চেক ইন হয়ে গেছে, বোর্ডিং কার্ড নিয়ে এগুচ্ছি ইমিগ্রেশনের দিকে, এবারের মতো কলকাতা বাস হলো শেষ ।
এক কর্মকর্তা আমাদের পাসপোর্ট নিরীক্ষণ শুরু করলেন; স্ত্রী পুত্র কন্যার ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিঃশব্দে ফিরিয়ে দিলেন। এবার আমার পালা। নীল বর্ণ অশোক স্তম্ভ ছাপ মারা ভারতীয় পাসপোর্টটি তিনি খুঁটিয়ে দেখেন, পাতার পর পাতা উলটে যান; সে সময়ে পাসপোর্টে জায়গা না থাকলে অতিরিক্ত পৃষ্ঠা জুড়ে দেওয়ার চল ছিল। এক সময় থামলেন ।
- আপনার জার্মান ভিসা কোথায় ?
-নেই। ইংল্যান্ডে কাজ করি, বাংলাদেশ বিমানে কলকাতা থেকে লন্ডন ফিরছি ; সে প্লেন প্রথমে যাবে ঢাকা , সেখানে কয়েক ঘণ্টা বিরতি , প্লেন বদল। তারপর একবার থামবে ফ্রাঙ্কফুর্টে । সেখানে যাত্রীদের ওঠানামা শেষ হলে উড়বে ইংল্যান্ড পানে। ফ্রাঙ্কফুর্টে যারা নামবেন না তাদের ঠায় বসে থাকতে হবে প্লেনে, ডিউটি ফ্রিতে কিছু কেনা কাটার সুযোগ অবধি নেই। আমার জার্মান ভিসার কি প্রয়োজন? আসবার সময় হিথরোতে কেউ দেখতে চান নি, তাহলে এখন কেন?
- অল্প সময়ের জন্য হলেও এ প্লেন ফ্রাঙ্কফুর্টে নামছে। জার্মান ট্রানজিট ভিসা না থাকলে আপনাকে এই ফ্লাইটে চড়তে দেওয়া যাবে না।
-বিমান যে ইতিমধ্যে এয়ারলাইন্সের দায়িত্ব অনুযায়ী সব দেখে শুনেই আমাকে বোর্ডিং কার্ড দিয়েছে । কোন প্রশ্ন তোলে নি।
-সেটা বিমানের উচিত হয় নি। জার্মান ট্রানজিট ভিসা ছাড়া আপনি এ ফ্লাইটে যেতে পারেন না।
স্ত্রী পুত্র কন্যা ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছে না। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাত বছরের ঐন্দ্রিলা বললে, বাবা তুমি কি আমাদের সঙ্গে আসবে না ?
কথা বার্তা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি স্ত্রীকে বললাম , তোমরা এই প্লেনে ঢাকা যাও। সেখানে তো ঘণ্টা পাঁচেকের বেশি ওয়েটিং। আজ যদি সময়মত ভিসার ব্যবস্থা করতে পারি, ঢাকায় দেখা হবে। নইলে আর কি, তোমরা ভালোয় ভালোয় লন্ডন পৌঁছোও, আমি ভিসা জোগাড় করে নতুন টিকিট কেটে যাবো। এরা অবশ্য রিফানড দেবে বলে মনে হয় না।
পাসপোর্ট চেকিং -এর দোরগোড়ায় হাত তুলে তাদের বিদায় জানালাম। দু বছরের ইন্দ্রনীলের মুখে কোন কথা নেই।
দাদা বউদি আমাদের নামিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। সে আমলে মোবাইল নেই । কোন মতেই তাঁদের উদব্যস্ত করব না।
অতঃপর?
ভিসা জোগাড় করে ঢাকা পৌঁছে আজকের লন্ডনগামী বাংলাদেশ বিমানের সেই প্লেন ধরা যেতে পারে কি? সেখানে অনেকগুলো প্রশ্নচিহ্ন মুখব্যাদান করে আছে।
জার্মান কনসুলেট যদি স্থান বদল না করে থাকে তাহলে যেতে হয় আলিপুরে এক নম্বর হেসটিংস পার্ক রোডে। তেরো বছর আগের একদিন সেখানে শেষ গেছি, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কাজে ফ্রাঙ্কফুর্টে প্রথম বছরের বসবাসের অনুমতি সহ ভিসার অনুমতি পত্র সংগ্রহ করতে।
এখন বেলা এগারটা বাজে। কনসুলেটের ভিসা দফতর খোলা থাকবে কতক্ষণ ?
আজ বিকেলে কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার কোন প্লেন আছে কি যেটা ধরে আমি সেই লন্ডন ফ্লাইট ধরতে পারি ? (১৯৯০ সাল- তখন ঘণ্টায় ঘণ্টায় প্লেন হাওয়ায় উড়ত না) ।
যদি ফ্লাইট থেকে থাকে তার টিকিট কোথায় পাবো ? তারা কি ক্রেডিট কার্ড নেবে? পকেটের টাকায় কুলোবে?
আমার বাংলাদেশি ভিসা নেই – ট্রানজিটের জন্য কি সেটা লাগে? আবার কি সেই চক্করে পড়বো ?
বিদ্যুৎচমকের মতন রিতা কুমারের কথা মনে পড়ল। তিনি তখন সিটি ব্যাঙ্ক চৌরঙ্গির ব্রাঞ্চ ম্যানেজার গৌতম মজুমদারের সেক্রেটারি। অসম্ভব করিতকর্মা মহিলা, আজকের গুগলের চেয়ে কিছু কম ছিলেন না। এয়ারপোর্টের টেলিফোন বুথ থেকে রিতাকে ফোন করে আমার দুঃখের বারোমাস্যা জানালাম। রিতা আমার ভাবনা বাড়ালেন না, একি বিপদ, কি হবে ইত্যাদি অনুষঙ্গ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে জানালেন জার্মান কনসুলেট সেই পুরনো ঠিকানায় আছে; আপনি এখন সেদিকে ধাবিত হন। ভিসা পেলেই খবর দেবেন। রেস্ট ইজ অন মি - ইফ দেয়ার ইজ এ ফ্লাইট টু ঢাকা দিস আফটারনুন, ইউ উইল বি অন ইট। নাউ রাশ।
আমার মতন সতত বিভ্রান্ত মানুষকে জীবনের অন্ধকার পথের মোড়ে আলোক বাতি দেখানোর জন্য কেউ যেন করুণাময় মানুষদের মোতায়েন করে রেখেছেন । তার ইঙ্গিত অনেকবার পেয়েছি ।
কাঁটাকলে অর্থনীতির ক্লাসে অসীমদা (ডক্টর অসীম দাশগুপ্ত ) হ্যারড ডোমার গ্রোথ মডেল পড়াতেন। সেই বিশাল ভয়ানক ব্যাপারটা এক ধাক্কায় ঘাড়ে না চাপিয়ে হাঁটি হাঁটি পা পা করার মতন বলতেন , দেখ এটা হলো স্টেপ ওয়ান। বুঝলে তবে এগুবে, স্টেপ টু !
আমার পরিবারের বাকি তিন সদস্যকে নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের হেফাজতে রেখে টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে নিজেকেই বললাম
স্টেপ ওয়ান – ট্যাক্সি ধরো।
পাওয়া গেল শেয়ারের ট্যাক্সি, সে ট্যাক্সি সোজা আলিপুর যাবে না। তার প্রাথমিক গতি চিড়িয়া মোড় অভিমুখে, তারপর খদ্দের পেলে শ্যামবাজার হয়ে চৌরঙ্গি। সেখানে পৌঁছলে চালককে বললাম আলিপুর মুখো কাউকে যদি না পান, মিটারে যা উঠবে তার ডবল দেবো। বেজায় ঠেলায় পড়েছি ।
-আচ্ছা চলুন, আলিপুরে কোথায় যাবেন ?
-এক নম্বর হেসটিংস পার্ক রোড, জার্মান কনসুলেট। আপনি মিটার ডাউন করে অপেক্ষাও করতে পারেন। বেশিক্ষণ লাগবে না।
-তার পর কোথায় যাবেন ?
-কনসুলেট থেকে বেরিয়ে এসে জানাবো। ততক্ষণ আমার ব্যাগটা একটু দেখবেন।
ইংরেজিতে হাইট অফ এক্সপেকটেশন বোধ হয় একেই বলে । কতক্ষণে সেখানে পৌঁছুব কনসুলেট খোলা না বন্ধ , ভিসা মিলবে কিনা কে জানে ! সেখানে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রাখব!
এক নম্বর হেসটিংস পার্ক রোডের দ্বার রুদ্ধ। ফোকর দিয়ে মুখ বের করে প্রহরী জানালেন বারোটায় অফিস বন্ধ হয়ে গেছে । কনসুলেট কাল নটায় আবার খুলবে। আমি কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করলাম, জানি । কিন্তু একবার আপনাদের কোনো সায়েব বা মেম সায়েবের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেবেন? কি বুঝলেন জানি না। তিনি অত্যন্ত দ্বিধাভরে একটা বোতাম টিপলে এক ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো , জানতে চাইলেন কি প্রয়োজন। পাহারাওলা কিছু বলার আগে আমি সরাসরি সেই মহিলাকে জার্মানে বললাম সুপ্রভাত , আমার ভীষণ সঙ্কট । লন্ডন যাবো কিন্তু আপনার দেশের ট্রানজিট ভিসা নেই বলে আমাকে প্লেন থেকে নামিয়ে দিয়েছে । আমার স্ত্রী কন্যা পুত্র থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে আপনার দ্বারস্থ হয়েছি । আমাকে দয়া করে একটা ট্রানজিট ভিসা দেবেন ?
তিনি অনায়াসে বলতে পারতেন, আগে আসেন নি কেন? আমার অফিস বন্ধ, লোকজন নেই। আমি এই খেতে বসেছি, কাল আসবেন।
পাঁচ সেকেন্ডের নীরবতা। এবার ইন্টারকমে মহিলা প্রথমে প্রহরীকে ইংরেজিতে বললেন একে ভেতরে আসতে দিন। তারপর আমাকে জার্মানে বললেন, লন পেরিয়ে সোজা যে দরজাটা পাবেন সেটা ঠেলে চলে আসুন । আমার সহকারীরা এখন কেউ নেই , কাগজপত্র, স্ট্যাম্প কোথায় আছে খুঁজতে হবে । ভাববেন না, আমি ট্রানজিট ভিসা দিয়ে দেব ।
প্রহরীকে অনুরোধ করলাম আমি যদি ঢুকতে পারি, ট্যাক্সিওলা কি অন্দরে আসতে পারে? তিনি একজিকিউটিভ ডিসিশন নিলেন , বললেন ঠিক আছে।
লন পেরিয়ে একটা পেল্লায় ঘরে ঢুকলাম, অনেক উঁচু সিলিং। নির্ঘাত হেসটিংসের ভূত এখানে রাতের বেলা ঘোরাফেরা করে । বিশাল টেবিলের অন্যপ্রান্তে এক মধ্যবয়েসি মহিলা একা বসে আছেন, মুখে মৃদু হাসির রেখা। আশে পাশের ডেস্ক গুলো জনশূন্য। বললেন, বসুন। কি ঘটনা সংক্ষেপে বলুন দেখি। যদি সময় থাকে।
বাড়িয়ে চড়িয়ে কথা বলার সনাতন অভ্যেস ত্যাগ করে একটা সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দিলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, থাকেন লন্ডনে, জার্মান শিখলেন কোথায়?
জানালাম ফ্রাঙ্কফুর্টে থাকতাম আগে , আমার জার্মানের ভুলত্রুটির জন্য গোয়েথে ইনসটিটিউট নয় একমাত্র আমিই দায়ী! তিনি আবার হাসলেন, ইন্টারকমে আপনি একটা মজার শব্দ ব্যবহার করলেন, ইখ বিন আউসগেলাদেন ওয়রডেন*! যেন জাহাজ থেকে মাল নামানো হচ্ছে ! আপনার সমস্যাটা আমার কাছে প্রাঞ্জল হয়ে গেল!
সেটা কি আর ভেবে বলা? গোরু হারালে এমনি হয়। এখন আমাকে ভিসা দিয়ে উদ্ধার করো মা জননী!
হাতের কাছে পাঁচটা সাগরেদ না থাকলে অনেক বড়ো সায়েবকে পঙ্গু হয়ে যেতে দেখেছি। এঁকে দেখলাম এ টেবিল সে টেবিল ঘুরে ভিসার লেবেলের কাগজ আর স্ট্যাম্প জোগাড় করলেন। যদিও তিনি কোন ইচ্ছে প্রকাশ করেন নি তবু তাঁকে লন্ডনের ফ্লাইট টিকেট দেখালাম।
ট্যাক্সি ড্রাইভার বললেন, এবার ?
-টেলিফোন বুথ।
জজ কোর্ট রোডের কোনায় পাওয়া গেল বুথ। ভিসা পেয়েছি জেনে রিতা বললেন দু ঘণ্টার ভেতরে ফ্লাইট আছে । আমি বলে দিচ্ছি তারা টিকেট রেডি রাখবে । ওরা চেক করে নিয়েছে , ঢাকা লন্ডন ফ্লাইটের বেশ খানেক আগেই পৌঁছে যাবেন। সিনক্লেয়ার বিমানকে জানিয়ে রেখেছে আপনি কলকাতা থেকে অন্য ফ্লাইটে ঢাকা পৌঁছে সেই লন্ডনের প্লেন ধরবেন। সিধে মির্জা গালিব স্ট্রিটে সিনক্লেয়ারের অফিসে চলে যান।
একটা সুর রিয়ালিসটিক ছবির মতন ঘটনাগুলো ঘটছে যেন ।
সিনক্লেয়ারের অফিসে যেতেই দেখি টিকেট প্রস্তুত । গ্যাঁটের টাকায় তার দাম মেটানো গেল।
নিচে নামতে ট্যাক্সি ড্রাইভার বললেন, বলতে হবে না সার, এবার এয়ারপোর্ট !
দমদমে নামিয়ে দেওয়ার সময় তিনি গভীর সহানুভূতির সঙ্গে বললেন, ভালো ভাবে যাবেন সার, যা ঝক্কি গেলো।
বাংলাদেশ বিমানে চেক ইন করার সময়েও মনে সংশয় – আমার পকেটে বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা যাবার ওয়ান ওয়ে টিকেট । সে দেশের ভিসা নেই , বাংলাদেশের ট্রানজিট ভিসা লাগবে না তো ?
বিমানের ডেস্কে জিজ্ঞেস করলাম । মহিলা আমাকে আশ্বস্ত করলেন, কোন চিন্তা নাই সার। আপনে প্লেন থেকে নেমে সিধা ট্রানজিট ডেস্কে গিয়া ঢাকা- লন্ডনের টিকেট দেখাইলেই বোর্ডিং কার্ড পেয়ে যাবেন । তারা আপনের কেসটা জেনে গেছে।
ইমিগ্রেশনের লোক কোন প্রশ্ন করলেন না।
দমদমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ট্যাক্সি ধরা থেকে ভিসা ও টিকেট নিয়ে ফিরে আসার সময় সীমা – তিন ঘণ্টার কম।
কি ভাগ্যে কলকাতা লন্ডন ফ্লাইটে ঢাকায় প্রায় ছ ঘণ্টার গ্যাপ ছিল !
ঢাকা এয়ারপোর্টে প্রতীক্ষা কক্ষের সোফায় আধো ঘুমে আচ্ছন্ন ছেলে মেয়ে জেগে উঠে যখন দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল মনে হল সমস্ত দিনের শেষে সেটাই আমার সেরা পাওনা !
পুনশ্চ:
প্রায় পাঁচ দশকের নিরন্তর ভ্রমণে আমার পাসপোর্টগুলি ভরে গেছে নানান দূতাবাসের অজস্র ভিসার ছাপে। আজ মনে হয় অন্য কোথা নয়, অন্য কোনো দেশে নয় , এই কলকাতায়, আলিপুরে শীতের স্তব্ধ দুপুরে সুপ্রাচীন হর্ম্য মণ্ডিত অট্টালিকায় নির্জন বিদেশি কনসুলেট অফিসে দয়াময়ী এক জার্মান মহিলার স্বাক্ষরিত বিনামূল্যের এই ট্রানজিট ভিসাটি আমার সবচেয়ে মহার্ঘ্য সঞ্চয়।
*মাল তোলার ক্রিয়াপদ লাদেন ( laden – ইংরেজি to load), মাল নামানো আউসলাদেন, পুরাঘটিত হলে আউসগেলাদেন ; নির্জীব বস্তুর (inanimate object ) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য । আমি সজীব প্রাণী তাই এক্ষেত্রে ‘আউসগেলাদেন’ শব্দের ব্যবহার ব্যাকরণ বিরোধী, কিন্তু ভাষার প্রতি এই দুরাচারকে তিনি সম্ভবত আর্ষ প্রয়োগ ধরে নিয়ে বললেন , দারুণ বর্ণনা দিয়েছেন ( গান্তস গেনাউ বেশ্রিবেন )!