https://ibb.co/35Wg7sPy
যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব যে আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু
পুরুষোত্তম সিংহ
দেবেশ রায়ের ‘যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ যুদ্ধের ভিতরে’ (২০০৩) পরিচ্ছেদহীন ১০৪ পৃষ্ঠার এক অবিস্মরণীয় টেক্সট। বাংলা উপন্যাসের টেক্সটের গুণগত মান পরীক্ষায় অনিবার্যভাবে দেবেশ রায়ের স্মরণাপন্ন হতে হয়। গদ্যের জোড়ালো গতি, উপমার অবিচ্ছেদ্য অবিরাম প্রয়োগ ও বিশ্লেষণের নব্যত্বে একটা টেক্সট কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। এ আখ্যান যুদ্ধ, যুদ্ধের সজ্জা, যুদ্ধ বিরোধিতা ও যুদ্ধে বলির হিংসাত্মক বিবরণ। নায়ক ফার্সি পুরাণের কিংবদন্তি রুস্তম। নায়কের যুদ্ধ সজ্জা, যুদ্ধ সাধ, যুদ্ধ অভিলাষ, যুদ্ধের আভরণ-আবরণ, যুদ্ধের কৌশল, যুদ্ধের কার্যকারণ, ফলাফল, যুদ্ধের উত্তরাধিকার, যুদ্ধের অতীত, যুদ্ধের গতি, যুদ্ধের বিরাম, পিতা-পুত্রের যুদ্ধের কৌশল পরায়ণ বিবেচনা নিয়ে ক্রমেই যুদ্ধ সরণিতে প্রবেশ-অস্থিরতা-স্থিতাবস্থা। যুদ্ধ নিয়ে পিতা রুস্তম ও পুত্র সোহ্রাবের মস্তিষ্ক যুদ্ধ। মানব ভূমির অনিয়ন্ত্রিত সীমারেখা ধরে আর্তনাদ, আগ্রাসী মানসিকতা, যুদ্ধ স্পৃহার মধ্য দিয়ে এক মানবদর্শন রচনা করে চলেন। তা ক্রমেই বাক্যজালে গড়িয়ে যায়। বাক্যের অন্তর্গঠনের শৃঙ্খলিত যোগ ধরে আরেক বাক্যে জড়িয়ে পড়ে। যোদ্ধা রুস্তমের বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় নির্বাচিত ঘোড়া রাক্স। বনভূমিতে বিশ্রামরত অবস্থায় একদা ঘোড়াই হারিয়ে যায়। একি শত্রুপক্ষের শিকার না ঘোড়ার যুদ্ধ করতে অস্বীকার? যে যোদ্ধা ঘোড়াই হারিয়ে ফেলে সে কেমন যোদ্ধা? ভবিষ্যতের রুস্তম-রাক্সের গল্প তবে কি পরাজিতের গল্প হবে? ভবিষ্যতের রূপকথা-উপকথার মধ্যে রুস্তমের গল্প কি পরাজিত অনুপ্রবেশের গল্প হয়ে উঠবে? লেখক খুব সচেতনভাবে প্রবাহিত ন্যারেটিভ থেকে পুনর্গঠিত ন্যারেটিভ কেমন হতে পারে তার ভাষ্য রচনা করেন। তেমনি গঠিত ন্যারেটিভকে যদি রূপকথা, উপকথার কবন্ধে ফেলে দেওয়া যায় তবে গড়ন কেমন হতে পারে তার একটি আপাত স্ট্রাকচার রেখে যান। সেদিনের কিংবদন্তি রুস্তম, ঘোড়া রাকসকে কেন্দ্র করে যে রূপকথা, উপকথা গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে লেখক ক্রমাগত লাঙল চালাচ্ছেন। যা দিয়ে ন্যারেটিভ রচিত হচ্ছে। তা উপকথা, রূপকথা নয় আধুনিক আখ্যান। আবার রূপকথা, উপকথার প্রত্যাবর্তন করলে তার গঠন কেমন হতে পারে—সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন দেবেশ রায়। রুস্তম-সোহ্রাব পিতা-পুত্রকে কেন্দ্র করে পিতামহ-প্রপিতামহ-পিতা হয়ে যুদ্ধজয়ের অভিলাষ রচিত হতে থাকে। রূপকথা, উপকথায় সমস্ত সত্য থাকে না। চাষিদের গল্পে, কথোয়ালের গল্পে রুস্তমের পুরো ইতিবৃত্ত নেই। রূপকথা, উপকথা ক্রমাগত ভাঙন-সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে চলে। গল্প তৈরি হয় গল্প ভাঙে। সোহ্রাবের যুদ্ধসাধ ও পিতৃপুরুষদের গল্প জানার মধ্যে ইতিহাস আছে। কিন্তু গল্প তো ইতিহাস থেকে আলাদা। গল্প ইতিহাসকে ছুঁতে চায়, কিন্তু ইতিহাসের কোনো দায় নেই গল্পের কাছে। পল্লির চাষি, কথোয়ালরা কেবল স্মৃতি রোমন্থন, জীবনের অলসবেলা অতিক্রম করতে গল্পে সন্নিবেশিত হয়। লেখক খুব চমৎকারভাবে আখ্যানের গল্পকে চিহ্নিতকরণ করেছেন—
“এ গল্প সেই সময়ের গল্প, যখন মানুষ শ্বাসবায়ুর সঙ্গেই বলার কথা উচ্চারণ করত ও নিশ্বাস আর উচ্চারণের মধ্যে কোনো বিরতির সঙ্কট তৈরি হত না। এ গল্প সেই সময়ের গল্প, যখন কিশোরদের বিষণ্ণতা ও একাকিত্বের কারণ বৃদ্ধ নাগরিকরা জিজ্ঞাসা করতেন। এ গল্প সেই সময়েরও গল্প যখন ঘোষিত যুদ্ধে এমনকী পিতাও পুত্রকে চিনে নিতে পারতেন না বা পুত্রও পিতাকে পৃথক করার সুযোগ পেতেন না। এ গল্প সেই সময়েরও গল্প, যখন কোনো কিশোর নগরবৃদ্ধকে তার বিষণ্ণতা ও একাকিত্বের কথা বলতে পারত। এ গল্প সেই সময়েরও গল্প যখন একই সঙ্গে এতটা প্রকাশ্যতা ও এতটা বিনিময় অভ্যস্ত ছিল অথচ পিতা ও পুত্রের সম্পর্ক গোপন হয়ে পড়ত বা সম্বোধন অসম্ভব হয়ে থাকত।” (যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ যুদ্ধের ভিতর, দে’জ পাবলিশিং, প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০০৩, পৃ. ৪৮)
বাস্তবের রূপকথা কেমন হতে পারে দেবেশ রায় তা সচেতন বীক্ষণে স্পষ্ট করেছেন। সোহ্রাব নিজের জীবনের অর্ধবৃত্ত জেনেছে চাষি, কথোয়াল ও মাতার গল্পে। বাকি ইতিবৃত্ত চাষি, কথোয়ালরা সময় অন্তর জানাবে। সোহ্রাব বাস্তবের নায়ক হয়ে সেই চাষি, কথোয়ালদের গল্পে ঢুকে যাচ্ছে। আবার সব কথা, সারাদিনের সমস্ত চলমানতা, সমস্ত সজ্জাবিন্যাস দিয়ে তো গল্প গড়া যায় না। গল্পের একটা নির্দিষ্ট বিন্দু চাই। যে বিন্দু ধরেই কথোয়ালরা বানিয়ে বানিয়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনার গায়ে গায়ে অজস্র কথা জুড়ে কথকতা গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। এমনকি এই কথকতা একমাত্র প্রাচীন বৃদ্ধরাই পারেন। শুধু তো গল্প গড়া নয় গল্প শোনানোর লোক চাই। অবধারিতভাবে রাতের অন্ধকারে শিশুদের উজ্জ্বল চোখ, জানার আকাঙ্ক্ষা সেই সুযোগ করে দেয়। রুস্তম-সোহ্রাবকে এখানে দুটি ইউনিট ধরা যেতে পারে। রুস্তম গল্প হয়ে গেছে, যে গল্প চাষি, কথোয়ালরা জানে, এমনকি সন্তান সোহ্রাবও শুনেছে। সোহ্রাব বর্তমানে গল্পে প্রবেশ করছে। যে গল্প চাষি, কথোয়ালদের পরবর্তী প্রজন্মের কথোয়ালরা তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে বলবে। বয়ানে পাই—
“সেই প্রাচীন কথোয়ালরা জানত, সব কথা থেকে গল্পের অঙ্কুর বীজ ফাটিয়ে বেরয় না। কিন্তু ফসল যখন পাকে, তখন আর এই হিশেব করা যায় না—কোন বীজ ফলন্ত হল, আর কোন বীজ হল না। গল্প যখন পাকে, তখনো আর এই হিশেব কষা যায় না—কোন কথা পাকল আর কোন কথা ঝরল। এই বিপুল গল্প, যা তৈরি করে তুলতে সেই চাষীদের ও কথোয়ালদের প্রাচীন ও প্রবীণ হতে হয়েছে, আর একবার মাত্র প্রাচীন ও প্রবীণ হলেই যে তারা গল্প গাঁথা বা রোয়া শেষ করতে পেরেছে তা নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চাষীরা প্রাচীন ও কথোয়ালরা প্রবীণ হয়ে উঠেছে, তাদের পাশ দিয়ে চাষ ও যুদ্ধ বয়ে চলে গেছে আর তাদের গলায় এই গল্প থমথমিয়ে ঝমঝমিয়ে উঠেছে।” (তদেব, পৃ. ৫৮)
শুধু পাঠসংস্কৃতি নয় উপন্যাসের নান্দনিকতাকে লেখক কয়েকগুণ বৃদ্ধি করেছেন। উপন্যাস তো কথাজাল, সেই কথাজালের গড়ন, তন্ময়তা, বাঁক বদল কতপ্রকার হতে পারে তার সচেতন বীক্ষণ বাংলা উপন্যাসের দৃঢ় প্রত্যয়কে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। রূপকথা, উপকথার ভিতর সত্য থাকে। কিন্তু সেই সত্য কি যথার্থ কার্যকারণগত সত্য? শিল্পের সত্য আর আকাঁড়া সত্য কি এক? বাস্তবের সত্য থেকেই শিল্পের সত্য গড়ে ওঠে। কিন্তু শিল্পের সত্য মানেই বাস্তবের সত্য নয়। সত্যের নানামাত্রিক রূপান্তর, বীক্ষণ, দেশকালের গ্রথিত সত্য থেকে কথোয়ালের বহনযোগ্য সত্য নিয়ে আখ্যান আর্টের সত্যকে প্রতিষ্ঠা দিতে চেয়েছে।
‘যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ যুদ্ধের ভিতরে’ নামটি তাৎপর্যপূর্ণ। পিতা রুস্তম যুদ্ধে বেরিয়ে ঘোড়া নিয়ে নিরুদ্দেশ, পুত্র সোহ্রাব নব যুদ্ধে চলেছে। এমনকি সে যুদ্ধ পিতার সঙ্গেই। মনস্তত্ত্ব যুদ্ধও বটে। এক সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে আরেক সাম্রাজ্যের উত্থানে। পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসের যেন বিরাম নেই। তা নিয়ে রূপকথা, উপকথারও বিরাম নেই। ক্ষমতাদখলের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের, জন্ম-মৃত্যুর পরম্পরায় পৃথিবীর গল্প ঘুরছে, বদলে যাচ্ছে। এক মানচিত্রের গল্পের সঙ্গে বহুবিধ মানচিত্রের গল্প মিশে গিয়ে গল্পের স্বরূপ বারবার বদলে যাচ্ছে। কথোয়াল নিজের দায়িত্ব যেন অন্যের হাতে অর্পণ করে দিচ্ছে। পৃথিবীর ঘূর্ণায়মানের মতো গল্পও ঘুরছে। সেই দুর্নিবার বেগই এ আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দু। ইরানকে গতানুগতিকভাবে রক্ষা করে এসেছে রুস্তম। সেই ইরানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধে গিয়েছে সোহ্রাব। চাষি, কথোয়ালদের গল্পে এই বৃত্তান্ত ছিল না। সোহ্রাবের জানাও হয়নি প্রতিপক্ষে তাঁর পিতার উপস্থিতির কথা। যুবক সোহ্রাবের লাগাতার যুদ্ধ স্পৃহা, ইরান নবাব হুজিরকে পরাজিত করা ও নব্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্পৃহার মধ্যে যুদ্ধবিজয়ীর দম্ভ, লোভ আছে। যা যেকোনো যোদ্ধারই থাকে।
এক যুদ্ধবিরোধী আখ্যান রচনা করেছেন দেবেশ রায়। গোটা পৃথিবীর সাম্রাজ্যবাদকে মাথানত করিয়েছেন বীরের কাছে। যুদ্ধ মানে শত্রু খেলা, যুদ্ধ মানে মৃত্যু তা জানেন রুস্তম। রুস্তম টলস্টয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’ এর নায়ক বা আমাদের মহাভারতের যুধিষ্ঠিরের মতো মনে হলেও শেষে মোহভঙ্গ ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে দেবেশ রায় তো অনুকরণ করবেন না বা সাঁচে ঢেলে চরিত্র সাজাবেন না। তাই পূর্ব নির্ধারিত ধারণা তিনি ভেঙে দিয়ে যোদ্ধার সত্য ব্যক্ত করেছেন। যোদ্ধার কোনো নীতি, আদর্শ থাকতে পারে না। যোদ্ধা জানে জয়ই ধ্রুব সত্য, একমাত্র লক্ষ। যদিও রুস্তম অপরিচিত সন্তানকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল—‘যুদ্ধ যদি না করলেও চলে তাহলে যুদ্ধ করো না’। সে যুদ্ধের পরিণতি জানে। বালক সোহ্রাবের দম্ভ, জেদ, সখ যুদ্ধসাধ। গল্প বলাতে কথকের একটা ভূমিকা থাকে, একটা প্রতিনিধিত্বমূলক মনোভাব থাকে। কথকের প্রবণতা, আদর্শ, ভালোলাগা থেকে সে গল্প সাজায়। কথোয়ালরা নায়ক রুস্তম না সোহ্রাব এই মীমাংসায় পৌঁছতে পারেনি। যুদ্ধ যেন চলমান ভাষ্য। তার উপসংহার হতে পারে না। তাই একপাক্ষিক ঘোষণা দ্বারা তারা গল্পও শেষ করতে চাননি। অতীত যুদ্ধের স্মৃতি যত না লেখা হয়েছে তার থেকে লোকশ্রুতিতে ভেসে গেছে। যে বালক সোহ্রাবের এত যুদ্ধসাধ যুদ্ধক্ষেত্রে রণনীতি লঙ্ঘন করে সে একদা রুস্তমকে জানায়—
“প্রাগুষায় তবু দ্বিতীয় দিনের মল্লযুদ্ধে, সকালে সূর্যোদয়ের আগের সকালে, যখন রুস্তম ও সোহ্রাব পরস্পরের সম্মুখীন, তখন সোহ্রাব রুস্তমকে বলেছিল, যুদ্ধের রীতি লঙ্ঘন করেই বলেছিল, বা যুদ্ধের রীতি জানত না বলেই বলেছিল, রাত্রি এত স্বাভাবিক শেষ হল, সকাল এত সহজে সকাল হচ্ছে, এই দিনটি তার আগের দিনকে তার পরের দিনের মধ্যে এমন অবধারিত মিলিয়ে দেবে যে আমাদের এই যুদ্ধটা সময়মাল্যের বা স্রোতের কোন বিচ্ছিন্ন বিন্দুতে ঘটছে, তা স্থির করাই যাবে না। তবে কেন আমরা যুদ্ধে মেতে উঠব। আসুন, আমরা এই অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ করি।” (তদেব, পৃ. ৯৮)
লেখক সাম্রাজ্যবাদের খণ্ডসত্যকে ভেঙে দেন। জীবনবোধের উন্মোচন দ্বারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির সত্য ডুবিয়ে দেন। যার পিতা মহাবীর রুস্তম অন্যদেশের প্রতিনিধি হয়ে ক্রমাগত দেশকে রক্ষা করে যাচ্ছে তার পুত্র কি করে হিংস্র যুদ্ধ হয়ে ওঠে? অসম্ভব। আবার পিতা এত উপদেশ দেওয়ার পরও শেষপর্যন্ত যুদ্ধে পুত্রকে হত্যা করে। জীবনের সমীকরণ মেলে না। দেবেশ রায় সচেতন বীক্ষণে সহজ পথে যাননি। যুদ্ধের রণক্ষেত্র তৈরি করে যুদ্ধের হিংসা বুঝিয়ে চরিত্রকে মানবিক সুরে ফিরিয়েও ডুবিয়ে দিয়েছেন হত্যালীলায়। আধুনিক উপন্যাসের ন্যারেটিভের মধ্যে প্রাচীন কথোয়ালকে ঢুকিয়ে দিলে উপন্যাসের জটিলতা, বাক্যসজ্জা, ভাবভঙ্গি কেমন হয় তা দেবেশ রায় প্রমাণ করেছেন। নীতিনির্ধারক হয়ে কখনো কখনো কথোয়ালরা পূর্ব ঘোষণাও দেয়। কিন্তু আখ্যান সেখান থেকে ক্রমেই বাঁক নেয়। যুদ্ধ, যুদ্ধবিরোধিতা, নীতি আদর্শ নিয়ে আখ্যান চলছে, সেখানে চাষি, কথোয়ালরা এসে ন্যারেটিভকে বদলে দিচ্ছে। আবার কথোয়াল, চাষিরা যা ভাবছে তা ন্যারেটিভে ঘটছে না। এক চূড়ান্ত অস্থিরতা দ্বারা মনস্তত্ত্বের জটিল ভাষ্য লেখক খনন করছেন। কেউই প্রকৃত সত্যে পৌঁছতে পারছে না অথচ সকলেই পথ খুঁজছে। পিতা রুস্তম যখন মল্লযুদ্ধে পুত্র সোহ্রাবের কাছে প্রায় পরাজিত তখন যুদ্ধের নীতি লঙ্ঘন করে প্রাণভিঙা চাইছেন। আবার সেই যুদ্ধক্ষেত্রে পুত্রকে হত্যা করছে। পুত্র সোহ্রাবের ইচ্ছা ছিল রুস্তমের সঙ্গে যুদ্ধ। কিন্তু কে রুস্তম তা জানা হয়নি। মৃত্যুমুখে জেনে গেল রুস্তমের কাছেই হত হলেন। পিতা রুস্তম হত সোহ্রাবের দেহ নিয়ে চলছেন তাঁর পিতা শ্বেতকেশ জালের কাছে। পিতামহ দেখবেন পৌত্রের মৃতদেহ।
যুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে, যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে, যুদ্ধবিরোধী প্লট নির্মাণ করেও হত্যার ধূসর লীলায় আখ্যানকে ভাসিয়ে দিলেন। তা কি শুধু দেশাচার না অন্যকিছু? কিংবদন্তি নায়ক রুস্তম কোনোদিন পরাজিত হতে পারে না কথোয়ালদের সেই সত্যকে মান্যতা দেওয়া না অন্যকিছু? নাকি সাম্রাজ্যবাদ কখনোই ভালোবাসা, মানবতার সম্মিলন ঘটাতে পারে না সেই বিভ্রান্ত ধারণাকে ভেঙে দেওয়া? ফার্সি পুরাণকে তিনি কাউন্টার বা বিনির্মাণ করেননি। সেই পুরাণের মধ্যেই একাধিক সত্যকে ঢুকিয়ে, রূপকথা, উপকথা, কথোয়ালদের জীবনচারণা রেখে আধুনিক আখ্যান নির্মাণ করেছেন। উপন্যাস তার অর্জিত সত্যে, আর্টের সত্যে বিশ্বাসী। তা পুরাণের সত্যকে নাও ভাঙতে পারে। অথচ পুরাণের মধ্যে একাধিক জারণক্রিয়া ঢুকিয়ে সত্যের বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। কথোয়ালদের জ্ঞাত সত্যকে, অর্ধসত্যকে এ আখ্যান ভাঙেনি। অথচ সেই সত্য থেকে কীভাবে শিল্পের সত্যে পৌঁছনো সম্ভব তা আবিষ্কার করেছে। দেবেশ রায় বারবার দেশজ ধারায় বিশ্বাস রেখেছেন। কিংবদন্তি, রূপকথা, উপকথা, লোককথার সত্য থেকে কীভাবে আধুনিক উপন্যাসের প্লট গড়ে নেওয়া সম্ভব তার নিরীক্ষামূলক বয়ান এখানে হাজির করেছেন। যুদ্ধ তো শুধু সাম্রাজ্যবাদী লড়াই নয়, নিজের মস্তিষ্ক বীক্ষণের সঙ্গেও। সেইসঙ্গে যুদ্ধের অস্থিরতা ব্যক্তির মানবিক বোধকে একদিন পরাজিত করে দেয়। ভুল যায় সম্পর্কের ইতিবৃত্ত। যা কথোয়ালদের সত্য জানে অথচ যোদ্ধা জানে না। যোদ্ধার ইতিবৃত্ত কথোয়াল ছাড়া মনে রাখবেই বা কে? দেবেশ রায় গুরুত্বপূর্ণ বীক্ষণে তা স্পষ্ট করেছেন।
যুদ্ধের ভিতরে যুদ্ধ যুদ্ধের ভিতরে। দেবেশ রায়। দে’জ পাবলিশিং। প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি ২০০৩। মূল্য ৪০ টাকা।
পুরুষোত্তম সিংহ। ঘোষপাড়া, সুভাষগঞ্জ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর। ৭৩৩১২৩। ৮৭৫৯১০৪৪৬৭।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।