এ এক অদ্ভুত বই। পাতার পর পাতা উলটেও আমি ঠিক করতে পারিনি এ কোন বৃক্ষের ফুল, কোন জনরেঁ এর উৎস। প্রবন্ধ, ইতিহাস, রসনা-রেসিপি, ইদানীং ফুড-ব্লগ নামে যা জগত-বিখ্যাত, শিল্প ও শিল্পীর ওপর কিছু কথা, নাকি কেবলই মনোহরণ দাস্তান বা আখ্যানগুচ্ছ। সব কাননের ফুলের সুবাস পাওয়া যাবে এতে আলাদা করে, আবার প্রত্যেকটি মিলেমিশে একটি নিবিড় কথকতা! বাংলা সাহিত্যে এরকম আর কিছু আছে কি?
শ্রুতিতেই নিহিত ছিল সাহিত্যের আদি বীজ। দেশে এবং বিদেশে। দেশে যদি বেদের উদাহরণ, দূর বরফের সাম্রাজ্যে সেই কবে এংলো স্যাক্সন যুগের চারণকবিরা বীণাটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন দেশান্তরে। সমুদ্রের গর্জন আর বালি মিশে থাকা অন্ধকারে গরম মাংস, পানীয় সহযোগে তাদের সুর শুনত মনোযোগী শ্রোতারা। শুধু তো সুরই নয়, প্রবহমান ঘটনাপঞ্জি, রাজনীতি, সমাজনীতি, সবই ভিড় করে থাকতো সেই সুরের পরতে পরতে। বেউল্ফ-এর বীরত্বের গাথা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা শেখাত, কখনও আনন্দে উদ্বেল করে তুলত, আবার কখনও তার পরিণত বয়সের মৃত্যু যেন অকাল-মরণের শোক গায়ে মেখে অশ্রুসিক্ত করে তুলত চোখ। এমনই শক্তি সেই কথকতার!
সুপর্ণা দেবের সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র খোঁজখবর যারা রাখেন তারা সকলেই জানেন পেশায় তিনি জবরদস্ত আধিকারিক হলেও নেশায় তিনি এক দিওয়ানা দাস্তানগো, যার দিন কাটে মানুষকে সব আজিব কহানি শুনিয়ে। কী সুবাস, কী মাধুরী সেই সব কাহিনীতে, যেন রঙবেরঙের বেলোয়ারি ঝাড়, যা থেকে আলো ঠিকরে পড়েছে রুহানির পাতায় পাতায়! পড়ছি ঠিকই, কিন্তু যেন দেখছি শুনছিও সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে! আর লেখক অনায়াসে মিলিয়ে দিচ্ছেন দেশ থেকে দেশান্তরের সমস্ত দাস্তান, তার মধ্যে বুনে দিচ্ছেন মানুষের মধ্যে ভাগাভাগির প্রবণতার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া কোমল পরিহাস, প্রাণের মিলনে যে সুন্দরের উদ্ভব, তার প্রতি প্রীতি-অর্ঘ্য!
যেমন ধরুন না এই জায়গাটা, "বিধাতা প্লাবন তুললেন। সে এক কীর্তিনাশা মহাপ্লাবন। ফুলে উঠল সমুদ্র। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সব ভেসে গেল। সব। জীবনের কোনো চিহ্নই রইল না। শুধু তোলপাড় জলরাশির মধ্যে গর্জনশীল চল্লিশার ঢেউ-এর মধ্যে আছাড়িবিছাড়ি খেতে লাগল মোচার খোলার মত একটা জাহাজ। হ্যাঁ, ওটাই নোয়াহর তিনতলা জাহাজ। প্রলয়পয়োধি জলে তখন কেশব বিষ্ণু, নৌকার মত মৎস্য অবতার হয়ে ডুবন্ত প্রাণকে রক্ষা করছিলেন কোথাও বা।
নোয়াহর তিনতলা জাহাজও বাঁচাল, ওই মৎস্য অবতারের মতই সমস্ত প্রাণকেও বাঁচাল। নোয়াহ তাঁর বউকে বলেছিলেন, “সব প্রাণীদের ভেতর থেকে একটি নারী আর একটি পুরুষ বেছে নিয়ে ভেসে পড়ি চলো। আবার যদি কোথাও গিয়ে ঘর-গেরস্থালি বাঁধতে পারি। জীবন রুইতে পারি কোনোদিন!”
এইভাবে জলের প্লাবনের সঙ্গে লড়তে লড়তে ভাসন্ত-ডুবন্ত নোয়াহ একদিন দেখলেন, নাহ, অতটা উথলপাথল মনে হচ্ছে না আজ! তিনি জাহাজের কুঠরি থেকে বেরিয়ে দেখলেন দিগন্তে এক পাহাড়ের আবছা ছায়া।
আবার এদিকে কোথায় যেন মন্দার পর্বতকে দণ্ড করে ক্ষীরসমুদ্র মন্থন হচ্ছিল। কেশব বিষ্ণু কচ্ছপ হয়ে তাঁর পিঠের শক্ত খোলের ওপর সেই পাহাড়কে তুলে নিলেন। মন্থন হল শেষ, উঠল অমৃত। প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে খাবার চাই।
নোয়াহর জাহাজও এত দিন পর যেন জিরোতে চাইছে। সেই পাহাড় দুধেল গাইয়ের মত তুলতুলে বরফে মোড়া। নোয়াহর মুখে বিজয়ীর হাসি। চিৎকার করে বলে উঠলেন, “গিন্নি, ও গিন্নি বাইরে এসে দ্যাখো একবার। এই পাহাড়ের গায়ে জাহাজটাকে ভিড়িয়ে দিই। চলো একটু ডাঙায় নামি। মনে হচ্ছে এ যাত্রা বেঁচে গেলুম গো!”
নোয়াহর জাহাজ থামল। সেই পাহাড়ের তলায়। জাহাজ বাঁধা হল পাহাড়ের গায়ে। নোয়াহ, সেই প্লাবন-পূর্ব যুগের আদিপিতা, আদি মাতাকে ডাক দিয়ে বললেন, “ভাঁড়ারে কী কী আছে দ্যাখো একবার। কিছু একটা রাঁধতে ভারী ইচ্ছে করছে।” গিন্নি ভাঁড়ার হাঁটকে বললেন, “এই যা আছে নাও।” নোয়াহ জুলজুল করে দেখলেন কয়েক দানা গম। কিছু যব, একটু-আধটু দানা এদিক-সেদিক ছড়ানো-ছিটনো, ফলের দানা, দুটো বাদাম। তাই নিয়ে নোয়াহ পুডিং রাঁধতে বসে গেলেন। পুডিং বা পিষ্টক সে যাই হোক না কেন, তিনি মহানন্দে সেই পুডিং বানিয়ে গিন্নি আর যত ক-টি প্রাণী তাদের সঙ্গে ছিল সব্বাইকে নিয়ে খেতে বসলেন। এর নাম আশুরে। মধুসূদনের ভাঁড়ের মত সেই খাবারে বেশ কুলিয়ে গেল সব্বার। খেয়েদেয়ে সেই বরফ তুলতুলে পাহাড়ের কোলে বসে খানিক বিশ্রাম নিলেন তিনি।
এই আরারত পাহাড়, আর্মেনিয়া আর তুরস্কের সীমানায়। হিব্রু বাইবেলের জেনেসিসে এইসব গল্প লেখা হয়েছে। আরমানি তুর্কিতে একেবারে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। এখন দু-দেশের সীমান্ত বন্ধ। এদিকে মহরম মাসের দশ তারিখে মানে আশুরের দিন তুরস্কে বানানো হয় নোয়াহর আশুরে পুডিং। পরিমাণে অনেকটা করে। সবার মধ্যে ভাগ করে খাওয়া হয়। প্যাকেটে প্যাকেটে বাক্সে বাক্সে বাড়ি বাড়ি পাঠানো হয়। ইহুদি, আদি খ্রিস্টান আর ইসলাম ধর্মের গোলোকধাঁধায় দুই দেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে আরারাত পাহাড় মুচকি মুচকি হাসে। সে তুরস্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে। অথচ আরমানির জাতীয় প্রতীকে দিব্যি রয়ে গেছেন!"
এক জায়গায় পাই "আব-এ-হায়াত" বা জীবনের জলের উল্লেখ। ঐ জল যার খোলা চুলে না পড়েছে, সে কখনই কোঁচড় ভরে শিউলি কুড়নোর মত জমিয়ে রাখতে পারবে না এতো এতো কাহিনী, তাদের মধ্যে অনায়াস যোগসূত্র খুঁজে বার করাও অসম্ভব হবে। রুহানির দাস্তানগোর লম্বা চুল নিশ্চয়ই আব-এ-হায়াতে ভিজে চুপচুপে, তাই এই দেখি তাকে হিরামন কাঁধে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে, আবার দেখি সে গুটি গুটি চলেছে পারস্যের দিওয়ানা কবি মেহর নিগারের বিশাল ক্যারাভানের পাশে। গেছোদাদার চূড়ান্ত সংস্করণ এই দাস্তানগো লক্ষ্ণৌ থেকে লাফিয়ে যান ইতালির ফ্লোরেন্সে, কৃষ্ণনগর থেকে ক্যাস্পিয়ান সমুদ্রের তীরে, সর্বত্র বিচ্ছুরিত হতে থাকে হাতে থাকা মায়া লন্ঠনের আলো, যে আলোতে জাতপাত ধর্মের বেড়া ডিঙিয়ে জীবন হয়ে ওঠে এক আশ্চর্য রূপকথা।
আসলে রুহানি এই উপমহাদেশের যাপনচর্চার একেবারে সামনের সারির কিতাব। বিভিন্ন জীবন, সংস্কৃতি কীভাবে এক মহামিলনের কথাই বলেছে এতকাল, তার প্রামাণ্য বয়ান। খুব কঠিন আর ভারী কথা আলগোছে রূপকথার তবকে মুড়ে বলা, যেন চিরকাল মাথায় থেকে যায়। শুধু থাকা নয়, যেন বহতা ধারার মত গড়িয়ে যায় যূথ-স্মৃতিতে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, সে ব্যবস্থাও করা আছে পাকাপোক্ত ভাবে। গঙ্গা যমুনি তেহজিব খালি এই শব্দ ক'টি উচ্চারণ করলে মর্মার্থ বিস্মৃত হবার চান্স ষোলো আনা। কিন্তু ঐ তেহজিবের কেন্দ্রবিন্দু লাখনৌয়ের আদবকায়দার একটি কিসসা শুনলে ব্যাপারটি ভোলা দুষ্কর,
"খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল। পিসি বললেন, “যা বলছিলাম, লখনউয়ের ভাষা বা বুলিই আমাদের আসল পরিচয়। সেখানে মেয়েপুরুষ, গরিব-বড়োলোক—কোনো ভেদ নেই। একবার লখনউয়ের বাইরের একজন লোক ভাবল লখনউয়ের ভাষা নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। যাই, গিয়ে শুনে আসি কীরকম ভাষা ওদের। চকবাবাজারে গিয়ে দ্যাখে বেশ একটি ডাগর গুলফারোশ মানে ফুলওয়ালি ফুল বিক্রি করছে। সে ফুলওয়ালির দিকে একেবারে সামনাসামনি এসে ড্যাবড্যাব করে দেখতে লাগল। গুলফারোশ তাকে বলল, কী দেখছেন অমন করে? জানেন না এই শহরে অমন ড্যাবডেবিয়ে দেখাকে অসভ্যতা বলে?
সেই লোকটি বলল, সবুজ পোশাকে ঢাকা একটি শরীর দেখছি।
গুলফারোশ বেশ ঝাঁঝিয়ে বলল, না মিয়াঁ, তুমি লখনউয়ের লোক মোটেই নও।
সে লোকটি খানিক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বলল, না না, আমি তো এখানকারই।
গুলফারোশ বলল, না জনাব, হতেই পারে না। লখনউয়ের লোক এমন ভাবে কথা কইবেই না! আপনি যা বলেন তাকে আমরা বত্তমিজি বলি!
লোকটা এবারে জিজ্ঞেস করল লখনউয়ের লোক হলে কীভাবে বলত?
গুলফারোশ বলল, মন দিয়ে শুনে নিন, লখনভি জবান বলত, সবুজ ফানুশে একটি শিখাকে জ্বলে উঠতে দেখলাম!”
আমি বললাম, “আহা আহা! হায় হায়!”
একটি ভুলে যাওয়া আভিজাত্য তার রঙ রূপ স্পর্শ নিয়ে যেন সামনে এসে দাঁড়ায়। তার কারুকাজ মণ্ডিত শাল দোশাল মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমরাও সমস্বরে বলে উঠি আহা! আহা! হায়! হায়!
গুরুচন্ডা৯-কে ধন্যবাদ এতো বিচিত্র বিষয়ে বই প্রকাশ করবার জন্য। সুপর্ণা দেবকে ধন্যবাদ বাংলাসাহিত্যে প্রায় স্তব্ধ হয়ে যাওয়া, শুকিয়ে আসা একটি স্রোতকে নবজীবন দেবার জন্য। রুহানিকে বোঝার সেরা উপায় হচ্ছে রুহানি পড়ে ফেলা। এক নিঃশ্বাসে বইটা শেষ করবার পর বুঝেছি নীচের কথাগুলো কতটা সত্যি,
"দাস্তানের আত্মা আছে। নীরবতার মধ্যে যে উপলব্ধি তাই দাস্তানে মুখরিত আকার নেয়। দাস্তানে জমাট বাঁধে কত আবেগ, কত অনুভূতি, কত বিশ্বাস, কত ত্যাগ, কত বেদনা। দাস্তানকে বাঁধা যায় না। সময় তাকে পোড়াতে পারে না। সময় গিলে নেয় সব, শুধু দাস্তানকে সে গিলতে পারে না। একজন দাস্তানগো তার বুকের ভেতরে ধরে রাখে কত কত যুগ। তবেই না সে আশ্রয় হয়ে ওঠে মানুষের। তার দাস্তানের ছাতার তলায় দু-দণ্ডের বিশ্রাম নেয় অস্থির মন।
দাস্তানগুরু ধূপের গন্ধ পায়, গোলাপের গন্ধ পায়। খালি চোখে যাদের দেখা যায় না তারা দাস্তানগুরুকে ছুঁতে চায়। না বলা কথা বলতে চায়, তাদের চাপা বেদনা গুমরে গুমরে মরে গেছে। তাদের কথা কেউ বলেনি। আঁধার রাতে দাস্তানগুরুর চারপাশে তারা ঘুর ঘুর করে। দাস্তানগুরু তাদের কথা শোনে। তখন দৃশ্যমানতা পেরিয়ে দাস্তান গুরু অতীন্দ্রিয় পথের যাত্রী। দুটো অদৃশ্য ডানা বেরিয়ে আসে তার পিঠ থেকে। ওয়েভ লেংথ বা তরঙ্গায়িত অনুভূতি সবাই বুঝতে পারে না। দাস্তানগুরু পারে। তাই দাস্তানগুরু অনেকের মনের গভীরে ডুবুরির মত সাঁতার কেটে ঝিনুকের ভেতরে মুক্তোর সন্ধান পায়। আর এই কারণেই দাস্তানগুরুকে অনেকে বুঝতে পারে না।
ভুল বোঝে। অনেকে দূরে সরে যায়।
এক শীতের সকালে ভুলি ভাটিয়ারি কি মহলে ছমছমে পরিবেশে দাস্তানগুরু বলেছিল
আশিকোঁ অর ফকিরোঁ কা কোঈ জমানা নহি হোতা
উয়ো জিস জমানেমে আয়ে উয়ো জমানা উনকা নহি হোতা
প্রেমিক আর ফকিরদের কোনো যুগে বেঁধে রাখা যায় না
তারা যে সময়ে আসে, সেই সময়কেও ছাড়িয়ে যায় তারা।"