১৫ টি গল্পের এই সংকলনে যশোধরা জীবন নামে প্রিজমটিকে নেড়েচেড়ে দেখেছেন, আর তার নানা বর্ণালীতে পাঠককে মোহিত করেছেন। স্বভাবসিদ্ধ সরস ভঙ্গিতে মুখবন্ধে জানিয়েছেন, বইটির একটি লেখাও পরিকল্পনা করে লেখা নয়, 'নিছকই জীবনকে হজম করতে না পারা বা পারার প্রক্রিয়াজাত, বাইপ্রোডাক্ট!'
এই অপরিকল্পিত লেখাগুলির প্রথম আকর্ষণ তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা। প্রথম গল্প 'একটি আষাঢ়ে দুগগাপাঁচালি' থেকেই এই অবিরল অকৃত্রিমতার ঝরে পড়া। নিসঃন্দেহে এটি একটি রাজনৈতিক গল্প, যা অবধারিত মনে পড়াবে গৌরী লঙ্কেশের পরিণতিকে। কিন্তু সংবাদকে, তথ্যকে, আখ্যান করে তোলার জন্য যে আয়াসহীন ঝরঝরে ভাষা, ঘটমান পরিস্থিতির বর্ণনার ওপর যে নিয়ন্ত্রণ, সবার ওপরে যে নিজস্বতা, দৃষ্টিভঙ্গির যে আমূল স্বচ্ছতা দরকার হয়, যশোধরায় তার সবটুকুই উপস্থিত। ''মৃত্যুর সময় দুগগার চোখ ছিল বন্দুকবাজদের দিকে...সে দেখল, মুখে কাপড় চাপা দেওয়া দুটি লোক একটা বাইকে আওয়াজ তুলে এসে দাঁড় করিয়ে, স্টার্ট বন্ধ না করেই হাতে একটা কিছু তুলে আনছে। দুগগার চোখদুটি বিস্ফারিত হলো। সে চেতনার একঝলক উৎসারে বুঝতে পারলো ওরা কারা...সে দেখতে পেল তার শরণার্থী সংক্রান্ত সমস্ত ফাইল পত্র, কাগজ দাউ দাউ আগুনে পুড়ে যাচ্ছে...হন্তারকদের চোখের দিকে জ্বলন্ত বিস্ফার নিয়ে তাকিয়ে রইল দুগগার চোখ। র্যাট ট্যাট… গুলিতে ঝাঁঝরা দুগগা পড়ে রইল মাটিতে। বাইক চলে গেল।"
ছোট ছোট সংক্ষিপ্ত বাক্যের বহুল ব্যবহার পরিস্থিতির টেনশনটুকু ধরে রেখেছে সযত্নে, দুগগার চোখের জ্বলন্ত বিস্ফার মনে হতে থাকে প্রতীকী, আশু প্রতিরোধের একটি আশা নিজে থেকেই উপ্ত হয়ে যায় পাঠকের মনে। না, তা এ গল্পে ঘটে না অবশ্য, কেননা তার প্রাথমিক দায় শুধু বাস্তবের কাছেই। তাই এইটুকু জেনেই থমকে যাই আজীবন শরণার্থীদের জন্য কাজ করা দুগগার সুপারি কিলাররা ছিলো দ্বিতীয় প্রজন্মের শরণার্থী।
যা যেমন করে ঘটার তা তো ঘটতেই থাকে, আবার জীবনে যেমন হয়, খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসা, বাঁচার আনন্দ, উল্লাস, সেইসব সোনার কুচিও এই বইতে বিস্তর। সখীসংবাদে দুই ভার্চুয়াল বন্ধুর এ ওকে ছুঁয়ে থাকার প্রবল আনন্দ সব প্রতিকূলতাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। একজন ক্যান্সারকে জয় করলে আরেকজনের দুঃসহতাগুলি সহনীয় হয়ে ওঠে, ''প্যারালিসিস মায়ের চিৎকার আর শাপশাপান্ত সহনীয় লাগে। প্রাণের স্পর্শ বলে মনে হয়। আমি অবন্তীকে ভার্চুয়ালি ছুঁই, আর আমার নিজের রক্তকে নিজে যেন চলতে-ফিরতে দেখি।"
দুজন মানুষের মধ্যে এ এক আশ্চর্য রসায়ন, দূরত্ব, দেখা না হওয়া, যাপনের ফারাক, কোনকিছুই যাকে দমাতে পারে না।
এ বইয়ের ভরকেন্দ্র সমনামের গল্পটি, যেখানে এক অল্পবয়সী মেয়ে প্রশাসক পদে কাজ করতে গিয়ে হাসপাতালে পুড়ে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া এক মেয়ের ডাইং ডিক্লেরেশন নিতে বাধ্য হয়। আর সেই সূত্রে আবিষ্কার করে ফেলে সেই মানুষদের, পাশাপাশি থেকেও যাদের ভাষা সে কখনো বোঝেনি, সেই মেয়েরা যারা পুড়ে যায়, মার খায়, জন্তুর মতো মার খেয়ে মরে যায়,"আর সিট খালি থাকলেও যারা সিটে না বসে,চালের বস্তাটস্তা নিয়ে মাটিতে বসে পড়বে গোল হয়ে,...সিন্থেটিক শাড়ি পরা, ব্লাউজে একটাও বোতাম না-থাকা, সেপ্টিপিনে লজ্জা নিবারণ করা, ঘাম আর ময়লায় মাখামাখি দুই স্তনের ভেতরে ছোট্ট রুমালে গুটকতক টাকা লুকিয়ে লাইনে লাইনে ঘুরে বিনা টিকিটে রাস্তা পাড়ি দেওয়া বউগুলো, একটা অচেনা ভাষায় চিৎকার করে কথা বলে চলেছে। ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে সেই শব্দ উঠছে, তোমার কানে তার কোনো অর্থ নেই। ছিল না কোনোদিন। গোঁ গোঁ, খস খস, শোঁ শোঁ। তুমি ওদের ভাষা বুঝতে পার না।"( লেডিজ কম্পার্টমেন্ট)
অবোধ্য ভাষা শুধু নয়, এই অচেনা নির্মম জীবন মনোনীতাকে নিজের সাধ্যের অপারগতা সম্বন্ধে সচেতন করে তুলেছে, সমব্যথীও ; সেই ভাবটি ন্যারেটিভের গায়ে খুব ভালো বুনে দিয়েছেন লেখক। কেমন ওপর ওপর উদাসীন বলে যাওয়া, অথচ ভেতরে কষ্টের অসহায়তার চোরা পাঁক, ঠিক মূল চরিত্র মনোনীতার দ্বৈত ব্যক্তিত্বের মতো। গল্পটি কনটেন্ট এবং স্টাইলের হাত ধরাধরিতে অনেকদিন মনে থাকবে।
মেয়েরাই উঠে এসেছে এ বইতে কথার পর কথায়, কিন্তু এ বই শুধু মেয়েদের বই নয়। এর মরমিয়া কথন, বিষয়ের ব্যাপ্তি সবাইকে দিয়ে পড়িয়ে নেবে গল্পগুলোকে। উপরি পাওনা মনস্তত্ত্বের নিখুঁত মিশেল আর শ্লেষের নির্দয় চাবুক। ব্যথা নিরোধক যন্ত্র গল্পটি খুব নাড়া দেয়। দত্তক, একটি মেয়েলি দুপুর, গোধূলিসন্ধি, সবগুলোই গতানুগতিকতার বাইরে অন্য গল্প। আর রয়েছে কল্পবিজ্ঞান টিট্টিভ । তাকে সার্থক গল্প করে তোলার কাজটি যশোধরা করেছেন অবলীলায়।
কবি যশোধরাকে চিনতাম, গল্পকার যশোধরা কি তাকেও ছাপিয়ে গেলেন!