পূর্ব জার্মানিতে বারো হাজার সরকারি শিল্প বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সাময়িক মালিকানা তুলে দেওয়া হয়েছে একটি ট্রাস্টের হাতে (ত্রয়হানড)। তার সর্বেসর্বা ডেটলেফ রোভেডার ও তাঁর অফিসের শ দুই কর্মী স্থির করবে কোন কারখানা বন্ধ হবে, কোনটা কোন দামে বেচা হবে, এ ব্যাপারে তাঁদের সিদ্ধান্ত ফাইনাল, কোনো আপিল করা যাবে না। লোক ছাঁটাই করতে সিদ্ধহস্ত আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিকের জ্যাক ওয়েলচকে নিউট্রন জ্যাক বলা হতো; তিনি সারা কর্মজীবনে হয়তো হাজার পঞ্চাশেক মানুষকে ঘরে ফেরত পাঠিয়েছিলেন । এবার ত্রয়হানড কর্তা রোভেডার বৈদ্যুতিক করাত হাতে মাঠে নামলেন ; তার আঘাতে এক বছরের ভেতরে দশ লক্ষের বেশি মানুষ কাজ হারাবেন। চল্লিশ বছরের কমিউনিস্ট শাসনে কেউ বেকার ছিলেন না। বার্লিন লাইপৎজিগের পথে পথে বিক্ষোভ- এ স্বাধীনতা তাঁরা হয়তো চান নি।
সে সব দূরে, অনেক দূরে কোথাও ঘটছে, আমাদের ছুঁয়ে যায় না।
আমরা সামান্য মানুষ, বোনাস ও বেতনেবাধিকারস্তু; মা ফলেসু নয়, কেন না ফলটাই আমাদের একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের অবসানে এসেছে গণতন্ত্র। , নতুন রাজনীতিটা কি? এখন কোন পার্টির শাসন? জানি না, জানবার প্রয়োজনটাই বা কি? আমাদের সে সব দেশে আসা যাওয়ার কোন বাধা নেই, কমপিটিশন নেই, ব্যবসা চলে ভালো, কেউ কোথাও আটকায় না, ভিসা লাগে না (রাশিয়া বাদে), পশ্চিমি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের স্টাইলের পান্থশালায় রাত্রি যাপন করি, ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার কম তাই গুচ্ছের ক্যাশ নিয়ে ঘুরতে হয়, এই যা। সিটি ব্যাঙ্কের শাখা অফিস চলে লন্ডন ফ্রাঙ্কফুর্টের অভ্যস্ত কায়দায়। ওয়ারশ, প্রাগ, বুদাপেস্ট, ব্রাতিস্লাভার সহকর্মীরা দ্রুত পশ্চিমি স্টাইল শেখার চেষ্টা করছেন।মনে আছে ওয়ারশ অফিসে আমার অধস্তন সহযোগী ডানিয়েল আমাকে হীরেন বলে ডাকছে শুনে কয়েকজন রীতিমত অস্বস্তিতে পড়েছিলেন।
চোখে কি ঠুলি পরানো ছিল?
পূর্ব ইউরোপের মাঠে নামার আগে দু বছর ব্রেমেনে কুর্ট আ বেখার কমানডিট গেজেলশাফট (সীমাবদ্ধ পার্টনারশিপ) নামের একটি শস্য দ্রব্য (এগ্রি কমোডিটি) ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নিয়মিত ব্যবসা করেছি। সে প্রতিষ্ঠানের মালিকের নাম হের কুর্ট আনদ্রেয়াস বেখার, এক সময়ে পশ্চিম জার্মানির সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, অশ্বারোহী এস এসের (শুতস্টাফেল, নাৎসি প্যারা মিলিটারি বাহিনী) স্টানডারটেনফুয়েরার বা মেজর। হাইনরিখ হিমলারের পেয়ারের লোক, বুদাপেস্টে আডলফ আইখমানের পাশের অফিসে বসতেন। অর্থের বিনিময়ে হাঙ্গেরিয়ান ইহুদিদের সুইজারল্যান্ডের ট্রেনে তুলে দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর প্রকল্প চালু করেন। তবে জীবনের সঞ্চয় বেখারের হাতে তুলে দিয়েও খুব কম ইহুদি সে ট্রেনে উঠেছেন। কিন্তু জমে উঠেছিল অর্থ, গয়না, হীরে, জহরতের এক বিশাল ভাণ্ডার যার নাম বেখার ডিপোজিট। ইহুদিদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন এই সুবাদে নুরেমবেরগ আদালতে কোন শাস্তি হয় নি,সসম্মানে মুক্তি পেয়ে ব্রেমেনে ফিরেছেন বেখার, বিশাল ধন সম্পত্তি অর্জন করেছেন, কিন্তু সেই ডিপোজিটের সন্ধান মেলে নি।*
এই মানুষকে সসম্ভ্রমে সেলাম করেছি , সেটা আমার কাজের অঙ্গ। তাঁর নাৎসি অতীতের কোন দায়ভাগ আমাদের ছিল না।
এস এস স্টানডারটেনফুয়েরার কুর্ট আন্দ্রেয়াস আন্তন বেখার
ব্রেমেন ও জার্মানির সফল ব্যবসায়ী কুর্ট এ বেখার
যেমন ১৯৭৭ সালে ড্রেসনার ব্যাঙ্কে ট্রেনিঙের সময়ে জেনেছি তাদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস , দেওয়ালে পুরনো ছবির গ্যালারি দেখেছি । ১৮৭২ সালে ড্রেসডেন শহরে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যাঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ইউরোপে, নিউ ইয়র্কে জে পি মরগানের সঙ্গে পার্টনারশিপ , পরে একদিন বৃহত্তম জার্মান ব্যাঙ্ক । যেটা আমাদের বলা হয় নি তা হলো এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অয়গেন গুটমান, ইহুদি, ( ১৯২০ সালে মারা গেছেন , হিটলার ক্ষমতায় আসার আগেই ); নাৎসি রাজ স্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে বার্লিনের হেড অফিসে গুটমানের স্ট্যাচু গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, ব্যাঙ্কের সমস্ত ইহুদি কর্মীকে কাজ থেকে ছাঁটাই করা হয়। নাৎসি অধিকৃত দেশগুলিতে ব্যাঙ্কের পর ব্যাঙ্ক দখলীকরন চলেছে নির্বিচারে ; ড্রেসনার নাৎসিদের পছন্দের ব্যাঙ্ক , কনসেনট্রেশান ক্যাম্প বানানোর অনেক খরচা ড্রেসনার ব্যাঙ্ক জোগাড় করেছিল। ১৯৪৬ সালে নুরেমবেরগে বিচারে তৎকালীন ব্যাঙ্ক সি ই ওর কারাদণ্ড হয় কিন্তু আজ সে সব জানার, মনে রাখার কি প্রয়োজন? এরই নাম অতীতের সঙ্গে মোকাবিলা- ফেরগাঙ্গেনহাইটসবেভেলটিগুং। শুধু জার্মানরা কেন, নিজেদের জীবনে আমরা সবাই তাই করে থাকি।
তাহলে আজ এ প্রসঙ্গ কেন?
দু সপ্তাহ আগে ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে ট্রাম্প ও পুতিনের আলোচনার প্রসঙ্গ পড়ছিলাম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ফাইনান্সিয়াল টাইমসে । কোথাও দেখি পুতিন বলেছেন “আমার বন্ধু মাথিয়াসের সঙ্গে কথা বলতে হবে“।
বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হল - মাথিয়াস? কোন মাথিয়াস?
মাথিয়াস ভারনিগ ড্রেসনার ব্যাঙ্ক ফ্রাঙ্কফুর্টের কার্ল হানস শ্লুয়ের কাছে নামটা প্রথম শুনি। ১৯৯১ সালে মাথিয়াস ভারনিগ নামক একজন জার্মান সেন্ট পিটারসবুরগে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের রাশিয়ান শাখার (পরে সাবসিডিয়ারি) লাইসেন্স এনে দেন । তিনি জানিয়েছিলেন নতুন রাশিয়াতে সেন্ট্রাল কমান্ড অবলুপ্ত; মস্কোর ক্রেমলিনে নয় , এই ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স পাওয়া যাবে সেন্ট পিটারসবুরগ মেয়র আনাতোলি সোবচাকের অফিসে। কথা বলতে হবে সেই অফিসে বিদেশি সম্পর্ক দফতরের ভারপ্রাপ্ত অফিসারের সঙ্গে।ঘটনাচক্রে মাথিয়াস তাঁকে চেনেন ।
তাঁর নাম ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিন ।
পুরস্কার হিসেবে ড্রেসনার ব্যাঙ্ক ভারনিগকে তাদের রাশিয়ান সাবসিডিয়ারির বোর্ড চেয়ারম্যানের পদে অভিষিক্ত করে; আমার বন্ধু কার্ল হান্স হলো সেন্ট পিটারসবুরগ শাখার প্রথম আধিকারিক । পুতিনের সঙ্গে তার তখন নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ ।
প্রাশিয়া দেখি নি। আমার জার্মানি পৌঁছুনর বত্রিশ বছর আগেই সে দেশটা ভূগোলের পাতা থেকে অদৃশ্য। মুজতবা আলি সায়েবের লেখায় যে প্রাশান আদব কায়দার উত্তম বর্ণনা পড়েছি- সেই সিধে দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকে হাত মেলানোর সময় মেপে মাথা ঝোঁকানো এবং অত্যন্ত পরিশীলিত জার্মানে বাক্যালাপ, তার অদব সব মিলিয়ে ওয়েসেলের কার্ল হান্স আমার দেখা সবচেয়ে সাচ্চা প্রাশিয়ান। আমাদের ফ্রান্সের বাড়িতে বসে কার্ল হান্স একদিন তার সেন্ট পিটারসবুরগের দিনগুলির গল্প করেছিল – পুতিনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ (দুজন প্রায় সমবয়েসি) কার্ল হান্সকে চমকে দিয়ে পুতিনের জার্মান ভাষণ ! যদিও তাঁর উচ্চারণ একেবারে কড়াইয়ে চুবোনো সপসপে জেকশিষ (Sächsisch)। কারণটা সহজবোধ্য । মধ্য তিরিশের কে জি বির অফিসার ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর প্রথম ও শেষ ওভারসিজ পোস্টিঙে জার্মান শিখেছেন জাকসেন প্রদেশের রাজধানী ড্রেসডেনে । প্রথম পত্নী লুদমিলা ও কন্যা মারিয়া সহ কংক্রিট ব্লকের একটি দু ঘরের অ্যাপার্টমেনটে পাঁচ বছর বাস করেছেন । দ্বিতীয় কন্যা একাতেরিনার জন্ম ড্রেসডেনে। মাইনে খুব কম , তিনি নাকি স্তাসি অফিসারদের চেয়ে কম মাইনে পেতেন। একটা গাড়ি কেনার জন্যে টাকা জমাচ্ছিলেন এমন সময় কমিউনিস্ট সরকারের পতন । সেন্ট পিটারসবুরগের তুলনায় পূর্ব জার্মানির জীবন যাত্রার মান অনেক উঁচু –এখানে অনেকের বাড়িতে লুদমিলা প্রথম ওয়াশিং মেশিন দেখেন , সেন্ট পিটারসবুরগে তিরিশটা ফ্ল্যাটের জন্য একটা লন্ড্রি খানা ছিল। ১৯৯০ সালে স্তাসির বন্ধুদের সৌজন্যে একটি সেকেন্ড হ্যান্ড ওয়াশিং মেশিন সরকারি পরিবহনে তুলে পুতিন পরিবার সেন্ট পিটারসবুরগে ফেরেন।
ভ্লাদিমির পুতিনের বয়েস আটত্রিশ । দশ বছরের মধ্যে তিনি আপন দেশের সর্বেসর্বা হবেন।

লুদমিলার কোলে দ্বিতীয় কন্যা একাতেরিনা ড্রেসডেন ৩১ আগস্ট ১৯৮৬
নতুন চাকরিতে স্তাসি অফিসারদের পিছনে দাঁড়িয়ে পুতিন
স্থানীয় ইনফরমারের টেলিফোন কানেকশান স্থাপনার জন্য স্তাসির কাছে দরখাস্ত
গল্পের শেষে কার্ল হান্স বলেছিল,
"পুতিনকে দেখে মনে হয়েছে ইনি ঠাণ্ডা মাথায় গুলি চালাতে দ্বিধা করবেন না। হলফ করে বলতে পারি, এই মানুষটির সঙ্গে একা ঘরে বসতে চাইব না (ইখ মোয়েষটে নিমালস মিট ইম ইন আইনেম তসিমার অ্যালাইনে জিতসেন)।"
সে সময়টায় অনেক চিড়িয়া মস্কো সেন্ট পিটারসবুরগে ব্যাঙ্কিং লাইসেন্সের সন্ধানে ওড়াউড়ি করছে , আর এই মাথিয়াস ভারনিগ চাইতেই পুতিন ড্রেসনার ব্যাঙ্ককে ব্রাঞ্চ লাইসেন্সের মঞ্জুরি দিয়ে দিলেন। এঁদের কি আগে থেকে কি রকমের চেনাশোনা ছিল? অবাক হয়ে ভাবি এ কথাটা তো জিজ্ঞেস করি নি ! সিটি ব্যাঙ্কে আমাদের বসেরা বলেননি, ‘খদ্দেরকে চেনো’; নো ইওর কাস্টমারের ফতোয়া ছিল না । আমাদের আশে পাশে যে ঘটনাগুলি ঘটেছে তার কোন আঁচ পাই নি কেন সেদিন ? চোখে কি ঠুলি পরানো ছিল?
একবার ফাস্ট ফরওয়ার্ড করি।
নয়ের দশকের গোড়ায় যখন সিটি ব্যাঙ্ক পোল্যান্ড থেকে স্লোভাকিয়া রোমানিয়াতে ব্রাঞ্চ খুলেছে , আমরা ফিরিওলার মতন তাদের খদ্দেরের পিছনে ধাওয়া করেছি, তখন প্রধান ড্রেসনারকে সেন্ট পিটারসবুরগ ছাড়া আর কোথাও দেখিনি। সেখানেও সে ব্যাঙ্ক কি করতো কে জানে, অন্তত আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের নামতে দেখিনি। নিউ ইয়র্কের ৩৯৯ পার্ক এভিনিউ থেকে এসে কোথাকার এক ভুঁইফোড় সিটি ব্যাংক হামলে পড়ছে যে বাজারে ,সেটা জার্মান সীমান্তের সাত হাত দূরে! নিত্যি ঘটছে পালা বদল , তাদের হুঁশ নেই? জার্মানদের চেয়ে পূর্ব ইউরোপ আর বেশি কে চেনে? ভালোয় মন্দয় মিলিয়ে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, আজকের গোটা পোল্যান্ড দেশটা ছিল এককালের প্রাশিয়া! তাহলে আমরাই কি কিছু না বুঝে মুখ্যুর মতন গভীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছি আর বিচক্ষন জার্মানরা ফ্রাঙ্কফুর্টের নিরাপদ দূরত্ব থেকে কোন সঞ্জয় মারফত পূর্ব ইউরোপের বাজারি যুদ্ধের আঁখো দেখা সুরত-এ- হাল শুনছেন?
গডফাদার ভিতো করলিওনে বলেছেন বন্ধুর পাশাপাশি থাকো , কিন্তু থাকো শত্রুর আরও কাছাকাছি (স্টে ক্লোজ টু ইওর ফ্রেন্ডস ,বাট স্টে ক্লোজার টু ইওর এনিমি)। এমন সময় শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বীর দুর্গ থেকে সাড়া পাওয়া গেলো। ড্রেসনার ব্যাঙ্কের য়োখেন মলারের ফোন - সামাজিক সৌজন্য বিনিময়ের পরে সে জানালো পূর্ব ইউরোপে আমাদের গতি বিধি তারা কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করে যাচ্ছে। তবে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের হাতে এমন একটি ম্যানডেট আছে যা আমাদের পিলে চমকে দিতে পারে (দিখ ফেরর্যুকট মাখেন) সেই ডিলের বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিল, চেয়ারে বসে আছো তো? না হলে পতন ও মূর্ছার সম্ভাবনা! ঋণগ্রহীতা - গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম ,মালিকানা সরকারি অতএব কর্পোরেট নয় একেবারে রাশিয়ান স্টেট রিস্ক, মেয়াদ সাত বছর, পরিমাণ ১.৭৫ বিলিয়ন ডলার।
এই কালজয়ী ডিলের বিস্তৃত বিবরণ আছে আমার পূর্ব ইউরোপের ডায়েরির প্রথম খণ্ডে তার খুঁটিনাটি বর্ণনা এখানে অবান্তর। এতো দিন বাদে আমার প্রশ্ন অন্য –সিটি ব্যাঙ্ক যখন পূর্ব ইউরোপের আন্তর্জাতিক ঋণের বাজারে মত্ত সিংহের ধারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সে সময়ে ড্রেসনার ব্যাঙ্ক এমন ম্যানডেট পেলো কি করে ? তিরিশ বছর আগে ভাবি নি , তখন ফিয়ের পরিমাণ হিসেব করেছি । এবার সেই রহস্যের উদ্ধার হলো। গাজপ্রম ডিলের পিছনে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের কোনো তুখোড় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কারের মার্কেটিং এলেম ছিল না , ছিল স্তাসির এক ক্যাপ্টেনের হাত ।
তাঁর নাম মাথিয়াস ভারনিগ।
মাথিয়াস আরটুর ভারনিগের জন্ম ১৯৫৫ সালে, কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির ব্রানডেনবুরগ প্রদেশে , ১৮ বছর বয়েসে জার্মান যুব সঙ্ঘের সদস্য (ফ্রাইয়ে ডয়েচে ইউগেনড, নাৎসি আমলে - হিটলার ইয়ুথের সাম্যবাদী সংস্করণ); তাঁর সমবয়েসি এক তরুণী , আঙ্গেলা মেরকেল সেই দলের খাতায় নাম লিখিয়েছিলেন। তারপরে সোশ্যালিস্ট ইউনিটি পার্টি ( সংবিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনার জন্য নির্ধারিত একমাত্র দল ) মেম্বার , বিশ বছর বয়েসে স্তাসির অ্যাকটিভ কর্মী, ইকনমিকস গ্র্যাজুয়েট , মস্কোতে স্পাইং, বিশেষত ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসপিওনাজ প্রশিক্ষণ, ব্যাঙ্কিং বিদ্যা ও সে বিষয়ে গুপ্তচর বৃত্তির ট্রেনিং। গুরুগৃহে শিক্ষা সম্পূর্ণ হলে স্তাসি তাঁকে পাঠায় ডুসেলডরফে পশ্চিমি, বিশেষ করে জার্মান ব্যাঙ্কিং ব্যাপারটা বুঝে নিতে। মাত্র পঁচিশ বছর বয়েসে তিনি জার্মান গণতান্ত্রিক রিপাবলিকের ডুসেলডরফ ট্রেড মিশনের ভারপ্রাপ্ত অফিসার ; পরের পাঁচ বছর তিনি নানান পশ্চিমি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির পারস্পরিক লাভজনক ব্যবসায়ের বিষয়ে আলোচনা করেন, যেমন মানহাইমের কেমিক্যাল কোম্পানি বি এ এস এফ , ডুসেলডরফের থুসেন ক্রুপ এবং প্রধানত ড্রেসনার ব্যাঙ্ক। তাঁর অফিস ছিল গ্রাফ আডলফ স্ত্রাসেতে , ঘটনাচক্রে আমাদের সিটি ব্যাঙ্কের অফিসের অনতিদূরে ! তাঁর মুখোশটি এমন মজবুত , তাঁর কল্পিত সি ভি এমনই জবরদস্ত যে হয় সেটি কেউ খুঁটিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেন নি অথবা বুন্দেসক্রিমিনাল আমট তাতে কোন ফাঁক খুঁজে পান নি। মাথিয়াস ভারনিগ পশ্চিমে এসেছেন ১৯৮০ সালে, নাগাদ, কাঁটাতারের বেড়া উঠেছে তখন, , লাল নীলের ঠাণ্ডা লড়াই তুঙ্গে । পারস্পরিক সন্দেহ এবং অবিশ্বাস প্রতি পদে ।
১৯৭৯ সালে পশ্চিম জার্মানির হিরশবেরগ সীমান্ত চৌকি দিয়ে বার্লিনের ট্রানজিট অটোবানে ওঠার সময়ে রক্ষীরা আমাদের পকেট, সিটের তলা, বুট, গাড়ির নিচ অবধি তন্ন তন্ন করে দেখেও কোন বেআইনি বস্তু পেলেন না । তাঁরা জানতেন এ পথে আমাদের কোথাও থামা নিষিদ্ধ ( যদিও তার ব্যত্যয় করে আমরা হেরমেসডরফে যাত্রা ভঙ্গ করেছিলাম )। কিন্তু বার্লিনের চেক পয়েন্ট চার্লি দিয়ে পূর্ব বার্লিনে ঢোকার সময়ে আমাদের পুরো গাড়িটির খানা তল্লাশির সময়ে ফোপো ( ফোলকসপোলিতসাই , জনতার পুলিশ) একটি অবৈধ বস্তুর সন্ধান পেলেন ; আমার বগলের বিলড খবর কাগজটি (ইংল্যান্ডের সান ম্যাগাজিনের র সমতুল্য, যাবতীয় কেচ্ছা কেলেঙ্কারির দৈনন্দিন ফিরিস্তি) বাজেয়াপ্ত হলো । সারা দিনের ভিসা, পূর্ব বার্লিনের যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করবো , তখন এই পুঁজিবাদী দেশের জার্মান ট্যাবলয়েডটি পূর্ব জার্মানির কোন সাম্যবাদী সরল নিষ্পাপ নাগরিকের চোখে বা হাতে পড়লে তাঁরা মহান অক্টোবর বিপ্লবের কর্মসূচি থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে পারেন।
পূর্ব থেকে পশ্চিমে আসার সময়ে এ ধরনের কড়াকড়ি ছিল না। কিন্তু জার্মান আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা দফতর তো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলত না। তাহলে কি করে মাথিয়াস ভারনিগ জার্মান বুন্দেস ক্রিমিনালআমটকে কলা দেখিয়ে ডুসেলডরফ মানহাইমে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এসপিওনাজ চালিয়ে গেলেন? মাত্র ছ বছর আগে ভিলি ব্রান্ডের সেক্রেটারি গুইনটার গিওমের ধরা পড়ার কাহিনী তো ততদিনে বাজারে রীতিমত চাউর। তাহলে কি পশ্চিমের গোয়েন্দা দফতর জানতো ভারনিগের ট্রেড মিশনের তকমাটি ছদ্মবেশ মাত্র ? তারা জানতো কোন শুভ উদ্দেশ্যে ভারনিগ পশ্চিমে হাজির হয়েছেন? খুঁটোয় বাঁধা গরুকে লম্বা দড়ি দিচ্ছিল, এ লঙ রোপ ? ১৯৯১ সালে ভারনিগ যখন ড্রেসনার ব্যাঙ্কের হয়ে সেন্ট পিটারসবুরগের মেয়র আনাতোলি সোবচেক ও ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনা করছেন তার ট্রান্সক্রিপট কি পশ্চিমে চালান হচ্ছিল? ডাবল এজেন্ট ?
উত্তর মেলে না ।
১৯৯০ সালে বার্লিন দেওয়ালের পতন ও রাজনৈতিক পালা বদলের সঙ্গে সঙ্গে স্তাসির যাবতীয় কর্মী বাহিনী যখন তাঁদের পুরনো ইউনিফরম পুড়িয়ে ফেলে সাদা শার্ট গায়ে গলাচ্ছেন, ভারনিগের ডাক পড়ল পূর্ব জার্মানির অর্থনীতিকে নবজীবন দেওয়ার কাজে ব্রতী ত্রয়হানড নামক ট্রাস্টে। তাঁর স্তাসি অতীত, কে জি বির সঙ্গে মাখামাখি, ডুসেলডরফের গোয়েন্দাগিরির রেকর্ড কোন বাধা হলো না। অবিলম্বে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির অর্থনৈতিক সম্মিলনের বিষয়ে এক হাই পাওয়ার মিটিঙে বন শহরে ভারনিগের আলাপ হলো ড্রেসনার ব্যাঙ্ক সি ই ও হের রোয়েলারের সঙ্গে । তিনি ভারনিগকে বললেন আপনি খানিক রাশিয়ান জানেন আপনার পূর্ব ইউরোপে কানেকশান আছে, সেন্ট পিটারসবুরগে একটা ব্যাঙ্কিং লাইসেন্স জোগাড় করে দিন না ! তাঁকে অভয় দিয়ে মাথিয়াস ভারনিগ হয়তো বলেছিলেন, কাজটা হয়ে যাবে। সেখানে ঠিক লোককে জানি।
১২ই ডিসেম্বর ১৯৯১ ড্রেসনার ব্যাঙ্ক সেন্ট পিটারসবুরগ অফিসের দ্বার উন্মুক্ত হলো । আজ আমার মনে কোন সন্দেহ নেই ১৯৯৫ সালে তিনিই দেখিয়েছিলেন আরেক ভেল্কির খেলা. ঠিক মতন জায়গায় কলকাঠি নেড়ে তিনি ড্রেসনার ব্যাঙ্ককে এনে দিলেন গাজপ্রমের এক বিশাল অর্থায়ন প্রকল্প- সে যাবত কেবল রাশিয়া বা পূর্ব ইউরোপ নয়, সারা দুনিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলির( এমারজিং মার্কেট ) সবচেয়ে বড়ো ডিলের ম্যানডেট ।

ভলফগাংগ রোয়লার, ড্রেসনার ব্যাংক সি ই ও, যিনি ভারনিগকে নিযুক্ত করেন
অর্থনৈতিক জগতে পলিটিকাল মার প্যাঁচ , ষড়যন্ত্র সব দেশে সব যুগেই চলে এসেছে। কিন্তু আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি নিয়ে এবং আমাদের চেনা মার্কেটিঙের প্রথা অনুযায়ী ভেবেছিলাম ড্রেসনার ব্যাঙ্কের ধুরন্ধর ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কাররা হয়তো মস্কো সেন্ট পিটারসবুরগে গাজপ্রমের সঙ্গে আলাপ আলোচনা, একশটা স্লাইড দেওয়ালে বিচ্ছুরিত করে এক ফাইনান্সিং প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেটি গাজপ্রম বোর্ড অনুমোদন করে। একটা খটকা মনে অবশ্যই জেগেছিল- এত বড়ো ঋণের জন্য কোন পাবলিক টেন্ডার না হোক দুটো চারটে ব্যাঙ্ককে আলাদা করে ডেকে দর দাম করে কোন অফার নেওয়া হলো না কেন? পূর্ব ইউরোপ সম্বন্ধিত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় অপরিচিত ড্রেসনার ব্যাঙ্ক ঋণের যে সম্ভাব্য পরিমাণ, মেয়াদ এবং সুদের প্রতিশ্রুতি দিলো সেটিকেই মেনে নেওয়া হলো? অচেনা বা স্বল্প পরিচিত ঋণ গ্রহীতা আন্তর্জাতিক বাজারে আত্মপ্রকাশ করেন কম মেয়াদে, অল্প ঋণ তুলে, ভীরু পদক্ষেপে। এক্ষেত্রে গাজপ্রম এলো এক প্রকাণ্ড পরিমাণ এবং দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের দাবি নিয়ে। জানি য়োখেন মলার যখন আমাদের ফোন করে সেও সন্ত্রস্ত ছিল- ১৭৫ কোটি ডলার বাজার থেকে তোলা সহজ কথা নয় । এটি কি বাণিজ্যিক প্রকল্প না পুতিন/ ইয়েলতসিনের আদেশ পালন ? কোন ভরসায় ড্রেসনার নিজের গলায় ফাঁস পরতে রাজি হয়েছিল ?
১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এক উষ্ণ মধুর দুপুরে ফ্রাঙ্কফুর্টে ড্রেসনার ব্যাঙ্কের পুরনো বাড়িতে সেই অকল্পনীয় সফল ঋণ স্বাক্ষরের দিনে সভাগৃহে সমবেত চব্বিশটি ব্যাঙ্ক , প্রেস, টি ভি । বাইরে লাগানো ডজন দুয়েক ফ্ল্যাগ পোস্টে ব্রাসেলসের ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন দফতরের কায়দায় উড়ছে বিশটা দেশের পতাকা । প্রটোকল ভেঙ্গে কিছু রাজপুরুষ ও রাজদূত বাণী দিলেন । নতুন দিগন্তের আহ্বান শোনা যাচ্ছে কোথাও, একটা নতুন কিছু ঘটছে আমরা সেই উদ্দীপনার অংশীদার , আবেগকে পোষ মানানো যায় না।
প্রায় চুয়াল্লিশ বছর আগে জার্মানির সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ, পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম স্থল অভিযানের কাহিনী একটা ফুট নোট মাত্র।