ট্রেনে। ওই প্রাইম টাইমের ক্লিপিং ইউটিউবে আপলোড হয়, ঘুরে বেড়ায় নেট দুনিয়ায়। আমরা দেখি, উত্তেজনার আঁচ পোয়াই, আর যাঁরা আপলোড করলেন তারা পয়সা কামান। বিষ ছড়ায় দিগন্ত জুড়ে। দিনের শেষে বাড়ি ফিরে চা এর সাথে টা খেয়ে, গা এলিয়ে, আবার প্রাইম টাইমের উত্তেজনায় নিজেকে আঁচিয়ে নেওয়া। বাড়তে থাকে TRP, আসতে থাকে নতুন বিজ্ঞাপন। যত চিৎকার, যত অশ্লীলতা, যত সস্তা ও কুরুচিপূর্ণ হয় এই নৌটঙ্কি ততই বাড়ে TRP, ততই ভাইরাল হয় ক্লিপিং। বিষচক্র ঘুরতেই থাকে।
২০০৬ থেকে ২০শে জুন, ২০২২, স্থান অমরাবতি, মহারাষ্ট্র
আজকের আখ্যানের দুই মূল চরিত্র, ইউসুফ খান বাহাদুর এবং উমেশ কোলহের আলাপ, ঘনিষ্ঠতা আর যৌথ পথ চলা শুরু ২০০৬ সালে। ইউসুফ খান পেশায় পশু চিকিৎসক, সবাই ডাকতেন, ডাক্তার সাহেব বলে। উমেশ কোলহে ছিলেন অমিত মেডিকেল এর মালিক, সেই ১৯৯৮ সাল থেকে। পশুদের ওষুধের প্রথম দোকান ওই জেলায়। দোকান খোলা থাকতো সকাল ৭.৪৫ থেকে রাত ১০ টা অব্দি। ডাক্তার সাহেব ও দিনে পরিশ্রম করতেন ১৬ ঘন্টা। মা, চার বোন, স্ত্রী ও তিন বছরের দুই যমজ সন্তানের বাবা ইউসুফ খান ছিলেন বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী। এই ডাক্তার সাহেবের কাছ থেকে উমেশ কোলহে প্রচুর ব্যবসা পেতেন আবার অন্যদিকে উমেশ বহুবার প্রচুর সাহায্য করেছেন ইউসুফকে। পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত ছিল নিয়মিত। এভাবেই বয়ে যাচ্ছিল সময়ের নদী, ১৬ বছর ধরে।
২৭শে মে, ২০২২ সাল, স্থান মুম্বাই এ সংবাদ চ্যানেল এর টিভি স্টুডিও
প্রাইম টাইমের এক আলোচনা / বিতর্ক বকলমে চিৎকার সভায় এক স্বঘোষিত মুসলিম ধর্মের ঠিকাদার আক্রমণ করলেন এক হিন্দু দেবতাকে তার পাল্টায় নবীকে অপমান করলেন ওই মোল্লার আপাত বিরোধী একজন, যিনি আবার হিন্দুত্বের ঠিকা নিয়ে রেখেছেন। শুরু হয়ে গেল হই হই। মুম্বাই এর ইংরেজি টিভি চ্যানেল, কিন্তু এই ঘটনার জল গড়াল সারা দেশে এমনকি অন্যান্য দেশেও। তারপর একদিন সময়ের সাথে চাপা পড়ে যায় ঘটনা, সামনে এসে যায় অন্য কোনো অশ্লীলতা।
২১-০৬-২০২২, অমরাবতি
আবার ফিরে আসি অমরাবতি শহরে। রাত দশটা, দিনের শেষে অমিত মেডিকেল বন্ধ করে উমেশ, ছেলে সংকেত আর তাঁর পুত্রবধূ ভৈষ্ণভি দুটি স্কুটারে রওয়ানা দিলেন দুই কিলোমিটার দূরে বাড়ির দিকে। তাঁরা জানতেও পারেন নি, তিন জন লোক তাঁদের ওপর নজর রাখছিলেন। এই তিনজন উমেশরা রচনা শ্রী মল থেকে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই ইশারায় জানিয়ে দেয় তিন মোটর সাইকেল আরোহীকে, যারা ছুরি নিয়ে অপেক্ষা করছিল সামনের রাস্তার মোড়ে। উমেশ মোড়ের মাথায় বাঁক নিতে গিয়ে স্কুটার এর গতি কমাতেই একজন উমেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছুরিটা আমূল বসিয়ে দেয়। পিছনেই ছিলেন সংকেত আর ভৈষ্ণভি। ঘটনা ঘটলো তাঁদের চোখের সামনে। এলো স্ট্রেচার, উমেশ পৌঁছালেন হাসপাতালে, সেখানে ডাক্তার জানালেন আসার পথেই মারা গেছেন, উমেশ, সেই উমেশ যাঁকে সবাই বলত বড্ড বেশি অন্যের বিপদে বিপত্তারণ হয়ে উদয় হন। পুলিশ অফিসাররা উমেশের দোকানের খাতা দেখে অবাক হয়ে বাড়ির লোকেদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, যে এত লোককে এইভাবে টাকা ধার দেবার পর উনি নিজের সংসার চালান কি করে। হিন্দু পত্রিকা উমেশ সম্বন্ধে লিখেছে "generous to a fault".
পটভূমি
কি হলো সে তো জানলাম। কিন্তু কেন? এক এক করে সাত জন গ্রেফতার হলো, পালের গোদা ইরফান খান সমেত। ইরফান খান রাহবার নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার। স্কুলছুট ইরফান গত কয়েক বছর ধরে হয়ে উঠছিল তীব্র গোঁড়া ধার্মিক আর তার সাথেই ঝাঁপিয়েছিলো বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে। এরপরেই আসল চমক, গ্রেফতার হলেন ইউসুফ খান। প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে ওঠার পর সবাই জানলেন যে ব্ল্যাক ফ্রীডম নামের একটি WhatsApp গ্রুপে উমেশ কোলহে একটি পোস্ট ফরওয়ার্ড করেছিলেন। পোস্টটি ছিল নুপুর শর্মার সমর্থনে। ব্ল্যাক ফ্রীডম গ্রুপটি এই পশু চিকিৎসার সাথে যুক্ত মানুষদের নিয়ে। স্বভাবতই সেখানে ইউসুফ খান ও ছিলেন। ডাক্তার সাহেব ওই পোস্টের একটি স্ক্রিন শট নিয়ে সেটি শেয়ার করেন আর একটি গ্রুপে যার অধিকাংশ সদস্যই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। ডাক্তার সাহেব আহত হয়েছিলেন উমেশের পোস্ট দেখে কিন্তু হয়ত কল্পনাই করতে পারেন নি এই পোস্ট তার উপকারী বন্ধুর খুনের কারণ হবে। ইউসুফের পরিবারের সদস্যরা জানাচ্ছেন যে উমেশের মৃত্যুর পর ভেঙ্গে পড়েন ইউসুফ। তদন্তে পুলিশের সাথে পূর্ণ সহযোগিতাও করেন। কিন্তু এখন তিনি কারাগারে অন্তরীণ। যথারীতি সমাজ মাধ্যম উত্তাল, ধর্মের কারবারিরা নখ দাঁত বের করে ফেলেছেন। কি বলছেন উমেশ আর ইউসুফের পরিবার পরিজন? মহেশ কোলহে, উমেশের ভাই, জানাচ্ছেন ইউসুফের পরিবারের প্রতি তাঁদের কোনো অভিযোগ নেই। বরঞ্চ যমজ শিশু দুটির কথা ভেবে তাঁদের খুব খারাপ লাগছে। মহেশ আরো জানিয়েছেন যে তাঁরা তাঁদের বহু মুসলিম বন্ধুদের কাছ থেকে ফোন পাচ্ছেন। বন্ধুরা বলছেন লজ্জায় তাঁদের মাথা কাটা যাচ্ছে আর সমাজে তাঁরা মুখ দেখাতে পারছেন না। ইউসুফ খানের পরিবারের লোকেরা জানাচ্ছেন ইরফান এর সাথে ইউসুফের কোনো সম্পর্ক ছিলো না, বিচারে উমেশ কোলহের হত্যাকারীদের শাস্তি হলেই তাঁদের আশা ডাক্তার সাহেব নির্দোষ প্রমান হবেন। NIA এর তদন্তে তাঁদের পূর্ন আস্থা আছে।
উপসংহার
আপাতত এই আখ্যানের এখানেই শেষ। যে প্রাইম টাইম অনুষ্ঠান থেকে এই আখ্যানের সূত্রপাত, আন্দাজ করা যেতেই পারে যে ওই চ্যানেলের দর্শক বেড়েছে, TRP বেড়েছে, সঞ্চালক এর ভার ও দাম বেড়েছে, উত্তেজনার বিষ ছড়ানো আলোচনায় অংশগ্রহনকারীদের নিজস্ব বলয়ে জনপ্রিয়তা বেড়েছে, বিজ্ঞাপনদাতাদের দর্শক বেড়েছে, ফলত বিক্রি বাটা মুনাফাও বেড়েছে। সোজা কথায় সবাই যে যার মত লাভের কড়ি গুনে নিয়েছে। শুধু অমরাবতি শহরের দুই পরিবারের, একটি পরিবারে এক ছেলে বাকি জীবন বয়ে বাড়াবে চোখের সামনে বাবাকে ছুরির আঘাতে খুন হবার দৃশ্য, আর এক পরিবারে ছোট্ট দুই যমজ শিশু ও ছয় জন অসহায় মহিলা বসে থাকবেন যদি কোনোদিন তাদের পরিবারের একমাত্র রোজগেরে মানুষটি ফিরে আসে। গত ষোল বছর ধর্ম যে বিভাজন রেখা টানতে পারেনি উমেশ ও ইউসুফের মধ্যে, আজকের বিষ হাওয়া তা পেরেছে। আমরা আদৌ জানি না, ইউসুফ নির্দোষ কিনা। যদি নির্দোষ হন তাহলে বহু ঝড় ঝাপটা সামলানোর পর হয়তো একদিন পরিবারের সাথে মিলিত হবেন। যদিও বলা মুশকিল সেই পরিবারের কী পড়ে থাকবে ততদিনে। যদি দোষী হন, শাস্তি পাবেন ইউসুফ। সেক্ষেত্রেও তাঁর পরিবার কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে শেষ হয়ে যাবে।
২০২১ সালে PEW এর সার্ভে মোতাবেক ভারতবর্ষে ৮৪% মানুষ মনে করেন পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা তাঁদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ভারতীয়ত্বর এ এক অতি আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য। তাই যদি হয় তাহলে বিষ ছড়ায় কেন? উদয়পুরের কানহাইয়া লাল তেলি, অমরাবতির উমেশ কোলহে, দাদরির মহম্মদ আখলাক, দিল্লির হাফিজ জুনাইদ - লিস্টে নাম বেড়েই চলে কেন? বেড়ে চলে কারণ শতকরা হিসেবে নগণ্য কিছু মানুষ বিরামহীন ভাবে সমাজ মাধ্যমে, খবরের কাগজে, বৈদ্যুতিন মাধ্যমে নিরন্তর সম্পুর্ন মিথ্যে বা অর্ধ সত্যের মাধ্যমে বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন আর আমরা হাঁ করে সেই বিষ বুক ভরে নিশ্বাস নিচ্ছি। তথ্য দেখাচ্ছে আমাদের বেশির ভাগ নিউজ চ্যানেল গুলোর ৭০% আলোচনা ধর্মীয় ক্যাঁচাল নিয়ে। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। PEW এই সার্ভের ৮৪% মানুষকে যতটা সম্ভব কম করে দেওয়া। যত বেশি ঘৃণা, যত বেশি হিংসা তত বেশি সবার লাভের কড়ি – শুধু মূল্য চুকিয়েছে আখলাক, জুনাইদ, উমেশ, কানহাইয়া লাল আরও অনেক অনেক নিরীহ মানুষ। আগামী দিনের শিকার হয়ত আমি আপনি বা আমাদের পরের প্রজন্ম। মাতব্বরদের গায়ে অতীতেও কোন আঁচ লাগে নি, আগামী দিনেও তারা থাকবে নিরাপদে, তেনারা শুধু উত্তাপ নেবেন চকচকে টাকার।
সব অন্ধকারের শেষ আছে। ইতিহাস শিক্ষা দেয় কোনো কিছুই স্থায়ী নয় দুনিয়ায়। কাজেই এই ভূতের কেত্তন ও একদিন শেষ হবে। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে কি আমরা কিছুই করতে পারি না? পারি অবশ্যই পারি। ট্যাংক ম্যান কে মনে পড়ে? ১৯৮৯ সালে তিয়েনয়ানমেন স্কোয়ার এ ট্যাংকের সারির সামনে একা দাঁড়িয়ে রুখে দিয়েছিলেন আগ্রাসী বাহিনীকে, অন্তত সাময়িক ভাবে। কাজেই যদি চাই আমরাও পারি। পারি বন্ধ করতে প্রাইম টাইমের নৌটঙ্কি দেখা। দর্শক কমা মানেই TRP কমা, বিজ্ঞাপন কমা আর তাহলেই কমতে বাধ্য বিষ বাষ্পের কারখানা। বন্ধ হবে না কিন্তু কমবে তো বটেই। আমাদের আশেপাশে যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে ডিগ্রি পাওয়া অশিক্ষিত মানুষরা এই ২০২২ সালে এসেও মৌলবাদের পক্ষে গলা ফাটান তারা যে আসলে কৌতুক উদ্রেককারি ভাঁড় মাত্র, সেটাতো বুঝিয়ে দিতে পারি পাশের মানুষদের। আমাদের সাথে তো আছেন ৮৪% দেশবাসী। এটুকু যদি করতে না পারি তাহলে মনে রাখা ভাল কানহাইয়া লাল তেলি, উমেশ কোলহে, মহম্মদ আখলাক, হাফিজ জুনাইদ এবং এদের মত আরও অনেকের রক্তে হাত লাল করা উন্মাদদের সংখ্যা বেড়েই চলবে। বিষ বাষ্পের কারখানা চলতে থাকলে দিনের শেষে মৌলবাদীদের ই সুবিধা হয়ে যায়, নতুন নতুন খুনি উন্মাদ এর জন্ম দিতে। আর কবে যে আমরা নিজেরাই তার শিকার হব, কেউ জানি না। তাই চুপ করে বসে আর প্রাইম টাইম দেখে ধর্মের নামে যারা বিষ ছড়াচ্ছে তাদের পরোক্ষ মদত না দিয়ে “আয় বেঁধে বেঁধে থাকি” – ৮৪% কে ১০০% এ নেবার চেষ্টা করি একযোগে।
তথ্যসুত্রঃ The pharmacist and the tailor, The Hindu, 9th July, 2022