রাস্তার ধারে ঝুপসি গাছপালাগুলো অব্দি কুয়াশার কম্বল মুড়ি দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একটু বাতাস বইলে দেখায় বিশাল দৈত্যের মাথা নাড়ার মতো। ধোঁয়া-ওঠা বুক নিয়ে এলিয়ে পড়ে থাকা নদীর দিক থেকে কেমন একটা গোঁওওও শব্দ ভেসে আসে, যেন কেউ কাঁদে, কষ্টে গা মোচড়ায়, নিজের গলায় নিজের দশ আঙুল চেপে ধরে।
তাতে গা শিরশির করলেও অষ্টমী ভালোই জানে আসল বিপদ লুকিয়ে আছে পেছন বাগে। সে বিপদ যে কখন বিদ্যুতের মতো ঘাড়ের ওপর অব্যর্থ লাফিয়ে পড়বে কেউ জানে না। সে এক আশ্চর্য হলদে আগুনের শিখা, তাকে দেখার আগেই নিজের কানেই শুনতে পাবে নিজের ঘেঁটি ভাঙার মট মট শব্দ, আর কিছু বোঝার আগেই এতো আলহাদের শরীরখানা তেনার কষে ঝুলতে থাকবে। যেন তুমি আর মানুষ নও হে, দাঁত বার করা মরা বেড়াল একটা। শিউরে উঠে অষ্টমী তার কালো ফাটা হাতখানি কোঁকড়া চুলে ঢাকা ঘাড়ের ওপর আলগোছে বুলিয়ে নেয়। রক্ষে কর সোনার বন্ন বনবিবি, মা আমার!
ভয় তাকে পেড়ে ফেলে, হঠাৎ এমন কাঁপুনি দেয় যে শরীরের সমস্ত রোঁয়া খাড়া দাঁড়িয়ে ওঠে।
বাঘের ভয়-বসা এই রাস্তাতেও চলতে ফিরতে তার পেছন থেকে কে যেন রোজ সিটি মারে। ঘাড় ঘুরিয়েও কিছু দেখা যায় না। মাঘ মাস শেষ হতে চলল, তবুও রোজ বেলা বসলেই পরদিন বেলা ওঠা অব্দি অন্তরীক্ষ থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো টুপটাপ কুয়াশা ঝরতে থাকে যে। জল জল কুয়াশা, তুলোর আঁশের মতো ইতিউতি ভেসে বেড়ায়, তার ভেতর নিজের হাত মেলে দিলে সে হাতও হারিয়ে যায়। কে সিটি মারে, অষ্টমী দেখে কী করে!
খরাঠি ধান বা খরার সময় যে ধান হয় তা রুইবার কাল এখন। বাবুরা একেই বলে বোরো ধান। সেই ধানপাতা রুইতে ক্ষেতে গিয়ে নেমেছ কী, অমনি তলতলে কাদায় ভরা মা ধরিত্রী তোমার পা দুখানিরে নিজের বুকের গভীরে টেনে নেবেন। ফ্যাঁচ করে শব্দ হবে, পাঁক ছিটকে উঠে শাড়ি ছুঁতে চাইবে, কিন্তু অষ্টমীরা কী কম সেয়ানা, শাড়ির ঘের হাঁটু অবধি আগে থাকতেই তুলে রাখে। কোমরে বাঁধা একখান লাল গামছা, মাথার পুরুষ্টু খোঁপাখানি সবসুদ্দু আরেক খানের আড়ালে অদৃশ্য। কানজোড়া ঢাকা থাকলে জাড় তেমন লাগে না একথা সবার জানা। তাছাড়া সারা দিনমান কোমর নুইয়ে চারা পোঁতার সময় পাঁকের ছিটা তো ছিটা, বেলা বাড়লে মাথার ওপরের গনগনে আগুনের তাত থেকেও অনেকটা যেন বাঁচা যায়। নাহলে নীচে নরম কাদা, ওপরে এই তাপ, দিনের শেষে অষ্টমীরা খোলা মুচি নামের সেদ্ধ পিঠে হয়ে বেরতো বোধহয়।
অবশ্য খোলা মুচি হবার আর বাকী থাকে কী ! যখন বেলা চারটে সাড়ে চারটেয় তিনশ টাকা ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে অষ্টমী বাড়ি ফেরে, তার কোমর বাঁশের ডগার মতো কেবলই নুয়ে পড়তে চায়, চোখ ঢোকে কাঁকড়ার গভীর গর্তে, পোড়া বেগুনের বন্ন ধারণ করে মুখ আর হাতের চামড়া, বুক ভর্তি থাকে তেষ্টা আর মনে বাঘের ভয়। অন্ধকার হবার আগেই তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে গ্রামের সবচেয়ে জনবহুল এলাকায় ঢুকে পড়তে হবে তাকে। কোমর দুলিয়ে ছোটে অষ্টমী, আবছা অন্ধকারে মনে হয় বাঘের ভয়ে পুরুষ্টু হরিণ ছুটছে।
সেইসময়ও পেছন থেকে কেউ যদি ঘন ঘন সিটি মারে, মেয়েটার মনের অবস্থা কেমন হয় !
তো অষ্টমী এইভাবে সিটি খেতে খেতে কাজে যায়, কাজ থেকে ঘরে ফেরে! আসলে সে তো খোলা মেয়ে। তাকে ঘিরে ধরবার, মাথার ওপর ছায়া ফেলবার কেউ নেই, কারণ বিয়ের পর একমাস যেতে না যেতেই তার স্বামীকে বাঘে খেয়েছে।
সে বেচারা পেটের দায়ে কাঁকড়া ধরে বেড়াত। নির্জন ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে, বালুচরের বুকের ওপর দিয়ে ছোট ছোট ঝোরা যেখানে বড় নদীর সঙ্গে এসে মেশে, ঠিক সেই মুখে আঁটোল পেতে রাখতো মুশকো জোয়ান লোকটা। খুব সরু সরু ক'রে ছিলে নেওয়া বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি চৌকো লম্বা বাক্সের মতো আঁটোল, ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা করা আছে, বেরোবার নাই কো। বুগিমাছ আর সাতহাতিয়া মাছ খন্ড খন্ড করে কেটে, নুন মাখিয়ে, কড়া রোদে শুকিয়ে সেই চারা ছড়িয়ে দেওয়া হয় আঁটোলের সর্বত্র। এই চারা কাঁকড়ার বড় প্রিয় খাদ্য, গন্ধ পেলে গর্ত ছেড়ে তারা গুটি গুটি বেরবেই । তারপর নদীর মাঝ বরাবর নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকো, চাঁদের মরা আলোয় একটু পরেই দেখতে পাবে, দুহাতে ধরে ওঠাতে পারবে না এমন বড় বড় কাঁকড়া অষ্ট পদে বালি সরিয়ে আঁটোল ভরতে ছুটে আসছে। মনে হবে বিশাল সাদা চর জুড়ে অসংখ্য গোলাকৃতি সচল ছায়া ! ভোরের বাতাস যখন নৌকার নড়া ধরে নাড়িয়ে দেয় একটু, তীরের দিকে তাকে যতটা নেওয়া যায় নিয়ে গিয়ে অষ্টমীর ঘরের লোকটা চুপিসারে জলে নেমে আঁটোল তুলে নিয়ে আসত। ভর্তি খাঁচাটায় তখন ছোট বড় কাঁকড়া কাঁটা লাগানো পায়ে এ ওকে জড়িয়ে ধরছে, ওপরে উঠছে, নীচে নামছে।
একরাতে, না রাতে না, ভোররাতে, নৌকা মিঠে হাওয়ায় অল্প দুলতে লেগেছে, তাতে নদীর জল একটু একটু কুঁচকে উঠছে, আঁটোল তুলতে গিয়ে অষ্টমীর বর দ্যাখে ইয়াব্বড় এক রাজা কাঁকড়া আঁটোলের পাশেই গর্ত থেকে গতরখানা বার করে তাকে দেখছে। কাউরে কিছু না বলে সে নি:শব্দে সেদিক পানে যায়। কিন্তু যেই না ছুটন্ত পায়ে পায়ে বালিচরের অন্তরে মৃদু কাঁপন জাগে, অমনি সে ক্যাঁকড়া টুপ। গর্তের ভেতর ঢুকে গেছে। কিন্তু অতো নধর গতরখানা দেখে ফেলার পর আর কি তারে ছেড়ে দেওয়া যায় ! লোভে নাল-পড়া মানুষটা তার কড়াপড়া খেটে খাওয়া হাতখানি সঙ্গে সঙ্গে গর্তের ভেতর সেঁধিয়ে দেয়। যাবি কোথায় রে নাদুস, বারউঠোনে তিন মাথাওয়ালা মাটির উনুনে কাঠকুটোর আঁচে তোরে রান্না করলে ঝোল যে পুরো লাল বন্ন ধারণ করবে! বাজারেও তুই অনেক টাকায় বিকোবি !
কে আর কোথায় যাবে, বাঁকানো ছুরির ফলা বসানো দাঁড়া দিয়ে সে কাঁকড়া তো ততক্ষণে চেপে ধরেছে ঘাতকের শক্ত হাত। যন্ত্রণায় চোখ উলটে যেতে যেতেও লোভী লোকটা ভাবে, এটা নিশ্চয়ই মেয়ে কাঁকড়া, এই শীতকালে ওর সারা শরীরে থকথকে ঘেনু জমে আছে, জমাট ঘিয়ের মতো, তরকারীতে দিলে ডিমের কুসুমের মতো ঝোলে ইতিউতি ভেসে বেড়াবে, কী তার আস্বাদ!
কিন্তু তার শতেক টানাটানি বৃথাই যায়, উলটে ক্রমে হাতের মাংসে গেঁথে বসতে থাকে ছোটবড় ধারালো চারটে ফলা, শালা গর্তও এমন মাপে মাপে যে শত টানাটানিতেও মোটা পুরুষালি হাত উঠে আসে না কিছুতেই । আর না পেরে নৌকোতে কালঘুমে ঘুমিয়ে থাকা পাড়ার ছেলে সুদামকে কাতর কিন্তু গভীর কন্ঠে হালকা ডাক দেয় লোকটা, আমারে বাঁচা রে সুদাম।
বাঘের ভয়ে সে তো বাপ রে মা রে বলে চিৎকার দিতেও পারছে না!
ভোরের মিঠে হাওয়ায় সে ডাক কোথায় ভেসে যায়। সুদামের নিদ্রা ভাঙে না, কিন্তু দূরে ঝোপের আড়ালে হাঁড়ির মতো বড় মাথা নিয়ে লুকিয়ে থাকা বনের রাজার ছোট ছোট কান মূহুর্তে নড়ে ওঠে। সারা শরীর টান টান আর লেজ শক্ত হয়ে যায়। সুদাম নাকি কিছুই টের পায়নি, তবে ঘুমের ঘোরে কারও বিলাপ শুনেছে ছেঁড়া ছেঁড়া, ওরে আমারে এখনও উঁচায় তোলেনি রে, ঘেঁটিটায় দাঁত বসেনি তেমন, ছুইট্যে আয় ভাই, আমারে বাঁচা! কেঁকড়ার গত্ত থেকি হাত তুলতি না পেরি এ আমার কী হল রে বাপ!
কিন্তু সুদাম তো ভেবেছে স্বপনের ঘোর! তাছাড়া বাদাবনের অতৃপ্ত আত্মাদের রাতবেরাতে কাঁদনের কথা কে-ই বা না জানে। সেসবে কান দিলে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে কোন দূরে! ঘুমের মধ্যেই সুদাম গামছা চাপা দিয়েছে কানে, পাশ ফিরে শুয়েছে, ভোরের এই সময়টায় নিদ্রা দেবী যেন নিজে তার চোখের ওপর হাত চাপা দিয়ে রাখেন! কিছু পরে কী মনে হওয়াতে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখে সঙ্গী হাওয়া। আঁটোলের পাশে বালিতে ভারী জিনিস ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাবার দাগ কিছুদূর অব্দি, তারপর নিশ্চয়ই লোকটাকে মুখে তুলে নিয়েছিল, ঝোপেঝাড়ে তার ছেঁড়া জামা, লুঙ্গি, চাপ চাপ রক্ত, এ-ই নাকি পড়ে ছিল।
এই বনজঙ্গল নদীনালা পশুপাখি রকমারি মানুষ মিলে রাতদিন যেন এক যাত্রাপালার আয়োজন, এইরকম মনে হয় অষ্টমীর। সারাক্ষণ গরীবের মাথার ওপরে তলোয়ার ঘুরছে বনবন, চুপিচুপি কাঠ কেটে আনো বা বাগদার মিন ধরতে যাও, মধু যোগাড়ে ছোটো কী মাছ ধরো, পার্টি কত্তে যাও কী সরকারি সাহায্য যোগাড় কর, তলোয়ারটির ঘোরার বিরাম কই! মাথা ঝুঁকিয়ে, নাড়িয়ে, ঘুরিয়ে, নানা কায়দা করে পারো তো নিজেকে বাঁচাও, নাহলেই পর মূহুর্তে তোমাকে কন্ধকাটার সাজে নাচতে গাইতে হবে। পেটের গর্তে আগুন নেভে না, খাবার পড়লে একটু কমে থাকে শুধু, তাই এখানে ঝলমলে রাজসাজ থেকে ন্যাতাকানি পরা বা উলঙ্গ হয়ে যেতে লাগে দুটো টুসকি বা চোখের পাতা ফেলার মতো সময়। যেদিন তার সিঁদুর ঘসে ঘসে তুলে দিল সবাই মিলে, সেদিন থেকে অষ্টমীর এই ভাবনা। গরীবের ঘরেও বিয়েসাদিতে বর কনে নতুন কাপড় পরে, দু পাঁচজন ভাত ডাল খায়। মাত্র একমাস আগে সেসব অষ্টমীর জীবনে ঘটেছিল। ভাঙা চালা চুইয়ে পরা জোছনায় হুমদো বর হামলে পড়ে তাকে সোহাগ করেছে। আর আজ সে খিদের আগুন কমাবার জন্য নিরিবিলি অন্ধকারে বাঘে-ধরা রাস্তা দিয়ে ধানপাতা রুইতে যাচ্ছে। এখন কান-ফাটানো সিটির আওয়াজ হলেও সে স্বস্তি পায়, একেবারে একা তো নয়, পেছনে কেউ আছে তাহলে।
সেদিন আকাশ খুব মেঘলা করে এলে প্রায় সবাই চলে গিয়ে ক্ষেত ফাঁকা। আগে কাজ শুরু করেছে যারা, তারা আগে যাবে, পরে এসেছে যারা, তারা পরে। এটাই নিয়ম। অষ্টমীর শরীলটা সকালের দিকে লাগছিল যেন ন্যাতাকানি, কতো দিন জ্বরে ভুগে উঠেছে বা। রোগাসোগা মায়ে বলছিল বটে, অষ্টা আজ আর যাসনি, কিন্তু সেই সর্বদা জ্বলতে থাকা আগুনের তাত চেগে উঠতেই দে ছুট ছুট। হুমড়ি খেয়ে ধানের চাতোরে পড়ে গামলায় ধানপাতা তুলে ক্ষেতে নিয়ে আসতে আসতেই চারদিক ফর্সা। তাই চটপট হাত চালাচ্ছিল অষ্টমী, এমন সময় চোখ না তুলেও মনে হল তার দিকে কেউ নজর পেতে রেখেছে। জঙ্গলের সীমানা-ছোঁয়া এই জমি, একথা মনে হতেই লাফিয়ে ওঠে অষ্টমী। বাঘ নয়তো? তারা নাকি ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে থেকে শিকারের ঘেঁটি তাক করে বসে থাকে অনেক্ক্ষণ। আকাশে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দূরের সবুজ প্রান্তরেখার দিকে তাকায় সে, চোখ দুখান দিয়ে জরিপ করে জমির গা ঘেঁষে আসা হলুদ ঘাসের থোপা, তাদের পেছনের হেতালি খেজুর গাছের ঝোপ। অনেকক্ষণ ধরে দূরে তাকিয়েও তার অস্বস্তি যায় না, কে যেন তাকে দেখতেই আছে! অবশেষে নিজের ডানদিকে তাকিয়ে অবশ শরীরে একটু বল পায় অষ্টমী, বাঘ নয়, আল-কাটা পাশের জমিতে খালি গামলা হাতে তার দিকে চেয়ে আছে সুদাম। চোখে চোখ পড়তেই থতমত খেয়ে সে ছেলে চোখ নামায়, জলকাদায় থেবড়ে দেওয়া চওড়া পায়ের পাতায় ছপছপ শব্দ তুলে রাস্তার দিকে হাঁটতে শুরু করে।
অষ্টমী জানে, সুদামের সাহস নেই তার চোখে চোখ রাখার। একই গ্রামে বড় হয়ে উঠেছে তারা। ছোটবেলা থেকে দেখছে সে সুদামেরে। কেষ্ট ঠাউরের মতো চেহারা। বাবরি চুল, বাঁশির মতো নাক। সম্পর্কে তার মরা বরের মাস্তুতো ভাই। চেরকাল অষ্টমীরে আড়েঠারে দেখতো। এক একদিন তাদের ঘরের চৌকাঠে অনেকক্ষণ বসে থাকত, যেন যা বলার আছে তা উগরাতে কষ্ট হচ্ছে। তার মা জিজ্ঞাসা করলে লজ্জা লজ্জা করে হেসে কইতো, কিছু না মামী। অষ্টমীর বিয়ের পর বৌদির সঙ্গে কথাবার্তা বিশেষ হতো না, তবে নিজের মাস্তুতো দাদার সঙ্গে কাঁকড়া, মধু, কী গোলপাতার জন্য বনেবাদাড়ে যেত। সবাই বলে, ওর মন নাকি ভারী নরম । মিঠে মিঠে কথা কয় আর ভদ্র ব্যবহার বলে এ তল্লাটে সবাই ছেলেটাকে ভালবাসে। তাই কারোরই অবিশ্বাস ঘটেনি, যখন সে নিজেই সকলকে বলেছে ভোর রাতে স্বপনের ঘোর কাটেনি তার, তার অজ্ঞাতে অষ্টমীর স্বামীরে নিশ্চুপে বাঘে টেনে নে গেছে। এই ঘটনা নাকি তাকে এমনই মরমে মেরে রেখেছে যে সদ্য বিধবা দু:খী মেয়েটার সঙ্গে কথা বলা দূরে থাক, মুখোমুখি হলেও সে রা-টি কাড়ে না, অষ্টমী-বৌদির পায়ের পাতায় চোখ রেখে তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে ধাঁ হয়ে যায়।
এই সবই অষ্টমী লোকমুখে শুনেছে। তাই সুদামের চলে যাওয়া দেখে সে আশ্চর্য হয় না। বরং খানিক দূর গিয়েও আজ সে ফিরে আসছে দেখে তার অবাক লাগে। অমন হুড়মুড়িয়ে ফেরত আসে ক্যান! সুদাম অবশ্য চোখ তোলে না, কাদাজলে চোখ ডুবিয়ে বলে, হয়নি তোমার? তো আমারেও দাও খানিকটা। বেলা তো বইসতে চললো, আমি কিছুটা রুইয়ে দি।
অষ্টমী এমনিতেই ঠান্ডা মেয়ে, কারুর সঙ্গে চোপা করা, গলা তুলে চেঁচানো, তার ধাত নয়কো। আর সে ভালো করেই জানে, বাঘের দেখা, কপালে লিখা। স্বামীকে বাঘে টেনে নিয়ে গেছে বলে সে নিজের ভাগ্যকে দোষে, কিন্তু অন্য কারও ওপরে তার রাগবাগ নেই। যাকে ভালমতো চেনেইনি, মুখটাও আর স্পষ্ট মনে পড়েনা, বয়সে অনেক বড় সেই মানুষের জন্য তার খুব কাঁদন আসে না। তবে অন্যেরা নেই-কারণে কাঁচাখাগী, অমঙ্গুলে ডাক পাড়লে মন খারাপ হয় বৈকি। যে কোনো শুভ কাজে তার আমের পল্লব, ঘট, কলাগাছ দিয়ে সাজানো বাড়িতে ঢোকা নিষেধ। গঙ্গা নিমন্ত্রণে কাঁখে কলসি নিয়ে গান গাইতে গাইতে যায় সধবা আর কুমারী মেয়েরা, মুখোমুখি হয়ে গেলে অষ্টমী নিজেই নয়ানজুলিতে নেমে দাঁড়ায়। হাঁপ-টানা বুড়ি মা মরলে কোথায় যাবে সে জানে না। এইসব ভেবে মন খুব বেশি খারাপ হলে পুকুরে নেমে ডুব দিতে দিতে চোখের জল ফেলে আরও ঠান্ডা হয়ে সে ঘরে ফেরে। কিন্তু কখনও গলা উঁচু করে না, গালমন্দ করা দূরে থাক। এমন কী তার সোয়ামীরে খেয়েছে যে, সেই বাঘের ওপরেও তার তেমন রাগ নেই। বাঘ হচ্ছে বনের তালুকদার, স্বয়ং দক্ষিণ রায় তারে এই অধিকার দেছেন, আর সেই তাকেই তালুক ছাড়া করে মানুষ সব কিছুর দখল নিতে চাইলে, তার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিলে, তারে ফাঁদে ফেলে কুপিয়ে মারলে, সে তো দাঁত নখ বার করবেই।
আসলে সর্বগ্রাসী এক অসহায় দু:খ ছাড়া আজকাল অষ্টমী যেন কিছুই অনুভব করে না। তাই এখন নিশ্চুপে এক গোছা ধানপাতা সে সুদামের হাতে তুলে দেয়। দুজনেই মন দিয়ে ধান রুইতে লাগে, বেশি সময় হাতে নেই, খুব আন্ধার করে এসেছে চতুর্দিক। রোয়ার কাজ যখন প্রায় শেষ, মাটির ওপর নুয়ে থেকেই অষ্টমীর কানের কাচে মুখ এনে সুদাম প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে, শহরে যেতি মন চায়নি তোমার? কত মেয়েছেলেরা তো বাবুর বাড়ির কাম নিয়ে চইলে যেতিছে। এতো কষ্ট নাই সেখানে। স্বামী স্ত্রী দুইজনা মিলে বাবুর বাড়ির গ্যারেজে থাকে। দুইজনেই খাইটে খায়। যাবা?
আকাশে মেঘ হুহুঙ্কার ছাড়ে, বনের দিক থেকে বাতাস এসে ঠেলা দেয় দুজনকেই। দূরে কোথায় বাজ পড়ে, অষ্টমী কেঁপে ওঠে৷ বনের রাজা বুঝি ডাক ছাড়লেন গো! ভয়ের কাঁপুনি ছাড়াও সে কাঁপে, কারণ আকাশ থেকে দু একটি ঠান্ডা জলের ফোঁটা তার উদোম হাতে আর কন্ঠায় এসে পড়ে। অমনি সুদাম নিজের কাদা মাখা গামছা খুলে সেইসব জলের ফোঁটা মুছতে মুছতে অষ্টমীর উঁচু বুক ঘেঁষে দাঁড়ায়। আশ্বাস দেবার মতো করে বলে, ভয় নাই, ভয় নাই, ও বাঘের ডাক নয়, বাজের ডাক। আমি থেকতি তোর ভয় কী পাগলি!
হাওয়ার ঝাপটায় তার বাবরি চুল হু হু করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটার চোখেমুখে। বন-ছোঁয়া আকাশের গম্বুজ, সেখান থেকে কুয়াশার মতো মিহি বৃষ্টির অবিরল ধারাপাত, হাওয়ায় পাগলের মতো মাথা হাঁকড়ানো গাছের দল, সবাই মিলে যেন একটি আড়াল তুলে দিয়ে তাদের বাইরের পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেয়। সেখানে অষ্টমী আর সুদাম ছাড়া আর জনপ্রাণী নেই। এমনকি পায়ের নীচের জলকাদা, কচি সবুজ ধানপাতা, সব অদৃশ্য হয়ে গিয়ে যেন রায়মঙ্গলের থেকেও এক চওড়া ক্ষেপা নদ তাদের ফিরে ফিরে নাচায় ঢেউয়ের মাথায়।
কতক্ষণ কে জানে, দুজনেই কাদাজলে ওলটপালট খায়, দুজনেই দুজনার দেহের নৌকায় দাঁড় বায়। কোনো চাঁদনি রাতে এইরকম কিছু একটা তার সঙ্গে ঘটেছিল এইরকম ছেঁড়া ছেঁড়া মনে পড়ে অষ্টমীর। অপ্রস্তুত সলজ্জ শরীরে মনে তাকে জবরদস্তি ছাড়া সেদিন আর কিছু মনে হয়নি। আজ কিন্তু এমন নেশা লাগে অষ্টমীর, সে এঁটুলি হয়ে লেগে থাকে সুদামের বুকে। ঘরে ফিরলে মাথার চুল থেকে পা অব্দি কাদা মাখা পেত্নীকে দেখে মা আঁতকে উঠবে এই বোধও যেন তার বিলুপ্ত হয়েছে। বাঘে-ধরা, ভুতে-পাওয়া মানুষের মতোই সে গোঁ গোঁ করে বলে, আমারে দেখলে আড়াল থিকে কোন ব্যাডায় যেন সিটি বাজায়। সুদাম তার বুকের ধুকপুকি শুনছিল উবুর হয়ে শরীর ছেড়ে দিয়ে। এবার সে কাদা-মাখা মাড়ি বার করে হাসে, নিজের বুকে আঙুল ঠোকে, এই যে সেই ব্যাডা, তোমার দাস। মাথা উঁচু করে অষ্টমী, তুমি, তুমি সিটি বাজাইতে! সুদাম এবার মাটির ওপর উঠে বসে। মহা উৎসাহে বলে ওঠে, আরও যা করিছি, শুনলে চমকে উঠবা নে।
অষ্টমী স্থির তাকায় কাদা-মাখা ভুতের চোখে, সেখানে বাঘের মুখে ঝোলা এক মানুষের ছায়া চমকায়, জাগন্ত থেকেও কে যেন নৌকার ভেতর গামছায় কান ঢেকে গুটিসুটি শুয়ে। অন্যের মরণ-বিলাপ শুনেও এগোয় না। বিলাপ মিলিয়ে গেলে ভয়ে ঝপাস ঝপাস দাঁড় বেয়ে দূরে মিলিয়ে যায়।
যেন সে নিশ্চয় জানে সুদাম কী বলবে, এইভাবে অষ্টমী ঝটাস হাত চাপা দেয় তার মুখে, ফিসফিসিয়ে বলে, ওসব কথা শুনতি চাইনে, কোনও দিন বলবা না! বাঘে খাবে তবে তোমারেও, এই দিব্যি রাখলাম।