পূর্ব পশ্চিম ৪

বাদ বেরকায় প্রাতরাশ
জার্মান সানাটোরিয়ামে রোগীর সঙ্গে বাইরের লোকের দেখা সাক্ষাৎ করা অনুমোদিত, কিন্তু সে বিষয়ে বেশ কিছু কড়াকড়ি আছে। ভিজিটরদের দৌড় রিসেপশন অবধি । সে আইনকে কলা দেখিয়ে অবশ্য অরটউইন একদিন নিয়ে গেল তার ঘর দেখাতে ; ফাইভ না হোক ফোর স্টার হোটেলের সমতুল্য সেটি ! অধিকন্তু ,সম্পূর্ণ ফ্রি ! তবে অতিথি হিসেবে সানাটোরিয়ামের ডাইনিং রুমে বসে চা রুটি খাওয়া যায় না। কারণ কি? তাদের ভাঁড়ারে কি চাল মাপা থাকে ? অন্ন অকুলান ? আমাদের দেশের মতো বাড়িতে হঠাৎ অতিথি এসে পড়লে কেউ বলেন না , খেয়ে যেও। যেমন এই সেদিন আমাদের বংশের আদি বাড়ি সিউর গ্রামে অনাহুত হয়ে হাজির হয়েছিলাম ,আমাদের জ্ঞাতি সঞ্জয় সিংহ বললেন, বসে যান, আজ বাড়তি চাল নেব !
অরটউইন বললে , এটা হোটেল নয় যে তুমি আরাম করে বসে এটা সেটা অর্ডার করবে ! অধিবাসীদের জন্য লাঞ্চ ডিনারে দু রকমের মেনু থাকে , এদের রেস্তোরাঁয় কোন বিলিং সিস্টেম নেই! এখানে খাবে ও খাওয়াবে সানাটোরিয়ামের লোক , তার যাবতীয় খরচা দেবে জার্মান সরকার । এই পদ্ধতি নির্দিষ্ট হয়ে আছে বিসমার্কের আমল থেকে, এখানে বন্ধু বান্ধব নিয়ে গজল্লা করার ইজাজত নেই । তবে সেই বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বেরুনো অনুমোদিত। তার জন্য আগাম এত্তেলা দিতে হবে এবং সঠিক সময়ে ফিরতে হবে।

খাবার ঘর বাদ বেরকা
মনে পড়ল বহু বছর আগে সিসিলির সিরাকুজাতে ( যেখানে আরকিমিডিস অয়রেকা বলে হুংকার দিয়েছিলেন) সস্তায় খাবার জায়গা খুঁজছি শ্রীধর আর আমি। গরমের দিন , সিসিলিতে ৩৫ ডিগ্রি কোন আলোচনার বস্তু নয় । এমন সময় দেখি একটা ক্যান্টিনের মতো জায়গায় ভেতরে ও বাইরে লম্বা লম্বা বেঞ্চের দু পাশে অনেক লোক খাচ্ছে , বসে পড়লাম । টেবিলের মাঝে কার্ডবোর্ডে লেখা ১ পিতসা মারগারিতা ২ লাসানিয়া । উদিপির মতো মনে হল । যিনি অর্ডার নিতে এলেন কেবল জানতে চাইলেন উনো , দুয়ে ? শ্রীধর তামিল ব্রাহ্মণ মারগারিতা তার মনের মতন,লাসানিয়ার লাবণ্য আমার প্রাণে। খাওয়ার পরে দাম দিতে গিয়ে সমস্যা হলো। ডেস্কের মহিলা প্রথমে ভীষণ অবাক হলেন। তিনি খাবারের সাপ্লাই লাইন ম্যানেজ করেন, ক্যাশ ম্যানেজ করেন না । নিতান্ত দুর্বোধ্য ইংরেজিতে জানালেন , দাম নেওয়া যাবে না । এই ক্যান্টিন সিরাকুজা রেল স্টেশনের ও রেল কর্মীদের জন্য , বাইরের লোকের জন্য নয়। অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখালেন লেখা আছে Solo Ferroviari!
খাওয়া হয়ে গেছে। কি আর করা যাবে ? দাম দিতে হবে না জেনে দুই বুভুক্ষু দরিদ্র ভারতীয়কে অন্ন যোগানোর জন্য সদাশয় ইতালিয়ান সরকার ও তাদের রেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানিয়ে গেলাম শহর দর্শনে ।
অরটউইনকে বললাম তোমাদের খাওয়ার ঘরে খাবার জুটবে না । চলো বাইরে কোথাও ব্রেকফাস্ট করে বাদ বেরকার জি ডি পি বাড়াই !
দেশটার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সাড়ে চার দশকের সম্পর্ক, আজ বলতে দ্বিধা নেই জার্মানির ছোট শহর ও গ্রামের সামান্য কাঠের ওপরে এক পলতা কুশন আঁটা চেয়ারে ভরা পাব বা রেস্তোরাঁ আজও আমার সবচেয়ে প্রিয়।
আমার বাদ বেরকা আসা নিয়ে তার বাবার শঙ্কার কথা অরটউইনকে জানালাম , আমি যেন বাদ বেরকা বা থুরিঙ্গেনে সাবধানে ঘোরাঘুরি করি , একা কখনই যেন না বেরুই। ব্রাউন শার্ট *পরা লোকজন নাকি পথে ঘাটে দেখা যাচ্ছে । শার্টের অন্য রঙ হলেও হতে পারে , কিন্তু ধারণকারির চেহারা, মতলব পরিচিত।
প্রসঙ্গত , আমাদের দেশে হলে ‘তোমার বাবা ‘ নয়, বলতাম কাকা বা জ্যাঠা মশায় বলেছেন কিন্তু জার্মান কেন পশ্চিম ইউরোপের কোন ভাষায় সে সুবিধে নেই । বড়জোর বলা যায় আঙ্কল ক্রাইবিখ; সেটা বেজায় খাপছাড়া শোনায় , অতএব তোমার বাবা অথবা হের ক্রাইবিখ ।
অরটউইন বললে , আমাকেও ফোন করেছিলেন। একটা অন্য কথা জিজ্ঞেস করি । হেলা মশকশকে মনে পড়ে ?
১৯৭৮ সালের জুন মাসে অরটউইনের অধীনে ফ্রাঙ্কফুর্টের ২৬-২৮ নম্বর গোয়েথেস্ত্রাসের দোতলায় স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বৈদেশিক বিভাগে যোগ দিয়েছি । যেখানে বসি তার উলটো দিকে প্রায় কোনাকুনি একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি জানলার ধারে বসতো হেলা , অসম্ভব মনোযোগ সহকারে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বিভিন্ন কারেন্সি অ্যাকাউনটের হিসেব মেলাত, সেটা এক জটিল কাণ্ড ! পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি জাবদা খাতায় হেলা আট দশটা কারেন্সিকে লাল নীল রঙ দিয়ে রেখেছিল – তাতে নাকি গুনতির সুবিধে ! হেলার বাড়ি ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে পাঁচশ কিলো মিটার উত্তরে, প্রায় হল্যান্ডের লাগোয়া নর্থ সির বন্দর ভিলহেলমসহাফেন।
ভিলহেলমসহাফেন একটি মিলিটারি পোর্ট। যদি কারো মনে থাকে , সাউনড অফ মিউজিক ছবির ক্যাপ্টেন ফন ট্রাপকে অস্ট্রিয়ার নাৎসি সরকার এইখানে রিপোর্ট করার নির্দেশ দিয়েছিল, যেটি এড়াতে তিনি মারিয়া ও সাত ছেলে মেয়ে নিয়ে অস্ট্রিয়া ছেড়ে পালালেন।
এতো জায়গা থাকতে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ফ্রাঙ্কফুর্ট কেন ? একমাত্র কারণ তার স্বামী ফ্রাঙ্কফুর্টে একটি ল ফারমে কাজ পেয়েছে, সে নিজে কাজ খুঁজতে গিয়ে স্থানীয় কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করেছিল নানান জায়গায়। প্রথম জবাব আসে স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে ! তাই !
হঠাৎ হেলার কথা উঠল কেন ?
- চাকরির ইন্টারভিউতে কাজের বিষয়ে আলোচনা শেষ হলে সরল বিস্ময়ের সঙ্গে হেলা আমাকে বলেছিল ভিলহেলমসহাফেন থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট হাউপটবানহফে ( মেন স্টেশন ) ট্রেন থেকে নেমে সে প্রথম অশ্বেতকায় বর্ণের মানুষ দেখেছিল । মানুষের যে এতো রকমের রঙ চেহারা হতে পারে ! বিভ্রান্ত হবার জোগাড়। ভিলহেলমসহাফেনের জনসংখ্যা ফ্রাঙ্কফুর্টের আট ভাগের কম, ৯৮ শতাংশ মানুষ ভিলহেলমসহাফেনের দশ কিলোমিটারের মধ্যে জন্মেছে , বড়ো হয়েছে , মারা গেছে ! সেখানে অন্য চেহারা, বর্ণের মানুষ একমাত্র টেলিভিশন বা সিনেমায় দেখা যায় ।
- শুনেছি ইম্যানুয়েল কান্ট নাকি কোনিগসবেরগ থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটারের বেশি দূরে কখনো যান নি । প্রসঙ্গটা কি ?
- ফ্রেমডেনআনগসট ( অপরিচিতের ভীতি )। অচেনা, অজানার সংশয়। ফ্রাঙ্কফুর্টে আসার আগে হেলা অন্য রঙের মানুষ দেখে নি। দেখার পরে প্রথমে কি ভেবেছে ? মনে জেগেছে শঙ্কা , ভয় ? এরা কারা ? কেমন লোক জন ? স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ফ্রাঙ্কফুর্ট ব্রাঞ্চে এসে তোমার, শ্রীধরের মতো ভারতীয়দের সঙ্গে কাজ করে বুঝেছে তার ভয়টা হয়তো অমূলক ছিল । তবে সেটা একদিনে কেটে যায় নি, সময় লেগেছে ।
চল্লিশ বছর আজকের পূর্ব জার্মানির সদর দরোজা ছিল বন্ধ , এরা কোন অশ্বেতকায় মানুষ প্রায় দেখেনি । বিদেশি বলতে রাশিয়ান পোলিশ চেক হাঙ্গেরিয়ান, সেখানে ভাষার পার্থক্য আছে , বর্ণভেদ নেই। এখানে রাস্তায় বেরুলে মানুষ তোমাকে অন্য চোখে দেখবে। আমার বাবার ভাবনাটা এখান থেকেই শুরু। তবে সেখানেই বোধহয় শেষ নয়, শুরুটাও বাবার জানা !
থুরিঙ্গেনের সেকাল ডাইনে সাজো 
পারলামেনট ভবন এরফুরট
থুরিঙ্গেনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন ভিলহেলম ফ্রিক।
১৯২৩ সালে মিউনিকে হিটলারের ব্যর্থ বিয়ার হল অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন; সেই অপরাধে পার্টি ব্যান হলে তিনি পরের বছর নাশিওনাল সোতসিয়ালিসটিশে ফ্রাইহাইট বেভেগুংগ ( জাতীয় সমাজতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন - নাৎসি পার্টির এক সাময়িক ছদ্মনাম ) দলের টিকিটে ভোটে জিতে বার্লিনের রাইখসটাগে আসন গ্রহণ করেন। হিটলার জেল থেকে ছাড়া পেলে এবং নাৎসি পার্টির ওপরে ব্যান উঠে গেলে তাদের টিকিটে ১৯২৮ সালে পুনরায় সাংসদ নির্বাচিত । ঠিক সে সময় থুরিঙ্গেনের প্রাদেশিক নির্বাচনে কোন দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দল নাৎসিদের সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়। ভিলহেলম ফ্রিক তার শর্ত হিসেবে স্বরাষ্ট্র দপ্তরটি দাবি করেন এবং মন্ত্রী হন।**
মনে রাখা দরকার , সে অবধি ভুঁইফোড় নাৎসি পার্টি প্রাদেশিক সরকার কেন, কোন পৌর সভা নির্বাচনে অবধি ক্ষমতা দখল করতে পারে নি । দেশের বহু অঞ্চলে , যেমন হামবুর্গ , ব্রেমেনে পার্টির অস্তিত্ব ছিল না বলা চলে। ছলে বলে কৌশলে তারা যে কোন স্তরে ক্ষমতায় আসতে উদব্যস্ত । তাই নাৎসিদের উত্থানের ইতিহাসে থুরিঙ্গেনের এই মিলিজুলি সরকারে অংশ নেওয়াটা একটি ল্যান্ড মার্ক ,এই প্রথম তারা কোন শাসন যন্ত্রের স্টিয়ারিং হইলে হাত দেবার অধিকার পেলো। ।
গৃহ মন্ত্রী হয়েই ভিলহেলম ফ্রিক কমিউনিস্ট ও সকল প্রকার নাৎসি বিরোধী মতবাদ দমন শুরু করেন । রাস্তায় , গলির মোড়ে ঝটিকা বাহিনী নিয়মিত তাদের পেটায় , সুযোগ মতন জেলে ভরে , পার্টি লাইনের বাইরে চলে গেলে খবর কাগজের প্রকাশ বন্ধ হয় । সাংস্কৃতিক শোধন শুরু হল - মাত্র কয়েক বছর বাদে সারা দেশে যা ঘটবে তার ট্রেলার থুরিঙ্গেনে দেখা গেলো ; এরিখ মারিয়া রেমারকের কাহিনি অবলম্বনে চিত্রায়িত ইম ভেসটেন নিখটস নয়েস ( অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট) ছবিটি ‘শান্তিবাদি’ অভিযোগে নিষিদ্ধ হয় ।
১৯৩১ সালে ফ্রিক মন্ত্রীর গদি হারান। ততদিনে থুরিঙ্গেন তুচ্ছ , নাৎসি পার্টি গোটা দেশের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখলের পথে অনেক এগিয়ে গেছে । বার্লিনের পাড়ায় পাড়ায় কমিউনিস্টদের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ অন্য দিকে রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের সঙ্গে গোপন বোঝা পড়া।
বিশের দশকে নাৎসি স্লোগান ছিল –‘ আজ জার্মানি , কাল গোটা দুনিয়া ‘ ( হয়টে ডয়েচলানড , মরগেন ডি ভেলট ) বিশ্বজয়ের প্রথম ডঙ্কা নিনাদ ।
আজ থুরিঙ্গেন আগামীকাল জার্মানি ! থুরিঙ্গেন আজ যা ভাবে , জার্মানি ভাবে আগামীকাল !
অতীতের সঙ্গে মোকাবিলা পূর্ব ও পশ্চিমে এটি তো অতীতের কথা ! কিন্তু থুরিঙ্গেনের কাহিনির পুনরাবৃত্তি হয়েছে সারা দেশে। ১৯৪৫ সালের পর থেকে জার্মান ভাষায় একটি শব্দ মুখে মুখে ফিরেছে , ফেরগাঙ্গেনহাইটসবেভেলটিগুংগ , অতীতের সঙ্গে মোকাবিলা ।
যা ঘটে গেছে তাকে ফেরানো যায় না, ইতিহাসকে নতুন করে লিখে ফ্ল্যাশ ব্যাকে প্লট বদলে দেওয়ার চেষ্টা বৃথা কারণ ১৯৩২-১৯৪৫ এই বারো বছরের জার্মান কাহিনি বিশ্ববিদিত । তাহলে যুদ্ধের পরে যারা বেঁচে রইলেন এবং পরবর্তী প্রজন্ম তারা কি এই যুদ্ধের , জার্মান নৃশংসতার , পিতার পাপের বোঝা ( সিনস অফ ফাদার ) বয়ে চলবে অনন্তকাল? চাইবে না কি নতুন দিগন্ত , স্লেটের লেখা মুছে ফেলে নতুন আঁক কষতে ? এটি একটি কঠিন অধ্যবসায়ের কাজ যা আমি দেখে চলেছি কয়েক দশক । মনে রাখা ভালো অত্যন্ত অন্তরঙ্গ পরিচয় না থাকলে এক পাত্তর বিয়ারের পর আপনি কোন জার্মানের সঙ্গে ‘আচ্ছা তখন ঠিক কি ঘটেছিল ‘ এসব নিয়ে গল্প করতে পারেন না। অনেক কিছু উহ্য থেকে যায়, যুদ্ধ ঘটানোর দায় যেমন ছিল, তার শাস্তিও পেয়েছে এ দেশ , রাষ্ট্রের সীমানা খণ্ডিত , গ্রহণ করেছে চেক পোল্যান্ড বালটিক দেশগুলি থেকে বিতাড়িত পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ ।
তাই বলে হৃদয় খোঁড়ার কী প্রয়োজন।
অপরিচিতের সান্নিধ্যে জাগে অস্বস্তি , সেটি নিতান্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া । বাদ বেরকা এসে ইস্তক চোখে পড়েছে , একটা সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। সেটা আমার ঠিক অচেনা নয় , মাত্র দু বছর আগে লিথুয়ানিয়ার গ্রামে একটি মুদির দোকানে ঢুকে পড়ে এমনি চাউনির মুখোমুখি হয়েছি । এখানে , এই থুরিঙ্গেনে আমি একাকি আবির্ভূত হই নি , এক ব্লনড জার্মানের সঙ্গে ঘুরছি, ভাষাটা বলি , ভদ্রগোছের গাড়ি চালাচ্ছি , উড়ে এসে কোথাও জুড়ে বসিনি । সরল কৌতূহল নিতান্ত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া, শঙ্কা নয় । যেমন জার্মানিতে এসেই দু দিন বাদে ভাষা শিক্ষা করতে গেছি ইজারলোনে – আমার বয়স্কা গৃহকর্ত্রীর বান্ধবীরা জানতে চেয়েছেন , আমার গায়ের রঙ কি সূর্যের আলোয় ট্যান হয়ে যাওয়া ? আমার হাত ধরে পরীক্ষা করেছেন। আমাদের বীরভূমের গ্রামে “বিরেনা গাঁয়ের “ ( অন্য গ্রামের ) মানুষ এসে আটচালায় বসলে দু চারজন দাঁড়িয়ে যেতো। তাদের চোখে কৌতূহল ছিল, ভীতি ছিল না।
তাহলে কেন শঙ্কিত কেন হের ক্রাইবিখ ? তিনি তো এ অঞ্চলে আসেন নি পঞ্চাশ বছর ।
সম্ভবত ফিশারের বইতে পড়েছিলাম , ১৯৪৫ সালের ৮ই মের ( ফ্রান্সের রেমস শহরের একটি স্কুল বাড়িতে শর্ত বিহীন আত্মসমর্পণ) পরে জার্মানিতে নাৎসি পার্টির কোন সদস্য খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল। জিজ্ঞাসিত হলে অনেকে বলেছেন নাৎসি? সে কে বা কারা ? তাদের চিনি না । পালের গোদাদের শাস্তি হল , এই তো যথেষ্ট , বাকিরা, ধর্মাবতার, সম্পূর্ণ নির্দোষ। তবু কয়েক বছর ডি নাৎসিফিকেশন প্রোগ্রামের ইন্টারভিউ চলে । সেখানে প্রায় সকলেই ফুল মার্ক্স নিয়ে পাস করে আপন পেশায় ফিরে গেলেন। এইখান থেকেই ফেরগাঙ্গেনহাইটসবেভেলটিগুংগ শুরু ; সব তো চুকে বুকে গেছে সেটা থাকুক না অতীতে।
৭৩ বছর বয়েসে যুদ্ধোত্তর জার্মানির হাল ধরলেন নতুন চ্যান্সেলর কনরাড আদেনআউয়ার, সমাজের সকল স্তরে যে যা করতেন ,বিচারক, কোম্পানির সি ই ও, পুলিসের দারোগা , সেই কাজে পুনর্বহাল হলেন, পেনশন মঞ্জুর হল যুদ্ধে নিহত নিখোঁজ সৈন্যের পরিজনদের । যুদ্ধের বিভীষিকা সে অন্য কোন দিনের ঘটনা ( হামবুর্গে বলে স্নে ফন গেসটার্ন , গতকালের তুষার )। আদেনআউয়ার যাকে চিফ সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত করেন তাঁর নাম হান্স গ্লোবকে । গ্লোবকে কট্টর নাৎসি, আইনবিদ , ১৯৩৫ সালে নুরনবেরগ জাতি সংক্রান্ত আইন ও তার পরিবর্ধনের রচয়িতা, যার ফলে ইহুদিদের সামাজিকভাবে একঘরে করা হয় । তিনি এমন আইন প্রণয়ন করেন যা অনুযায়ী সব নবজাত ইহুদি সন্তানের নাম হবে ইজরায়েল, কন্যার নাম হতে হবে সারা, যা থেকে তাদের ধর্ম চেনা যায় । বাকিটা ইতিহাস । এমন বর্ণময় মানুষকে চিফ সেক্রেটারি পদে বসানো হল কেন ?
আদেনআউয়ার বলেছিলেন যতদিন পর্যন্ত পরিষ্কার জল না পাওয়া যাচ্ছে, নোংরা জলেই কাজ চালাতে হয় ।
নেতা বা রাজনীতির পট পরিবর্তনে নেতৃত্ব বদল হয়, প্রশাসন নয় । ১৯৩২ থেকে ১৯৪৫ সালে জার্মানিতে তার ব্যতিক্রম দেখা গেছে ,আই এ এস পরীক্ষা পাস করা নয়, কেবলমাত্র রাজনৈতিক ভাবে সম চিন্তক , হামরাহিদের স্থান হয়েছে সেখানে ( হয়তো পৃথিবীর আরেকটি দেশে তেমনটা ঘটছে এখন ), স্টেট মেশিনারি চালনা করেছেন নাৎসিদের প্যারা মানুষ । ১৯৪৯ সালে নতুন সংবিধান কার্যকরী হলে আদেনআউয়ার চাইলেন প্রশাসনের ধারাটি যেন বিচ্ছিন্ন না হয় , বিধ্বস্ত দেশের প্রয়োজন কনটিনিউটি অফ অ্যাডমিনিসট্রেশন । সেক্ষেত্রে কার বাবা কার ভাই কটা ইহুদি মেরেছে, পোল্যান্ডের খেত জ্বালিয়েছে সে হিসেব করতে গেলে দেশ গঠন করা যায় না ।
তার মানে কি অতীতের ওপরে ইরেজার চালিয়ে নতুন ছবি আঁকা ? আমি যুদ্ধ শেষের তিন দশক বাদে পশ্চিম জার্মানি আসি, জার্মান রেডিও এবং টেলিভিশনকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ বিভীষিকা বর্ণনায় সঙ্কুচিত হতে দেখি নি । ১৯৭৭ সালে দশ পর্বের একটি ডকুমেনটারি দেখি , তার নাম ফোর ফিয়েরতসিগইয়ারেন , চল্লিশ বছর আগে । জার্মান নিউজরিল , ব্রিটিশ ফরাসি রাশিয়ান টি ভি থেকে সংগৃহীত বিশাল ফুটেজ , জার্মান বর্বরতার নির্মম ছবি । ১৯৭৮ সালে জার্মান স্টেট টেলিভিশন হলোকষ্ট নামের পাঁচ পর্বের একটি একান্ত সত্যনিষ্ঠ আমেরিকান সিরিয়াল ( জারমানে ডাব করা ) দেখায় । নাৎসিদের হাতে , গ্যাস চেম্বারে ইহুদি ভাইস পরিবারের মৃত্যু যাত্রা । তখন মনে হয়েছে অতীতের মোকাবিলা করতে হলে অতীতকে যে জানা দরকার সেটা পশ্চিম জার্মানি হয়তো অস্বীকার করে নি । অথচ দেশ এবং মানুষের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে জেনেছি পশ্চিম জার্মান স্কুলের ইতিহাস ক্লাসে নাৎসি পিরিয়ড শুধু ছুঁয়ে যাওয়া হতো , গভীরে কখনোই নয়- শিশুদের মাথার ভেতরে অপরাধবোধের গজাল ঠুকে দেবার কি প্রয়োজন ? ( এখন অবশ্য সেটা খানিক বদলেছে, যদিও ক্লাসরুমে ১৯৩২-১৯৪৫কে গুরুত্ব দেওয়া হয় না )।
পূর্ব জার্মানির স্কুলের শিক্ষা অন্য রকমের । সেখানকার পাঠক্রম অনুযায়ী নাৎসি দর্শন কার্যকলাপ অত্যন্ত নিন্দনীয় , অমানবিক । মাননীয় নেতা এরিখ হোনেকার সহ বহু কমিউনিস্ট নাৎসিদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন ; প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়েছে, নাৎসিরা ক্ষমতা দখল করে তাদের ওপরে অত্যাচার চালায় বারো বছর যাবত । ইহুদি হত্যা, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প , পোল্যান্ড ইউক্রেন রাশিয়ায় তাণ্ডবের জন্য নাৎসিরা দায়ী , পূর্ব জার্মানি নয় । নিতান্ত ভাগ্যের বশে রাশিয়ান ভাইয়েরা এসে নাৎসি দুঃস্বপ্ন থেকে দেশকে বাঁচিয়েছে ।
এবার , ১৯৪৯ সালের পরে কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ – তাদের দেশকে রক্ষা করতে হবে ভেতরের ও বাইরের শত্রুর হাত থেকে !
কি ভাবে ?
রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা নজরবন্দি নাগরিক 
স্তাসি লোগো
রাষ্ট্রের সুরক্ষার স্বার্থে সকল প্রকার সংবাদ সংগ্রহের জন্য ১৯৪৯ সালে জার্মান ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক স্থাপনার সঙ্গে সঙ্গে একটি মহান প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়, তার সরকারি নাম রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা মন্ত্রণালয় ( মিনিসটিরিউম ফুয়ের স্টাটসজিখারহাইট) লোকমুখে স্তাসি। রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার অর্থ কেবল কুচক্রী বিদেশি শক্তির হাত থেকে নয়, নিজের দেশের নাগরিকদের ওপরে কড়া নজর রাখাটাও অত্যন্ত জরুরি । ইন্টারনেট ইউ টিউব না থাকলেও এই প্রোজেক্টের দুটো ব্লু প্রিন্ট মজুদ ছিল তাঁদের সামনে - একটি জার্মান , তিরিশ বছর আগে তৈরি নাৎসিদের গেস্টাপো ( Geheime Staatspolizei) দ্বিতীয়টি বন্ধু দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কে জি বি ( Komitet Gosudarstvennoy Bezopasnosti- কমিটি ফর স্টেট সিকিউরিটি ) । তবে স্তাসি সেটাকে চিরাচরিত জার্মান তৎপরতায় অন্য লেভেলে নিয়ে যায় । শত্রু কেবল সীমান্তের ওপারে বসে বন্দুক বা মিসাইল তাক করছে না, নানান ছলে তারা পূর্ব জার্মানির খেটে খাওয়া শ্রমিক ও কৃষকদের মহান সাম্যবাদী উদ্দেশ্য থেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিদেশে কে কোন প্ল্যান আঁটছে তা জানতে পাঠানো হবে পূর্ব জার্মান গোয়েন্দাদের , তেমনি নজর রাখতে হবে নিজের দেশে প্রতিটি নাগরিকের ওপরে - কারা কাদের সঙ্গে মেলা মেশা করে , বিদেশি পত্রিকা ,বই পড়ে, কমিউনিস্ট সমাজ বিরোধী চিন্তা বা সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদের জল্পনা করে করে, সবচাইতে বিপদজনক, শ্রমিক কৃষকের স্বর্গরাজ্য ছেড়ে অবক্ষয়ী পশ্চিমে পলায়ন করবার স্বপ্ন দেখে । এ কাজ সরকারি আমলা , বেতনভুক চর ,পাড়ার পুলিস থানার গোয়েন্দা দিয়ে শুধু হয় না , অনেক বেশি মানুষের ওপরে অনেকগুলো চোখ রাখা সহজ কাজ নয় ; কেউ কোন গোল পাকানোর আগেই একটা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের আচরণ থেকে তার ভাবনার পরিমাপ করে নিতে হবে । ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে তাদের পিতা মাতা মহান অক্টোবর বিপ্লবের সাম্যবাদী পথ থেকে বিচ্যুত হচ্ছেন কিনা, আপিসে তাঁরা এক রকম সেজে থাকেন কিন্তু বাড়িতে বসে গোপনে রেডিও ফ্রি ইউরোপ শোনেন কি (পারিবারিক সূত্রে জানি রোমানিয়ার সিকিউরিতাতে একই কর্ম পদ্ধতি অনুসরণ করেছে ) ? শুধু সরকারি মাইনেতে পোষা গোয়েন্দা নয়, নিজস্ব সংবাদদাতা খুঁজে নিতে হবে বাড়িতে বাড়িতে – ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো ! একটা হিসেব পাওয়া যায়, কোন দেশে নাগরিকের পিছনে অন্তত কতজন ইফরমার ছিলেন ; নাৎসি জার্মানিতে প্রতি ২০০০, সোভিয়েত ইউনিয়নে ৫,৮২৭ এবং পূর্ব জার্মানিতে ৬৩ জনের ওপরে নজর রাখার জন্য একজন সংবাদ দাতা ছিলেন ।
আজকের জার্মানিতে অতি দক্ষিণ পন্থি দল এ এফ ডি ( জার্মানির জন্য বিকল্প ) মাত্র তেরো বছরের মধ্যেই রীতিমত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার কারণ খুঁজতে গেলে স্তাসির কর্মকাণ্ডটি কিঞ্চিত অনুধাবন করাও প্রয়োজন। । ১৯২৮-১৯৩৩ সালের জার্মানিতে যেমন একদিকে দেখা গেছে অতি দক্ষিণ নাৎসিদের কর্মবর্ধমান জনপ্রিয়তা তেমনি অন্যদিকে ছিল বলিষ্ঠ বামপন্থী আন্দোলন, সে আমলে কমিউনিস্ট পার্টি অফ জার্মানি সারা ইউরোপের বৃহত্তম বামপন্থী দল।
আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে আমার থুরিঙ্গেনের দিন গুলিতে কি তাদের আগমনের প্রথম হ্রেষা ধনি শুনেছিলাম ?
ক্রমশ :
*নাৎসি ইউনিফরম ছিল ব্রাউন; সেটা কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনা থেকে উৎপন্ন হয় নি। আউত কুটুরও (haute couture) নয় । প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দেশে অনেক কিছুর অভাব; কিন্তু সেই অভাবের মধ্যেও কেউ কেনে না বলে ব্রাউন কাপড়ের থানের দাম ছিল কম । পার্টির অর্থ অকুলান, টাইট বাজেট , তাই স্থির হয় ব্রাউন কাপড় দিয়ে ইউনফিরম বানানো হবে ! ১৯৩২ সালের পর যখন নাৎসি পার্টির ক্যাডারের সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে তখন ব্রাউন কাপড়ের থানের চাহিদা ও মূল্য দুটিই আকাশছোঁয়া !

পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।