ভৌত ধর্মের নিয়মে সে ক্ষয়ে যাচ্ছে টের পায় তিতাস। তিতাস বন্দোপাধ্যায়। তার ৫ফুট ১১ ইঞ্চির শরীর থেকে একটু একটু করে চুন বালি সুরকির আস্তরণ খসে পড়ছে সে বুঝতে পারে। গভীর রাতে সে জেগে ওঠে। আর তখন তার তীব্র জলতেষ্টা পায়। ক্ষয়প্রাপ্ত বাড়ির মতো তার শরীর খুব জল টানে। জোর হাওয়া দিলে ধুলো ওড়ে। জানলা দিয়ে সে দ্যাখে রাতের অন্ধকার ভেদ করে মিটমিটে আলো জ্বেলে প্লেন উড়ে যাচ্ছে দিল্লি কিংবা জয়পুরের দিকে। কতদিন সে প্লেনে চড়েনি! মনে পড়ে না তিতাসের। আর কতদিন? এভাবে চলবে?
হিসেব করে কূলকিনারা পায় না বলে ভোর রাতে ঘুমিয়ে পড়ে তিতাসের কংক্রিট শরীর। কাছে পিঠে কোথাও ফোন বাজে। ঘুম অথবা স্বপ্নের মধ্যে কেউ ধরে নেয় সেই ফোন। ফোনের ভেতর থেকে মেয়েলি কন্ঠস্বর ডেকে ওঠে: তিতাস, তিতাস!
তার মা না বৌ বোঝা যায় না। মা চলে গেছে ৯ বছর ৩ মাস ২৭ দিন আগে। বৌ ছেড়ে চলে গেছে প্রায় দু-বছর হলো। ওর সঙ্গে নাকি থাকা যায় না।
দু-জন পাড়ার ডাক্তার ওকে দেখে শুধু ব্যথার ওষুধ আর ক্যালসিয়াম দিয়ে গেছেন। ডাক্তার রুদ্র, বিখ্যাত রিউমাটোলজিস্ট বলেছেন: এটা একটা অদ্ভুত কেস। ছবি তুলিয়েছেন। এক্স রে, এম আর আই, রক্ত পরীক্ষাও হয়েছে। এরকম একটা কেস নাকি ভূ-ভারতে আগে দেখা যায়নি। তার বক্তব্য: একটু হালকা রোদে থাকুন। গাছপালার মধ্যে থাকুন। শরীর অক্সিজেন পাবে। ন্যাচারাল অক্সিজেন থেরাপি। জলে ভিজবেন না। কড়া রোদে বেরুবেন না। তাহলেই সর্বনাশ।
তিতাস বাড়িতেই থাকে। তার পোষা বেড়াল আর গাছপালা নিয়ে।
ভোরবেলা উত্তর দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া বয়। দোতলার পাশে ঝুঁকে পড়া বেলগাছ যেন এদিক ওদিক তাকিয়ে তার ডালপালা নামিয়ে দেয় জানলার পাশে। খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা তিতাসের দেহে প্রবেশ করে টাটকা অক্সিজেন। সকালের দিকে টাটকা অক্সিজেনের প্রভাবে তিতাসকে অনেকটা মানুষের মতো দেখতে লাগে। কাগজওয়ালা বিক্রম জেঠু আর কাজের মাসি মায়া মনুষ্যজ্ঞানেই কড়া নাড়ে তিতাসের একতলার দরজায়। প্রতিদিনের মতো ভোর হয় রোজ। দরজা খোলে আর দরজা বন্ধ হয়। পাড়ার সবাই দেখতে পায় ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি লম্বা তিতাস বন্দোপাধ্যায় কালীমন্দিরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কমলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দিকে। মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বিশাল আয়নায় জিবে গজা আর গরম সিঙ্গাড়ার মধ্যে দিয়ে নিজের ভাঙাচোরা চেহারাটা একবার দেখে নেয় তিতাস। কত জায়গায় রঙ চটে গেছে। চটা উঠে গিয়ে হাড়ের কঙ্কাল উঁকি মারছে। জামা দিয়ে আর কত ঢাকা যায়।
বাড়িতে আয়না নেই। যেটা ছিল কাজের মাসি মায়া ভেঙে ফেলেছে। আপদ গেছে। মনে মনে ভাবে তিতাস।
ভাবতে ভাবতে শঙ্কুর চায়ের দোকানে বসে পড়ে। এক কাপ চা আর একটা লেড়ে বিস্কুট তার বরাদ্দ।
চা খেতে গিয়ে দ্যাখে তার দুটো কষের দাঁত ক্ষয়ে গেছে। ফলে জিভে ঘষা লাগছে আর ঠোঁটের কোনা দিয়ে গরম চা গড়িয়ে পড়ছে। সে শঙ্কুর প্লাস্টিকের জগ থেকে ঢক ঢক করে জল ঢালে গলায়। কিন্তু তার বুকের ভেতর কাঠের খাঁচা থেকে কেউ যেন ঘোর আপত্তি জানায়। টক গরম চা, জল, কাল রাতের বাসি ভাত ও ঝোল গলগল করে বেরিয়ে আসে… বেঞ্চি ও মাটির ওপর। একটু ঝুঁকে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে বমি করে তিতাস। একই সঙ্গে তার তলপেট দু-দু-বার মোক্ষম মোচড় দেয়। সে প্রাণপণে মলদ্বার সঙ্কুচিত করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর প্রাণপণে ছুটতে থাকে বাড়ির দিকে। কী অমানুষিক পরিশ্রম এই পথটুকু চলা! ঘর্মাক্ত শরীরে দোতলায় উঠে, বাথরুমে ঢুকে কমোডের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করে তিতাসের কলেবর। মুক্ত হবার ঠিক আগের মুহূর্তে সারা শরীর কাঁপিয়ে মোশন আসে এবং চলে যায়। মল ও টকে যাওয়া বাসি খাবারের দুর্গন্ধের মধ্যে তিতাস লক্ষ্য করে তার বাঁ হাতটা কেমন অবলীলায় জলশৌচ করছে আর ডান হাতটা চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে বাথরুমের এক অদৃশ্য হাতল কে ধরার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। পড়ে গিয়ে চেতনা হারাবার আগে এটাই ছিল তিতাসের শেষ পার্থিব অনুভূতি। তারপর সব অন্ধকার হয়ে যায়।
আই ডি হাসপাতালে ভর্তির আগে তিতাসের অর্ধেক মস্তিষ্ক কার্যকর ছিল। ভর্তির পর সে কার্যত অন্ধ, বধির এবং মূক হয়ে পড়ে।
তার চুনকালি সম্বলিত ক্ষয়িষ্ণু দেহটাকে একটু দূর থেকে খুব সন্দেহের চোখে দেখছিলেন ভারপ্রাপ্ত চিকিৎসক। তারপর আরো একজন ডাক্তার আসেন।
এক ঘণ্টা পর...
চিকিৎসকদের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। ডিরেক্টর ডাঃ সেন একবার এসে দেখেও যান। কিন্তু হার্টবিটের বদলে হৃদয়ের কাছে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজকে কাঠের শব্দ বলে উড়িয়ে দেন তিনি।
এরপর জেরা করা হয় বিন্তিকে। অর্থাৎ তিতাসের পরিচারিকাকে, যে ওকে হাসপাতালে নিয়ে আসে এবং ভর্তি করে।
বিন্তি বছর তিরিশের যুবতী… ৫ ফুট দুই, শ্যামবর্ণা এবং স্বামী পরিত্যক্তা।
দু-বছর হল তিতাসের বাড়িতে কাজ করছে। সে কিছুই বোঝে না। তিতাসের রোগ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। ও শুধু বলল, যে, কিছুদিন ধরে রাত্তিরে দাদা হাঁটলে খট খট করে খড়মের মতো শব্দ হত। আর দাদা বৌদি দু-বছর হলো আলাদা হয়ে গেছে। কেন, সে বলতে পারবে না। আর হাঁ, পোষা বেড়ালটাও তিনদিন ধরে পলাতক। বলে সে হঠাৎ কেঁদে ফেলে।
তিতাসের প্রস্তরীভুত দেহটাকে মানুষের শরীর বলে চেনার আর কোনো উপায় নেই। মিডিয়া আসার আগেই বডি মর্গে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে – এটা কোনো জটিল সংক্রামক ব্যাধি হতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট সকলকে ৭ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার। মিডিয়ায় খবরটা শোনামাত্র ডিরেক্টর সব ডাক্তারদের ডেকে পাঠান। ঐ দু-জন চিকিৎসক এবং মর্গের ডাঃ অধিকারীর সঙ্গে তার গোপন রুদ্ধদ্বার আলোচনা হয়। ঠিক হয় মিডিয়ার সামনে যা বলার ডিরেক্টর ডাঃ সেন বলবেন।
বাইরে দাঁড়িয়ে মুখে কাপড় দিয়ে বিন্তি কাঁদতে থাকে। তার এই কান্না অকৃত্রিম। সে যে এ মাসের শেষ দশ দিনের বেতন পাবে না তা জানা সত্ত্বেও তার চোখ ফেটে জল আসে। মাত্র তিনদিন আগে শেষবারের মতো তার সঙ্গে তিতাসের ভালবাসা হয়েছিল। একটু কাঠ কাঠ লাগলেও মনে হয়নি সে একজন কাঠের মানুষের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে। মাত্র তিনদিন। লোকটা আর মানুষ রইল না!
মেডিক্যাল বুলেটিনে ডাঃ সেন বললেন, এটা একটা বিরলতম অসুখ। এবং গুরুতর সংক্রামক রোগ ও হতে পারে। সব রকম প্রস্তুতি ও সাবধানতা নেওয়া হয়েছে। রুগির পরিচারিকা ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বাধ্যতামূলক কোয়ারান্টাইনে পাঠানো হয়েছে।
পরীক্ষাকক্ষ স্টেরিলাইজ করার কাজ চলছে।
হঠাৎ ব্রেকিং নিউজ...
একটি দুরারোগ্য ব্যাধি সঠিকভাবে শনাক্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকার ডিরেক্টর সেনকে বিশেষ ভাবে পুরস্কৃত করতে চলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, সারা বিশ্বের কাছে চিকিৎসা বিজ্ঞানে আমাদের মুখ আরো উজ্জ্বল হলো। ডাঃ সেন আমাদের গর্ব।
নিজের চেয়ারে বসে আপনমনে হাসছিলেন সেন সাহেব। চিরকাল তিনি সহকর্মী ও অসহায় রুগিদের মুরগি বানিয়ে এসেছেন। তবে এবার একেবারে জ্যাকপট লাগিয়ে দিয়েছেন। কম যোগ্যতা সত্বেও ডিরেক্টর হয়েছেন। এবার দেখা যাক কোন মুকুট তার মাথায় ওঠে। ক্রমাগত ফোন বেজে চলেছে। এবার বাড়ি থেকে…
হাসি মুখে টেবিলের উপর রাখা দামি মোবাইল ফোনটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। কিন্তু এ কী? সবিস্ময়ে তিনি তাকালেন তার ডান হাতটার দিকে। ওটা আর হাত নেই। অন্য কিছু। সভয়ে ওটাকে নাড়াবার চেষ্টা করতেই দেখলেন ওখান থেকে চুন সুরকি খসে খসে পড়ছে।
তাঁর চোখের সামনে শীততাপনিয়ন্ত্রিত চেম্বারের ঠান্ডা মেঝে বালি আর সুরকিতে ভরে গেল।