"সূর্যাস্তের মুখোমুখি বসে হঠাৎই একদিন বাবা অন্ধ হয়ে গেল। অন্ধ হবার মুহূর্তে একটাও কথা বলেনি বাবা। অনেকক্ষণ একইভাবে বসে থেকে, ইজিচেয়ার ছেড়ে ওঠার সময় আমাকে বলেছিল 'দেখো তো একটা লাঠি পাও কিনা। আমি আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না, আমি অন্ধ হয়ে গিয়েছি।' আমি অবাক হইনি, অবাক হবার কথাও নয়, কেননা বাবা ও আমি দুজনেই এই অন্ধত্বের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অবাক হবার যদি কিছু থাকে, তবে তা এই-ই, অন্ধ হওয়ার এত স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বাবা শুধু বলেছিল 'এতদিনে সূর্যদেব আমার চোখের ভেতর প্রবেশ করলেন।'"
বাংলা গদ্যে যে ধারায় জীবনানন্দ, উদয়ন ঘোষ, সন্দীপন, অরূপরতন বসুরা লিখে গেছেন, রবিশংকর বলও সেই ধারাতেই। অর্থাৎ নিজের জীবনকে আয়নায় দেখে নিস্পৃহভাবে লিখে রাখা আর তাকে কখনো গল্প কখনো উপন্যাস বলে ছাপিয়ে দেওয়া। জাগরণের দিনলিপির পাশাপাশি বাকিদের থেকে তিনি সফলভাবে স্বপ্ন কাহিনিগুলিও লিখে রাখতে পেরেছেন এবং সেখানেই তার স্বতন্ত্রতা।
তার গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলির নামও সেই উত্তরাধিকার বহন করে - অনুপম ত্রিবেদী, সুবিনয় মুস্তাফি, সুরঞ্জন, সরোজিনী, মণিভূপকণ্ঠ,অবলোকিতেশ, অরুণিমা সান্যাল, সোমেন পালিত। রাজমোহনের বই পোড়ানোর বিপ্লবও তার গল্পে জায়গা করে নেয়। পোখরান '৯৮ উপন্যাসে ম্যানিক ডিপ্রেসিভ সাইকোসিসে ভোগা উদয়ন স্বয়ং ঢুকে পড়েন - "লিখে কিছু হয় না হেমন্ত। ও তো এক প্রতিযোগিতার জগৎ। যেমন কেউ ম্যানেজার হয়, ডেপুটি ম্যানেজার হয়। লিখে আর সত্যি কথা বলা যায় না। আলেক্সান্ডার আর কখনো কথা বলবে না। সে তার বাড়িতে আগুন লাগিয়ে পাগলাগারদে চলে যাবে। ওই দৃশ্যটিই সত্যি কথা, বাড়িটা পুড়ছে, পুড়ে যাচ্ছে।"
লিখতে ভুল হল, ছেঁড়া ছেঁড়া একের পর এক স্বপ্নদৃশ্যে রবিশঙ্কর এই সমস্ত চরিত্রদের কাহিনি লিখেছিলেন, গল্প উপন্যাস লেখেননি। সেসব লেখায় স্বপ্ন ইতিহাসের প্রধান মোটিফ। বিরাট এক শূন্য প্রান্তরে স্বপ্নরা এলোমেলো ঘোরে। পরস্পরের আয়নায় মুখ দেখে। ছুঁতে পারে না। সেই পুরাণ এক স্বপ্ন পুরাণ। কিছু স্বপ্নকে ঘিরে কয়েকটি মানুষের হাঙ্গরের ঢেউয়ে লুটোপুটি খাওয়া। রক্তাক্ত হতে হতে একেবারে অবলুপ্ত হয়ে যাওয়া। যেন দেবতাদের উত্তরায়ণে জন্ম আর দক্ষিণায়ণে মৃত্যু। "আমি কোনও কিউরিও নই" - সভ্যতার উত্তরাধিকারের ভারে ন্যুব্জ চরিত্রগুলি যেন প্রবহমান ভিড় থেকে আলাদা থাকতে চেয়েও আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস পিঠে নিয়ে হাঁটতে থাকে ভিড়ের চেতনাহীনতায় মিশে যাবার জন্য। মণিময় সংশোধনাগারের করিডোরে যে মানুষের মুখোমুখি হয় তার মুখে ইতিহাসের উলকি আঁকা। সে জানে স্কাড পেট্রিয়ট দিয়ে এখন এক গোটা দেশকে ধ্বংস করে ফেলা যায়। সে বলেছিল মৃত্যু আসলে এক আয়না অতিক্রম করা। বস্তুত এই শৈলাবাস ও বাগিচার গোলাপগুলি তাকে জানিয়েছে আয়নার মধ্যে দিয়ে কিভাবে দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়। এর আগে আর পাঁচটা মানুষের মত আয়নার ব্যবহার জানত না মণিময় অর্থাৎ আয়নার সামনে সে দাঁড়াত নিজেকে দেখার জন্য অর্থাৎ হারিয়ে যাবার জন্য আয়নার ব্যবহার সে শেখেনি। কারণ আয়না যখন নিজেকে অদৃশ্য করে তখনই এমন অলৌকিকতা জন্ম নেয়। মণিময়ের একটি ফোটন রকেট ছিল যাতে চড়ে সে সময়ের উল্টোস্রোতে উড়তে উড়তে চলে যেত সেই জলাশয়ের নীচে যেখানে একটি প্রাসাদ তার মর্মরধ্বনি নিয়ে বেঁচে ছিল।
কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আয়নার মধ্যে দিয়ে চলে যেতে পারত। তার জন্য অবশ্য আয়নার যথার্থ ব্যবহার জানা দরকার। নিজেকে দেখবার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়ালে এমনটা সম্ভব নয়। রবিশংকর লিখেছেন প্রাচীনতাকে বহন করার অর্থ পুরাণ ও স্মৃতিকে বহন করা। যে কোনো স্মৃতি তাড়িত মানুষ সারা জীবন নির্বাসিত, সে তার স্বভূমিতে থাকলেও নির্বাসিত। কারণ স্মৃতির প্রতি তার যে দায়বদ্ধতা, তা আসলে জীবনের সাধারণ বিষয়গুলিকে খুঁটিয়ে দেখে নেবার আকাঙ্খা। যেমন কারুর মা কিভাবে চা বানান। মোহাজিররা যেমন লখনৌ থেকে করাচি গেছিল তেমনই ক্রমে সারা পৃথিবী জুড়ে এরকম নির্বাসিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের যেন এক ধু ধু হেমন্তের ভেতরে বেঁচে থাকা, যেখানে গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-শীত-বসন্তের খবর এসে পৌঁছয় না। নির্বাসিতের জীবনের ক্যালেন্ডার তাই অন্যরকম। মাহমুদ দারবিশের মত।
"কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কখনও খুচরো জমিয়ে রাখতে শেখে না। যেমন সরোজিনী। এরা খুচরো দান নেয় না কাউকে দেয়ও না। আমার কেমন যেন মনে হয়, এরা হারিয়ে যেতে ভালবাসে। সরোজিনীও হারিয়ে যেতে চাইত। "
প্রিয়নাথ এখন অনেকের চোখে, একজন বিস্মৃতপ্রায় লেখক। সে অবশ্য এসব নিয়ে ভাবে না। প্রিয়নাথ লিখত বটে, কিন্তু লেখক না হলে তার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে, এমন কখনও ভাবেনি। আসলে লেখা ও জীবনকে প্রিয়নাথ কখনও আলাদা করতে পারেনি, লেখক হবার জন্য যা খুবই প্রয়োজন। প্রিয়নাথের জীবন তাই এমন নানা গল্পের মধ্যে দিয়েই বয়ে চলে, যেখানে সেও কেবলই ভিন্ন ভিন্ন গল্প হয়ে ওঠে। সে যেন রূপকথার রাখাল, গল্পের বাইরে যার কোনও অস্তিত্ব নেই।
সুকুমারের মনে পড়ল, এই তিনদিন সে কেবল সমুদ্রের উপর ঘুরে বেড়িয়েছে আর একজন নাবিককে সে দেখেছিল বেলাভূমিতে বসে থাকতে, তার পাশে স্তূপাকার শীতের ঝরা পাতা এবং সেই নাবিক এক একটি করে পাতা ভাসিয়ে দিচ্ছিল জলে। সুকুমারের এও মনে পড়ে, সমুদ্রের ওপর ঘুরপাক খাওয়া পাখিটির কথা, মনে পড়ছিল বহু বছর আগের শিশু সন্তানের কথা, যাকে জন্মের সাতদিনের মাথায় সে কবরে শুইয়ে দিয়ে এসেছিল। দেবদারু শীর্ষ ও তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সুকুমারের মনে হল, প্রেম আসলে একটি নক্ষত্রের আলো। তার উৎস খুঁজতে গেলে দেখা যাবে কত কোটি বছর আগে মরে গিয়েছে সেই নক্ষত্র। শুধু সেই আলো কেবলই আসছে। এই আলো যত এগিয়ে যাচ্ছে, সুকুমার তত বুড়ো হয়ে যাচ্ছে।
রবিশংকর লিখেছিলেন পুরো একজন মানুষকে জানতে হলে সেই মানুষটিকে জানলেই শুধু চলে না। জানতে হয় তার আকাশ বাতাস গাছ নদ নদী পাখপাখালি, গোপনে নিভৃত যাদের সঙ্গে সে কথা বলে সেইসব বাস্তব ও কল্পনার অস্তিত্ব; কত নক্ষত্র, আরো কত মৃত নক্ষত্রদের। এই মহাবিশ্বের মত কাহিনির কোনো শুরু নেই, শেষ নেই। আলতামিরার গুহায় বাইসন আঁকার সময় থেকে একটাই কাহিনি লেখা হয়ে চলছে। 'নীল দরজা লাল ঘরে'র সেই কাহিনি। সেখানে মৃত্যুর আয়নাতেই জীবনকে দেখা যায়। মন একটা কারাগার, যার জন্য আমরা প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারি না। কারুর কারুর কাছে অতীত শুধু কিছু মরা জিনিসপত্র, ফুরিয়ে যাওয়া ঘটনা। 'মধ্যরাত্রির জীবনী'তে জ্যোতিপ্রকাশের কাছে অতীত এক গাছের মত, যা দিনে দিনে ডালপালা ছড়াচ্ছে, ফুলে ফুলে ভরে উঠছে। তাই পেটা ঘড়ি বন্ধ হয়ে যাবার পর সে কবেকার বালিঘড়ি ট্রাঙ্ক থেকে বার করে টেবিলের ওপর বসিয়ে দেয়। খুব অভিনিবেশে কান পাতলে বালি ঝরার শব্দ শোনা যায়। একদিকের বালি অন্যদিকে চলে গেলে ঘড়িটি উল্টে দাও। এইভাবে শুধু আসা যাওয়া, জ্যোতিপ্রকাশের নিজস্ব সময়। শুধু বালি ঝরে যায়, কিন্তু কোনো কিছুই হারায় না।
নবকুমারের কাহিনি বলতে তো ওই স্বপ্ন বা হিয়েরোনিমাস বস্কের 'দি শিপ অফ ফুলস' নামে আঁকা ছবিটি। ঝড়ের সমুদ্রে মাতাল তরণীতে উন্মাদেরা চলেছে নির্বাসনে। জলবন্দী কিছু মানুষের কাহিনি। তাদের মাথার ভেতর আকারহীন জলস্রোত। "জীবনের প্রতি ভাষাচর্চার একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি" - এই আধ্যাত্মিকতা ছাড়া রচনা আজ লেখকের কাছে মূল্যহীন। কাকে কোন বিছানায় শোয়ানো হবে এমন আধুনিকতা নিপাত যাক। ধ্বংস হোক উপন্যাসের নামে মধ্যবিত্ত সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যান। লেখকের ঘরের কাছে আরশিনগর, সেথা এক পড়শি বসত করে। রবিশংকর তার মুখ দেখতে চান। বাস্তববাদীরা সে মুখ দেখে না। বাস্তববাদ মানে আয়নায় দেখা প্রতিফলন। আয়নায় কারুর রক্তমাংসময় মুখ দেখা যায় না। প্রতিফলন দেখা যায়। সেই লেখক এই বইতে পাগলদের নিয়ে এক উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শূন্য করোটির ভেতর যেসব দৃশ্যাবলীর চলাচল, লেখক নিজে স্বীকারও করেছেন, তিনি তা দেখতে পান নি।
কাহিনির শেষ দিকে জ্যোতিপ্রকাশ তার বালিঘড়ি ভেঙে ফেলে। 'আমার আর সময়ের প্রয়োজন নেই রজত। সময় তো মানুষের বানানো একটা ব্যাপার। সব একদিন মুছে যাবে রজত। আমি দেখতে পাই। ঘণ্টা মিনিট সেকেন্ড কিচ্ছু নেই। শুধু একটা গাছ জেগে আছে। বোধিদ্রুম। বুদ্ধত্ব কাকে বলে জানো? মানুষ বুদ্ধ হয় যখন তার পার্থিব চেতনা দিব্য হয়। কুণ্ডলিনী যোগে বলেছে, সুষুম্না পথে এক অগ্নিস্রোত মূলাধার হতে সহস্রারে গিয়ে আদিত্যের মত ছড়িয়ে পড়ে। একটা ছাতা খুলে ধরার মত। একে বলে অহিচ্ছত্র - সর্প রূপিনী কুণ্ডলিনী মাথায় গিয়ে হাজার সূর্য ফেটে পড়ছে।' শুধু এক আদিকাহিনির বীজ থেকে যাবে। এক সাপ লেজ থেকে নিজেকেই খাচ্ছে।
লুপ্ত টোটেমের মত এই সাপ রবিশংকরের লেখায় বারবার ফিরে ফিরে আসে। মহাপৃথিবীর ইতিহাস আসলে নাকি কতগুলি মেটাফরের ইতিহাস। কতদিন আগে বোর্হেসের একটি রচনার শুরুতেই এমন বাক্য পড়েছিল মণিময়। তার লিখতে না পারা নিয়ে বন্ধুমহলে অনেক মত চালু আছে। কারও মতে তত্ব বিশ্বের প্রতি মণিময়ের প্রবল ঝোঁক তার সৃজনীশক্তিকে নষ্ট করেছে। কেউ বলে মণিময় আসলে শুধু নিজের কথাই লেখে। এইরকম সাবজেকটিভ লেখালেখির ভাঁড়ার খুব তাড়াতাড়ি শূন্য হয়ে যায়।
'বাসস্টপে একদিন' উপন্যাসে চরিত্রের চোখ থেকে ধূসর ছাড়া বাকি সমস্ত রং মুছে যেতে থাকে। বাথরুমে লাগানো রাক্ষুসে আয়নায় স্নান সারার পর নিজেকে প্রতিফলিত দেখতেই হয় তাকে। ধেড়ে ইঁদুররা নিজেরাই জানে ওরা দেখতে খুব খারাপ। তাই ওরা মানুষদের দেখলেই পালায়, মানুষের থেকে দূরে থাকার জন্য সুড়ঙ্গ খোঁড়ে। ওদের কি নিজস্ব কোনো আয়না আছে, যার সামনে বসে ওরা নিজেদের মুখব্যাদান দেখে? নাকি এমন হয় যে সুড়ঙ্গের অন্ধকার একসময় আয়না হয়ে যায়?
'তিমিরের হার্লেমে' রবিশংকর লিখেছিলেন শৈশব থেকে তিমিরের জীবনে নিজস্ব বিছানা বলে কিছুই ছিল না। বড় হতে হতে তিমির বুঝে যায় মানুষের নিজস্ব বিছানার বড় প্রয়োজন। এই এক জায়গা, যেখানে সে জাগরণ ঘুম স্বপ্নের নানা স্বাধীনতায় চলাচল করতে পারে। আয়নার মধ্যে একটা শহর আর শহরের ভেতর একটা আয়না, যেখানে মেয়েরা কাপড় কাচছে আর খেলা করছে হৃৎপিন্ড নিয়ে। শহরের ভেতর একটা আয়না আর আয়নার মধ্যে একটা শহর, যেখানে প্রেমিকেরা চিবোচ্ছে আর রফা করছে দিগন্তের সাথে। আয়নার মধ্যে দিয়ে যে একবার চলে যায়, ফিরে আসার পর আর কাউকে চিনতে পারে না। আয়নার ভেতরের দেশে সারাদিন তুষার ঝরে।
শুরু থেকে রবিশংকরের লেখা ধারাবাহিক পড়ে যেতে থাকলে দেখা যায় একসময় তার লেখা বদলাতে শুরু করে। স্বপ্নদৃশ্য দিয়ে কাহিনি বোনার প্রক্রিয়া ছেড়ে তিনি ক্রমশ এক কথক হয়ে উঠতে থাকেন। দাস্তানে জায়গা করে নিতে থাকে চিরন্তন ইউসুফ আর জুলেখার গল্প, ফলক আরা আর কালে খানের গল্প অথবা বাবা চুহারমলের আখ্যান। ইসমাইল কাদারের উপন্যাসে ইতালীয় জেনারেলের হাড় খুঁজে পাওয়া থেকে তৈমুরের হাজার হাজার মৃত শত্রুর খুলি দিয়ে পিরামিড বানানোর ইতিহাস। লেখার মধ্যে কাহিনি হিসেবে জায়গা করে নেয় নাইয়ের মাসুদের তাউস চমন।
এই পর্বেরই লেখার ফসল 'দোজখনামা'। এককালে এক গল্পের ভেতর রবিশংকর লিখেছিলেন এক চরিত্র কাফকা আর তলস্তয়ের কথোপকথন নিয়ে উপন্যাস লিখতে চায়। দোজখনামায় এসে আমরা পড়ি দুই দেশের মাটির নিচে শুয়ে কথা চালিয়ে যাচ্ছেন মির্জা গালিব আর সাদাত হাসান মান্টো। তারা যেন মুখোমুখি বসে থাকা দুই আয়না যাদের ভেতর শূন্যতা। দুই শূন্যতা একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। শূন্যতারা কি কথা বলতে পারে নিজেদের মধ্যে?
'ছায়াপুতুলের খেলা'য় সঞ্জয়দাদু এই সব স্মৃতি গল্পের মত লিখে রাখেন। ক্রনিকল। রাতে তার ঘরের এক কোণে ডাই করা পাণ্ডুলিপি কাটতে থাকে ইঁদুর। রাত যত বাড়ে কাগজ কাটার শব্দে ভরে ওঠে ঘর। আর সঞ্জয়দাদু বসে বসে ভাবে কোন শব্দটা ও চিবোচ্ছে এখন। মায়া শব্দটা যখন চিবোয় একটু বেশি শব্দ হয়। ইঁদুর কখনও সাদা পাতা চিবোয় না। শব্দ লেখা না থাকলে সেই পাতা ও খাবেই না। সঞ্জয়দাদু বলেন এক একটা শব্দ খেতে সময় লাগে এক আলোকবর্ষ।
রবিশংকর জানতেন মানুষে মানুষে দীর্ঘ সংলাপের দিন শেষ হয়ে গেছে। যে কোনও কথা শুনতে চায় না, তাকে আমরা ভয় পেতে শুরু করি। এভাবেই সন্ত্রাসবাদীর জন্ম হয়। পৃথিবীর সব দুর্দশার কারণ, নানারকম ইউটোপিয়া। রবিশংকর লেখেন মানুষ রিয়ালিটি থেকে সরে গেলে নানা ইউটোপিয়ার খপ্পরে পড়ে। 'জিরো আওয়ার' উপন্যাসে অমলকান্তি সেরকম এক জাতীয় কবি। তার ফ্ল্যাটে তরুণ সন্ত্রাসবাদী ঢুকে পড়ে একে ৪৭ হাতে।
"প্রগতির নামে সবকিছুই মেনে নিচ্ছে মানুষ। সব হত্যা, ধর্ষণ, সাংস্কৃতিক পিছু হটা যাবতীয় স্থিতাবস্তাকে জোরদার করা হচ্ছে প্রগতির নামেই। এর বিরুদ্ধে তার অনেক কিছু বলার আছে। বিজ্ঞানের উন্নতি আর সভ্যতার প্রগতি যখন সমার্থক হয়, রাজনীতি তখন মানুষের নৈতিক মাত্রা থেকে বিচ্যুত হতে বাধ্য। এটাই আধুনিক পৃথিবীর গতিপথ। বৈজ্ঞানিক কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুতে বিশ্বাস নেই আপনাদের। স্কাড পেট্রিয়ট দিয়ে একটা দেশকে ধ্বংস করা যায় ছাড়া।"
মণিময়ের মনে পড়ল, সারা জীবন ধরে সে আসলে একটি ভ্রমণ কাহিনি লিখতে চেয়েছিল। এমন সব জায়গার কথা, যা সে কখনও দেখেনি। এ এমন এক ভ্রমণ কাহিনি যেখানে নতুন নতুন দৃশ্য, ঐতিহাসিক সৌধ দেখার চমক নেই। এ যেন তারকোভস্কির ছবির সেই জোন, যা পাংশু আলোয় ঢাকা, আর সেই আলো অনেক প্রাচীন সময়কে অতিক্রম করে আসছে। মানুষের বয়স যত বাড়ে, সে ততই একটি সমাধিক্ষেত্রের গভীর থেকে গভীরতর পথে ঢুকে যেতে থাকে, দুপাশে সারি সারি ফলক, ফলকের গায়ে নানা রকম কথা, শুকিয়ে যাওয়া ফুল, নিভে যাওয়া মোমবাতির টুকরো পিছনে ফেলে তাকে এগিয়ে যেতে হয় তারপর সেই সমাধিক্ষেত্রটা তাকে নিয়ে একদিন সমুদ্রের ভিতর হারিয়ে যায়। মণিময়কে নিয়ে গল্প লেখা তাই খুবই সোজা, সে আসলে পথের পাশে একটি পাথর হয়ে পড়ে থাকতে চেয়েছিল, কেননা জীবনে সে প্লটবন্দ্বীত্বকে বিশ্বাস করেনি, সে দেখেছে তার জন্মেরও আগে থেকে যে গল্প লিখিত হয়ে চলেছে এবং মৃত্যুরও পরে যে গল্প লিখিত হতে থাকবে তা আসলে সেই আদিকাহিনিটিই, অর্থাৎ একটি সাপ লেজ থেকে নিজেকেই খেয়ে চলেছে, অনিঃশেষ এই ভক্ষণপর্ব, অনন্ত এই কাহিনির মাধুকরী।
তাই রবিশঙ্কর বিশ্বাস করেছিলেন, প্রভাত স্বপ্নে উপন্যাস লেখে। "স্বপ্নে যাদের কথা সে লেখে অথবা তার স্বপ্নে যাদের কথা লেখা হয়, তারা কেউ অলীক নয়। কেননা, এমন তো হতে পারে, এই পৃথিবীতে আমাদের যে জীবন - কয়েক হাজার বছরের যে সভ্যতা - তা আসলে কারুর দেখা স্বপ্ন। অনন্তনাগের শয্যায় শুয়ে থাকা সেই হিরণ্যপ্রভ পুরুষ আমাদের স্বপ্নে দেখছেন।"