ভোটের দিন ও তারপরের দিন
আমাদের গ্রাম ন্যাপহিলে ভোট নেওয়া হয় স্থানীয় স্কাউট ক্লাবের মাঝারি গোছের একটা ক্লাসরুমের ভেতরে। সেখানে মুখোমুখি দুটি বেঞ্চ পাতা , কয়েকটি চেয়ার , মধ্যিখানে মতদানের দুটি ঘেরাটোপ । দু পাশে দুটো নোটিস বোর্ড, সেখানে মতদাতাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ব্যালট সংগ্রহ করতে হবে তার ঠিকানা অনুযায়ী। কোন পথে বাড়ি ? এ থেকে কে বাঁ দিকে,ডানদিকে এল থেকে জেড। আমাদের রাস্তার নাম লিটলউইক রোড , অতএব দক্ষিণ পন্থা ধরে হাজির হলাম বেঞ্চের ওপাশে অধিষ্ঠিতা মহিলার কাছে। তিনি প্রথমে জানতে চাইলেন রাস্তার নাম পরে আমার নাম । এবারে প্রমান করতে হবে আমিই সে ! সোহম !
ভোটার তালিকায় নাম থাকলে ইলেকশানের দু সপ্তাহ আগে বাড়িতে একটা কার্ড আসে। তাতে ভোটার নম্বর , ভোটিং বুথের ঠিকানা লেখা । ভোট কেন্দ্রে সেটা দেখালেই ব্যালট পেপার পাওয়া যায় , যথাস্থানে টিক দিয়ে বাকসোয় ফেলে দিলে মতদান কর্ম সম্পূর্ণ হয়। কয়েক বছর আগে অবধি কোন পরিচয় দেখাতে হতো না , কার্ডই আমার প্রমাণ পত্র । কার্ড ছাড়াও, শুধু বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে ভোট দেওয়া সম্ভব ছিল। কয়েক বছর যাবত ছবি ওলা সবুত দেখানো আবশ্যিক – পাসপোর্ট , ড্রাইভিং লাইসেন্স, লাইব্রেরি কার্ড যেটা খুশি । আজ আমি কোনোটাই আনি নি , অগত্যা আমার সিনিয়র বাস পাস দেখিয়ে ভোট দিলাম। এবারে আমাদের টেলিং এর কাজ শুরু। বুথে ঠিক ঢোকার মুখে আমার বসার জন্য নিজের হাতে চেয়ার নিয়ে এগোয়ে এলেন প্রিসাইডিঙ অফিসার স্বয়ং । ইতিমধ্যে অন্য দুই যুযুধান পক্ষ মঞ্চে আবির্ভূত : লেবার পার্টির প্রতিনিধি ড্যান সাম্পসন এবং কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী সাজ হুসেন ; তিনি আমাদের স্থানীয় সাব পোস্ট মাষ্টার। বারো বছর যাবত জিতে আসছেন এই সিটে । এবার লিবারাল ডেমোক্র্যাট দলের নিশানায় আছেন তিনি। আমাদের ক্যান্ডিডেট জন পিয়ারস প্রথম ভোট যুদ্ধে নেমেছেন , তিন টার্মের সিটিং কাউনসিলরকে হারানো যে শক্ত কাজ সেটা আমরা সকলেই অনুধাবন করেছি । তবু বুকে বল বেঁধে হও অগ্রসর।
লেবারের ড্যান সাম্পসনের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল চট করে , তাঁর মা রোমানিয়ান । বুখারেসট শহর নিয়ে গল্প হলো – বর্তমানে সে শহর ইউরোপের টুরিস্ট তালিকার শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে। এমন সময়ে স্থানীয় প্রকাশক জন ডেভিস এলেন । আমাদের কেউ চা কফি দেয় নি দেখে তাঁর গাড়ি নিয়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ কোথা থেকে কাগজের কাপে কফি যোগাড় করে আনলেন। কিন্তু এতো আয়োজন যাদের জন্য সেই ভোটার কোথায় ?
সকাল থেকে অন্ধকার হয়ে আছে আকাশ। কে বলবে এটা মে মাস? বুথের ভেতরে ছ জন কর্মী, হলে আমরা চারজন। শুধু ভোটার কম পড়িয়াছে! অনেকদিন আগে দেশে দেখা একটা ছবি মনে পড়ে গেল – আই এস জোহরের একটা কলাম ছিল ফিল্ম ফেয়ারে , তাতে কার্টুন :ফার্স্ট ক্লাস কামরায় একজন যাত্রী বসে আছেন তাঁকে ঘিরে কন্ডাক্টর , চা ওলা সহ আরও কয়েকজন। নিচে মন্তব্য - উই অলওয়েজ হ্যাভ মোর পিপল সারভিং ওয়ান কাসটমার !
এক ঘণ্টায় পাঁচজন ভোট দিলেন। আমার বদলি সাইমন এলে আমার দু ঘণ্টার ছুটি হলো।
পরের স্টপ মেবেরি সেন্টার, কানালসাইড । এটি একটি ছোটো খাটো কনফারেন্স হল এবং লাইব্রেরি । উওকিং হিস্টরি সোসাইটির সদস্য হিসেবে মাসের প্রথম সোমবারের মিটিঙে আসি , তাই বেশ চেনা । ব্যবস্থা চমৎকার । বুথের ঠিক বাইরে একটা টেরাসে চেয়ার টেবিল পাতা, তার একটি দখল করা গেল সহজেই। কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কোথা থেকে চা কফি আসতে থাকে কাগজের কাপে । মুহুর্মুহু মতদাতা আসছেন , তাল দেওয়া ভার । উৎসবের আবহাওয়া । লেবার দলের হয়ে টেলিং করছেন একজন, আমার উলটোদিকে । তাঁর হাতে মোবাইল ফোন , প্রায় সর্বদা মেসেজ আসছে ,মাঝে মাঝেই উঠে যাচ্ছেন কথা বলতে । ফিরে এসে জানতে চাইছেন তিনি কোন কোন ভোটারকে মিস করলেন, তাঁদের নম্বর গুলো যদি তাঁকেও জানিয়ে দিই! এ ব্যাপারে সমস্ত প্রতিযোগী দলের মধ্যে একটা সমঝোতা থাকে , আমরা এ তথ্য শেয়ার করি । আলাপ হলো, নাম তালাত। এক সময়ে বললেন ‘ নিজের ব্যবসা আর টেলিং এ দুটো একসঙ্গে সামলানো বেশ কঠিন ব্যাপার । জানেন সকাল আটটা থেকে এখানে বসে আছি ! কখন যে কেউ এসে আমাকে ছুটি দেবে জানি না ‘ অবাক হয়ে বললাম, ‘ সে কি ! আপনার ডিউটি শিট নেই ?’ তালাত হেসে বললেন, ‘ ডিউটি শিট ? আমার শালা তাহির ইলেকশন লড়ছে ! তার সেবা করাটাই আমার ডিউটি !’
লাল (লেবার ) এবং হলুদ (লিব ডেম) হাজির কিন্তু নীলের(কনজারভেটিভ ) দেখা নেই । দেওয়াল লিখন তাঁরা ভোরবেলায় পড়ে নিয়েছেন।
ভোটাররা বেশির ভাগ আমাদের উপ মহাদেশের কোন না কোন দেশ থেকে এসেছেন । বুথে ঢুকবার পথে অত্যন্ত ভদ্র ভাবে অনেকে তাঁদের ভোটার কার্ড আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন , আমরা জানালাম ওটা মতদানের পরে দেবেন। দুজন ভোটদাতা নীরবে আমার কোটের হলুদ ব্যাজটি ছুঁয়ে ইশারা করে জানালেন তাঁরা কাকে ভোট দেবেন ! এ ধরণের কোন বাক্যালাপ অবশ্যই নিষিদ্ধ, তবু জেনে ভালো লাগল! পরিবেশটি ভারি সুন্দর , বাংলা হিন্দি উর্দু গুজরাতি শোনা যায় চতুর্দিকে। সম্পুর্ন অপরিচিত ভোটার সামনে এসে দাঁড়ান ; ‘ সেলাম আলায়কুম’ , ‘ কেমন আছেন’ ‘কেম ছো ‘ ইত্যাদি নানান সৌহার্দ্য বিনিময় হতে থাকে । ছোটো কমিউনিটি , অনেকে পরস্পরকে চেনেন, রীতিমত উৎসবের হাওয়া চলছে যেন । দু একজন আবার গল্প জুড়ে দেন, যেটা ঠিক কেতাব সম্মত নয় ।
আমি বদলি টেলারের আশায় আছি, লুইজার ফোন এলো । আমার পরবর্তী স্টেশন শিয়ারওয়াটার কিন্তু আমি কি এই মেবেরিতে থেকে যেতে পারি অতিরিক্ত দু ঘণ্টা ? এমনি করে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে!
শিয়ারওয়াটারে আমাদের সদস্যা টিনার কাছে শুনলাম- তিনি ন্যাপহিলের লেবার প্রার্থীর বাবাকে কোনো সূত্রে চেনেন । সেই বৃদ্ধ মানুষটি গত কয়েক দিন যাবত একগাদা লিফলেট নিয়ে দোরে দোরে ঘুরছেন। টিনাকে সামনে পেয়ে বলেছেন , ছেলের জন্যে এই বোঝা ঘাড়ে নিতে হয়েছে ! আমার বয়েস পঁপ্রায় আশি হলো , লেবার পার্টির কোন ক্যাডার নেই। ছেলে সবটাই ধরিয়ে দিয়েছে আমার হাতে , তার নাকি লন্ডনে জরুরি মিটিং থেকে রোজ।
ভোট গণনা হবে উওকিং লেজার সেন্টারে, সেখানে প্রবেশ বাই ইনভিটেশান ওনলি, কত রাতে যে শুরু হবে জানা নেই। আমি একা বাড়িতে, কুকুরের পাহারায়। টেলিভিশনে মন দিলাম।
১৯৯৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে লেবারের ল্যান্ডস্লাইড বিজয় দেখেছি। হাওয়া কোনদিকে বইছে তার আঁচ অনেক আগেই পাওয়া গিয়েছিল। ঋষি সুনাকের কনজারভেটিভ পার্টি এবার যে গোটা দেশে সম্পূর্ণ ভোট ডুবির দিকে দ্রুত নৌকা বাইছে সেটা বুঝতে জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হতে হয় না । যেমন যেমন রাত বাড়ে , টেলিভিশনে কনজারভেটিভদের দুর্গ ভেঙ্গে পড়ার খবর আসতে থাকে । রাত তিনটে নাগাদ দেখা গেলো সারা দেশের পৌরসভা নির্বাচনে মোট কাউনসিলরের সংখ্যার হিসেবে লিবারাল ডেমোক্র্যাট দল লেবারের পরেই দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী -ইংল্যান্ডে পাঁচশোর বেশি কনজারভেটিভ কাউনসিলর তাঁদের কাউসেলিং করার অধিকার হারালেন , পার্টি হারালো বারোটি পৌরসভার মেজরিটি। লন্ডন ম্যানচেস্টার লিভারপুলে সরাসরি মেয়রের নির্বাচন হয়, লেবার জিতেছে সর্বত্র । আঞ্চলিক মেয়র নির্বাচিত হন উত্তরে টিস ভ্যালি , ইস্ট মিডল্যানডস, ওয়েস্ট মিডল্যানডস, নর্থ ইস্ট ইংল্যান্ড , ওয়েস্ট এবং সাউথ ইয়র্কশায়ার। টিস ভ্যালি বাদে বাকি গুলি জেতে লেবার পার্টি । শুক্রবার ভোরবেলায় টিস ভ্যালির পুনঃ নির্বাচিত মেয়র সবে ধন নীলমনি বেন হাউখেনকে অভিনন্দন জানাতে হেলিকপ্টারে চড়ে ঋষি হাজির হয়ে সেখানকার বিমান বন্দরের ভাষণে বললেন, আমাদের পার্টির কাছে এই বিজয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা প্রমাণ করে যে মানুষ আমাদের ওপর বিশ্বাস রাখেন। একমাত্র আমরাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে জেতে পারি । উই হ্যাভ এ প্ল্যান !
জলে ডোবার আগে খড় কুটোকে আঁকড়ে ধরার প্রচেষ্টা চিরন্তন।
সারা দেশের ভোট গণনা শেষ হতে সকাল। প্রিসাইডিঙ অফিসার একেক বার মাইক দখল করে ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড ফলাফল ঘোষণা করেন । দশটি আসনের ন’টিতে লিব ডেম বিজয়ী। সবচেয়ে বড়ো সাফল্য- বারো বছরের সিটিং কাউন্সিলর ন্যাপহিলের পোস্ট মাষ্টার সাজ হুসেনকে হারালেন স্থানীয় রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নতুন চেহারা জন পিয়ারস । তিনি ও আমি একত্রে জন গণেশের দুয়ার প্রদক্ষিণ করেছি কিন্তু ভাবতে পারি নি ষাট পেরুনো এক রিটায়ার্ড আই টি এঞ্জিনিয়ার সমাজে পরিচিত মুখ এক পোস্ট মাষ্টারকে দুশো ভোটের ব্যবধানে তাঁর আসন থেকে সরাতে পারবেন ! বোধহয় লেবার প্রধান মন্ত্রী হ্যারলড উইলসন বলেছিলেন, এ উইক ইজ এ লং টাইম ইন পলিটিক্স।
কানালসাইড ওয়ার্ডে সিটিং কাউন্সিলর তাহির আজিজ আমাদের প্রার্থী ফয়জল মুমতাজের বিরুদ্ধে ২৯ ভোটে পরাস্ত হলেন।
বাইফ্লিট ও ওয়েস্ট বাইফ্লিট আসনে লিব ডেম সমর্থিত নির্দলীয় প্রার্থী স্টিভ হাওস হারালেন সিটিং টোরি পার্টি কাউন্সিলর জশ ব্রাউনকে। একটি সম্পূর্ণ অচেনা অজানা ওয়ার্ডে ৩৪৯টি ভোট হাসিল করে মায়া তাঁর জয়ের পথ সুগম করে দিলো ।
চার বছর আগে তিরিশ জনের কাউন্সিলে তাদের ছিল ষোল জন সদস্য । এবে উওকিং কাউন্সিল কনজারভেটিভ মুক্ত।
পুঃ বুধবার তেইশে মে বিকেলে দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক সাধারণ নির্বাচনের দিন ঘোষণা করলেন- ৪ জুলাই । ফলত সব পার্টি শিবিরে রীতিমত সাজো সাজো রব পড়ে গেছে ; সামনের সাত সপ্তাহ আদা জল খেয়ে কাজ করার ঘণ্টা বেজেছে।
প্রসঙ্গত , গ্রীষ্মকালে ব্রিটেনে কখনো সাধারণ নির্বাচন হয় না - স্কুলের ছুটি, ক্রিকেট , উইম্বলডন টেনিস, ব্রিটিশ ওপেন গলফ, গ্লাইনডবোরনের অপেরা ( তার সঙ্গে যোগ করুন এবারের ইউরো ২০২৪ ফুটবল , প্যারিস অলিম্পিক ) ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন মতদাতারা। বিগত একশো বছরে এই ট্র্যাডিশনের একটি মাত্র ব্যতিক্রম দেখা গেছে:
৮ মে , ১৯৪৫ জার্মানির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কয়েকদিন বাদে প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ৫ই জুলাই নির্বাচনের দিন ঘোষণা করলেন । চার্চিল সদ্য এক বিশাল রণে বিজয়ী হয়েছেন ; ভোট যুদ্ধে কৃতজ্ঞ দেশবাসী যে তাঁকে ও তাঁর দলকে বিপুল সমর্থন জানাবেন এ বিষয়ে তাঁর মনে কোন সংশয় ছিল না।
রাত পোহালে দেখা গেল কনজারভেটিভরা হারালেন দেড়শর বেশি আসন , তাদের পিছনে ফেলে প্রথমবার পার্লামেন্টে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করল ক্লিমেনট অ্যাটলির লেবার পার্টি ( ৩৯৩-১৯৭ )।
এক ঋষি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। নিশ্চয় অনেক ভেবে চিন্তেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।