আমার জন্ম অবিভক্ত ভারতে। বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়। গ্রামের নামটি নাগর পাড়া। বাবা শিক্ষকতা করতেন প্রথমে নাগর পাড়া, তারপর টাঙ্গাইলে। নাগর পাড়ায় ছিল পূর্বপুরুষদের স্থায়ী বাড়ি, তাই আয়তনেও বেশ বড়। জমি-জায়গা, গাছগাছালি প্রচুর ছিল। পাঁচটা বড় ঘর ছিল আমাদের। দক্ষিণমুখী বড় শয়ন ঘর – মেঝে ও দেওয়াল ইটের তৈরি, উপরে ত্রিভুজাকৃতি টিনের ছাদ। পূর্বদিক, পশ্চিমদিক আর দক্ষিণদিকে আরো তিনটি ঘর আর মাঝখানে বড় উঠান। পুবদিকের ঘরের পাশে বড় রান্নাঘর ছিল। আর ছিল কুয়ো পায়খানা।
বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া ছিল বিশাল আমবাগান। গরমকালে সেই আমবাগানে পাটি পেতে সবাই গল্পগুজব করতাম। ঝড়বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। ঝড় থেমে গেলে আমরা ছোটরা যেতাম আম কুড়োতে। ছ-ভাই বোন মিলে কত যে আম কুড়িয়েছি! আম ছাড়াও আরো অনেক ফল তুলতাম – কুল, করমচা, পেয়ারা, কলা, জাম, কামরাঙ্গা ইত্যাদি। আমগাছের আবার খুব বাহারি নাম ছিল – স্বর্ণরেণু, সীতাভোগ, জংবাহাদুর, চিকণকলা। একটা কাঁচামিঠে আমগাছও ছিল। অনেক নাম ভুলেও গেছি – এখন আপসোস হয় বাবাকে কেন বাড়ির কথা আগে জিজ্ঞেস করি নি! আমি নিজেও শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত থেকেছি, তখন পুরোনো দিন নিয়ে ভাবার সময় ও আগ্রহ কম ছিল। এখন অবসরকালীন দীর্ঘ জীবন, সময় অঢেল কিন্তু স্মৃতি অস্পষ্ট।
কয়েকটি ছবি ভেসে ওঠে। তার মধ্যে একটি - বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টি হলে উঠোনে মাছ চলে আসতো – শিং, মাগুর, কৈ, ট্যাংরা, আরো ছোটো ছোটো কতরকমের মাছ! আমরা জলের মধ্যে নেমে খালুই দিয়ে, গামছা দিয়ে মাছ ধরতাম – সে এক আলাদা আনন্দ!
কাঁঠাল, তাল, খেজুর, নারকেল গাছ কত ছিল! মাকে খেজুরের রস জ্বাল দিতে দেখেছি। আমরা সেই রস, মায়ের বানানো তালের বড়া, নারকেল নাড়ু খেয়েছি। বড় পাটিতে আমের গোলা ঢেলে রোদে শুকোতে দেওয়া হত, তা থেকে তৈরি হত আমসত্ত্ব। তাছাড়া ধানী জমিও প্রচুর ছিল। লাল চালের ফেনাভাত-ঘি, আলুসেদ্ধ – তার স্বাদ ভোলা যায় না। আমাদের বাড়ির পিছনে একটি বাড়িতে থাকতেন আমাদের জ্ঞাতি রসিক বসু। তাঁদের একটি বিশাল আমলকী গাছ ছিল। সেখান থেকে আমলকী পেড়ে খেতাম। আমাদের রান্নাঘরের পাশে যে পুকুর ছিল, তাতে ছোটো মাছই বেশি পাওয়া যেত। পুকুরের পাশেও আমগাছ ছিল কয়েকটা। লেবুগাছ। আর ছিল ফুলের গাছ। জবা, গন্ধরাজ, শিউলি।
দেশভাগ না হলে..
একবার দক্ষিণ পাড়ায় খুব হৈহল্লা হচ্ছে। আমরা উত্তরপাড়ায় থাকি। কেউ এসে খবর দিল হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা হচ্ছে। বাবা-মা আর আমরা ভাইবোনেরা ঝুড়ি ভর্তি করে ইটের টুকরো নিয়ে রান্নাঘরে লুকিয়ে পড়লাম। এরকমভাবে বেশ অনেকক্ষণ ছিলাম। পরে বেরিয়ে এসে জানতে পারি, ফুটবল খেলায় জিতে দক্ষিণ পাড়া আনন্দোৎসব করছে। আমরা আমাদের চারপাশে কখনো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে বিদ্বেষ দেখি নি। তবু এক সময় বাবা পশ্চিমবঙ্গে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। এ দেশে এসে আমরা নৈহাটিতে বসবাস শুরু করলাম। বাবা নৈহাটি মহেন্দ্র বিদ্যানিকেতনে শিক্ষকতা করতেন আর বাবার পথ ধরে আমিও নৈহাটি কাত্যায়নী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে বহু বছর শিক্ষকতা করেছি।
তবু সেই ফেলে আসা দেশের জন্য মন কেমন করে। গ্রামের এক মুসলমান ভাই বলতেন, দ্যাশ ছাইড়া গ্যাছে যারা তারা আবার আইবনি।