সদা আনন্দময় যে মানুষ
হিমাচল প্রদেশে ঢুকলাম শিবরাত্রির সমারোহ মাথায় নিয়ে। জলুসের পর জলুস যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে, সবাই নিজেদের ট্র্যাডিশনাল পোষাকে সজ্জিত, মেয়ে পুরুষের মাথা আচ্ছাদিত, হিমাচলি রঙবেরঙের ঠাটু, টুপি, সব একেবারে জায়গা মত।
জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সবাই চলেছে মান্ডির তিনশ বছরের পুরানো শিবমন্দিরের দিকে, যে দেবতার এমনই মহিমা, গত বছর জুলাই মাসের বন্যায় আশেপাশে সব রসাতলে গেছে, কিন্তু মন্দিরটির কোনো ক্ষতি হয়নি। পেতলের পাল্কিতে জলুসের ঠিক মাঝখানে দেবতা যাচ্ছেন, তাঁর অঙ্গও পেতলের। নানা রঙের জাব্বাজোব্বা, মস্তকাবরণে তাঁকে প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। কিন্তু যে মানুষদের কাঁধে চড়ে তিনি যাচ্ছেন তারা সবাই আনন্দময় গ্রামীণ মানুষ, সাদাসিধে আর বিশ্বাসী।
তীর্থান গ্রামের পঞ্চায়েত কার্যালয় প্রাঙ্গণে আর একরকম আনন্দের বিস্ফার দেখলাম দুদিন পর, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস উপলক্ষে। পঞ্চায়েত প্রধান মহিলা, সরকারি আধিকারিকও তাই। মাইকে তারা নারী সশক্তিকরণের উদ্দেশে গঠিত বিভিন্ন সেল্ফ হেল্প গ্রুপগুলিকে নানা উন্নয়নমূলক কাজ ও ঋণপ্রকল্প সম্বন্ধে অবহিত করাচ্ছিলেন। তাদের কথা শেষ হতেই মেয়েরা শুরু করল নাচগান।
বিভিন্ন গ্রুপের বিভিন্ন ধরণের প্রোগ্রাম। নাম এবং ঠাটুও বিভিন্ন। লক্ষ্মী মহিলা মন্ডলের ঠাটু বা মস্তকাবরণ উজ্জ্বল সোনালী, জাগৃতি নারীশক্তি মন্ডলের বেগুনি, তাতে কুলু স্টাইলের ছাপছোপ। ধর্মীয় নয়, পরম্পরাগত নয়, তবু এই উৎসব গ্রামের বেশিরভাগ মেয়েদের অংশগ্রহণে ধন্য হচ্ছে দেখে ভালো লেগেছে।
অনেক কথা হল লক্ষ্মী গ্রুপের প্রধান জি, বিদ্যার সঙ্গে। মেয়েরা এখানে লোনের টাকায় উলের পোশাক বানিয়ে ট্যুরিস্টদের কাছে বিক্রি করে, আচার ঘি জ্যামজেলি ছাড়াও পাইন ফলের অংশ দিয়ে নানা দৃষ্টিনন্দন হস্তশিল্প বানায়। মোটামুটি কিছুটা লাভ থাকে বৈকি বেশির ভাগ গ্রুপেরই। নাহলে হাড়ভাঙা খাটুনির পর মেয়েরা আরও কাজের দায়িত্ব নিতে যাবে কেন! এই জি, বিদ্যার চোখেই সব দেখা হল আমার।
পাহাড়ের কোনো দেবতা নেই?
তীর্থান গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে, দেবতা মানুষকে এবং জাগতিক সমস্ত কিছুকে রক্ষা করেন সব দুর্ভোগ দুর্বিপাক থেকে। এই বিশ্বাস তীর্থান বা হিমাচলের কেন, হয়ত ভারতবর্ষের সব গ্রামে গ্রামে সব উৎসবের প্রাণ, সব আনন্দের মূল। এই মানুষগুলো শ্রম ও অর্থ দান করে নিজেদের গ্রামের চৌহদ্দিতে মন্দির বানাবে, সেখানে নিত্য পূজার্চনা হবে, তবে না গ্রাম পূর্ণতা পাবে!
আমি বিদ্যাকে শুধোই, শুধু পাহাড়ের কি কোনো একক দেবতা নেই, যিনি তাকে রক্ষা করতে পারেন লাগাতার ধ্বংস আর নির্বিচার আক্রমণ থেকে? তাকে বলি, সমস্ত পাহাড়ের রাণী যে হিমাচল প্রদেশ তার চেহারা দিনের দিনের পর দিন যেভাবে কুৎসিত হয়ে উঠছে, তা কল্পনাতীত। পাঞ্জাব পেরিয়ে হিমাচলের সীমানায় ঢুকলেই শুধু উন্নয়ন, নির্মাণ, জেসিপি আর ট্রাকের পর ট্রাক! ট্যুরিজম পয়সা আনে, এজন্য রাস্তার পর রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সিঙ্গল লেন ডাবল হচ্ছে বিয়াসের পাশে, সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে যাচ্ছে জেসিপি। ধুলোভরা গাড়ি চলার রাস্তাই হয়ত খুব শিগগিরই উন্নয়নের একমাত্র প্রতীক হয়ে উঠবে।
বিদ্যা বা অন্য মেয়েদের বেশি বাইরে যাওয়া হয় না। ক্ষেতি বাড়ি মন্ডলের কাজ সামলাতে অনেক সময় যায়। তবে তারাও শুনেছে পাহাড় ফুটো করা টানেলের পর টানেলের কথা! চল্লিশ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে না পেরোতে পাঁচখানা টানেল ধোঁয়া আর ধুলো ভর্তি বিরাট হাঁ-মুখে মানুষকে গিলে নেয়।
টানেল আগেও ছিল, কিন্তু সে সংখ্যায় কম, যাত্রাপথ হ্রস্ব করা ছাড়া তার আর কোনো কাজ ছিল না। এখন তো ভঙ্গুর পাহাড়ের পেট ফুটো করে কেবলই টানেল, জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে। এরকম চললে কোনো যুদ্ধ বাঁধার আগেই পাহাড় ধ্বসে পড়বে, কোনো নির্মাণই বাঁচবে না, সঙ্গে মারা পড়বে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষ, ভেঙে পড়বে বাস্তুতন্ত্র।
গতবারের সেই বন্যা
বিদ্যারা বলে, প্রকৃতির রুদ্ররোষ যে কী ভয়াবহ চেহারা নিতে পারে, তা দেখিয়ে দিয়েছে গতবারের বন্যা। মান্ডির শিবমন্দির বেঁচে গেলেও মানুষের প্রাণ, ঘরবাড়ি, জীবজন্তু, গাছপালা, কিছুই রেহাই পায়নি। বন্যার জল সঙ্গে নিয়ে এসেছে বিশাল ধ্বস, ব্রিজ উপড়ে, জনপদ ভাসিয়ে সে এক প্রলয়ংকর কাণ্ড!
মেয়েরা দেখায়, তীর্থান নদীর ওপর এই ব্রিজের নীচে এখনও লেগে আছে এক বিরাট গাড়ির (টাটা হ্যারিয়ার) কংকাল। না বলে দিলে চেনার উপায় নেই।
সেতুর মুখোমুখি পাহাড় উপড়ে ধ্বসের সঙ্গে নেমে এসেছে অজস্র ছোট বড় পাথর। ধ্বসের পথে পড়েছিল এক বিরাট গোশালা। দুধেলা গাই সমেত সেটি নিশ্চিহ্ন হয়েছে। জল উঠে এসেছিল অনেকদূর।
সেতুটিও বেশ খানিকটা ভেসে গেছে বন্যার জলে। কিন্তু কী আশ্চর্য, নদী সরে আসায় বন্যার পর বোল্ডার পরিকীর্ণ তীর সাফ করে এর মধ্যেই উঠে গেছে হোমস্টে নামের সব ছদ্মবেশী হোটেল। এখন নাকি আইন হয়েছে নদীর গায়ের ওপর নির্মাণ চলবে না। একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এতদিন এই আইন ছিল না! যেগুলো এরমধ্যেই মাথা তুলেছে সেগুলো আর একটা বন্যায় ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে বলে অপেক্ষা থাকবে আমাদের? লক্ষ্মী মন্ডলের লক্ষ্মী মেয়েরাও এই প্রশ্নের সামনে বিমূঢ় হয়ে পড়ে।
সব দেখেশুনে মনে হয় ট্যুরিজম একটা ভয়ংকর দৈত্যের চেহারা নিয়েছে। হিমাচল প্রদেশে যেহেতু জমি কেনা যায় না, স্থানীয়দের জমি লিজ নিয়ে হোমস্টে-র নামে হোটেল ব্যবসা খুলে চলেছে রাজ্যের বাইরের ধনী ও প্রভাবশালীরা। স্থানীয়রা লিজের টাকা ও কর্মসংস্থানের অল্প সুযোগই পাওনা বলে মেনে নিয়েছে। কঠিন হাতে এর মোকাবিলা না করলে অচিরেই গোটা হিমালয় ধ্বংস হয়ে যাবে। পরিবেশের সেই নির্বিচার ধ্বংস প্রভাব ফেলবে সারা দেশেই।
বিবর্তনের পথে এত সুন্দরের সৃষ্টি হল, সে কি শুধু ধ্বংস হবার জন্যই? তীর্থান গ্রামের মেয়েরা, সমস্ত অধিবাসীরা এ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল এবং চিন্তিতও। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞ আটকাবার উপায় তাদের অজানা। বৃহত্তর পরিবেশ ভাবনায় দেশের যে মাথারা ভাবিত হলে কাজ দিত, তারা কোথায়!