“এই আপনাদের অফিস? এ তো অর্থের মন্দির! ক্যাথিড্রাল অফ মানি!”
ডয়েচে ব্যাঙ্কের বিশাল আধুনিক থামও’লা, গোল-মাথা স্তম্ভিত মিনারের মতন অফিসের ভেতরে ঢুকে মাথিয়াস গাবকে এই কথা বলেছিলাম। গাড়ি থেকে নেমে ভেবেছি, কোথায় এলাম! এটি কি আধুনিক স্টাইলের গির্জে, না চিত্র সংরক্ষণশালা! নাম লেখা আছে দেখে আশ্বস্ত হয়ে রিসেপশনে আমার পরিচয়পত্র দেখালাম। লগ্নি বিভাগের অন্যতম প্রধান, মাথিয়াস, নিচে নেমে এলেন আমাকে নিয়ে যেতে। এই বাড়িটি বানানোর কারিগরি অনবদ্য। অফিসের মাঝখানটা খোলা – যাকে এত্রিয়াম বলে। একটি বৃত্তাকার উন্মুক্ত ভজনা ভূমি। কেন্দ্রবিন্দু। মাথার ওপরে অনেক উঁচুতে খিলান দেয়া গির্জের মতন ছাত। সেটিও বৃত্তাকার। একটা কেয়ারি করা বাগানের মতন ধাপে ধাপে উঠে গেছে ঊর্ধ্বপানে। দোতলা-তিনতলা যেকোনো জায়গায় দাঁড়ালে চোখে পড়বে সারে সারে মানুষ কাজ করছেন আপন ডেস্কে। কিন্তু কোনো শব্দ কানে আসে না। এ এক আশ্চর্য ধ্বনিতাত্ত্বিক নির্মাণ। দেখছি এত মানুষ। কাজও তারা নিশ্চয়ই করছে। টেলিফোনে বাক্যালাপ করছে। মৌমাছিদের মত কাজের গুঞ্জন কানে আসে না। কোনো শব্দ নাহি শুনি। লক্ষ লক্ষ টাকার লেনদেন হচ্ছে। বিশাল অর্থব্যবস্থার ভরসায় জাহাজ বোঝাই হচ্ছে কোনো বন্দরে। প্রায় নীরবে এই মন্দিরে চলেছে অর্থদেবতার ভজনা। তাই বলি, এ তো অফিস নয়, এ যেন ক্যাথিড্রাল অফ মানি! মাথিয়াস পরে এই গল্পটা চালু করে দেয়। হালে তার বিদায় সভায় সেটির উল্লেখ করল সেদিন।
ডয়েচে ব্যাঙ্ক লুক্সেমবুর্গ!
নরওয়ের আছে তেল, জার্মানির লোহা-কয়লা, ফ্রান্সের চাষবাস। যার বিশেষ কিছু নেই, তার আছে পাহাড় ও সমুদ্রের শোভা – যেমন গ্রিস। তার ঘরে আসে বিদেশি অতিথি। ভ্রমণের ইচ্ছায়। ব্যয় করে অকাতরে। ছোট্ট রোডস দ্বীপে বাস করেন হাজার চল্লিশ মানুষ, তাঁদের পুরোনো কেল্লার আশেপাশে। বছরে আসেন তিরিশ লক্ষ টুরিস্ট।
লুক্সেমবুর্গের আছে কী?
বিরাশি কিলোমিটার লম্বা, সাতান্ন কিলোমিটার চওড়া এই দেশের এ’ মুড়ো থেকে ও’ মুড়ো যেতে এক ঘণ্টাও লাগে না। লুক্সেমবুর্গের আছে কোনো সম্পদ? ছ’ লক্ষ মানুষের বাস। তার অর্ধেকের বেশি বিদেশি। আছে কিছু ইস্পাতের ব্যাবসা।
বিধ্বংসী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৮ সালে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, লুক্সেমবুর্গ একত্রিত হয়ে একটি শুল্ক সমবায় গঠন করে। দেশগুলির নামের আদ্যক্ষর দিয়ে তার নাম দেয় বেনেলুক্স। এই তিনটে দেশের মধ্যে মানুষের, দ্রব্য-সামগ্রীর এবং অর্থের গতায়াত হবে অবারিত। এর তিন বছর পরে প্যারিস চুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপীয় কয়লা-ইস্পাত সমবায় এবং দশ বছর পরে রোম চুক্তিতে ইউরোপীয় কমন মার্কেট। আজকের একত্রিত ইউরোপের পুরোধা এই বেনেলুক্স। সান মারিনো, অ্যান্ডোরা আর ভ্যাটিকান বাদ দিলে ইউরোপের সবচেয়ে ছোট দেশ লুক্সেমবুর্গের আসল খ্যাতি ব্যাঙ্কিং-বিদ্যায়। ১৯২৯ সালে তাঁরা একটি সুচিন্তিত আইন পাস করেন। কতকগুলি কায়দা কানুন মানলে এদেশ যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে অধিকার দেবে একটি হোল্ডিং কোম্পানি খোলার। এমন প্রতিষ্ঠান, যাদের এখানে কোনো বস্তু উৎপাদন করার অথবা সরাসরি বাণিজ্য করার কোনো প্রয়োজন নেই। ধরে নিন, মাতৃরূপী এই হোল্ডিং কোম্পানি বাস করবে লুক্সেমবুর্গে, আর তার ছত্রছায়ায় বিভিন্ন দেশে কন্যারা করবেন সেই কাজ – যা থেকে অর্থ উৎপাদন হয়। মানে হেড অফিসের বড়বাবু। হোল্ডিং কোম্পানিকে কর দিতে হবে অতি সামান্য, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি ১%। আইনের বা তদারকির বিড়ম্বনা কম। এই সুবিধা যে কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই পাওয়া সম্ভব। দিকে দিকে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে। মুখ্যত ব্যাঙ্কিং সংস্থাগুলি এই সভায় শ্রেষ্ঠ আসন নিলেন। আজ ১৪৪টি ব্যাঙ্কের অধিষ্ঠান, তার মধ্যে ১২০টি বিদেশি। লুক্সেমবুর্গের জাতীয় আয় ৭০ বিলিয়ন ডলার আর তাদের ব্যাঙ্কে দেশি ও বিদেশিদের জমা টাকার পরিমাণ তার দশগুণ। ৭৭৩ বিলিয়ন ডলার। দেশটি ক্ষুদ্র, আইনকানুন ঢিলে। তবু এখানে টাকা রাখাটা অনেকেই সুরক্ষিত বলে মনে করেন। অ্যাকাউন্ট খুলতে আপনার পাসপোর্ট আর বিজলির বিল যথেষ্ট। পিতৃ-পিতামহের বাসস্থান বা আয়ের সূত্র নিয়ে কেউ টানাটানি করবে না। লুক্সেমবুর্গে যা লেনদেন হবে, তার নথিপত্র জ্ঞানগম্যি সে দেশেই নিহিত থাকে।
লুক্সেমবুর্গে অধিষ্ঠিত হয়েছে ৩৭টি জার্মান ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান। দুনিয়ার আর কোনো শহরে বন্দরে এতগুলি জার্মান ব্যাঙ্কের শাখা নেই। কী কারণে গুষ্টিশুদ্ধ জার্মান ব্যাঙ্ক সীমানা পেরিয়ে এ দেশে বাসা বেঁধেছে, তার নানান ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। এ কি নেহাত বাড়ির কাছের শহর বলে? না অন্য কোনো কারণ আছে? মাইন্তসের লান্দেসব্যাঙ্ক রাইনল্যান্ড ফালতসের আমার খুব চেনা এক কর্তাব্যক্তি, ডক্টর শ্মিঙ্কে, দীন দুনিয়ার কৌতূহল ও হাস্য উদ্রেক করেন। তাঁকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, কী কারণে তাঁর ব্যাঙ্কের একমাত্র বিদেশি শাখাটি লুক্সেমবুর্গে খোলা হল। এর উত্তরে তিনি বলেন, এ শাখাটি খোলার পিছনে এক সুকৌশলী চিন্তা আছে। কারো বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হবার কথা নয় এই কৌশলটির অন্য নাম, কর বাঁচানোর নতুন তরিকা।
আইনত ধরে নেয়া হয় – এই হোল্ডিং কোম্পানি বলুন আর মাতৃরূপিণী প্রতিষ্ঠান বলুন – তার পবিত্র কর্তব্য হল কন্যাদের যথোপযুক্ত পর্যবেক্ষণে রাখা। কে কোন কাজ করছে, কেমনভাবে করছে – তার খোঁজখবর নেওয়া। ১৯৯১ সালে লুক্সেমবুর্গে সংগঠিত ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স নামক ব্যাঙ্কটি ধরাশায়ী হল। দোকান বন্ধ। এ ব্যাঙ্কের কাজকর্ম বিশ্বময়। ইংল্যান্ডে তার আকার বিশাল। প্রশ্ন উঠল, এ ব্যাঙ্কটির তদারকি কে করছিলেন? লুক্সেমবুর্গ কর্তৃপক্ষ জানালেন, সেটা তাঁদের দায়িত্ব ছিল না। এটি একটি হোল্ডিং কোম্পানি। তাঁরা কী হোল্ড করছিলেন, তা জানার ঝক্কি লুক্সেমবুর্গের কি? তবে সে কোন মনিষীর কাজ? তার উত্তর মেলেনি। ইংল্যান্ডের অনেক আমানতকারিদের অর্থ জলাঞ্জলি গেল।
আমাদের ব্যাবসা – গোষ্ঠীবদ্ধ (সিনডিকেটেড) ঋণ জোগাড় করা। দশটি ব্যাঙ্ক একত্রিত হয়ে দিলেন অর্থ। এবারে প্রয়োজন একটি ব্যাঙ্কের, যারা এই অর্থ সংগ্রহ ও বণ্টন করবে, ঠিক সময়ে সুদ আদায় করবে এবং কাল-অন্তে দেনাদারের কাছ থেকে বাকি বকেয়া আদায় করবে। এই কারণে ওই দশটি ব্যাঙ্ক একটি কোনো প্রতিষ্ঠানকে এই সুকর্তব্যটি দেন, অবশ্যই কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। এর সরকারি নাম – এজেন্সি। অনেকটা জমিদারবাবুর নায়েবের সেরেস্তার কাজ। কমারতসব্যাঙ্ক লুক্সেমবুর্গ সে আমলে সমস্ত ব্যাঙ্কের হয়ে আমাদের কিছু গোষ্ঠীবদ্ধ ঋণের তদারকির ব্যাপারে খুবই দক্ষতার পরিচয় দেয়। সে দপ্তরের অধিকারী ছিল রাইনার ত্রাপেন। ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে এক গ্রামে তার বাড়ি কিন্তু দীর্ঘদিন লুক্সেমবুর্গ-বাসী।
একবার দেখা করতে গেছি। রাইনার যে ঠিকানা দিয়েছিল, সেটা কির্খবের্গে। ঠিকানামত যে বাড়ির সামনে হাজির হলাম, সেটা দুটো রাস্তার কোনায় একটা মামুলি তিনতলা বাড়ি। দরোজা ঠেলে ঢুকেই মনে হল ভুল জায়গায় এসেছি। এটা কোনো ব্যাঙ্কের কর্পোরেট অফিস হতে পারে না। একটা মাঝারি সাইজের হলঘর। অনেক চেয়ার ছড়ানো ছেটানো। সব চেয়ার অধিকৃত। সেখানে যে জনতা বসে আছেন, তাঁদের গড়পড়তা বয়েস পঞ্চাশের বেশি। পোশাক অতি সাধারণ। সস্তার জ্যাকেট। বেমানান স্পোর্টস জুতো। কেউ কারোর সঙ্গে কথা বলছেন না। বেলগেছের দাতব্য চিকিৎসালয়ের মত। গরীব মানুষেরা যেন ডাক্তারের ডাকের অপেক্ষায় আছেন। এই কি সেই ব্যাঙ্ক, যেখানে আমি এসেছি অনেক বিলিয়নের দায়িত্বভার মাথায় নেওয়া মানুষের সঙ্গে সাক্ষাত করতে? রিসেপশনের মহিলাকে আমার পরিচয়ের কার্ডটি দিয়ে দ্বিধা-ভরে বললাম, আমি এসেছি রাইনার ত্রাপেনের সঙ্গে দেখা করতে। এটি কি সঠিক ঠিকানা? তিনি স্মিত হেসে বললেন, এটা তাঁর অফিস নয়, কিন্তু দেখা করার ঠিকানা। হের ত্রাপেন বসেন অন্য অফিসে। এই দু’ মিনিট দূরে এডওয়ার্ড স্টেলখেন পথে। আমি ফোনে বলে দিচ্ছি। এসে যাবেন। দু’ মিনিট বসুন। তিনি চক্ষু মেলে দেখলেন ঘর একেবারে ভর্তি। আমি বললাম দু’ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে এসেছি। দু’ মিনিট দাঁড়াতে ভালোই লাগবে।
রাইনার এসে বিলম্বের জন্য প্রভূত ক্ষমা চাইল। তার আবার আরেকটা সমস্যা হয়েছে। অফিসে কোনো মিটিঙের ঘর খালি নেই। আমাকে নিয়ে গেল কির্খবের্গের একটি চমৎকার কফি হাউসে। সেখান থেকে চোখ চলে যায় দূরে। দেখি ক্ষীণ আলতসিগ (ফরাসী আলযেত) নদী। পাথরের সেতু দিয়ে অনেক পাহাড়কে জুড়ে তৈরি হয়েছে এই শহর লুক্সেমবুর্গ। অনেকটা নিচে বয়ে যায় সে নদী। মনে হল, কী ভাগ্য যে করেছি! ব্যাঙ্কের কাজের বাহানায় এই সব সুন্দর জনস্থানে পরিভ্রমণ করি। প্রথাগত জার্মান কায়দায় রাইনার এনেছে তার বই-খাতা (আই ফোন আসতে কয়েক বছর বাকি)। কাজের কথা শেষ হল। এতক্ষণ আমার কৌতূহল মনেই রেখেছি। এবার আর থাকা গেল না।
‘রাইনার, এই যে সব মানুষ তোমাদের ব্যাঙ্কের হলঘরে বসেছিলেন, এঁরা কারা? এদের কাউকে ব্যাঙ্কার কেন, এমনকি শিল্পপতি বলেও তো মনে হল না?’
রাইনার বললে, চুপ কর দেখি (জাই রুহিগ)। তুমি কি মনে কর তোমাদের গোষ্ঠীবদ্ধ ঋণের পারিশ্রমিক নিয়ে আমাদের ব্যাঙ্ক চলে? ঘরভাড়া ওঠে না। এখানকার খরচা জান? যাদের দেখলে, তারা আমাদের প্রাইভেট ব্যাঙ্কের গণ্যমান্য মক্কেল। সোজা বাংলায় (এর সরাসরি জার্মান আছে – আউফ ডয়েচ গেজাগট) করপ্রদানের পরিমাণ কমানোর জন্য আমাদের সঙ্গে এখানে কারবার করে। অ্যাকাউন্ট খোলে। টাকা তোলে। জমা দেয়। তারাই আমাদের রুটি রুজির মালিক’।
আমার প্রশ্ন তখনো ফুরোয়নি। আমি বললাম, রাইনার, এদের পোশাক-আশাক, এমনকি সম্পূর্ণ বেমানান স্পোর্টস জুতো দেখলে তো হাঘরে মনে হয়। এরা তোমাদের মূল্যবান মক্কেল? কী গুল দিচ্ছ?’
রাইনার তখন বললে, তবে শোনো। এরা সকলেই ট্রিয়ার (সীমান্তবর্তী জার্মান শহর, যেখানে কার্ল মার্ক্স জন্ম গ্রহণ করেন) অথবা জার্মানির কোনো কাছের শহরে তাদের বিএমডবলু, মারসেডিজ গাড়ি পার্ক করেছে। তারপর গাড়িতেই জামাকাপড় বদলে গরিব বা তোমার ভাষায় হাঘরে বেশ ধারণ করে ট্রেনে লুক্সেমবুর্গ এসে পৌঁছেছে। ৪৫ মিনিট লাগে। আট মার্ক (আজকে চার ইউরো) ভাড়া। এরা নিজের দেশে কখনো ট্রেনে চড়ে না! আমাদের ব্যাঙ্ক ম্যানেজার স্যুট-বুট পরে এই হতদরিদ্র (আরম) চেহারার মানুষগুলির আপ্যায়ন করেন তাঁর ওক-প্যানেল দেওয়া অফিসে। সে ম্যানেজার জানেন, এইসব লোকেরা তাঁকে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বেচে দিতে পারেন! তিনি আরও জানেন, তাঁর সারা বছরের আয় তাঁর মক্কেল এক সপ্তাহে উপার্জন করেন! এবার বুঝলে?
বাঙালির প্রশ্ন শেষ হয় না। ‘আচ্ছা, এরা সবাই সম্পূর্ণ নীরবে বসে ছিলেন কেন? কেউ কারোর সঙ্গে একটা কথা বলে না। সবাই তো জার্মান। এই বিদেশ বিভুঁইতে দেখা হল! একটু দেশ-গাঁয়ের পাড়া-পড়শির গল্প করতেও তো পারে! রাইনার জানাল, ‘এরা সবাই জানে কী কারণে তারা এখানে একত্তর হয়েছে। কর বাঁচানোর তাগিদে। এ দেশের আইনে সেটা আটকায় না। কিন্তু জার্মানির আইন খুব একটা স্পষ্ট নয়। এখানে কেউ কেন অন্যের সঙ্গে আলাপ পরিচয় আর গুলতানি করবে? কোন মূর্খ আরেকজনকে জিগ্যেস করবে, কী হে, তুমি কত ট্যাক্স বাঁচালে?’
আমাদের এই বাক্যালাপের কয়েক বছর বাদে জার্মান অর্থদপ্তর কমারতসব্যাঙ্কের ওপরে কর ফাঁকি দেবার অনুসন্ধানে বিশেষ তদন্ত চালু করে।
অর্থবান কারা? যাদের ওই রাইনারের ব্যাঙ্কে দেখলাম তারা?
আটের দশকে তার উত্তর মুখে মুখে চালু ছিল। বেলজিয়ান ডাক্তার আর ডেন্টিস্ট। আক্ষরিক অর্থে তাঁরা যে সকলেই বেলজিয়ান আর ইউরোপের সবচেয়ে ধনী সম্প্রদায় তা নয়। তাঁরা জার্মান হাতুড়ে, ফরাসি দাঁতের ডাক্তার অথবা ডাচ বদ্যি হতে পারেন। মোনাকো বা ফ্রান্সের কোত দাজুর জন্মসূত্রে বড়লোক এবং ভুঁইফোড় বণিকদের ক্রীড়াভূমি। বেলজিয়ান ডাক্তারদের কথাটা উঠত খানিকটা আলাদা প্রসঙ্গে। এর অর্থ একটি পেশাগত গোষ্ঠী। বড়লোক হয়ে জন্মাননি। লটারিও জেতেননি। খেটেখুটে অনেক অর্থ সঞ্চয় করেছেন। মেহনতের মূল্য জানেন। আর তাই নিত্যদিন রুগি মারার চেয়েও, সেই সঞ্চিত অর্থকে সুরক্ষিত রাখা ও সম্যক সুদের হারে তার পরিমাণ বৃদ্ধি করাটা তাদের জীবনের লক্ষ্য। জীবনের ধন যেন না হারায়। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে বা রুটি ও সসেজে। তার সঙ্গে যুক্ত হয় সামান্য বা আদৌ কর না দেবার উদগ্র বাসনা। একেক জনের সঞ্চয়ের পরিমাণ এমন নয়, যে জেনিভার প্রাইভেট ব্যাঙ্কাররা তাদের আনতে বিমানবন্দরে লিমুজিন পাঠাবে বা জুরিখের বানহফস্ত্রাসেতে কেউ লাল কারপেট পেতে দেবে। নম্বরি অ্যাকাউন্টের অধিকারী হবার মত বিশাল লোভ বা দুঃসাহস কোনোটাই তাদের নেই।
লাঠিটি না ভেঙে সর্পনিধন করার পথ দেখায় লুক্সেমবুর্গ। খুব জটিল ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলি, কর প্রদানের বিড়ম্বনা-বর্জিত নানা ধরনের লগ্নির সুযোগ আছে সেখানে। যেমন বন্ড। না, জেমস বন্ড নয়। এ বন্ড একটি দীর্ঘমেয়াদী লগ্নি। তিন মাস অন্তর সুদ দেওয়া হবে। তার পোশাকি নাম কুপন এবং পাঁচ বা দশ বছর বাদে আসল টাকাটি ফেরত পাওয়া যায়। এই আর্থিক প্রকল্পে প্রাপ্তব্য সুদটি সংগ্রহ করতে হবে নগদে, আপন করে। নইলে করের খোঁচা। আপনি লুক্সেমবুর্গে লগ্নি করে আপনার ব্যাঙ্ককে যদি বলেন, তিন মাস গেলে সুদের টাকাটি আমার স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিন, তাহলে আপনি আয়কর দেবেন আপনার দেশের হারে। অতএব ত্রৈমাসিক তীর্থ যাত্রা করবেন এই সুন্দর শহরে। চা বা জলযোগ করে ব্যাঙ্কে গিয়ে আপনার বন্ডের মালিকানা সাব্যস্ত করবেন। নগত টাকাটি পকেটস্থ হবে। এই প্রয়াসে আপনার দীনবেশ ধারণ করা আবশ্যিক নয়। তবে ফেউ লেগে আছে কিনা, জানেন না। সাবধানের মার নেই। আপনার মহার্ঘ্য গাড়িতে যাবেন না।
ব্রাসেলস মিডি স্টেশন থেকে লুক্সেমবুর্গের ট্রেন ছাড়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। সময় লাগে সোয়া তিন ঘণ্টা। সকাল সাড়ে ছ’টার ট্রেন ধরে রেস্তোরাঁ কারে প্রাতরাশ করে লুক্সেমবুর্গ পৌঁছুবেন এগারটা নাগাদ। বন্ডের কুপন ব্যাঙ্কের খাতায় জমা করলে পাবেন ত্রৈমাসিক নগদ সুদ। এটি পকেটে বা ব্যাগে পুরে মধ্যাহ্ন ভোজন সারবেন। প্রতি ঘণ্টার ন’ মিনিট বাদে ব্রাসেলস ফেরার ট্রেন। শহর লুক্সেমবুর্গ আপনার দেখা হয়ে গেছে প্রথম বা দ্বিতীয় যাত্রায়। আর কিছু দর্শনের বাকি নেই। এবার আপনার বর্ধিত সম্পদ সঙ্গে নিয়ে সে ট্রেনের সওয়ারি হ’ন। আপনার এই নবলদ্ধ অর্থাগমের টিকিটি কেউ পাবে না। গোপন টাকাটি রবে গোপনে। বাসেও যাওয়া যায়। এক ঘণ্টা বেশি লাগে।
ব্রাসেলস-লুক্সেমবুর্গের এই ট্রেনের আদরের নাম হল বন্ড এক্সপ্রেস!
জার্মানির আখেন, হল্যান্ডের মাসট্রিখট ও ফ্রান্সের মেতস থেকেও সেই দু’-তিন ঘণ্টার পথ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভেতরে কোথাও কোনো পাসপোর্ট চেকিঙ-এর বালাই নেই। আনাগোনার দ্বার সর্বদা উন্মুক্ত।
সোমবার সকালে ব্যাঙ্কিং হলে বন্ডের সুদ সংগ্রহে উৎসুক মানুষের কাতার দেখার স্মৃতি ভোলার নয়!