শিখা পায়েসের বাটিটা নিয়ে ছাদে উঠল। দোতলা বাড়ির ছাদ। চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে, একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে, একবার পাশের বাড়ির দিকে তাকিয়ে, সবদিক নজর করে শেষে পায়েসের বাটিটা সে ছাদের পাঁচিলে রাখল। তারপর গলার মঙ্গলসূত্রটা চেপে ধরে কি যেন ভাবা শুরু করল। পাশের বাড়ির ছাদে সপ্তর্ষি, বছর চোদ্দর ছেলে হবে, হাতে খাতা, মুখে পেন। খাতা উল্টেপাল্টে দেখছে আর পাশে বসে থাকা পায়রাটাকে কীসব পড়ে শোনাচ্ছে। ছেলেটি একঝলক শিখাকে দেখল, শিখা সেটা খেয়াল না করে তাড়াতাড়ি করে নিচে নেমে এল।
নিচে এসে শিখা মোবাইল ফোন তুলল।
"মা, ছাদে পায়েসের বাটিটা রেখে এসেছি। কাক কখন আসবে কে জানে!"
"ভালো করেছিস। শর্মাজী ভালো জ্যোতিষী। চিন্তা করিসনা। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
"ঠিক হয়ে যাবে? ঠিক বলছ? শর্মাজীও বারবার একই কথা বলে। পল্লব আর আমার যেদিন থেকে বিয়ে হয়েছে, সবাই একই কথা বলেছে। কিছু তো বদলাতে দেখলাম না আজ অবধি!"
"বারবার ওই এক কথা! দেখ এই কাককে পায়েস খাওয়াতে হবে পনেরো দিন ধরে। আজ তিন নম্বর দিন। হিসেব রাখছিস? রাখছিস তো?"
"কে জানে!"
"কে জানে আবার কী? ওসব কি কথা!"
"আমি হিসেব না রাখলেই বা কী! তুমি তো ওই পাটনায় বসে হিসেবে রাখছ। আচ্ছা, ছাড়ো এবার। আমাকে এখন অফিসের জন্য রেডি হতে হবে।"
দুই বাড়ির ছাদে বিশেষ ব্যবধান নেই, মাঝখানে পাঁচিল। দুই ভাইয়ের কোন্দলের পর বাড়ি ভাগ হয়েছে- ছাদেরও বাটোয়ারা হয়েছে। এদিকটাতে দোতলায় শিখা আর তার বর পল্লব ভাড়া থাকে- বেশিদিন হয়নি। ওদিকে অন্যপাড়ের মালিক থাকে- সপ্তর্ষির বাবা। মোটা উঁচু পাঁচিল তুলে দিলেও ওপার থেকে এপার দেখা যায়, পাঁচিল টপকে চলেও আসা যায়, তবে কেউ আসে না। কিন্তু সপ্তর্ষি চলে এল, পাঁচিল ডিঙিয়ে। পায়েসের বাটিতে তার চোখ। হঠাৎ শিখা কোথা থেকে এসে হাজির হল কে জানে। সপ্তর্ষি পালানোর চেষ্টা করল। শিখা কিছু বলল না, খালি সপ্তর্ষিকে ভাল করে একবার দেখে নিল। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি, দোহারা গড়ন কিন্তু ভালো স্বাস্থ্য। মুখে একটা চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার মতো সংকোচ ভাব। কিন্তু সেই সংকোচের মধ্যে কোনো লজ্জা নেই। অদ্ভুত রকমের নির্লজ্জ ছেলে- মনে হল শিখার।
পরদিন সপ্তর্ষি স্কুলব্যাগ নিয়ে স্কুলের পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, শিখার সঙ্গে একঝলক মুখোমুখি হয়ে গেল। সুন্দর শাড়ি পরে শিখা তখন অফিস যাচ্ছে। না দেখার ভাব করে শিখা পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
ছেলেটার মতিগতি ঠিক নয়- শিখার মনে হল। ভদ্রমহিলার মনটা ঠিক নেই- সপ্তর্ষির মনে হল। রাতে কোচিং থেকে ফেরার সময়ে যেখান থেকে শিখার ঘরের জানালা দেখা যায় সেখানে এসে দাঁড়াল সপ্তর্ষি, সাইকেল থেকে নামল। শিখা চুল আঁচড়াচ্ছিল- জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে। সপ্তর্ষি দিব্যি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল- এই নিয়ে বিশেষ সংকোচ তার নেই। দেখা যাচ্ছে, দেখতে ভালো লাগছে- দেখবে না কেন! কারোর চুল আঁচড়ানো দেখলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। সপ্তর্ষি কখনও বড়বড় চোখে, কখনও চোখ আধা বুঁজে দেখছিল। চোখটা অর্ধেক বুঁজলে সত্যিটাও স্বপ্নের মতো লাগে - তাই। হঠাৎ দেখল শিখার পিঠে একজন পুরুষ তার হাত রাখল। আরও দেখতে ইচ্ছে করছিল- কিন্তু শিখা হঠাৎ তার স্টুল ছেড়ে উঠে পড়ল। তড়িঘড়ি করে সপ্তর্ষি সাইকেল নিয়ে সরে পড়ল।
রাতে সপ্তর্ষি তার বিছানায় শুয়ে সাতপাঁচ ভাবছে। শিখা তার চুল খুলে এসে বসেছে সপ্তর্ষির বিছানায়, সপ্তর্ষির দিকে পিঠ রেখে। সপ্তর্ষি শিখার পিঠে হাত রাখল, শিখার পিঠের মাঝখান দিয়ে আলতো করে আঙ্গুল বোলালো। কিছুক্ষণ হাত বোলানোর পর শিখা অদৃশ্য হয়ে গেল। স্বপ্ন যখন, ভাঙারই কথা। তবে সপ্তর্ষি তখনও হাত বোলাচ্ছে- নিজেরই শরীরে। তার হাত বারমুডা অবধি পৌঁছল।
পরের দিন শিখা পায়েসের বাটি নিয়ে আবার ছাদে এলো। সপ্তর্ষি, ওপাশের ছাদে, তার কাঁধে বসে থাকা পায়রা নিয়ে খেলছিল।
"সব ঠিক আছে, ম্যাডাম?"
"আছে!"
"কাক আসেনি?"
"জানি না।"
"চিন্তা করবেন না। ওরা না এলে আমি গিয়ে ধরে আনব?"
"কি ধরে আনবি? কাক?"
"আনবো। কাক। আপনার জন্য। এই যেমন আমি পায়রাটাকে বাগে এনেছি।"
"চুপ কর ছোঁড়া। আমি অত মরিয়া নই।"
"মরিয়া নও? সত্যি চাও না?"
"না, চাই না।"
শিখা তড়িঘড়ি করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো।
কিছুক্ষণ পর শিখা আবার ছাদে এল, তবে এবার অফিসের পোশাক পরে। সপ্তর্ষি এখন শিখার দিককার ছাদে। জলের ট্যাঙ্কিতে হেলান দিয়ে বসে। সে শিখার উপস্থিতি নজরই করল না। দিব্যি তার আঙুল দিয়ে তুলে তুলে পায়েস খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে তার পায়রাটাকে ভাগ দিচ্ছে। পায়রাটা বেশ অশান্ত প্রকৃতির আর সপ্তর্ষি পায়রার সঙ্গে নানারকম আলোচনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পায়রাটাকে খেলিয়ে খেলিয়ে পায়েস খাওয়াচ্ছে। হঠাৎ করে সে শিখার উপস্থিতি টের পেল।
"আমি এই পাখিটিকে আপনার প্রসাদ খেতে সাহায্য করছিলাম।"
"এটা কাকের জন্য। পায়রার নয়।"
"কেন ম্যাডাম? শুধু কাক কেন? যদি আপনি আপনার ছাদে খাবার খোলা হাওয়ায় বসিয়ে রাখেন তবে যে কোনও পাখি এসে মুখ দিয়ে যাবে।"
"ওটা পাখির জন্য, মানুষের জন্য নয়।"
"আপনি জানেন আপনার সমস্যাটা কোথায়? আপনি যাকে দেখেননি, সেই অদৃশ্য ভগবানের অনুগ্রহ পাবার জন্য এতো কিছু করেন, কিন্তু আপনাকে জলজ্যান্ত মানুষ যারা ভালোবাসতে চায় তাদের দিকে ফিরেও চান না।"
"কারা ভালোবাসতে চায়?"
"বলব?"
"না বলতে হবে না। জাস্ট শাট আপ।"
সপ্তর্ষি এবার পায়রার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে জানতে চাইল, "ম্যাডাম, আপনি শেরুকে পছন্দ করেন?"
"বেশ রংচঙে পায়রা। আনুগত্যবোধও বেশ ভালো দেখছি।"
"সে তো হবেই। আমার পোষা যে।"
"আমি পাখিদের খাঁচায় রাখা পছন্দ করি না।"
"শেরু খাঁচাবন্দী নয়। খাঁচা ছাড়া পাখি পোষাই যায়, তার জন্য পুষতে জানতে হয়। ভালবাসার জন্য এদের শিকল পরানোর দরকার হয় না।"
সপ্তর্ষি শিখার মঙ্গলসূত্রের দিকে চোখের ইশারা করল।
"চুপ কর ছোকরা! আর শোন, এই অবধি সব ঠিক ছিল। কাল থেকে এগুলো ছুঁবি না, খাওয়ার কথা ভাববিও না। এগুলো শুধু কাকের জন্য। ক্লিয়ার?"
শিখা হুড়মুড় করে নিচে নেমে এল, আর সপ্তর্ষি তখনও আঙ্গুল চাটছে, ধীরে সুস্থে পায়েসের স্বাদ নিচ্ছে। শিখার এই বিরক্তিটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। পায়েসের সাথে তারিয়ে তারিয়ে সেটাও সে উপভোগ করছে।
আবার পরদিন, শিখা বাটিটা ছাদের উপর এনে রাখল। চারপাশে তাকাল কিন্তু সপ্তর্ষিকে আশেপাশে দেখতে পেল না। ছাদ থেকে নেমে চলে গেল। পল্লব মাঝে মাঝে বাইরে থেকে ডিনার করে আসে, সকালবেলা জানিয়েও যায় না। সন্ধেবেলা ফোন করে জানায়। শিখা একাই ডিনার করে, পল্লবের খাবারটা পরেরদিনের টিফিনে প্যাক করে দেয়। আজকেও তাই করল। আজ দেখল পল্লব টিফিন না নিয়ে চলে গেছে।
শিখা অফিসের পোশাক পরে ছাদে উঠল দেখার জন্য কাক এসেছিল কিনা। কাক, বাটি, সপ্তর্ষি, পায়রা কেউই নেই। কী মনে হল, ছাদের এক কোণে জলের ট্যাঙ্কের পিছনে লুকিয়ে, মেঝেতে বসে শিখা কাঁদতে বসল। কিছুক্ষণ পর, একটা হাত তার পিঠে এসে আলতো করে চাপ দিল। শিখা উপরে তাকালো। সপ্তর্ষি দাঁড়িয়ে। কাঁধে শেরু আর হাতে পায়েসের বাটি।
"এতো দুঃসাহস তোর? এই পায়েস তোর জন্য নয়। রাখ ওটা। নামিয়ে রাখ।"
"রাখব না। কাক না খেলে পায়রা খাবে। খাবারের অপচয় করেন কেন?"
"চুপ কর হতভাগা!"
"করব না।"
"করবি না?"
"না!"
শিখা একটা লাঠি কোথা থেকে জোগাড় করে সপ্তর্ষিকে পেটাতে শুরু করল। শেরু সপ্তর্ষির কাঁধ ছেড়ে ফরফর করে উড়ে পালালো।
"রাখ বাটিটা। এটা তোর জন্য না, কক্ষনো না!"
রাতে বিছানায় শুয়ে সপ্তর্ষি নিজের পিঠে হাত বোলাচ্ছিল। যন্ত্রণা হচ্ছে, কিন্তু কেন জানা নেই, তার বেশ ভাল লাগছে। ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে পাচ্ছে দুপুরের দৃশ্যগুলো - শিখা তাকে পেটাচ্ছে। শুয়ে শুয়ে সপ্তর্ষি মৃদুমন্দ হাসছে। পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে সে হাতটা নিয়ে গেল বারমুডার ভেতরে। ফ্লাশব্যাক নয়, এবার সে কল্পনার চোখে অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছে- শিখা লাঠি দিয়ে তার পিঠে বেতের বাড়ি মারছে আর সে শক্তভাবে ছাদের পাঁচিলটাকে ধরে অবলম্বন নিচ্ছে। গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে ব্যথার মধ্যেও হাসার চেষ্টা করছে। সে চোখ বন্ধ করে আবার গভীর নিশ্বাস নিল।
সপ্তর্ষি নিজের মনেই বলে যাচ্ছে,
"যদি পায়রাকে পোষ মানাতে পারি, কাককেও পারব। তোমার জন্য কাক নিয়ে আসব, শিখা। এটাই তো তুমি চাও, তাই না? আমি জানি তুমি কাক চাও, তার মূল্য যাই হোক না কেন। আমি তোমার জন্য কাক আনব, যা লাগে লাগুক। আমি জানি কাক কোথায় থাকে, কাল সকালেই কাকের ব্যবস্থা করতে বেরোবো।"
এইসব ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
পল্লব কাঁধে অফিস ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইকে স্টার্ট দিল। সপ্তর্ষি একটু দূরত্ব বজায় রেখে তার সাইকেলে তার পিছু নিল।
"কাক ধরতে হবে", মনে মনে বলল।
পল্লব কন্সট্রাকশন সাইটে পৌঁছে হেলমেট বদলালো, বাইকের হেলমেট ছেড়ে ইঞ্জিনিয়ারের। সপ্তর্ষির চোখ তখন পল্লবের দিকে। বছর আঠাশেকের এক যুবক সপ্তর্ষির চোখের সামনে দিয়ে সাইটে এসে ঢুকল। পল্লব তাকে হাই-হ্যালো করে ভিতরে নিয়ে গেল। সপ্তর্ষিকে এবার সাইটে ঢুকতে হবে তবে পাহারাদারদের নজর এড়িয়ে। সাইটের এক দিকে একটা নির্জন কোণ দেখতে পেয়ে সপ্তর্ষি ওখান থেকেই লাফ দিয়ে পাঁচিল টপকালো। তার নজর পল্লব আর বন্ধুটির দিকে। পল্লব তরুণ বন্ধুটিকে সাইটের পিছনের অ্যাপার্টমেন্টের দিকে নিয়ে গেল। সপ্তর্ষি দেখল ওরা দুজন সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। গার্ডদের থেকে আড়াল করে, সিঁড়ি দিয়ে ওঠার উপায় সে খোঁজার চেষ্টা করল। সিঁড়ির সামনেও গার্ড। শেষ অবধি জানালা-সানশেড ব্যবহার করে এক ফ্লোর উপরে সে উঠল। এবার দেখল সিঁড়ি বেয়ে ওঠা যাবে। এই ফ্লোরে কেউ পাহারায় নেই। ধুলোময় সিঁড়ি, কিন্তু তাতে সুবিধা এই যে ধুলোর জন্য দুই জোড়া পায়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কয়েক তলা যাবার পর, পায়ের চিহ্নগুলি সিঁড়ি ছেড়ে একটা ফ্ল্যাটের দিকে যাওয়া শুরু করল।
পায়ের ছাপ ধরে ধরে এগিয়ে সপ্তর্ষি একটা ফাঁকা ফ্ল্যাটে ঢুকল আর দেখল একটা বেডরুমের দরজা বন্ধ। বেডরুম থেকে দুজনের গভীর এবং দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ আসছে। সপ্তর্ষি কী-হোল দিয়ে দেখার চেষ্টা করল, তারপর দরজার নিচ দিয়ে।
"শিখা ম্যাডাম। চিন্তা করবেন না। আপনার কাক আপনাকে ধরে এনে দিচ্ছি।" নিজেকেই বলল।
সপ্তর্ষি পকেট থেকে মোবাইল বের করল, বারান্দায় গেল, চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করল। যা হচ্ছে তার ভিডিও নিতেই হবে। শিখাকে দেখাবে। হঠাৎ একজন নিরাপত্তারক্ষী কোথা থেকে এসে তার কাঁধে চাপ দিল।
"এই ছোকরা, কি করছো?"
"উমম… আমার পায়রা বাড়ি থেকে পালিয়েছে।"
"তো?"
"এখানে এসেছে। আমি তাকে খুঁজছি।"
গার্ড এবার লাঠি তুলল,
"চুপ কর, মিথ্যা বলবি না।"
"এই একশ টাকা রাখো কাকু। আমি তোমাকে একটা গোপন কথা বলব।"
নিরাপত্তারক্ষী তাকে সপাটে থাপ্পড় কষালো আর লাঠিপেটা শুরু করল। শোরগোল শুনে পল্লব ও তার বন্ধুটিও বেরিয়ে এলো।
"মহেশ, ওকে ছেড়ে দাও। আমার মনে হয় আমি একে চিনি। তুমি সপ্তর্ষি, তাই না?"
সপ্তর্ষি শক্ত চোখে পল্লবের দিকে তাকাল। চোখেমুখে ভালমতোই রাগ।
"সপ্তর্ষি, তোমার বাবা-মায়ের সাথে আমার কথা বলা দরকার।"
"না, দরকার নেই। আমি বাচ্চা নই। আমিই নাহয় আপনার ব্যাপারে দু'চারটে কথা বলে আসি আপনার বাড়িতে। বলব?"
সপ্তর্ষি এবার পল্লবের বন্ধুটির দিকে চোখের ইশারা করল। পল্লবকে বিব্রত দেখাল।
সপ্তর্ষি বলল, "যদি চাও এসব নিয়ে তোমার বাড়িতে কোনো ড্রামা না হোক, তাহলে আমাকে যেতে দাও।"
পল্লব নিঃশব্দে সপ্তর্ষিকে দরজা দেখাল, আর মহেশকে থামতে ইঙ্গিত করল। গায়ের চোটগুলোয় হাত বোলাতে বোলাতে সপ্তর্ষি দরজামুখো হল।
সন্ধ্যার সূর্য অস্ত যাওয়ার পথে, সপ্তর্ষি শেরুকে গম খাওয়াচ্ছে। সে লক্ষ করল শিখা অন্য ছাদে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে।
"আরে, সপ্তর্ষি, স্কুলে যাওনি?"
"না। এত তাড়াতাড়ি কাজ থেকে ফিরে এলেন?"
"জরুরী কিছু ব্যাপার স্যাপার হয়ে গেছে বাড়িতে। তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফিরে আসতে হল। আরে, সপ্তর্ষি, এটা কী হয়েছে? তোমার গাল লাল হয়ে আছে, হাতে কালশিটে।"
"আপনি গতকাল আমাকে মারধর করেছেন। ভুলে গেছেন?"
"মিথ্যা কথা। আমি এতো পেটাই নি। আর গালেও হাত দিই নি।"
"ওহ, আঘাত করা প্রতিটি জায়গা মনে আছে?"
"নিচে যেতে হবে। আমার বর ডাকছে।"
"উহু! সেও কি তাড়াতাড়ি ফিরে এল? তোমাদের ব্যাপারটা কি বলোতো আজকে? সবাই সকাল সকাল অফিস ছেড়ে বাড়িতে!"
পরদিন সপ্তর্ষি ছাদে তার সকালের ব্যায়াম করার সময়, লক্ষ করল শিখা ইতিমধ্যেই পায়েসের বাটি রেখে চলে গেছে। সপ্তর্ষি শেরুর সাথে কথা বলা শুরু করল,
"শেরু, ভদ্রমহিলা আজ খুব তাড়াতাড়ি বাটি রেখে চলে গেলো। আর পায়েসের বাটিটা ঢাকনা দেয়া কেন রে? অন্যদিন তো খোলা থাকে। কাক ঢাকনা খুলে পায়েস খাবে কীকরে!"
রাস্তা থেকে একটা আওয়াজ আসছে। সপ্তর্ষি নিচের দিকে তাকায় এবং লক্ষ করে একটা টেম্পো-তে লাগেজ রাখা হয়েছে। সে ছুটে যায় নিচের দিকে। শিখাকে গাড়িতে উঠতে দেখল সপ্তর্ষি।
"চলে যাচ্ছ?"
"হ্যাঁ, পল্লব আর আমি আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গতকাল ও বলল নিজের প্রতি অনেক অন্যায় করছে। আরও কিছু কথাবার্তা হল, মনে হল একসাথে না থাকলেই ভাল।"
"কাক আপনার ডাকে সাড়া দিল!"
"যাই হোক, ছাদে তোমার জন্য কিছু আছে।"
"ওহ, আমার জন্য? ঐজন্য ঢাকনা দেয়া? আমি ভাবছিলাম কাক আবার কবে থেকে ঢাকনা খুলতে শিখল!"
শিখা একচোট হেসে গাড়িতে উঠে গেল।
সপ্তর্ষি আঙুল দিয়ে পায়েস খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে শেরু তার ভাগ পাচ্ছে। সপ্তর্ষি হাসছে, আর তার হাতে একটুকরো ছোট কাগজে লেখা "ধন্যবাদ"। সে কাগজটা উল্টে পাল্টে একাধিক বার দেখল, তারপর শেরুকে পড়ে শোনালো, “শোন, কাগজের উল্টোপিঠে কী লেখা আছে- তুইই একমাত্র লোক যে আমার রান্না এতো ভালবাসত।"