১/ কাঁটাতার
খারাপ শহর ছেড়ে ভাল শহরের দিকে একবার যাব।
যে পথ দেখাবে সেই স্বাধীনতা হারিয়েছে পথ।
রঙিন চশমা পরে বর্ডারের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিলাম।
ভিসা নেই, পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত, চোরা পথে আইনি শপথ।
প্রতিটি বুটের শব্দ প্রতীকী ও সন্দেহপ্রবণ।
সব রাস্তা বেঁকে গেছে রাষ্ট্রহীন নরকের দিকে।
প্রকৃত গাইড ছাড়া ছদ্মবেশ কোথায় লুকাব?
মামণির জন্মভিটে ডুবে
গেছে ধূসর অলীকে ...
খারাপ শহরে আমি রেখে যাচ্ছি অতিমারী, রেহানার নরকগামিতা
কিছু কিছু স্বীকারোক্তি, 'ক্যাসল' ও 'ফল' নামে দুটি বই, তেরজা ভনিতা
ভোটরঙ্গ, দুরারোগ্য ধর্মভয়, ইতস্তত খুন ও ধর্ষণ
গাইড নিজেই এক হঠকারী মৃত্যুদূত, সদ্যমৃত সন্তানের পিতা।
দেশভাগ মানে এক দিশাহীন অন্ধ কানামাছি।
এই লেখা রেহানার জন্য -- তার প্রতীক্ষায় আছি।
২/ দেশভাগ ৭৫
আজ থেকে ৭৫ বছর আগে, নুরুল সাহেব,আপনে ছিলেন ১০ বছরের ছটফটে পোলাপান। গোস্তাকি মাফ করবেন, রিপন স্ট্রিটের ওই বাড়িটা -- দুই কামরার দোতলা বাড়িটার দাম ছিল সেই বাজারে কুল্যে হাজার টাকা, যার নিচে আপনি গোল্লাছুট খেলতেন, আর ফতিমার মাথায় চাঁটি মেরে বলতেন, "তর্ সুলতান কা মৎ হো যায়গা।" ১৪ ই আগস্ট ১৯৪৭ সাল, আপনি ওই রাস্তার ওপর দেখেছিলেন তিন-তিনটে হিন্দুর লাশ, একটা রক্তমাখা ছেঁড়া জামা। কিন্তু দুপুরে বাসায় ফিরে পোস্ত দিয়ে মেখে ভাত খেয়েছিলেন, সঙ্গে আন্ডাভাজা আর কাঁচা লঙ্কা -- তখন খিদের ছিল এত জোর।
আপনি তখনও জানতেন না (আপনার বালক বয়েস) যে জিন্নার ছিল সাংঘাতিক কর্কট রোগ, যে ফতিমাও শাদি করে চলে যাবে পূর্ব পাকিস্তান, যে আপনাকে আরও ৭০ বছর ঘুরতে হবে রিপন স্ট্রিটের বেড়াজালে, আর পাশের রাস্তার নাম পাল্টে হয়ে যাবে রফি আহমেদ কিদওয়াই রোড।
আপনার বিবির বয়েস ছিল স্বাধীনতার চেয়ে মাত্র ১০ বছর কম। সেও একটা ছোট্ট ভুলের খেসারৎ দিতে শুয়ে আছে পার্ক সার্কাসের ভিজে মাটির তলায়। আপনার বড় ছেলের চোখে উঠেছে সোনালি রঙের রিমলেস চশমা আর হাতে ইলেকট্রিক গিটার আর বাড়ির চৌকো উঠোনে পুরনো প্রেস-মেশিনের আওয়াজ হচ্ছে ঘড়ঘড়্..ঘড়ঘড়্..। আপনার হৃদয়যন্ত্রে ছোবল মেরেছে শীতের কুয়াশা, সেলিমার সরে যাওয়া আঁচল আর শামসের ... থুড়ি, ভাস্কর-কবির বন্ধুপত্নীর চোরা চাউনি। ভোররাতে স্বপ্ন ভেঙে জেগে উঠে আপনি শুনতে পান নিজের ফুসফুসের জলভরা আর্তি -- ঘড়ঘড়্ ঘড়ঘড়্। আপনার অসহায় টেলিফোন যন্ত্র রাত্রিবেলা আর্তনাদ করে,আর আপনি ঘোল খেয়ে শুয়ে থাকেন। আপনার বিবেক হৃদপিণ্ডের ওপর চড়াও হলে আপনি শশা আর সরবিট্রেট খেয়ে শুয়ে থাকেন।
আপনি কর্পোরেশন স্কুল ও আকাশবাণী, প্রেস ও রবীন্দ্রসদনের মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে বাড়িয়ে ফেলেন তার ইঞ্চি ভুঁড়ির চর্বি আর আপনার তৃতীয় সন্তান ঝংকার পত্রিকার জন্য হয়ে ওঠেন সম্রাট আকবরের মতো অহংকারী। কখনও ফিসফিস কখনও চিৎকার করে জানান: দেশভাগ নয়, বরং বাংলাভাষার স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ কবিতা চাই।
আপনার হুংকারে কেঁপে ওঠে দেশ-গাঁয়ের বাসার চারপাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা হোগলার ঝোপ, যেখানে এক গোড়ালি কাদাজল আর পাড়ের ওপর দিয়ে হিল হিল করে হড়কে যায় হেলে সাপ -- এ সেই গ্রাম, সেই অবিভক্ত দেশ, যে দেশ গাঁয়ের গল্প করতে গিয়ে অন্যমনস্ক, আপনি, গান, কবিতা ও অন্যান্য ডালপালার জগতে চলে যান, আর রসুল মিঞার আদা মেশানো গরম চায়ে আপনের জিভ পুড়ে যায়।
মাফ করবেন নুরুল সাহেব, আপনি দেখতে পাবেন না কিন্তু আমরা দেখছি সেই ভয়ঙ্কর পথ, সেই রক্তমাখা কাঁটাতার, ওপার থেকে আসা ছিন্নমূল শরণার্থী, উদ্বাস্তু শিবির, ভোটকর্মীদের ছাপ্পা মারা রেশন কার্ড আর গত ৭০ বছর ধরে লেখা অজস্র অপদার্থ কবিতার আবর্জনা ... মিনমিনে, নির্বিষ
হেলে সাপগুলোর মতো ...
না সাহেব, স্বাধীনতা নিয়ে, দেশভাগ নিয়ে বাংলাভাষার জন্য আমাদের ভাণ্ডারে আর কোনো কবিতা অবশিষ্ট নেই।