বাস্তব আর কল্পনা কোথায় যে হাত ধরাধরি করে চলতে শুরু করবে কেউ জানে না। আসলে তাই-ই তো স্বাভাবিক। কল্পনার পা থাকে বাস্তবের বুনিয়াদে, বাস্তব নিয়ন্ত্রিত অথবা অনিয়ন্ত্রিত হয় কল্পনার লাগামে অথবা লাগামহীনতায়।
গুরুচন্ডা৯তে অমিতাভ চক্রবর্তীর খড়্গপুর আইআইটির ছাত্র ফয়জান আহমেদের মৃত্যুর ওপর সুলিখিত প্রতিবেদনটি পড়ে এইরকম মনে হল। এই নির্মম ঘটনাগুলো নিয়ে কাজ করতে গেলে মানুষকে অনেক অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুরতা, গোপন রক্তপিপাসার মুখোমুখি হয়ে বিহবল হয়ে যেতে হয়। অবাক লাগে ভাবতে যে এই ধরনের কাজের অনেকগুলোই অবিশ্বাস্য দ্রুততায় করে ফেলে যারা, তারা সবাই কিন্তু ভাড়াটে খুনি বা সাইকোপ্যাথ নয়। তারা অনেক সময়ই মধ্যবিত্ত ঘরের দুধ ঘি খাওয়া মেধাবী ছেলে। আমাদের সন্তান। সমাজের সবচেয়ে সুবিধাভোগী অংশ। দারিদ্র নয়, সেকারণে নীতিহীনতাও নয়, নিষ্ঠুরতার জন্যই নিষ্ঠুরতা কী করে তাদের বীজমন্ত্র হয়ে ওঠে, কে জানে!
কেন এত কথা? শোনা যায় ফয়জানের মৃত্যু আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল কর্তৃপক্ষ এবং মেডিকেল কলেজও। কিন্তু সদ্য প্রকাশিত দ্বিতীয়বারের ময়না তদন্তের রিপোর্টে পরিষ্কার বলা হয়েছে, এটি আত্মহত্যা নয়, মাথার পেছন দিকে এবং বুকে প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে মৃত্যু ঘটেছে আসাম থেকে আগত এই মেধাবী তরুণের। আরও জানা গেছে, তার ঘাড়ে গুলির দাগ আছে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে প্রবল প্রহার করে তারপর গুলি করা হয়েছিল ফয়জানকে? স্মর্তব্য, এই দ্বিতীয় বারের ময়না তদন্ত হয়েছে হাইকোর্টের নির্দেশে। নাহলে সব ধামাচাপা পড়েই থাকত।
গুরুচন্ডা৯ প্রকাশিত রসিকার ছেলে উপন্যাসে রোহিত ভেমুলার ছায়ায় গড়া কেন্দ্রীয় চরিত্র রোশনের পাশে আছে ফয়জান, স্বনামে নয়, তার নাম ওখানে ফয়জল। তার মৃত্যুর পর মা ছুটে এসেছেন অতদূর থেকে। তাঁর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করেছে কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় পুলিশ, তার বর্ণনা আছে। সেই সময় প্রকাশিত বিভিন্ন কাগজের রিপোর্ট ঘেঁটে লেখা। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অনেকের ইন্টারভিউ নিয়ে তারপর তিলে তিলে গড়া হয়েছে এই দুর্ভাগা তরুণের চরিত্র। তাকে দাঁড় করানো হয়েছে রোহিত ভেমুলার পাশে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায় এই ২০১৬ এবং ২০২২ কে এক সুতোয় গেঁথে ফেলাকে অন্যায়ের প্রবহমানতা দেখাবার পক্ষে খুবই কার্যকরী হয়েছে বলে ভেবেছেন।
আমরা পড়ে দেখতে পারি উপন্যাসের কিছুটা অংশ, যেখানে মায়ের চোখের জল আর প্রবল আকুতি বৃথা হয়ে যাচ্ছে। এমপ্লুরা নামের রাসায়নিক দিয়ে যে নরপশুরা ফয়জানের মৃতদেহ অবিকৃত রাখবার চেষ্টা করেছিল, তাদের নির্লিপ্ততা। রসিকার ছেলে প্রকাশ করে গুরুচন্ডা৯ যে সামাজিক যুদ্ধের সূচনা করেছে, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অমিতাভ চক্রবর্তীদের প্রতিবেদন।
রসিকার ছেলে থেকে উদ্ধৃতি
“আইআইটিতে নেমে প্রথমে ফতিমা আন্টিকে গেস্ট হাউজে তুলল রোশন। দুজনেই হতবুদ্ধি, শোকে উন্মাদ, তার মধ্যে রোশনই সম্পূর্ণ কান্ডজ্ঞান হারায়নি। কাউকে না কাউকে তো খোঁজ খবর নিতে হবে। থানায় যেতে হবে, ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট, ডেথ সার্টিফিকেট এরা আগেই অন লাইন পাঠিয়ে দিয়েছে।
রোশন না ভেবে পারে না যে ফিজুর শরীর এখন মাটির নীচে মাটি হয়ে যাচ্ছে। তাদের গ্রামে নতুন কবর হলে সবসময় তা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়। পেছনে ফেলে যাওয়া মানুষের স্নেহ আর যত্নের মতো মৃতকে আগলে রাখে ঐ বেড়া। স্বজনরা এসে বেড়ার এপাশে দাঁড়িয়ে বা বসে কান্নাকাটি করে, কখনও মৃতের সঙ্গে কথা বলে নিজের মনে। তারপর কালের নিয়মে শোক প্রশমিত হয়, বেড়া জীর্ণ হয়ে মাটিতে মিশে যায়। তবু যেন কিছু থেকে যায়! বড় কোমলতা আর ভালবাসা মাখা এই বিদায় জানানোর পদ্ধতি! কিন্তু বিদেশে বিভুঁইয়ে কোথায় যে ফিজুকে এরা কবর দিয়েছে, কোন কবরিস্তানে, তা পর্যন্ত এখনও দেখা হয়নি তাদের। ছবিতে তো সব বোঝা যায় না।
যে ছেলে আগের সন্ধেয় কথা বলেছে রোশনের সঙ্গে, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী হিসেব কষে দেখা গেল, পরের পনের/ষোল ঘন্টার মধ্যে তার মৃত্যু হয়েছে। মাত্র পনের/ষোল ঘন্টা ! একটা গোটা দিনও তো নয়!
রাতে ছ’ সাত ঘন্টা তো সে নিশ্চয়ই ঘুমিয়েছে। সকাল হবার পর বাকি ন’ দশ ঘন্টায় কী এমন ঘটল যে ফিজু একটা অচেনা ফাঁকা ঘরে গিয়ে কালঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল! ভাবলেই রোশনের বুকের ভেতরটা বেবাক ফাঁকা হয়ে যায়, যেন তার হার্ট, লাংস,পাঁজর, কিছুই নেই। নিজের বুক চেপে ধরে রোশন, সেখানে সর্বগ্রাসী শূন্যতার মধ্য দিয়ে কোন দৈবী মায়ায় লাবডুব লাবডুব আওয়াজ ভেসে আসছে তবুও!
সন্ধেবেলায় ক্যাম্পাসে তারা পৌঁছনোর পর ভীম আর্মির কমরেডদের সূত্রে রাজশেখরন নামে একটি ছেলে দেখা করতে এল। না, সে এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। কারণ ওই সময়ে সে অন্ধ্রে নিজের বাড়ি গিয়েছিল। সে শুধু রোশন যেখানে বলবে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে। এত বড় ক্যাম্পাসে নাহলে কোথায় কী আছে, কোনও নবাগতের পক্ষে তা জানা সম্ভব না। এটুকু সাহসও তার হত না, কিন্তু সে খুবই সিনিয়র ফেলো, আর কয়েক মাসের মধ্যেই পাততাড়ি গুটিয়ে বাড়ি ফিরে যাবে। রোশন তাকে বলল,
আগে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে আন্না? যেখান থেকে প্রথম ডাক্তার গিয়ে মৃতদেহ পরীক্ষা করেছিলেন? তারা বাইকে স্টার্ট দিচ্ছে, এমন সময় পাগলের মত ফতিমা ছুটে এল,
- আমাকে না নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস বিড্ডা? আমি যাব, আমি যাব।
তার মুখের দিকে তাকিয়ে রোশন বুঝল কিছুতেই তাকে ফেলে যাওয়া চলবে না। তাই ফতিমাকে মাঝখানে বসিয়ে ছেলেদুটো দুজন দুদিকে বসল।
ক্যাম্পাসের এই পুরনো হাসপাতালটা গেস্ট হাউজের কাছেই। অনেক দূরে কোথায় নাকি আই আই টির জন্য সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হচ্ছে। এখনও বেশিটা এই হাসপাতালই সামলায়। রাজের বাইকের পেছনে বসে পাঁচ মিনিটে রোশন আর ফতিমা সেখানে পৌঁছে গেল। মূল প্রবেশ পথে ঢুকে বাঁ দিকে যেতে হল, তারপর ডাইনে একটা লম্বা করিডরের শেষে পাশাপাশি আবার অনেকগুলো ঘর। করিডরে লম্বা বেঞ্চে বসা রোগীদের ভিড় ছিল, পোশাক-পরা নার্সরা যাতায়াত করছিল, কথাবার্তা, জুতোর শব্দ, দরজা খোলা বন্ধের ক্যাঁচক্যাঁচ, ওষুধের গন্ধ, বেশ গ্যাঞ্জাম হয়ে ছিল জায়গাটা। রাজশেখরন রোশনের দিকে ফিরে বলল,
- সেদিন ছেলেরা প্রথমে ছুটে আউটডোরেই এসেছিল। কিছু ঘটলে ওরা সবসময়ই তাই করে। ওরা তো বুঝতেই পারেনি, শেখ ফয়জুল মরে গেছে, না অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। পরে পোস্ট মর্টেম করে জানা গেছে চারদিনের বাসি মরা ছিল। কিন্তু আশ্চর্য হয়েছি এই শুনে যে মৃতদেহ থেকে কোনো গন্ধটন্ধ বেরোচ্ছিল না। এমার্জেন্সি থেকে ডাক্তারকে ওরা হস্টেলের সেই ঘরটায় নিয়ে যায়।
- সেই ডাক্তারের আজ ডিউটি আছে তো? আমি তার সঙ্গে কথা বলব।
- হ্যাঁ, সেসব খবর আগেই নিয়েছি। আজ ওঁর এখানে নাইট ডিউটি আছে।
একটা ভারী কালো কাঠের দরজায় রাজশেখর ঠকঠক করে। তার ওপরে নেমপ্লেটে লেখা ড: ধরিত্রী সান্যাল, এম ডি। ভেতর থেকে নারীকন্ঠে প্রত্যুত্তর আসে,
- প্লিজ কাম ইন।
একসঙ্গে এত লোককে ঢুকে পড়তে দেখে ডাক্তার-ম্যামের ভ্রূ কুঁচকে যায়,
- রোগী ছাড়া আর দুজন বাইরে দাঁড়ান। আমি দরকার বুঝলে ডেকে নেব।
রাজশেখর বা রোশন কিছু বলার আগেই ফতিমা হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠে, সামনের টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে জড়ানো গলায় ডাক্তারকে নিজের ভাষায় জিজ্ঞাসা করে,
- নোডিডিয়া নান্না মাগু? আপনি কি আমার বাছাকে দেখেছিলেন?
ডাক্তার হতবাক হয়ে যায়, তারপর ভাষা না বুঝেও কী একটা সন্দেহ তার কপালে ভাঁজ ফেলে। রাজশেখরনের দিকে তাকিয়ে সে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করে,
- এরা কি শেখ ফয়জুলের কেউ হন?
রোশন হাত জোড় করে বলে,
- হ্যাঁ, ইনি ফয়জুলের মা, আমি বন্ধু। ম্যাম, সেদিন আপনি কী দেখেছিলেন, বলবেন আমাদের?
ফতিমার অনবরত ফোঁপানির মধ্যেই ডাক্তার রোশনদের মাথার পেছনের সাদা দেওয়ালে নিজের চোখ গেঁথে রাখে। মুখে বলে,
- বসুন আপনারা। ওঁকেও বসান প্লিজ। আমি পুলিশের কাছে যে বয়ান দিয়েছি, আপনাদেরও তাই-ই বলছি।
সেদিন জনাদশেক ছেলে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে আউটডোরে ডিউটিরত ড: ধরিত্রীকে এসে একটা খুব খারাপ খবর দেয়। একটি সদ্য জয়েন করা স্কলার হস্টেলের একটি অব্যবহৃত ঘরের মেঝেতে পড়ে রয়েছে, সে মারা গেছে না বেঁচে আছে বোঝা যাচ্ছে না। নাকের নীচে হাত রাখলে শ্বাসপ্রশ্বাস বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু দেখতে ফ্রেশ লাগছে, যেন জোরে ধাক্কা দিলেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসবে। এমার্জেন্সিতে ডিউটি তার, প্রচুর রোগী অপেক্ষা করছে, তার মধ্যে এ কী ঝামেলা !
শরদিন্দু চ্যাটার্জি তার জুনিয়র। বললেই চলে যেত। কিন্তু ধরিত্রী নিজেই যাবে ঠিক করল। গত বছরও এইসময় ক্যাম্পাসে একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। পুলিশের কাছে তখনকার ডাক্তার যে বয়ান দিয়েছিল, তাতে অনেক অসঙ্গতি ছিল। তাই নিয়ে সে কী ঝামেলা! ধরিত্রী ঠিক করল সে নিজেই যাবে। ছেলেদের কাছ থেকে ঠিকানাটা ভালো করে জেনে নিয়ে বলল,
- তোমরা এগোও। আমি আসছি।
জিমের সামনে দিয়ে আস্তে আস্তে ড্রাইভ করে এগোচ্ছিল ধরিত্রী, এই রাস্তাটায় বড় বড় সব স্পিড ব্রেকার বিছিয়ে রাখা আছে। উপায় নেই, জিম করে সব আলালের ঘরের দুলালরা সাঁ করে বাইক ছোটান সুইমিং পুলের দিকে। সে সময় তাদের গায়ে এত পুলক লেগে থাকে যে চক্ষে ঘোর ঘনিয়ে কে যে কোথায় বাইক নিয়ে পপাত চ মমার চ হবেন, কেউ বলতে পারে না। এই জেনারেশনটাকে সে ঠিক বুঝতে পারে না।
কখনও মনে হয় ওরাই ভালো, কেমন স্পষ্ট ভাবে নিজেদের চাহিদার জানান দিতে পারে। পোষালে থাক, নইলে কেটে পড়। আবার কখনও মনে হয়, না: বড্ড আত্মকেন্দ্রিক! নিজেদের নিয়েই মত্ত। এই যে ষোল হাজার ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা এতবড় ক্যাম্পাস, এদের মধ্যে ক'জন সমাজের কথা ভাবে, দেশের জন্য মাথা ঘামায়। তবে কিনা, একটু দু:খের হাসি হাসে ধরিত্রী, আমরাই কি দায়ী নই এ জন্য? স্বার্থমগ্নতা কি আমরাই যত্ন করে শেখানোর সিলেবাসে এক নম্বরে রাখিনি? সেখানে একটু আঘাত লাগলেই আত্মহত্যা, নয়ত অন্যকে আঘাত করা। প্রত্যেক বছর ক্যাম্পাসে একাধিক আত্মহত্যা! আর মারামারি তো লেগেই আছে। হাতাহাতি থেকে ধারাল অস্ত্র নিয়ে চোরাগোপ্তা আঘাত করা, সবই ঘটে। তবে প্রশাসনের ভূমিকাও খুব হতাশাজনক। যাই-ই ঘটুক না কেন, সবার আগে প্রতিষ্ঠানের সুনাম, এই নীতিতে চললে, কারও প্রতি সুবিচার করাই সম্ভব নয় !
ছেলেটি যে ভাবে মেঝেয় এলিয়ে পড়েছিল, দূর থেকে দেখেই ধরিত্রীর অভিজ্ঞ চোখ বুঝল, এ মৃত। তাকে লিফটের বাইরে আসতে দেখেই জমায়েতটা সরে সরে পথ করে দিল। ছেলেটার নাড়ি দেখবে বলে হাতটা তুলতেই, কী একটা অনুভূতি তাকে বেদম অস্বস্তিতে ফেলে দিল। অনেক ভেবে ধরিত্রী বুঝতে পারে তার অস্বস্তি হচ্ছে মৃত ছেলেটির ত্বকের বিবর্ণতা দেখে ! অনেক আগে কেউ মারা গেলে তার ত্বক যেমন বেরঙ, শুকনো খড়খড়ে হয়ে যায়, এরও তেমনি। কিন্তু আর সবই অল্পবিস্তর ঠিকঠাক!
ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে ধরিত্রী। আধবোজা চোখদুটো নিয়ে মুখ মাথা একদিকে হেলে পড়ছে। হাত পাগুলো এমন ছেতরানো, দেখলে মনে হচ্ছে গামছা নিংড়োবার মত ওগুলো থেকে কেউ নিংড়ে নিয়েছে মনুষ্যদেহের স্বাভাবিক শক্তির শেষ বিন্দুটুকু। কবে এর মৃত্যু হয়েছে? কতদিন হল ও এই ধুলোভরা মেঝের ওপর পড়ে আছে? নাড়ি দেখা শেষ করে মুখ তুলল ধরিত্রী, স্টেথো বার করতে করতে ছেলেগুলোকে জিজ্ঞাসা করল,
- পুলিশে খবর দিয়েছ?
- হ্যা ম্যাম, পুলিশ আসছে।
আরও দু একটি কথা চালাচালিতে সে বুঝল, কেউই চিনত না ছেলেটিকে, ও যে এইখানে পড়ে আছে সে খবরও কারও কাছে ছিল না। ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল, আজ ছুটির দিনে এই ফ্লোরের কয়েকজন মিলে একসঙ্গে বেরচ্ছিল। হয়ত ফিল্ম দেখবে কিম্বা রেস্টুরেন্টে খেয়ে মুখ বদলাবে। ছোট লিফট, তাই লিফটে কে বা কারা আগে যাবে সেই নিয়ে নিজেদের মধ্যে মজার হুটোপুটি বেঁধে যায়। ধাক্কাধাক্কি করবার সময় একজনের কনুই লেগে হঠাৎ লিফটের লাগোয়া এই ঘরের দরজাটা খুলে যায়। কেউ থাকতো না বলে ওটার কোনো খবর রাখত না কেউ। জানালাবন্ধ ঘরের আধো অন্ধকারে কেউ মাল খেয়ে বেহোঁশ হয়ে শুয়ে আছে, এইরকম ভেবেছিল ওরা। তারপর অনেক ডাকাডাকি করে সন্দেহ হওয়ায় কয়েকজন সময় নষ্ট না করে ডাক্তার ডাকতে হাসপাতালে চলে যায়। এর মধ্যেই পুলিশ চলে আসে। ধরিত্রীকে ওসি চেনে। বছর বছর আত্মহত্যার কেস ডিল করতে হলে পুলিশ, উকিল আর ডাক্তারে মুখ শোঁকাশুকি না হয়ে উপায় থাকে না।
- আরেকটা সুইসাইড?
ওসির সর্দিবসা গলা কানে আসে ধরিত্রীর,
- গায়ে জ্বর নিয়ে আসতে হল ম্যাডাম। এ তো দেখি আত্মহত্যা করেই যদুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবে !
তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে পুলিশবাহিনী। পটাপট সব আলোগুলো জ্বেলে দেয়। কে একজন ভিড়ের মধ্য থেকে বলে ওঠে,
- শেখ ফয়জুল, রিসার্চ স্কলার, লালা লাজপত রায় হস্টেল। রুম নাম্বার টুয়েন্টি টু। আ নিউ কামার টু হিজলি ক্যাম্পাস।
- কে রে, কে? কে বলল কথাটা?
ওসি আবার ঘরের ভেতর থেকে বার হয়ে আসে। রুল উঁচিয়ে ধরে ক্রমশ ফুলে ওঠা জমায়েতের একের পর এক ছেলের দিকে,
- আপনি, আপনি বললেন? নাকি আপনি? কে কী জানেন বলুন, তাতে আমাদের ইনভেস্টিগেশনের সুবিধে হবে !
কিন্তু নিরেট ভিড়টা থেকে একটা টুঁ শব্দও উঠে আসে না। একটা জমাট ধরা শ্বাসপ্রশ্বাসের ডেলা যেন ওটা। প্রাণ আছে, কিন্তু সুপ্ত, শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়া ছাড়া প্রাণের আর কোনও লক্ষণই দেখায় না ভিড়টা। শুধু আলো পিছলে যায় সুন্দর প্রসাধিত বুদ্ধিদীপ্ত মুখগুলোর ওপরে। বড্ড চকচকে, বড় বেশি উজ্জ্বল যেন ! কৃত্রিম উজ্জ্বলতা। ধরিত্রীর মনে পড়ে ক্যাম্পাসের বাইরে দেওয়াল ঘেঁষে সারি সারি গজিয়ে উঠেছে ইউনিসেক্স পার্লার !
ছাত্রদের কাছ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে এবার পুলিশ স্ট্রেচারে লাশটা তোলার তোড়জোড় করল। দূর থেকে ছেলেটিকে যেমন নেতিয়ে পড়ে আছে বলে মন হচ্ছিল, স্ট্রেচারে তোলার সময় ধরনধারণ দেখে সেই ভাবটা বেশ কম বলে মনে হল ধরিত্রীর। বেশ শক্ত যেন দেহখানা। কিন্তু তাই-ই বা কী করে হবে, রাইগর মর্টিসের লক্ষণ কোথায় ! দেহে পচন ধরেনি, দুর্গন্ধ নেই! ধরিত্রী খুব অবাক হচ্ছিল, কিন্তু ব্যাপারটা এখন তার হাতের বাইরে। লাশ চলে যাবে সোজা মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের মর্গে। সেখানেই পোস্ট মর্টেম হবে। দেখা যাক, কী রিপোর্ট আসে!
ধরিত্রী চলে যাবে বলে পেছন ফিরেছে, হঠাৎ ঠনঠন করে কিছু গড়িয়ে যাবার শব্দ। এক পুলিশের পায়ে লেগে কৌটো মতো কিছু একটা গড়িয়ে গেল ঘরের ভেতরে টয়লেটের দরজার দিকে। আর একজন সেটা কুড়িয়ে নিল। মনে হচ্ছে কোন ওষুধের কৌটো, বেশ বড়সড় সাইজের। ওসি নাকের ডগায় চশমা টেনে গায়ের লেখা পড়ার চেষ্টা করে কিছু বুঝতে না পেরে ধরিত্রীকে বলল,
- ম্যাডাম, দেখুন না একটু, এটা কিসের ওষুধ!
কৌটোটা হাতে নিয়ে চমকে উঠল ধরিত্রী। এমপ্লুরা। মাংস সংরক্ষণে এর জুড়ি নেই। যে কোনো রকম মাংসে এই ওষুধ মাখালে সেটা অনেক সময় ধরে তাজা থাকে, গন্ধ ছাড়ে না, খুব শক্ত হয়ে যায় না, ছোট্ট পাখি তিতির থেকে মানুষের…হ্যাঁ মানুষেরও তো…! আরে এ ওষুধ এখানে কেন! ধরিত্রীর পা থেকে মাথা অবধি বিদ্যুৎচমকের মতো কী যেন খেলে গেল! লিফটে নামতে নামতে তার কেবলই মনে হচ্ছিল লাশটি এতো গন্ধ ও পচনহীন কেন সে রহস্য যেন সে উদঘাটন করে ফেলেছে !
সারা রাত ধরে নির্ঘুম বসে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে পড়ল রোশন। ডিরেক্টর এখানে নেই, আগামীকাল তাদের ডিনের সঙ্গে দেখা করবার কথা। পাশের ঘরে ফতিমা আন্টিকে কড়া ঘুমের ডোজ দিতে হয়েছে। এখানকার ডাক্তার-ম্যাডামই দিল নিজে থেকে, ফতিমার মুখচোখ দেখে। রোশনকে গলা নামিয়ে বলল,
- আমিও তো মা। নিজের জোয়ান ছেলে মরে গেলে মনের ভেতরে কী হয় তা ভালই বুঝি। এই ওষুধটা রাখ। রাতের খাবারের আধ ঘন্টা আগে এটা ওঁকে খাইয়ে দিও।
গোটা হিজলি ক্যাম্পাসে এই ডাক্তার দিদিমণিই একমাত্র মানুষ যে ফতিমার প্রতি তবু কিছু সহানুভূতি দেখিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে রাজশেখরণ ওদের নিয়ে গেল থানায়। আগেই জানান হয়েছিল, মৃত ছাত্রের মা দেখা করবে। ওসি তাদের বেশ খাতির করে বসাল, কিছুক্ষণ ফতিমাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে খুব মিষ্টি ব্যবহার করল, তারপর নিরীহ হরিণের চামড়ায় ঢাকা সিংহের আসল চেহারা দ্রুত বেরিয়ে পড়ল। দোষের মধ্যে ফতিমা তার ছেলের মৃতদেহের ছবি দেখতে চেয়েছিল,
- আমার ফিজুকে দেখতে চাই। কেমন ভাবে পড়েছিল আমার মাগু, আমার কুসু, দেখাও অফিসার, আমাকে দেখাও!
দোভাষীর কাজ করতে করতে রোশন দেখছিল, ফতিমা আন্টির অস্থিরতা যতই বাড়ছে, ওসির মুখ ততই কঠোর হয়ে উঠছে। একসময় লোকটা ফতিমার মুখের ওপর বলে বসল,
- লাশের কোনো ছবি আমাদের কাছে নেই।
তার মানে? এই রকম কেসে ছবি তুলে সংরক্ষণ করে রাখা তো ম্যান্ডেটরি।
রোশন দোভাষির ভূমিকা ছেড়ে এখন সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ।
- হ্যাঁ, তোলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা ডিলিট করে দিয়েছি। আমাদের তদন্তের কাজ মিটে গেছে। ওসব ছবির আর কোনো মূল্য নেই।
রোশন খুব অবাক হয়ে ওসির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফতিমা কিছুই বুঝতে না পেরে অঝোরে কেঁদে চলে। ওসির রাগ ক্রমশ চড়ছিল, সে গজগজ করতে করতে বলে,
- এইরকম কেস মানে কী রকম কেস, হ্যাঁ? এটা একটা প্লেন এন্ড সিম্পল সুইসাইড কেস।
- তাহলে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ইনকনক্লুসিভ রইল কেন? সেখানেই তো বলা থাকত ফয়জুল আত্মহত্যা করেছে।
উত্তেজনায় ওসি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে,
- আপনাকে তো পড়াশোনা জানা বলেই মনে হচ্ছে। সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স বলে কিছু আছে সেটা জানেন তো। শেখ ফয়জুলের কবজিতে ব্লেড দিয়ে চেরার দাগ ছিল, জানতেন এ কথাটা? এখানে আসার পর থেকেই ওর ধরনধারন দেখে রুমমেটদের সন্দেহ হয়েছিল, ও হয় ড্রাগ এডিক্ট, নয় ডিপ্রেশনের রোগী। ও আত্মহত্যাই করেছে।
ফতিমা এই দুজনের মধ্যে কথাবার্তার কিছুই বুঝতে পারছিল না, কান্না থামিয়ে একবার ওসি, একবার রোশনের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল।
রোশনও এবার চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে, ওসির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। এ সেই দৃষ্টি যা তাকে কেউ হেই চামারের ব্যাটা, হেই মাদিগার ব্যাটা বলে অপমান করলে, তার দুচোখ ভেদ করে বেরিয়ে আসত। গলা ওঠায় না সে, কিন্তু খুব প্রত্যয়ী শোনায় তার কন্ঠ,
- স্যার, আমরা পঁচিশ বছর ধরে পরস্পরের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। আমি জানি, ফয়জুল কোনওদিন ড্রাগ ছুঁয়ে দেখেনি আর ডিপ্রেশনেও সে ভোগেনি। প্লেন এন্ড সিম্পল তাকে কেউ মার্ডার করেছে। আমরা হাইকোর্টে কেস করব। ফিজুর দেহ কবর থেকে তুলে আবার পোস্ট মর্টেম করাব। দেখব কী করে তদন্ত শেষ বলে আপনারা এভিডেন্স নষ্ট করে ফেলেন।
ওসি থতমত খেয়ে যায়। তারপর নিজেকে ফিরে পেয়ে বলে,
- প্রমাণ করুন। মুখে বললে তো হবে না। আমরা ইনভেস্টিগেশন করে যা পেয়েছি, তার ভিত্তিতে বলছি এটা আত্মহত্যার কেস। আমার কথা মানবেন না যখন, তখন আপনারা আসুন। আমার যা বলার ছিল বলা হয়ে গেছে। তবে যাবার আগে এই কাগজটায় সই করে যাবেন দুজনেই। আমাদের কথাবার্তার সারাংশ এখানে লেখা আছে।
রোশন কাগজটা টেনে নিয়ে পড়তে গিয়ে দারুণ চমকে উঠল। যতদূর সম্ভব এটা বাংলায় লেখা। ওসির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল, লোকটা হাসি হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবটা এমন, যে সে যেন বলছে, কী কেমন দিলাম? হাতের উদ্যত পেন নামিয়ে রেখে সই না করেই ফতিমাকে নিয়ে রোশন বাইরে চলে আসে। গোটা কথাবার্তাই সে তার মোবাইলে গোপনে রেকর্ড করে নিয়েছে।”