আমার পরিবারকে প্রত্যক্ষ ভাবে দেশভাগের যন্ত্রণা সইতে হয়নি, কারণ আমার পিতামহ, যাঁর নাম ছিল অবিনাশ চন্দ্র (দে)সরকার, তিনি ছিলেন এডভেঞ্চার প্রিয় এক প্রবল প্রতাপী মানুষ, যিনি ঘরে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে রেখে চলে গেছিলেন রেঙ্গুন। তার সদা চঞ্চল মন সেখানেও তাকে তিষ্ঠোতে দেয়নি, অনেক বছর বাদে যখন অবিভক্ত ভারতে ফিরে এলেন, তখন স্ত্রীকে নিয়ে বসত করলেন হিমালয় ঘেঁষা উত্তরে, তখন তাঁর হাতে জাদু, নিষ্প্রাণ কাঠের টুকরো অনায়াসে বদলে বদলে যায় কোনো অপরূপ মূর্তি, অলঙ্কৃত সিংহাসন, বা কারুকাজ মন্ডিত দুটো ড্রয়ারওয়ালা কাঠের টেবিলে, যেটার অধিকার নিয়ে আমি অতিমাত্রায় সচেতন ছিলাম। আমি একাই দাদুর বানান চেয়ার টেবিলে বসে লেখাপড়া করব, খালি আমার জিনিসপত্রেরাই থাকবে ঐ ড্রয়ার দুটোতে। এর অন্যথা হলে চেঁচামেচি মারামারি লেগে যেত।
সে যাক, এ তো আমার দাদুর গল্প নয়, দেশভাগের কাহিনী, যার গায়ে লেগে আছে, আগুন, হত্যা, অসম্মান আর সব হারাবার টক টক গন্ধ। কিন্তু একথা তো ঠিক, দেশভাগ সম্বন্ধে আমার জ্ঞান পুঁথিগত হয়েও হতে পারেনি ঐ ড্রয়ার দুটির জন্য। আসলে আজকাল স্মৃতি নির্ভর অভিজ্ঞতা, গল্পকাহিনী, এগুলোও ইতিহাসের অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, তাই মনে পড়ল ঐ অবিনাশী ড্রয়ার দুটির কথা, যে দুটোতে এখনও রয়ে গেছে মা, ঠাম্মা, দিদা এমনকি প্রতিবেশীদেরও নিজস্ব অভিজ্ঞতা অথবা নিছকই শোনা কথা। টুকরো টুকরো আলাপ এবং প্রলাপ, যাদের জোড়া দিলে উঠে আসে এই উপমহাদেশের একটি বালিকার অকিঞ্চিৎকর শৈশব এবং সেই শৈশবের গায়ে লেগে থাকা এক ভয়ংকর অবিমৃষ্যকারিতার তীব্র গন্ধ। দেশভাগের অনেক পরে জন্ম বলে যে বালিকার পাওনা ছিল একটি নিরুপদ্রব মেয়েবেলা, যে ছিল এইসব ঘটনা থেকে অনেক দূরে, দেশভাগের গল্পকথার অভিঘাত তাকেও ছাড়েনি। চারপাশে মন পালটে দেওয়া, মনুবাদী করে তোলার সমস্ত মাল মশলাই তৈরি ছিল, কিন্তু তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে ঐ গল্প ভর্তি গোপন দুটি ড্রয়ার আর সাহিত্যপাঠ। ভাগ্যিস!
যখন জানতে পারি, দেশভাগে সব খুইয়েছিল দেড় কোটির বেশি মানুষ, মরেছিল দশ লক্ষেরও বেশি, ধর্ষণ করা হয়েছিল প্রায় পঁচাত্তর হাজার মেয়েকে, তখন ড্রয়ার হাতড়ে বার করি আমার মাতামহীর বলা এক টুকরো গল্প, যা নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় পেয়েছিলেন তিনি, আর বলতেনও বলতেন এমন আবেগ, ভয়, কান্না মিশিয়ে, যেন চোখের সামনে ঘটতে থাকত গোটা ব্যাপারটা। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত!
মাতামহীর নাম ছিল কিরণ, কিরণবালা মজুমদার। ঘটনাচক্রে তার বিয়ে হয়েছিল নিজের অকাল মৃত সহোদরা মনোরমার স্বামী নিবারণ চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে। নোয়াখালির বাসিন্দা এই মনোরমা আর কিরণ, দুই বোন দিব্যি বড় হচ্ছিলেন হেসে-খেলে। হঠাৎ নিবারণ নামে এক কৃষ্ণকায় সুঠাম যুবকের সঙ্গে মনোরমার বিয়ে হয়ে গেল, নিমন্ত্রিত নাইওররা মুখ বাঁকাল,” অমন সোনার বরণি মাইয়াটার এমন কালা হুমদা বর!”
এই উপমহাদেশে যদি পুরুষের গাত্রবর্ণ ধর্তব্যের বিষয় হত, তাহলে ‘সোনার আংটি বাঁকাও ভাল,’ এই প্রবাদের জন্ম হত না। মিষ্টভাষী যুবক স্বামীর সঙ্গে মনোরমার প্রেম দিন দিন চন্দ্রকলার মতই বাড়ছিল, কিন্তু মুশকিল করল তার গর্ভধারণের অক্ষমতা। মন্দিরের দেবদেবী, বটতলার সিঁদুর-মাখা পাথর, পীর বাবার দোয়াদরুদ কিছুই কাজে লাগে না, মনোরমার চোখের জলও শুকোয় না। এই নিয়ে নিবারণ তাকে কোনদিন একটি কথাও শোনায়নি, সে ছিল পত্নীঅন্ত প্রাণ। কিন্তু পাড়াপড়শিদের ক্ষুরধার সবজান্তা সমালোচনায় “নিবারণের আঁটকুইর্যা্ বৌ” তকমাটা মনোরমার বড় গায়ে লাগত।
কিরণ দিদিকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হবার নয়, মনোরমা দিন দিন খালি শুকিয়ে যায়, সোনার অঙ্গ কালি হয়ে যায়, চোখের কোলে ঘন আন্ধার ! নোয়াখালিতে তখন শুরু হয়ে গেছে নানা গুজব আর চাপা উত্তেজনা। দেশভাগের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে বাতাসে, সম্পন্নদের হতোদ্যম কথাবার্তায়, পদদলিতদের হঠাৎ দুর্বিনয়ে। জমিদারেরা প্ল্যান আঁটছেন, টাকাপয়সা যতটা পারা যায় হাতে হাতে, হুন্ডিতে বা যে কোনো বিনিময়ের মাধ্যমে ওপারে পাঠিয়ে দেবার। আর যাদের কোনো সঙ্গতি নেই, তারা সর্ব শক্তিমানের ভরসায় বুক বেঁধেছে, কিন্তু অনবরত চলছে গুজগুজ ফুসফুস, গুজবেরই রাজত্ব তখন! এ বলে চারটে গ্রামের পরের গ্রাম হাওড়-খালিতে মাঝ রাতে ঘরে আগুন দিয়েছে প্রতিবেশীরাই, ও বলে নাভিতে গরম শিক ঢুকিয়ে পোঁচের পর পোঁচ দিয়ে শুয়োর মারার মত মেরেছে কাউকে, কাউকে বা রামদার এক কোপ। মারেনি শুধু কাঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া সোমত্ত মেয়েদের। কই মাগুরের মত জিইয়ে রেখে খাবে এই লোভে।
এই ডামাডোলের সময়েই বিয়ের দশ বছর পরে মনোরমা হঠাৎ গর্ভবতী হয়ে পড়ল।
গর্ভাবস্থার শুরুতে মনোরমা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, কবিরাজ বলবৃদ্ধির জন্য তাকে মকরধ্বজ পিষে খেতে বলেছিলেন, আর বারণ ছিল যে কোনো উত্তেজনা। দিদির সেবা করার জন্য কিরণ এসে থাকছিল, কিন্তু সোমত্ত মেয়ে, সেও যেন এক বাড়তি ঝামেলা! নিবারণ দিশেহারা হয়ে পড়ছিল। গর্ভবতী স্ত্রী, তরুণী শ্যালিকাকে নিয়ে সে এখন কী করে, কোথায় যায়!
১৯৪৬ এর ১০ই অক্টোবর কোজাগরি লক্ষ্মী পূর্ণিমা ছিল। পূর্ণ চন্দ্রের মায়ায় চরাচর ভেসে যাচ্ছিল৷ কিন্তু গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংয়ের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সে রাতে সব গুজব সত্যি হয়ে দেখা দিল। মা লক্ষ্মী পুজো না পেয়ে বোধহয় পালিয়ে বাঁচলেন, নাহলে তার কপালেও কী ছিল কে জানে! খড়ের চালার পোড়া গন্ধ, পোষ্যদের আর্তরব, মানুষের হাহাকার, এতো কিছুর মধ্যে বাড়ির পেছনের কচু বনে লুকিয়ে বসে ছিল নিবারণ, তার স্ত্রী, শ্যালিকাকে নিয়ে। পুরো রাত সে বসে বসে ভেবেছে আরও আগে চলে যাওয়া উচিত ছিল, আর কোনো আশা নেই, কোন মায়ায় সে এতদিন পড়েছিল!
ভোর হতে না হতেই শুরু হয়ে গেল এক অসম্ভব যাত্রা। পুরো মাসের গর্ভবতী এক রমণী, তার হাত ধরে রয়েছে এক তন্বী, সবার আগে হনহন করে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ। হাতে বাঁশের লাঠি, আর চিঁড়ে-গুড়ের পুঁটলি। পাট ক্ষেতের ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে মেয়েরা চলছে অতি মন্থর, নিবারণ বেশি দূর চলে গেলেই আবার সচকিত হয়ে পেছন দিকে ফিরে ফিরে দেখছে।
কারও না কারও সাহায্য ছাড়া রেল স্টেশনে পৌঁছান অসম্ভব ছিল। নিশ্চয়ই সাহায্য তারা পেয়েছিল, কিন্তু এও ঠিক অনিষ্টের ভয়ে তারা গ্রাম বা লোক চলাচলের রাস্তা পরিহার করেছে। তৃষ্ণার্ত হয়ে ডোবার জলও খেয়েছে। অনাহার অনিদ্রা এবং ভয়ে আধমরা তিনটি প্রাণী প্ল্যাটফর্মে উঠে এলো যেন তিনটি পিশাচ। নোংরা কাপড়, হলদে উসকোখুসকো চুল, কোটরাগত চোখ। এর ওপর এই অনিয়মে গর্ভিণীর শুরু হল এশিয়াটিক কলেরা। তখনও ওআরএস আবিষ্কৃত হয়নি, কলেরার রোগীকে এক ফোঁটা জলও দিত না কেউ, তাতে নাকি তার দাস্ত আরও বেড়ে যাবে।
ফলে শান বাঁধানো প্ল্যাটফর্মে আছাড়-পিছাড়ি খেয়ে একফোঁটা জলের জন্য হাহাকার করছিল মনোরমা, "ওগো আমারে এট্টু জল দিবা, এট্টু জল!"
যেন তার কণ্ঠনালী ভর্তি কেবল শুকনো বালি আর পাথর। মলিন শাড়ির আঁচল দিয়ে দিদিকে হাওয়া করছিল কিরণ, তার চোখে অবিশ্রান্ত ধারা। নিবারণের অবস্থা আরও খারাপ। পুরুষেরা আজন্ম জানে তারাই রক্ষক। হঠাৎ করে যদি দেখা যায় রক্ষা করার কোনো ক্ষমতাই নেই তার, তাহলে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বেদম উদভ্রান্ত হয়ে পড়ে। নিবারণ সবার হাত ধরে ধরে ভিড়ের মধ্যে একজন কবিরাজের খোঁজ করছিল।
যারা ভিড় করে দেখছিল তারা বুঝতে পারছিল, একটু একটু করে থেমে যাচ্ছে অসুস্থ নারীটির বুকের স্পন্দন। দৃষ্টি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে চোখ থেকে। এখনই কোথা থেকে বমির গন্ধে হাজির হয়েছে ডুমো নীল মাছি। তারা যথেচ্ছ বসছে মৃতপ্রায় মনোরমার ঠোঁটের কোণে। এইরকম দমবন্ধ পরিস্থিতিতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো এক মাঝ বয়েসী মহিলা, মাথায় ঘোমটা, হাতে সবুজ কাচের চুড়ি, মনে হয় কাউকে নিতে এসেছে সে, হয়ত ওপার থেকে পালিয়ে আসা তার কোনো স্বজন।
কিন্তু ট্রেন চলাচল নাকি বন্ধ হয়ে গেছে এর মধ্যেই। কিছুক্ষণ আগে কিরণ এই মহিলাকেই চেঁচিয়ে বলতে শুনেছিল, "গান্ধীজীর ছাগলিটারে কাটি খায়া ফেললি তোরা কোন আক্কেলে! এত গুনাহের কাম কইরলে তার ফল ভুগতি হবে তো।"
এখন সেই মহিলাই একটি মাটির ভাঁড়ে জল নিয়ে এসে বলছে,"আর দেখতি পাত্তিসি না। এন্তেকাল ঘনাইসে, মুখে দু ফোঁটা পানি দিবা না…।"
ভিড়ের ভেতর থেকে একটা প্রবল গুঞ্জন আছড়ে পড়ে। একে কলেরা, তায় মুসলমানির হাতের জল। নিবারণ দোটানায় পড়ে যায়। জাত আগে না তেষ্টা আগে! ইহকাল আগে, না পরকাল! ভাবতে ভাবতে তার চোখ পড়ে মনোরমার দিকে। তার বিস্ফারিত চোখদুটো জলের পাত্রে সেঁটে রয়েছে, অতি কষ্টে সে ভারী জিভের ডগাটুকু বার করতে পেরেছে, কালচে হয়ে যাওয়া ঠোঁট দুটি থরথর করে কাঁপছে। যেন দু ফোঁটা জল না পেলে সে শান্তিতে মরতেও পারছে না।
নিবারণ আর পারে না। মহিলার হাত থেকে বিদ্যুৎ গতিতে ছিনিয়ে নেয় জলপাত্র। অল্প ঢেলে দেয় স্ত্রীর ঠোঁটে। একটি অতি দীর্ঘায়ত আঃ, তারপরই সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে পড়ে মনোরমার। অজাত শিশুটিকে নিয়েই সে মানুষের সমস্ত হানাহানির বাইরে যাত্রা করে৷
তারপর কী করে বিপত্নীক জামাইবাবুর সঙ্গে এপারে আসতে পারে কিরণ, চরম দুঃখ কী ভাবে বেঁধে দেয় দুজনকে অমোচনীয় গ্রন্থিতে, সে আলাদা গল্প। কিন্তু এত কান্ডের পরেও আমার মাতামহীকে কোনোদিন কোন রকম সাম্প্রদায়িক মনোভাব ব্যক্ত করতে শুনিনি। বরং চিরকাল কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন সেই মহিলার উদ্দেশ্যে, যার দেওয়া দু ফোঁটা জলে তার দিদির মরণ কালীন তৃষ্ণা মিটেছিল৷ সেই সাহসী মহিলা, গান্ধীজির অনুগামী, অন্য ধর্মানুসারীকে ঐ পরিস্থিতিতে জল দিলে ঝামেলা হতে পারে জেনেও দয়ায় আর্দ্র হয়েছিলেন, তাকে আমার দিদা চিরকাল দু হাত তুলে প্রণাম করে গেছেন৷ গান্ধীজিকে দুধ দেওয়া ছাগলি, যেটাকে সঙ্গে করে তিনি নোয়াখালি নিয়ে গিয়েছিলেন খাদ্যাভ্যাস পাল্টাবেন না বলে, তাকে কেটে খেয়ে স্বয়ং গান্ধীজিকে যে বার্তা দিতে চেয়েছিল অপর পক্ষ, তার বিরুদ্ধে জনসমক্ষে একা কথা বলার সাহস রেখেছিলেন ঐ নাম-না-জানা মহিলা৷
দুই ড্রয়ার ওয়ালা টেবিলটা নষ্ট হয়ে গেছে। যারা পেয়েছিল তারাই অযত্নে নষ্ট করেছে৷ আর মেয়েরা তো কিছু পায় না, খুব ছোট স্মৃতিমাখা জিনিসগুলো থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হয়, পাছে আরও বেশি কিছু চেয়ে বসে৷ তবু আমি জানি দুই ড্রয়ার ভর্তি এই যে দেশভাগের গল্প, এ থেকে বঞ্চিত করে এমন কারও সাধ্য নেই। ওরা থাকবে, কারণ এরাই আমার পূর্বজাদের উত্তরাধিকার। যখন গোটা মহাদেশে মানুষের অবনমন হয়েছিল রক্তপিপাসু দানবে, যখন মানবিকতার থেকে বড় হয়ে উঠেছিল ধর্ম পরিচয়, তখন এই মেয়েদের গভীর সাহসের পরিচয়, মায়া মমতার কাহিনী, পাশে দাঁড়াবার আখ্যান চিরকাল থেকে যাবে, সব ক্ষতের ওপর শুশ্রূষার শান্তিজল হয়ে!