চল্লিশের দশক নিঃসন্দেহে একটি তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ কালঃ অগস্ট আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ , ঊনিশশো তেতাল্লিশের মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, স্বাধীনতা ও দেশভাগ। স্বাধীনতার বছরে আমি নবম শ্রেণীতে। স্বাধীনতার আনন্দ চাপা পড়েছিল বাস্তু-ত্যাগের দুঃখ বেদনায় , যা সমস্ত দেশত্যাগীর মনে চিরস্থায়ী হয়েছিল। পঁচাত্তর বছর কেটে গেল দেশভাগের পরে। প্রাক-স্বাধীনতা যুগের ক'টি ঘটনা , যা আমার বাল্য-কৈশোরের স্মৃতিতে চিহ্ন রেখে গেছে, তা' দিয়েই কথা শুরু করি। স্বল্প পরিসরের কথন শেষ করব স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও দুটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অসমাপ্ত কাজের উল্লেখে।
সেবাধর্ম
"স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে , কে বাঁচিতে চায়? দাসত্বশৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় ,হে, কে পরিবে পায়?"
হেমচন্দ্রের এই লাইনগুলি ষষ্ঠ/ সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে দেহ-মনে অনুরণন জাগাত। আমাদের এলাকায় (গোয়ালভাওড় গ্রাম, উত্তর শাহাবাজপুর পরগনা, বরিশাল), এমনকি আমাদের পারিবারিক বৃত্তে ছিলেন বহু স্বাধীনতাসংগ্রামী। তখনকার পরিভাষায়- স্বদেশী বা বিপ্লবী। প্রায় সকলেই ইংরেজের কারা-বন্দী অবস্থায় বহু বছর কাটিয়েছেন। এঁদের মধ্যে যুবা-তরুণরা পাড়ার ক্লাব তথা উন্নয়ন সমিতির সঙ্গে যুক্ত; এঁদের কাজ- সমাজসেবা যেমন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার পাশের খাল থেকে কচুরিপানা পরিষ্কার, অসুস্থজনের শিয়রে রাত জাগা, শবদাহ, পাঠাগার পরিচালনা, পরবে বা মেলায় স্বেচ্ছাসেবা (পানীয় জল দেওয়া, ভীড় সামলানো), ঝড়ঝঞ্ঝায় প্রাথমিক সাহায্য ইত্যাদি। ফলে কিশোরদের ভিতরে স্বতঃই কিছু সমাজচেতনা সঞ্চার হত।
আমাদের এলাকা ছিল বরিশাল জেলার উত্তর অংশে, মেঘনার গা ঘেঁষে। গত শতকের চল্লিশের প্রথম দিকে, আশ্বিনের এক সন্ধ্যায় এল প্রবল ঘূর্ণিঝড়। নদীতে নৌকায় ছিলেন যাঁরা- নিশ্চিহ্ন হলেন, নদী-সংলগ্ন কয়েক মাইল (দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে) জুড়ে বাড়ি-ঘর, গাছ-গাছড়া ভেঙে ফাঁকা হয়ে গেল। সহস্রজন নিরাশ্রয়, নিরন্ন হলেন। ইংরেজ-সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাহায্য-খয়রাত এল না, তাঁরা তো জাপানিদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত। ভারত সেবাশ্রম সংঘের সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীরা এলেন- বস্ত্র ও অন্ন নিয়ে। বৎসরাধিককাল গ্রামে থেকে দিবারাত্রি পরিশ্রম করে, অসহায়জনের অন্নের বন্দোবস্ত, আশ্রয় তৈরিতে সাহায্য করলেন। সেই নিঃস্বার্থ, নিরলস সেবা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এঁদের ক্যাম্প ছিল আমাদের বাড়ির কাছারিতে। ত্রাণ বন্টন নিয়ে সাধারণের কোনও অভিযোগ ছিল না। স্বাধীনতার পরে, পশ্চিমবঙ্গে থাকার সুবাদে ঝড়, অতিবৃষ্টি (বন্যা), অনাবৃষ্টিতে (খরা) সরকারি রিলিফ (ত্রাণ ব্যবস্থা) দেখেছি; অভিযোগ, দুর্নীতি যেন সেবা-পরিষেবাকে বহু যোজন অতিক্রম করে গেছে সব সময়।
দুর্ভিক্ষ
পঞ্চাশের মন্বন্তরে (বাংলা ১৩৫০/ ১৯৪৩ খৃস্টাব্দ) অখণ্ড বঙ্গ-প্রদেশে যদি ত্রিশ লক্ষ লোক অনাহারে প্রত্যক্ষভাবে মারা গিয়ে থাকেন, বহু গবেষক বলেন, অর্ধাহারে, অপুষ্টিজনিত কারণে মৃত্যুসংখ্যাও আরও কুড়ি লক্ষ হবে। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্ধকোটিজনের মৃত্যু হয়েছিল। এই হৃদয়বিদারক ঘটনা অন্নের উৎপাদনহ্রাসজনিত কারণে নয়, শাসকের স্বেচ্ছাকৃত ছক অনুযায়ী সংঘটিত হয়েছিল। তারা বড় বড় ব্যবসায়ী মারফত সমগ্র বাংলা থেকে বিশাল পরিমাণ খাদ্যশস্য , মাঠে ফসল তোলার সময় থেকেই কিনে বাংলার বাইরে নিয়ে সৈন্যবাহিনীর ব্যবহারের জন্য মজুদ করেছিল। উপরন্তু যুদ্ধের কারণে , বার্মা ( বর্তমানে মায়ানমার) থেকে চাল আসা বন্ধ। ফলে শীঘ্রই চাষীর গোলা শূণ্য হ'ল; স্থানীয় ব্যবসায়ীকর্তৃক সংগৃহীত স্বল্প পরিমাণ চাল যে মূল্যে বিক্রি হচ্ছিল, তা সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ক্রয়ক্ষমতাশূণ্য সাধারণ মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে রইলেন, শেষে দলে দলে বাস্তুত্যাগ করে, খাদ্য পাওয়ার দুরাশায় শহরের দিকে হাঁটতে লাগলেন; মধ্যপথে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল গৃহস্থের বাড়িতে ফ্যান ভিক্ষা চাইলেন। মা-কাকীমারা ভাতের ফ্যান শেষ বিকাল পর্যন্ত ধরে রাখতেন, সঙ্গে কয়েক মুঠি ভাত। এই নিরন্নদের অধিকাংশই শিশু-কোলে মহিলা- পা-ফোলা, কোটরগত চোখ; পুরুষেরা শীর্ণদেহ বৃদ্ধ। সরকার বা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান এই নিরন্নদের পাশে ছিল না। একমাত্র কলকাতায় কিছু রিলিফ আয়োজন করেছিলেন তাঁরা, যাঁরা বিদেশি সরকারকে যুদ্ধে সহায়তা করতেন । অনাহার- অর্ধাহারে ক্লিষ্ট অসহায় মানুষের স্মৃতি আজও ভুলি নি। এই দুর্ভিক্ষে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
বাংলার রাজনীতিকদের প্রতাপশালী অংশ স্বল্প সময়ে, সব ভুলে, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা (১৯৪৬), রক্তক্ষয়ে উন্মাদ হয়ে গেল- বিভ্রান্ত সাধারণ মানুষের সাময়িক সম্মতিতে বঙ্গভাগ করিয়ে নিল। দেশত্যাগের শুরু ১৯৪৬ থেকেই, ক্রমে তা জোরদার হ'ল।
স্বাধীনতা ও তারপর-
১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ব্রিটিশরাজের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন, " বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান-" সেবার বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চাশ বছরও কাটলো না। দাসজাতির ভাগ্যপিতার নির্দেশে দেশমাতৃকার কতিপয় সুসন্তান পরশু হাতে জননীর অঙ্গচ্ছেদে মত্ত হলেন! বীরের রক্তধারা বইল না- বইল শুধু ভয়ার্ত সন্তানগণের রক্তনদী। অগস্ট ১৯৪৬-এ যার আরম্ভ, সাতচল্লিশের অগস্টেও তার সমাপ্তি হল না। রক্তস্রোত আজও বহমান।
আশঙ্কা ও বিষাদের হাত ধরে ১৪ ই অগাস্ট '৪৭ এসেছিল- আমরা পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে গেলাম। তবে স্কুলে বা বাড়িতে পাকিস্তানের পতাকা ওঠে নি। মাঝে, অখণ্ড বাংলা গঠনের কথা নিয়ে শরৎ বসু, কিরণশঙ্কর রায়, সোহরাবর্দি প্রভৃতি নেতারা বহু আলোচনা করলেও, হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক নেতারা প্রায় সকলেই এ প্রস্তাব অন্তত তৎকালীন পরিবেশে অবাস্তব মনে করলেন। বর্ণহিন্দুরা পাকিস্তানের মুসলমান গরিষ্ঠতার শাসন মেনে নিতে অপ্রস্তুত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য মহাত্মা গান্ধীর আন্তরিক প্রয়াস তাঁদের মনে বিন্দুমাত্র সাহস যোগাতে পারল না।
আমাদের বাড়ির আট- নয় গৃহস্থ পরিবারের মধ্যে পড়ে রইলাম আমরা তিন - চার ঘর। মা বাবার ওপর চাপ দিতে লাগলেন কলকাতায় সপরিবার চলে যেতে। বাবা তখনও গররাজি। এভাবে এক বছর কেটে গেল। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে টেনের ক্লাস আরম্ভ হল। ততদিনে স্কুলের মাঠ চোর-কাঁটায় ভরে গেছে, খেলাধুলা হয় না। গ্রামের ক্লাবের অবস্থাও সঙ্গীন। টিমটিমে আলো-ও জ্বলে না সন্ধ্যের পরে। ম্লান সন্ধ্যা। নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব ঘিরে ধরতে লাগল।
ঐ বছরই, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দূর্মূল্যতা সম্পর্কে বাবা এক পত্রে লিখছেন , " চালের দাম মণ প্রতি ২১-২২ টাকা; দুধঃ টাকায় তিন - সাড়ে তিন সের; নারকেল ১ জোড়া ৮-১০ আনা। পত্রের তারিখ ২৪শে এপ্রিল, ১৯৪৮।
বাংলা ভাষার জন্য
হঠাৎ যেন এক প্রদীপ জ্বলে উঠল। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান সরকার উর্দুকে পাকিস্তানের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করল। এবারে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিতজন ও ছাত্ররা বিরোধিতার পথ ধরলেন- এর জন্যই কী স্বাধীনতা! তাহলে স্বাধীনতার আর এক নাম ভাষাগত পরাধীনতা! ছাত্র আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করল।
১৯৪৮ সালের প্রথম দিকে আমাদের হিজলা থানার কাছে এক মাঠে সব স্কুলের ছাত্রদের আহ্বান করা হল- প্রতিবাদ সভা হবে। আমরা জনা কুড়ি ছাত্র দুপুরের দিকে হাঁটা পথে রওনা হলাম। সবাই হাফ প্যান্ট পরিহিত, খালি পা। হাফশার্টের ওপর কারো উলের সোয়েটার, কারো বা আলোয়ান। ধান কাটা অনেক আগেই শেষ হয়েছিল, কিছু কিছু মাঠ যেমন কলাই, মটরশুঁটি, মসুর শাকে সবুজ, তেমন অনেক খেত সর্ষে ফুলে হলুদ হয়ে উঠেছে। দূর থেকে হাল্কা রোদে হলদে রং এর বিস্তীর্ণতা ছিল মনোমুগ্ধকর যা এখনও ঝিমোনো স্মৃতিকে সঞ্জীবিত করে। ফিরতি পথে ঠাণ্ডা গায়ে পায়ে জড়াতে লাগল ধীরে ধীরে; আমাদের সঙ্গে ক্লাস সেভেন কী এইটের একটি ছেলে ছিল- মীটিং ফেরত, ঠান্ডা লেগে নিমোনিয়া হল তার। তখন গ্রামদেশে পেনিসিলিন বা কোনো অ্যান্টিবায়োটিক প্রচলিত হয় নি। দু'দিন পরে স্কুলে তার জন্য শোকসভা অনুষ্ঠিত হল। শিক্ষক মোহিনীবাবু তাঁর কথার শেষে আবেগভরে বললেন,
"যে ফুল না ফুটিতে ঝরেছে ধরণীতে
যে নদী মরুপথে হারাল ধারা,
জানি হে, জানি তাও হয়নি হারা।"
এই বাণী সারাজীবন আমার মনে অনুরণিত হয়েছে।
কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে, পশ্চিমবঙ্গের আর্থসামাজিক বিষয়ে যেটুকু লেখালেখি করেছি- সবই বাংলায়। ভাষার ওপর দখল অর্জন করতে না পারলেও, পিছপা হই নি। আমার সামান্য প্রয়াস সেই দিনটিরই স্মৃতিতর্পণ ছিল।
গান্ধীজির মৃত্যু
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসেই এক মহাজীবনের নিধনে আমাদের এলাকাতে বিষণ্ণতা ও হতাশার গাঢ় ছায়া পড়েছিল। বছরও ঘোরে নি হয়তো, গান্ধীজি নোয়াখালিতে পদব্রজে সাম্প্রদায়িক প্রীতি ও শান্তির বাণী প্রচার করে গেছেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘরে ঘরে অরন্ধন, উপবাস। ১৯৪৫ সালের বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষচন্দ্রের 'মৃত্যু ' ব্রিটিশের ছড়ানো গুজব বলে সাধারণ মানুষ মনে করতেন, নেতাজি যথাসময়ে ফিরে এসে তাঁর শূণ্যস্থান পূর্ণ করবেন, এই আশা ছোট বড় সবাই করতেন। ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথের (১৯৪১) বা শরৎচন্দ্রের (১৯৩৮) মৃত্যুসংবাদ পাওয়ায় স্কুল ছুটি হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু শোক সীমিত ছিল শিক্ষিতজনের মধ্যে। কিন্তু গান্ধীজির মৃত্যু আপামর সবাইকে গভীর নাড়া দিয়েছিল।
খাদ্যে অনিশ্চয়তা
দুর্ভিক্ষের সময় কলকাতা ও শিল্পাঞ্চলে যুদ্ধের দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও সরবরাহের স্বার্থে প্রথমে শ্রমিকদের জন্য, পরে মোটামুটি সর্বজনের জন্য খাদ্যশস্যের সংগ্রহ ও বন্টন সরকার নিয়ন্ত্রণে নিল। তখন একে বলা হত কন্ট্রোল বা রেশন ব্যবস্থা। দেশত্যাগের পরে, পরিবারের বাকি সবাই যখন (১৯৫০) কলকাতায় এসে পৌঁছলেন, তখন আমাকে (আমি ও সেজদা ১৯৪৯-এ কলকাতায় এসে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম) একটি কাজ দেওয়া হল- ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে (বর্তমানে মির্জা গালিব) খাদ্য দপ্তরের রেশনিং অফিসে আবেদনপত্র জমা দিয়ে রেশন কার্ডের বন্দোবস্ত করা। তখন, খোলাবাজারে চাল, আটা, গম, চিনি মিলত না; অবশ্য পাঁউরুটি, চিঁড়ে-মুড়ি-খই -র উপর কন্ট্রোল ছিল না। সে সময়, শুনেছি, মৃতদেহ সৎকারের জন্য প্রয়োজনীয় নূতন বস্ত্রখণ্ড বিক্রিও সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল। যা হোক, খাদ্য দপ্তরের কর্মীরা একটা টিনের শেডযুক্ত বাড়ির বাইরে টেবিল চেয়ার নিয়ে তাঁদের দপ্তর সাজিয়ে বসেছিলেন, ঠিক সকাল দশটায়। লাইন অতিদ্রুত এগিয়ে গেল। বর্ডার( সীমান্ত ) অতিক্রম সংক্রান্ত স্লিপ জমা দিলাম সহজে, তাঁরা একখানা কাগজ ধরিয়ে দিলেন- তাতে অফিসের শিলমোহর দিয়ে লেখা ছিল, নিকটবর্তী রেশন দোকানের নম্বর, এবং পরিবারের সদস্যসংখ্যা-পূর্ণবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের যথাক্রমে। বললেন, সেইদিনই এই কাগজ দেখিয়ে সাপ্তাহিক-প্রাপ্য চাল গম কিনতে পারি। এই ব্যবস্থা আগামী দুই সপ্তাহের জন্য, সাময়িক। এর মধ্যে তাঁরা খোঁজখবর নিয়ে বাসায় এসে জানিয়ে যাবেন, কবে রেশনকার্ডগুলি পাওয়া যাবে। কোন ঝঞ্ঝাট বা অর্থ-বিনিময় ছাড়াই যথাসময়ে কাজ হয়ে গেল। রেশন পাওয়া যেতে লাগল, তবে, মাঝে মাঝেই, গমের ডিউ স্লিপ থাকত, আমেরিকান গমের জাহাজ এলে গম মিলবে। তবে আমাদের বড় সমস্যা হ'ল মা-পিসিমার জন্য আতপ চাল সংগ্রহ, কারণ রেশনে তা অপ্রাপ্য থাকত বহু সময়ই। সুতরাং-চোরাবাজার। বেলেঘাটার কাছে কাদাপাড়া এলাকায় বাবার এক খুড়তুতো ভাইপো বাড়ি করেছিলেন। কাদাপাড়া সেই সময় সার্থকনামা। দু'বার বাস পাল্টে যেতাম সেখানে প্রতি রবিবার। গ্রামের মেয়েরা পেটে থলি বেঁধে , ট্রেনে চড়ে কলকাতায় এসে এই চাল যোগান দিতেন- আমি রেশনের থলিতে নিয়ে আসতাম। পুলিশের নজর ছিল না।
আজ বহু বছর ধরে , চাল-গমের চলাচলের ওপর রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা নেই। শহরের বা শহর-তলির মধ্যবিত্তরা খোলা বাজার থেকেই এসব কিনে থাকেন। তবে তবে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারগুলির ভরসা এখনও এই রেশনসামগ্রী- গ্রহীতাদের সংখ্যা বিশাল। সংবাদপত্র দেখে মনে হয়, রাজ্যের দু' তৃতীয়াংশ জনই এই রেশন ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। দেয়- রেশনসামগ্রীর (চাল, গম) বড় অংশই নিখরচায় পাওয়া যায় । চালের গুণমান ভালো, প্রায় সবটাই নাকি রাজ্যে উৎপাদিত। স্বাধীনতার সময় পশ্চিমবঙ্গে লোকসংখ্যা আড়াই- পৌনে তিন কোটির মাঝামাঝি কোথায়ও ছিল। সেই সংখ্যক লোকের খাদ্যও এখানে উৎপন্ন হত না। খাদ্য আন্দোলন, পুলিশের গুলি-গোলায় শহীদ বহু দশক ধরে রীতি ছিল। গত শতকের ষাট দশকের মোটামুটি শেষ দিকে উচ্চ উৎপাদনশীল গম চাষ প্রবর্তিত হয়। কিছু পরে বোরো চাষে ঐ বীজ আসে। যতদূর মনে পড়ে, খরিফ ( আউশ, আমন) ধানের উচ্চফলশীল বীজের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও অন্তত এক দশক। তারপর থেকে চালের সমস্যা নেই। উৎপাদন কখনও এমন মাত্রায় পৌঁছে গেছে যে ভিন্ন রাজ্যে বৈধভাবে চালান যায়। প্রশ্ন হল- এত খাদ্যশস্য উৎপাদন সত্ত্বেও রেশনের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে বই কমছে না কেন? স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও?
খাদ্যগ্রহণের উদ্দেশ্য তো শুধু শরীরে শক্তি যোগানো নয়, শিশুদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধিও; প্রাপ্ত-বয়স্কদেরও সুষম খাদ্য প্রয়োজন যে খাদ্যে থাকবে পরিমাণমত কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, মিনেরালস ও ভিটামিন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বছরের চিত্র এক সরকারী রিপোর্টে (West Bengal Human Development Report 2004) ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকাল রিসার্চের সুপরিশকে মান (norm) ধরে বলা হয়েছে, ২০০২ সনে পশ্চিমবঙ্গের ১-৩ বছর, ৪-৬ বছর, ৭-৯ বছর বয়ঃশ্রেণীভুক্ত শিশুদের খাদ্যশক্তিতে (ক্যালোরি) ঘাটতি ছিল যথাক্রমে ৮৮, ৪০ ও ৩৭ %; প্রোটিনে এই ঘাটতি ১৭, ১৪, ২৮ %, ফ্যাটে ৬৩, ৫৬, ৪৯%। গর্ভধারিনী ও স্তন্যদায়িনীদের ঘাটতির ছবিঃ মোট খাদ্যশক্তিতে ঘাটতি যথাক্রমে ২৩ ও ১৭ %, প্রোটিনে ৬৫, ৭৫ %, ফ্যাটে ৪৫ ও ৬২ %। ফলস্বরূপ, জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা যায়, শিশুদের রক্তাল্পতা, বয়সের তুলনায় শরীরের উচ্চতার বা উচ্চতার প্রেক্ষিতে ওজনের ঘাটতি। এ সব কিছুর মূল কারণ, পরিবারের আয়ের অপর্যাপ্ততা।
লোকের আয় নির্ভর করে কর্মসংস্থানের উপর। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান জনসংখ্যা অনুমান করি, প্রায় দশ কোটি। এর মধ্যে শতকরা চল্লিশজন হয়তো শ্রমশক্তি (লেবার ফোর্স) ভুক্ত। শ্রমশক্তি বলতে, কর্মরত ব্যক্তিদের সংখ্যার সঙ্গে কর্মপ্রার্থী বেকারদের সংখ্যাও ধরা হয় (কর্মরত বা বেকার- সংখ্যার হেরফের হয় এদের সংজ্ঞার্থ বিভেদের উপর)। খ্যাতনামা অ-সরকারি সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং অফ ইন্ডিয়ান ইকনমির (মুম্বাই) সমীক্ষার হিসাব দেখলে মনে হয়, যে সব রাজ্যে বেকারি কম, পশ্চিমবঙ্গ তাদের অন্যতম। এতদ্সত্ত্বেও এই দুরবস্থা! তা হলে বোঝা যাচ্ছে, অধিকাংশ কর্মীই নিম্নস্তরের উপার্জনশীল কর্মক্ষেত্রে কাজ করেন। যেমন, গ্রামদেশে কৃষিমজুর, বা অকৃষিক্ষেত্রে দিনমজুর বা অতি নগণ্য উৎপাদনক্ষেত্রে স্বনিয়োজিত। এঁদের বেঁচে থাকতে সাহায্য করছে বিবিধ সরকারি খয়রাতি প্রকল্প যেমন মহাত্মা গান্ধীর নামে চালু একশো দিনের কাজ, অঙ্গনওয়াড়ি বা আশাকর্মীদের মতো কর্মক্ষেত্র। বহু দশক ধরে, এ'জাতীয় কর্মকাণ্ড চালু রয়েছে, শুধু বঙ্গভূমিতে নয়, সর্বভারতেই।
হায় পথবাসী
স্বাধীনতার হীরকজয়ন্তীতে পথবাসীদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছে? দশ- সালা লোকগণনায় এঁদের সংখ্যা পাওয়া যায়। ২০২১ শে তো' গণনা হল না। তবে, আপনারা নিশ্চয়ই দেখতে পান, মহানগরীর কেন্দ্রস্থলেই হোক, পথ-ঘাট হোক বা শহরতলির রেলস্টেশন- এঁরা সপরিবার দিনযাপন করেন। শহর-শহরতলির নিকাশি খালের পাড় ধরেও এঁদের বসতি। সংবাদমাধ্যমে এঁদের উপস্থিতি দুঃসহ দুঃসংবাদ হিসেবে নজরে আসে- শিশুরা কোন যানের তলায় পিষ্ট, নাবালিকা অপহৃত, ধর্ষিত। স্বাধীনতা -উত্তর বহু শাসক-জমানা এল গেল, পরিস্থিতি কতটা হেরফের হয়েছে? রবীন্দ্রনাথের কালে, ঝরঝর বারিধারায় গৃহহীনের পলিথিন-শিটের ঘেরাটোপ ছিল না, এখন আছে !
স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরেও খাদ্য, বাসস্থানের এই বিপুল অনিশ্চয়তা বড় বেদনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করি। লাল, গেরুয়া, সবুজ, মেটে রাজনীতির বাইরে, যে সকল চিন্তাশীল নবীনজন রয়েছেন, তাঁরা এগিয়ে আসবেন? ভেবে দেখবেন কি এর থেকে মুক্তির উপায়?
স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন প্রথম দেখি ১৯৪৯ সনে; সে' বছরই ভিটে ত্যাগ করে এসে, কলকাতার কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ছাত্রাবাসের অঙ্গনে, মাননীয় সুপারিন্টেনডেন্ট মহাশয় ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা তুললেন; সেই প্রথম সমবেত ছাত্রদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে 'জয় হিন্দ্' বলেছিলাম। আজ ২০২২এর অগস্টে এই লেখা শেষ করতে বসে, সেই দিনটির কথাই মনে পড়ছে। জয় হিন্দ।