ভিয়েনা -বুদাপেসটের পথে এম ওয়ানরিসেপশানে ঢোকার মুখেই দেখি পিয়ের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন ; আপিসের ভেতরে ধূমপান ইতিমধ্যে হাঙ্গেরিতেও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তিনি কার্নো মেটাল বক্স, পূর্ব ইউরোপের ট্রেজারার কাম চিফ ফাইনান্সিয়াল অফিসার । সল্ট ও আমাকে প্রভাতি সম্ভাষণ জানিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন , ভিয়েনা মিউনিকের নম্বরওলা গাড়ি আমাদের পারকিং লটে প্রায়ই দেখি , কিন্তু পশ্চিমের ওই ছোটো দ্বীপের নয়। আপনি কি আপনাদের ব্রিটিশ এয়ার বা মালেভের ( হাঙ্গেরিয়ান বিমান সংস্থা) ওপর আস্থা হারিয়েছেন?
সল্ট আমাকে জানিয়ে রেখেছিল এই ফরাসি ভদ্রলোক হাসি ঠাট্টা দিয়েই কোন আলোচনা শুরু করেন। মুশকিল হয় কোনটা তিনি সিরিয়াসলি (হাঙ্গেরিয়ানে সুলিওস , প্রায় একই শোনায় ) বলেন আর কোনটা নিছক রসিকতা সেটা অনেক সময় বুঝে ওঠা যায় না।
যান্ত্রিক আদান প্রদানউত্তর দিতে হলো
- না, তা মোটেই নয় , বারো ঘণ্টা গাড়ি চালানোর চেয়ে দু ঘণ্টায় ফেরিহেজ পৌঁছানোটা অনেক আরামের । তবে আমার একটু ব্যক্তিগত কাজ ছিল ফ্রান্সে তাই সেখান থেকে সিধে বুদাপেস্ট এসেছি।
- ফ্রান্সের কোথায় ?
- পা দে কালের নিচের দিকে একটা নগণ্য গ্রাম, উবি সাঁ লো। পিকারদির উত্তর সীমানা বরাবর । সেটা কেউ চিনবে না বলে আমি তার গায়ে লাগানো শহর হেসদিনের নামটা জুড়ে দিয়ে থাকি।
- এ রকম জায়গায় কেউ বেড়াতে যায় বলে আমার মনে হয় না।
- না, ওই গ্রামে আমাদের একটি আস্তানা আছে। সেখানে স্ত্রীকে রেখে এলাম। তারপর মোটরওয়ে -বেলজিয়াম জার্মানি অস্ট্রিয়া দিয়ে, তেরশ কিলোমিটার !
- সাঁ পোল তাহলে চেনেন, আমার খুড়ি থাকতেন। প্যারিস থেকে স্কুলের ছুটিতে যেতাম।
জানাতে হল সাঁ পোল চিনি, আমাদের কাছের জংশন স্টেশন। আমাদের অঞ্চলে সর্বত্র সিঙ্গল লাইনে ট্রেন চলে তাই লিল বুলোয়েনের মাঝে একমাত্র সাঁ পোলে এক ট্রেন অন্য ট্রেনকে অতিক্রম করতে পারে। পিয়েরের দফতর অবধি যেতে যেতে এইসব বাক্যালাপ চলছে , সল্ট বেশ বিভ্রান্ত- ভাবছে ব্যাঙ্কের কাজের কথা কতক্ষণে হবে !
আমাদের দুটি গদি মোড়া চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে নিজের আসনে এলিয়ে বসলেন পিয়ের ।
- আপনি অস্ট্রিয়ান সীমান্ত থেকে এম ওয়ান ধরেছেন তো ?
- হ্যাঁ। চমৎকার মোটরওয়ে, জর অবধি সিধে তারপর সামান্য বেঁকে একেবারে বুদাপেস্ট।
- আশাকরি আইন মেনে চালিয়েছেন । ওই রাস্তায় কিলোমিটার মাফিক হয়তো ইউরোপের সবচেয়ে বেশি স্পিড ক্যামেরা বসানো আছে।
- আমার ভিয়েনার কলিগরা সাবধান করে দিয়েছিলেন।
- যদি ধরা পড়ে থাকেন , ফ্রান্সের দোষ দেবেন না । রাস্তাটা বানিয়েছি আমরা কিন্তু স্পিড ক্যামেরা বসিয়েছে বুদাপেস্টের সরকার । তাঁরা বুঝে ফেলেছেন রাস্তা যতো ভালো হবে, জোরে গাড়ি চালানোর ইচ্ছে ততো জেগে উঠবে আর ফাইন কালেকশন জোরদার হবে।
- এম ওয়ান ফরাসিদের বানানো জানতাম না ।
- আপনি ফ্রান্সে গাড়ি চালান, আসবার সময়ে লক্ষ করেননি ভিয়েনা বুদাপেস্টের এম ওয়ানে পেয়াজ (টোল বুথ) একেবারে ফ্রান্সের অটোরুটের ধাঁচে বানানো ? তফাৎ শুধু এরা হাত বাড়িয়ে গুণে গুণে ফোরিনট নেয় । কেবল ক্যাশে ! ফ্রান্সে আপনি আমি কার্ডে পেমেন্ট করি ।
এককালে মানুষের দেখা মিলতসল্টের শঙ্কা না বাড়িয়ে ব্যবসা বাণিজ্যের যথাযোগ্য আলোচনা এবং দু প্রস্থ কফি ধ্বংস করে ওঠবার আগে পিয়েরের প্রতি আরেকটি প্রশ্নবাণ নিক্ষেপের বাসনা জেগে উঠলো ।
- আপনাদের ব্রাসেলসের হেড অফিসে গেছি , সেটা শহরের মাঝে, বেলজিয়ামের রাজবাড়ীর দু কদম দূরে। সেখানে গাড়ি পারকিঙ্গের মহা ঝকমারি । কিন্তু এ দেশের কর্পোরেট অফিস রাজধানী বুদাপেস্ট থেকে এতোটা দূরে খুলেছেন কেন?
- মসিও , আমাদের এই কর্পোরেট অফিসের নাম কার্নো মেটাল বক্স ইস্টার্ন ইউরোপ! হাঙ্গেরির জল হাওয়া সেবন করি বটে কিন্তু সেটাই আমার একমাত্র কাজ নয়। এবার আসুন দেওয়ালের দিকে, আপনাকে কিছু দেখাই।
পিয়েরের ডেস্কের ঠিক উলটো দেওয়ালে মধ্য ইউরোপের একটি ম্যাপ ঝুলছে । মনে হলো এটা মিশেলিনের ড্রাইভিং গাইড বা রোড ম্যাপ । সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন , হাতে পেন্সিল।
- এই দেখুন, বুদাপেস্ট থেকে আমরা আছি প্রায় আশি কিলোমিটার পূর্ব দিকে । আমার তত্ত্বাবধানে রয়েছে হাঙ্গেরি স্লোভাকিয়া চেকিয়া স্লোভেনিয়া ক্রোয়েশিয়া এবার ম্যাপে মন দিন , দেখুন ভোরবেলা গাড়ি চড়লে লাঞ্চ নাগাদ পৌঁছুতে পারি ব্রাতিস্লাভা , প্রাগ , লুবলিয়ানা , একটু দেরি করে জাগ্রেব! আর একটা কথা ,রোমানিয়ার বাজার এখনও খোলে নি কিন্তু যখন খুলবে এই অফিস থেকে সেখানে যেতে বিশেষ সময় লাগবে না। শাতো তেমিস মাত্র ঘণ্টা দেড়েক।
এই ছোটো শহর কেচকেমেত পূর্ব ইউরোপের একেবারে কেন্দ্রে!
হাঙ্গেরিয়ান সীমান্তবর্তী রোমানিয়ান শহর তিমিসোওয়ারার নাম হাঙ্গেরিয়ানে / ইদিশে তেমেশভার , জার্মানে তেমেশবুরগ (হাঙ্গেরিয়ান ভার ও জার্মান বুরগ একই অর্থ বহন করে : দুর্গ ) । কিন্তু সেই সব কলোনিয়াল নামে রোমানিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং , আমার মতে, সবচেয়ে সুন্দর শহরকে ডাকাটা রোমানিয়ানদের কাছে আপত্তিকর ,হয়তো বিদেশি আধিপত্যের দিন স্মরণ করিয়ে দেয় ! সেথায় রাজত্ব না করেও ফরাসিরা আরেকটা নাম দিয়েছে শুনে আমার রোমানিয়ান পত্নী বিশেষ ক্ষিপ্ত হয়েছিল – কেন তারা তিমিসোয়ারা বলতে পারে না ?
পিয়ের জানালেন প্রতি সপ্তাহে তিনি ব্রাতিস্লাভা ও প্রাগে একদিন করে বসেন , জাগ্রেব লুবলিয়ানায় পাক্ষিক পর্যবেক্ষণ। ইউরোপের ভূগোলটা সম্যক জানি বলে অফিসের লোকজন , আমার পুত্র কন্যার কাছে যে বারফাট্টাই করে থাকি সেটা বিচূর্ণ হলো।
কেচকেমেত থেকে ফেরার সময়ে সল্টের সঙ্গে মোটরওয়ে (হাঙ্গেরিয়ানে অটোপালিয়া ) টোল নিয়ে গল্প করছিলাম। হাতে সময় আছে যখন !
সল্টকে বললাম আজ থেকে বিশ বছর আগে, ১৯৮০ নাগাদ যখন ইউরোপে গাড়ি চালানো শুরু করেছি, টোল নামক বিড়ম্বনা ফ্রান্স ইতালি স্পেন পর্তুগাল ছাড়া অন্য কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বেলজিয়াম ,নেদারল্যান্ড, লুক্সেমবুরগ , জার্মানি, স্ক্যানডিনেভিয়া , ইউ কে ( ম্যানচেস্টারের পাশে এম সিক্সের সাতাশ মাইল বাদে যেটিকে এড়িয়ে যাওয়ার বিবিধ পথ আছে) ) আয়ারল্যান্ড সব পথ সার্বজনীন। কমিউনিস্ট পূর্ব ইউরোপে কিছু মোটরওয়ে দেখেছি, যেমন সেই বিখ্যাত ট্রানজিট অটোবান যা পশ্চিম জার্মানির পূর্ব প্রান্ত থেকে পশ্চিম বার্লিনের দুয়োর অবধি পৌঁছুত। পথে প্রবেশ দক্ষিণার জন্য কেউ হাত বাড়াতো না সেখানে । শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মতো জনপথের ব্যবহার ছিল শুল্ক বিহীন। এবার প্রথম টোল দেখলাম তোমাদের দেশে , হাঙ্গেরিতে, সেটিও আবার ফরাসিদের বানানো ! বার্লিন দেয়াল পতনের সঙ্গে সঙ্গে দেখছি দরোজা খোলা পেয়ে সকল প্রকার পশ্চিমি দুর্বৃত্ততা পুবে ঢুকে পড়েছে!
পূর্ব ইউরোপে হাইওয়ে ছিলো , হাইওয়ে রবারি ছিলো না । নরওয়ের পুবের প্রত্যন্ত শহর কিরকেনেস থেকে রাশিয়ান সীমান্ত পার হয়ে চমৎকার রাস্তায় তিনশো কিলোমিটার গাড়ি চালিয়ে মুরমান্সক পৌঁছেছি পথে কোন কর দিতে হয় নি । ১৯৯২ সালে বার্লিন থেকে প্রথম পোল্যান্ড প্রবেশের পরও নয়। পশ্চিম ইউরোপে মোটরওয়ে ব্যবহারের জন্য টোল ছিল সীমিত। কিন্তু এবার খেলা বদলে গেল। বার্লিন দেওয়াল ভেঙ্গে পড়ার কয়েক বছরের মধ্যে পূর্ব ইউরোপের পথে পথে যে দিনে ডাকাতি শুরু হলো তার গুরু অস্ট্রিয়া এবং খানিকটা সুইজারল্যান্ড । তারাই প্রথম ভিনিয়েত (Vignette) নামক একটি খুড়োর কল চালু করে। আপনি যদি হাবসবুরগ রাজাদের পুণ্য ভূমিতে স্বতশ্চলশকট যোগে পরিক্রমা করতে চান প্রথমেই সম্রাটের দরবারে অগ্রিম কর প্রদান করবেন। যেই আপনি অস্ট্রিয়া ঢুকলেন, পয়লা পেট্রোল স্টেশনে ভিনিয়েত নামক স্টিকারটি কিনে ( একদিনের জন্য ৯, দশ দিনে ১২, এক বছরের ১০৪ ইউরো) আপনার উইন্ডশিল্ডে লাগিয়ে প্রমাণ করবেন আপনার গাড়ি ইললিগাল ইমিগ্র্যানট নয় ! সুইজারল্যান্ড সোজা সরল পম্থায় এক বছরের মূল্য চল্লিশ ইউরো দাবি করে , যতদিন থাকুন না কেন। বছর দুই আগে ফ্রান্সের আনসি (Annecy) পেরিয়ে যেই সুইস ভূমিতে ঢুকেছি গাড়ি থামিয়ে ভিনিয়েতের স্টিকার বেচার জন্য হামলে পড়েছে সুইস জনতা , ক্রেডিট কার্ড তো বটেই নানান ইউরোপীয় মুদ্রার দর তাদের জানা ( সেটি নিঃসন্দেহে গলাকাটা) এবং ফেরত দেওয়ার মতন খুচরো তাদের পকেটে ।
স্লোভেনিয়ায় ভিনিয়েতফ্রান্স স্পেন পর্তুগাল ইতালির রাজপথ ব্যবহার করলে আমরা যে অর্থ দিয়েছি সেটা আপন ইচ্ছায় ; তাড়াতাড়ি কোথাও পৌঁছুতে চাই , অতএব জেনেশুনে টোল করেছি দান। আমরা সকলেই জানি অটোরুট বা অটোস্ত্রাদায় না উঠেও প্যারিস থেকে মার্সেই অথবা রোম থেকে নেপলস যাওয়া যায় । দের আয়ে পর দুরুস্ত আয়ে এই বাক্যটি স্মরণ করে একবার ফরাসি অটো রুটকে দূরে রেখে গোরু ছাগল , থলি হাতে বাজার থেকে ফেরা মহিলাদের পাশ কাটিয়ে ধীর মন্থর গতিতে উত্তর পশ্চিম ফ্রান্সের লে তুকে হতে রোদিকাকে চারশ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণের নানত অবধি পৌঁছে দিয়েছি ছ ঘণ্টায়; ফরাসি সরকারের খাজানায় একটি ফ্রাঁ জমা না দিয়ে ।
এবে অস্ট্রিয়া এবং তার সুগ্রীব দোসর সুইজারল্যান্ড স্থির করলে সে দেশে প্রবেশমাত্র আপনি পথ ব্যবহারের মূল্য দেবেন । সত্বর তাদের দেখাদেখি অস্ট্রিয়ার প্রতিবেশী পুবের একদা কমিউনিস্ট দেশগুলি , হাঙ্গেরি স্লোভাকিয়া স্লোভেনিয়া , চেকিয়া রাষ্ট্র পুঁজি বাড়ানোর এই কৌশলটি আয়ত্ত করে ফেলেছে । গুরুমারা বিদ্যে।
ভিনিয়েত একটি অত্যন্ত অসম ট্যাক্স । অস্ট্রিয়ার পুবের দেশে, যেমন স্লোভাকিয়ার মোটরওয়েতে আপনার গাড়ির চাকা গড়ালেই ন্যূনতম দশ দিনের জন্য ১০ ইউরো দণ্ড দিতে হবে, তা আপনি সে দেশে একদিন এক সপ্তাহ বা তিন সপ্তাহ চালালেও। এক মাসের জন্য দেয় ১৪ ইউরো , এক বছরের ৫০ ইউরো । হাঙ্গেরিতে এক দিনের কর ১২.৭০ ইউরো, দশ দিনের ১৫ এবং এক মাসের ২৫ ইউরো ! বাটপাড়ি আর কাকে বলে ।
ভিনিয়েতের দোকানভিনিয়েত অর্থনীতিবিদদের প্রিয় বিষয় ল অফ ডিমিনিশিং রিটার্নের উলটো উদাহরণ - যত বেশি দিন আপনি সে সব দেশে গাড়ি চালাবেন আনুপাতিক হারে খরচা কমে যায় ; কোথাও একদিনের লাগে দশ ইউরো তিরিশ দিনের চৌদ্দ, বছরে পঞ্চাশ ! ল অফ ইনক্রিজিং রিটার্ন।
আমার অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা শুনে সল্ট হেসে ফেললে , “ হীরেন , অন্যদিকটা ভেবে দেখো হাঙ্গেরিতে যখন ঢুকেই পড়েছ , আরও দশদিন গাড়ি চালালে মাত্তর তিন ইউরো বেশি দিতে হবে । ভাবলে তাহলে , শুধু বুদাপেস্ট কেন,সেন্ট স্টিভেন দ্বীপ,ভিসেগ্রাদ, দেবরেচেনটাও নাহয় ঘুরে যাওয়া যাক ! তাতে হাঙ্গেরিয়ান ইকনমির লাভ- যতদিন থাকবে, গাড়ি চালাবে, তেল কিনবে, খাওয়া দাওয়া বেড়ানো, পিকচার পোস্ট কার্ডের জন্য ফোরিনট খরচা করবে । তা থেকে হাঙ্গেরিয়ান দোকানির আয় এবং সরকারি ট্যাক্স কালেকশন দুটোই বাড়তে থাকে। সরকারকে বা পথ বানানোর কোম্পানিকে টোল নাকা খুলে , ব্যারিয়ার বানিয়ে লোক পুষতে হচ্ছে না আর করের টাকা ফটাফট সরকারি খাতায় চলে আসছে ।ফ্যালো কড়ি চালাও গাড়ি ।
অকাট্য যুক্তি !
মনে মনে ভাবলাম, কি ভাগ্যে ফ্রান্স আজও এ পথ ধরে নি ; লিবারতে এগালিতে ফ্রাতারনিতের ঝাণ্ডা উঁচু রেখেছে। তার সীমানা পেরুনো মাত্র দণ্ড দিতে হয় না । বেলজিয়াম জার্মানি সুইজারল্যান্ড থেকে ফ্রান্সে ঢুকে যতক্ষণ না আপনি ফরাসি মোটরওয়ে বা অটোরুটের গেট পেরিয়ে সে পথে গাড়ির চাকার ছাপ রাখছেন , আপনাকে কোন পেয়াজ ( péage) বা কর দিতে হবে না। এ ছাড়া ফরাসি অটো রুটের এমন অনেক অংশ আছে যেখানে গাড়ি চালানো ফ্রি । ফ্রান্সে যতো কিলোমিটার চালাবেন, কর দেবেন সেই অনুযায়ী । সময়ের যদি অকুলান না হয় , ম্যাপে বা গুগলে দেখে নিন – রু নাসিওনাল (RN) অথবা রু দেপারতমেন্তাল দিয়ে কিছু বিলম্বে কিন্তু অনায়াসে গন্তব্য স্থলে পৌঁছুনো যায় । ক্যালে থেকে উত্তর মুখে ডানকারক পেরিয়ে বেলজিয়ান সীমানা অবধি এবং দক্ষিণ মুখে আমাদের গ্রামের বাড়ি উবি সাঁ লো যেতে যে পথ পাই তার বেশ কিছুটা করমুক্ত । ক্যালের টার্মিনালে নেমে আমাদের গ্রামের দিকে প্রায় বিশ কিলোমিটার গেলে বন্দর শহর বুলয়েন (Boulogne), সে অবধি ফ্রি আসা যায় । এবার সেখানে আমার দুটো উপায় - কর দিয়ে অটো রুট ধরে থাকা অথবা গ্রামের পথ দিয়ে মন্থর গতিতে পরিভ্রমণ ।
সেটাই তো পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশিষ্ট লক্ষণ – ফ্রিডম অফ চয়েস ! বেছে নিন আজ কোন পথে যাবেন দুজনে ?অটোরুটে উঠে আমাদের গ্রামের কাছাকাছি পৌঁছুতে লাগে ৩.৪০ ইউরো। কিন্তু সর্বদা সে পথে উঠি না । দিন ভালো থাকলে গ্রামের পথ দিয়ে যাই, রাস্তার ধারে কেউ বসেছে আপেল, স্ট্রবেরি নিয়ে সেখানে থেমে দুটো বাক্যালাপ ক’রে ( রোদিকা বলে আমি শুনি) এক সময় বাড়ি পৌঁছুই।
ফ্রান্সের টোল বুথে আজ কোন মানুষ জানলায় বসে দিবারাত্রি বঁ জুর বঁ সোয়া বলে টিকিটের জন্য হাত বাড়ায় না। অটোরুটের বেড়ার সামনে গাড়ি হাজির হলেই যন্ত্র টিকিট বণ্টন করে, বেরুনোর সময়ে সেই টিকিট আরেক যন্ত্রের মুখে গুঁজে দিলে হিসেব করে নিয়ে সেটি জানায় দক্ষিণা কতো, ক্রেডিট কার্ড ঠেকালে আপনার আমার গ্যাঁটের টাকা ভিসা বা মাষ্টারকার্ড হয়ে ছু মন্তরে সিধে চলে যায় মাকরঁর তোশাখানায়। হাজার হাজার মানুষের কাজ গেছে ,টোল কালেকশন আজ অত্যন্ত লাভজনক।
হায়, পুঁজিবাদী অর্থনীতির সেই সব মহান মানদণ্ড , কলেজে পড়া পারফেক্ট কমপিটিশন, লেসে ফেয়ার , ফ্রি এন্ট্রি ,ফ্রি একজিট এসবের কিছুই শিখল না পূর্ব ইউরোপ ! আজ ক্রোয়েশিয়া স্লোভাকিয়া চেকিয়া বুলগারিয়া রোমানিয়া সার্বিয়া পোল্যান্ড সেই কাস্তে হাতুড়ি মার্কা সাম্যবাদী আইনের ধ্বজা তুলে ধরেছে – সকলেই এক, গাড়ি নিয়ে এদেশে যেই ঢুকেছ তৎক্ষণাৎ কর দিতে হবে ।
পুনরায় ভ্রম নিরসনের জন্য বলে রাখি, আপনি অবশ্যই এই সব দেশে ট্রেন বা প্লেন থেকে নেমে অন্য যান বাহন ব্যবহার করতে পারেন,।মেট্রো এবং ট্রেন সস্তা , স্লোভাকিয়াতে ট্রেন তো প্রায় ফ্রি । কিন্তু গাড়ি নিয়ে মোটরওয়েতে উঠলেই আপনাকে অতিরিক্ত কর দিতে হবে।
রাজপথে রাজদণ্ড ।
পুনশ্চ : হাঙ্গেরিয়ান সরকার হালে জানিয়েছেন ভিনিয়েত না কিনে তাদের দেশের মোটরওয়েতে গাড়ি চালানোর দরুন ২০২৩ সালের প্রথম ছ মাসে তাঁরা পাঁচ লক্ষ ইউরো জরিমানা আদায় করেছেন, ন্যূনতম ফাইন আড়াইশো ইউরো । চেকিয়াতে ধরা পড়লে মিনিমাম ফাইন আটশো ইউরো , স্লোভাকিয়াতে পাঁচশ, স্লোভেনিয়াতে তিনশো থেকে পাঁচশ। একটিও টোল নাকা না বানিয়ে , কর্ম সংস্থান না করে সরকারের আয় বাড়ানোর এ এক আজব কল যার মার্গ দর্শনের ক্রেডিট প্রাপ্য এই দেশগুলির পুরনো রাজা পুঁজিবাদী অস্ট্রিয়ার !
ওয়েস্ট মিটস ইস্ট , পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের আশ্চর্য মেলবন্ধন।