দাস্তানগুরুর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি বহুদিন। শুকনো পথে কেবল ধুলো উড়িয়ে চলেছি। এপথের শেষে কী আছে? “পাগল বাবর আলির চোখের মতো” এলোমেলো আকাশ। আকাশে লটকে আছে মেঘের পথ। তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো করুণ হয়ে আছি। লুঠ হয়ে যাচ্ছে মানসম্মান। বিকিয়ে যাচ্ছি। ভেঙে যাচ্ছি। জ্বালিয়ে দিচ্ছ কে আমাকে? দাস্তানগুরু, আমরা স্বপ্নের পথে মায়াপ্রাসাদ গড়তে শুরু করেছিলাম যে। তুমি তো বাকিটা বলে যাওনি। পথ চলব কী ভাবে।
সামনে একটা সরু গলি। একটা দরগা। কিছু মহিলা। ঢাকা পোশাক। কেউ একমনে মালা জপছে। কেউ চোখ বুজে বসে আছে। বিশাল একটা ঝাড়বাতি।
গোলাপের হালকা সুগন্ধের সঙ্গে গানের সুরের মতো অনেকগুলো মেয়েদের গলা থেকে অস্ফুট ঝরনা বেরিয়ে আসছে, মাই সাহিবা মাই সাহিবা মাই সাহিবা।
আমার মাথা টলে গেল। গোলাপের রং উড়ে উড়ে মিশে গেল বাদামি ঘাসের জঙ্গলে। বুনো ঘোড়ার ডাক। নীল আকাশে ফালা ফালা সূর্যের আলো। দেয়ালের গায়ে ফিরোজা রঙের পাথরের নকশা। এক বিশাল তৃণভূমি। আমার ঘাড়ে কে হাত রাখে? আরে! দাস্তানগুরু! দাস্তানগুরু হাসে। আমার হাতে একটা গোলাপ দেয়। ছোট্ট। সুগন্ধে ভরে আছে। দাস্তানগুরু বলে আজ একটা স্বপ্ন দেখলাম! চিরাগ দিল্লিতে যেখানে আমি বড়ো হয়েছি সেখানে একটা খুব পুরোনো রুটির দোকান ছিল। আমি সেখানে গিয়ে একটা বিশেষ ধরনের রুটি খেতাম। স্বপ্নে দেখছি, দোকানে এক বৃদ্ধ মানুষ বসে আছেন। আমি যতবার বোঝানোর চেষ্টা করছি উনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না আমি কোন্ রুটিটার কথা বলছি! তারপর ভেতরে গিয়ে একটা ঝুরঝুরে পুরোনো বই এনে আমার হাতে দিয়ে বললেন “আমি এই বইটার অর্ধেকটা পড়েছি। এখন বাকি আধা তুমি শেষ করবে।”
আমি আর দাস্তানগুরু ইউরেশিয়ার তৃণভূমি দিয়ে হাঁটছি। ঘাসের ভেতর দিয়ে। এই লম্বা লম্বা ঘাস। দাস্তানগুরুর জোব্বা ঘাসে আটকে যাচ্ছে। দাস্তানগুরু ধীরে ধীরে বলতে শুরু করে, বাকি অর্ধেকটা বলে দিই।
“ছোটোবেলা থেকে জুলেইখা শুনত আশ্চর্য সব গল্প। শুনত, যদি বড়োদের কথা না শোনো, ঠিক সময় যদি না খেয়ে নাও তাহলে তেমুচিন এসে হুশ করে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। একদিন সত্যিই ঘুম থেকে উঠে জুলেইখা দেখেছিল সে উড়ে এসেছে।
একটা নতুন দেশে। বুখারা থেকে বদায়ুন। ইউরেশিয়ার স্টেপ অঞ্চল থেকে হিন্দ। হেরাট, কাবুল, কান্দাহার, গজনি, লাহোর। ক্যারাভান আর ভ্রমণকারীদের জন্য সেটাই ছিল নিরাপদ রাস্তা। তারা আরব তুর্ক সম্প্রদায়ের মানুষ। হিন্দ-এ এসে জুলেইখা তুর্ক দাস সুলতান ইলতুতমিসের নাম শোনে। ওই যাযাবর তুর্ক থেকেই এসেছেন সুলতান। কঠিন জীবন নতুন নয় জুলেইখার কাছে। যাযাবর তুর্ক কষ্টসহিষ্ণু। মধ্য এশিয়ার যাযাবর গোষ্ঠী হিন্দ-এ ঢুকে যতই সুস্থির জীবনকে ভালোবাসেছে ততই মেয়েদের লড়াক্কু ভাবটা ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে গেছে। ইলতুতমিসের মেয়ে রাজিয়ার মধ্যে জুলেইখা সেইসব যোদ্ধা আমাজনদের শেষ ছায়া দেখতে পান। মেয়েদের তিনি দাপিয়ে বেড়াতে দেখেছেন, তারা যুদ্ধ করত, পুজোর পুরুত হত, দলের নেত্রী হত। জুলেইখার আবছা আবছা মনে পড়ে মেয়েরা বাচ্চাদের পিঠে কাপড় দিয়ে বেঁধে কেমন ঘোড়া ছুটিয়ে দিত। ছয়-সাত বছর বয়স হলে ছেলে-মেয়ে ঘোড়ায় চড়ে লম্বা লম্বা রাস্তা পেরিয়ে যেত। মেয়েরা কী পরিশ্রমই না করত! ইউরেশিয়ার তৃণভূমিতে ঘোড়া ছোটাত, ঘরগেরস্থালি করত। বড়োবড়ো পরিবার বেঁধে রাখত। প্রতিকূল আবহাওয়ায় বছরের পর বছর বুদ্ধি, হৃদয় আর শক্তির জাদু দেখিয়েছে একমাত্র তারাই। নিজের ছেলের মধ্যে এইসব মূল্যবোধগুলো ছবির মতো করে এঁকে দিয়েছিলেন বিবি জুলেইখা। “হজরত নিজামুদ্দিন আওলিয়ার মা। এই দরগা, সেই মায়েরই। মেয়েদের এখানে অবাধ প্রবেশ। বাবাকে কাছে পাননি মেহবুব এ ইলাহি। মায়ের ছায়ায় মানুষ হয়েছিলেন। সীমাহীন দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। খাওয়া যেদিন জুটত না মা বলত নিজাম, আমরা আজ খোদার মেহমান।
পরে নিজামুদ্দিন আওলিয়া বলেছিলেন, তাঁর মায়ের মধ্যে এক আশ্চর্য শক্তি ছিল। তিনি যা প্রার্থনা করতেন, ঈশ্বর তা মঞ্জুর করে দিতেন। মায়ের এই শক্তি দেখে বড়ো হয়েছিলেন বলেই হজরত বলতে পারতেন আধ্যাত্মিক জীবনে নারীপুরুষ ভেদ নেই। বরঞ্চ মেয়েরা অনেক এগিয়ে। গুহার ভেতর থেকে যখন সিংহ বা বাঘ বেরিয়ে আসে তখন সেটা ছেলে না মেয়ে সে প্রশ্ন কেউ করে না। মেয়েদের অসম্ভব সম্মান করতেন তিনি।”
দাস্তানগুরু বলে চলেছে। চারদিকে এক অপার্থিব আলোর বন্যা। আবার সেই দরগা। আবার সেই মাতাল করা সুগন্ধ আর অস্ফুট প্রার্থনা। দাস্তানগুরু বলল, “বাকি অর্ধেকটা যা আমার এতদিন জানা হয়নি সেটা কী জান? কিছুই থাকে না। গন্তব্য, পথ না পথের সঙ্গী কেউ থাকে না শেষ পর্যন্ত। থাকে কয়েকটা দাস্তান ভরা কৌটো। মুসাফিররা কুড়িয়ে কুড়িয়ে নেয়।”
গোলাপের সুবাসের মধ্যে মিলিয়ে যেতে যেতে দাস্তানগুরু বলে উঠল, “যা, যা তোর হুকুম সাহিবার দেশে যা। আমার কথার মানে বুঝে আয়!”
“বৃষ্টি ভেজা রাতে যেন
কোথায় ফোটে হাসনুহানা
মুঠি তোমার আলগা কর
কেউ থাকে না, কেউ থাকে না।”
মীরা ইসমালুন (১৮৩০-১৯০৯) ছিলেন খুব সুন্দরী আর তেজস্বিনী। জন্মেছিলেন কায়রোতে, ইসমালুনদের জমকালো বংশে। তারা ইজিপ্টের লোক হলেও বংশের আদি শিকড় ছিল স্পেনে। আবার ইসমালুনরা কোনো একসময় হাঙ্গেরিতে বাস করত। তের বছর বয়সে মীরা ইসমালুনের বিয়ে হয়ে গেল মিশরের এক ব্যাংকারের সঙ্গে, তিনি আদতে আরব দেশের লোক। কত ধর্ম আর সংস্কৃতির নির্যাস বয়ে চলেছিল ইসমালুনদের রক্তে। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দুই সংস্কৃতির বুননে মীরা ইসমালুন হয়ে উঠেছিলেন দ্যুতিময়, ধারালো, স্বতন্ত্র একটি বিদ্যুৎরেখা। সেই সময়ের সমাজ ও মেয়েদের অবহেলিত জীবনের প্রেক্ষিতে মীরা ইসমালুন ছিলেন এক জ্বলন্ত ব্যতিক্রম। সেই সময়ে দুটি মেয়েকে নিয়ে স্বামীকে ছেড়ে তিনি একা প্যারিসে চলে আসেন। কেন? কারণ স্পষ্ট নয়। অনুমান বলে মনের অমিল মতের অমিল। ইসমালুন আরবি ছাড়া কোনো ভাষা জানতেন না। কিছুদিনের মধ্যে শিখে ফেললেন ফরাসি ভাষা। অসম্ভব স্বাধীনচেতা ছিলেন তো। রূপ গুণ অর্থ তাকে সহজেই নিয়ে গেল ফরাসি অভিজাত মহলে, বহু নামজাদা মানুষের সঙ্গে ছিল তার মেলামেশা। পশ্চিম ইউরোপীয় সমাজে একরকম সেলিব্রিটি হয়ে উঠে ছিলেন। মহার্ঘ আরবি পোশাক আর অলংকারে তাকে এক রানির মতোই দেখাত। মরিস আলফাসা নামে আদ্রিয়ানপোলিসের এক তুর্কি ইহুদির সঙ্গে তাঁর দ্বিতীয় মেয়ে ম্যাথিলডির বিয়ে দেন মীরা ইসমালুন। মরিস আলফাসাও একজন ব্যাংকার। বিয়ের কয়েক বছরের পরেই পাকাপাকি ভাবে প্যারিস চলে আসেন মরিস। তিনি ছিলেন এক আশ্চর্য মেয়ের বাবা। এ মেয়ে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো লাফায়-ঝাঁপায় না, দস্যিপনা নেই, কোনো ছেলেমানুষি নেই। সে শুধু দেখতে পায়, চার-পাঁচ বছর থেকেই দেখতে পায়, মাথার ওপরে ঘুরে ঘুরে নামছে উজ্জ্বল আলোর বৃত্ত। সে আলো রেণু রেণু হয়ে ঢুকে যাচ্ছে তার মাথার মধ্যে, সমস্ত শরীরের মধ্যে, চেতনার মধ্যে। এ মেয়ে অন্য জগতের। অলৌকিক, অতিমানস। ইচ্ছাশক্তি, সাহস, স্বাতন্ত্র্য সৌন্দর্য একেবারে দিদিমার মতো। শরীরটিও মজবুত, ঋজু, কষ্টসহিষ্ণু। নামটিও মীরা। মীরা আলফাসা। বারো বছর থেকেই শুরু অকাল্ট চর্চা, গুহ্যবিদ্যা। এক অতিমানস চেতনা ও দিব্যজীবনের যাত্রার অস্ফুট সূচনা।
ভারতীয় দর্শন আর অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে তার খুব অল্পই পরিচয় তখন। তার চেতনার মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে দেখা দেয় এক কৃষ্ণকায় পুরুষ। মীরা তাকে কৃষ্ণ বলে ডাকতে শুরু করেন। মীরার সৃজনশীলতা তখন বর্ণাঢ্য ও সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছে চিত্রকলায় আর সংগীতে। খুব উঁচু দরের শিল্পী। অরগ্যানে পিয়ানোয় রঙে তুলিতে পারদর্শী এক দীপ্র প্রতিভা।
মায়ের সঙ্গে ভেনিস বেড়াতে গিয়ে পূর্বজন্মের কথা মনে পড়ে। জন্মান্তরের রহস্যময় মায়াবী ছায়াপথ বেয়ে একাত্ম হয়ে পড়েন মিশরের ফ্যারাও রানি হাটশেপসুটের সঙ্গে। হাটশেপসুট সেই ইতিহাসখ্যাত ফ্যারাও, এক গনগনে আগুনের মতো দৃপ্ত, তুলনাহীন সুন্দরী ও মেধাবী নারী সেই সময়ে কঠোর হাতে তুলে নিয়েছিলেন রাজদণ্ড। পূর্ণ রাজকীয় মহিমায় শাসন চালিয়ে গেছেন। এমনকি নকল দাড়িও পরতেন। এদিকে মীরার মনীষা, অধ্যাত্মশক্তি, উপলব্ধি ও প্রজ্ঞা ক্রমশ যেন ঊর্ধ্বমুখী শিখা, তীব্র, ভাস্বর, ব্যাপ্ত ও মন্দ্র।
চিত্রশিল্পী হেনরি মরিসের সঙ্গে বিয়ে, একটি ছেলে হবার পর কিছুদিনের মধ্যে ভেঙে যায়। বিখ্যাত দার্শনিক ও পণ্ডিত পল রিশারকে এরপর জীবনসঙ্গী করেন মীরা।
রিশার প্রাচ্যের অধ্যাত্মবাদ, বেদান্ত ও যোগের অনুরাগী ছিলেন। ইতিমধ্যে সেই স্বপ্নে পাওয়া কৃষ্ণ আরও প্রবল হয়ে তার চেতনা জুড়ে বসে থাকে। পাতলা শরীর, পিতল সোনালি রং, উজ্জ্বল কান্তি, এলোমেলো দাড়ি, লম্বা চুল, তীক্ষ্ণ চেহারা, পরনে ধুতি, ধুতির খুঁটে ঢাকা কাঁধ, খালি হাত পা।
১৯১৪ সালের ২৯ মার্চ মীরার জীবনে এক মহেন্দ্রক্ষণ এল। স্বপ্নপুরুষের সঙ্গে তার দেখা হল। ভারতবর্ষে। সে এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। “একটি নিমেষ দাঁড়ালো সরণী জুড়ে, থামিল কালের চির চঞ্চল গতি।” অবিকল তার স্বপ্নপুরুষ, তার কৃষ্ণ সামনে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এই সঙ্গ স্থায়ী হল না। ইওরোপে তখন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মীরা পরে লিখেছিলেন “তিনি আমাকে থেকে যেতে বললেন না, কাজেই ফিরে যেতে হল। কী ই বা করতে পারতাম আমি? কিন্তু আমার চৈত্যপুরুষ (psychic) তার কাছে রেখে গেলাম।”
রিশারের সঙ্গে তিনি তখন জাপানে। প্রথম মহাযুদ্ধের দাবানল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এখানেই সাক্ষাৎ। মীরার প্রতিভায় ও জ্ঞানে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হলেন, বললেন শান্তিনিকেতনে শিশুবিভাগের দায়িত্ব নিতে। মীরা রাজি হননি। তাঁর পথ অন্য।
১৯২০ সালের ২৪ এপ্রিল। সমুদ্র চরাচর জুড়ে এক অপার্থিব নীল আলোর পরিধি। আবার ভারতবর্ষের মাটিতে নামলেন মীরা ও রিশার।
মীরার আর প্যারিস ফিরে যাওয়া হল না। এবার তিনি যেতে চাইলেন না। ভারতের অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে পশ্চিমের মনন ও কর্মশক্তির দৈব মিলন। এই তো তার প্রকৃত কর্মভূমি। রিশার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারলেন না, ফিরে গেলেন প্যারিসে, একা।
পূর্ব উপকূলের সমুদ্রতট তখন স্থির। যোজন সমুদ্রপথ, নারকেল বীথি, আকাশের নীলিমা এক অনাগত শুভক্ষণকে স্বাগত জানাবে বলে প্রস্তুত। জন্ম-জন্মান্তরের রানি মীরা আলফাসা হয়ে উঠলেন মা মীরা। শ্রী অরবিন্দের সাধনসঙ্গী। আশ্রমের প্রাণপ্রতিমা। মাদার। শুরু হল দিব্যজীবনের এক অনবদ্য আলেখ্য। পন্ডিচেরির দিকচক্রবাল জুড়ে তখন সূর্যোদয়ের স্নিগ্ধ শান্ত আলো।
পন্ডিচেরির প্রমেনাদ বিচ। শহরের অন্যতম মুখ্য আকর্ষণ। কালো পাথরের বোল্ডারে ভেঙে পড়ছে সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ। দুধের মতো ছড়িয়ে পড়ছে তার ফেনা। সিগালেরা চিৎকার করে ইতিউতি উড়ে যাচ্ছে। এখানে সেই অর্থে কোনো তটভূমি নেই। সমুদ্রের পাড় যত্ন করে বাঁধানো। বড়ো বড়ও পাতাওয়ালা বেঁটে গাছ আর সুন্দর বাতিস্তম্ভ। মাঝে মাঝে ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা। ফরাসি উত্তরাধিকার পন্ডিচেরিকে অন্যান্য শহর থেকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে, যার নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এই শহরের সর্বত্র, আনাচে-কানাচে, পথে-ঘাটে, অলিন্দে, বাতায়নে। অনুচ্চারিত অভিজাত সুরুচি, ফরাসি সুগন্ধির মতো আবেশে জড়িয়ে রেখেছে তাকে। যেন শ্রী মা ছড়িয়ে রেখেছেন তাঁর স্নেহকণা। কেউ দেখতে পাচ্ছে না আবার কেউ তাকে এড়িয়েও যেতে পারছে না। এই হল পন্ডিচেরির জাদু।
ভূমধ্যসাগরীয় শহরের ধাঁচে পন্ডিচেরির পরিকল্পনা। সমুদ্রতীর বরাবর হাঁটলে মনে হয় যেন অন্য একটা দেশ। একেবারে অন্যরকম একটা অনুভূতি।
ফরাসি প্যাটার্নের বাড়ি, হলুদ, ছাইনীল, আকাশি রং, সাদা বর্ডার, আর্চ দেওয়া, ভেতরেটা গাছপালায় ঢাকা একরাশ নিরিবিলি, বোগেনভিলিয়ার উদ্ধত বেগুনি ফুলে ফুলে ছাওয়া ফরাসি ভিলার গেট, ঝুলন্ত একফালি বারান্দায় অদ্ভুত টবে সিড়িঙ্গে গাছে বড়ো বড়ো পাতা, কার লাল স্কার্ফ ঝুলে আছে, কার সাইকেল অপেক্ষা করছে, কার রান্নাঘর থেকে উড়ে আসছে জলপাইতেল আর চিজের গন্ধ। কমলালেবু রঙের রোদ। রঙিন। প্রাণবন্ত। যেন ক্লদ মনে (Claude Monet) ছবি এঁকে রেখেছেন পথের বাঁকে বাঁকে।
না, কোনো তাড়াহুড়ো নেই। যারা যেখানে যাবার চলে গেছে। রোদচশমা খুলে তুমি শান্ত হয়ে বসো। কপালের ঘাম মুছে এক গ্লাস জল খাও, রাখো নীল ছাতাটা গুটিয়ে। আশ্রম ছাড়িয়ে একটু ভিড়ভাট্টার রাস্তা। মিশন স্ট্রিট। এখানে ওয়াইন আর ফলের রসে মজানো একগ্লাস সাংগ্রিয়া (sangria) আর গরমাগরম সদ্য বানানো আভেনফ্রেশ পাতলা মুচমুচে পিৎজা তার ওপর গলানো চিজ নিয়ে বেতের চেয়ারটায় বসা যাক।
নীচে বয়ে চলেছে পন্ডিচেরির ব্যস্ত জীবন। মোৎজারটের সুরের মায়াজাদুতে তৈরি হয়েছিল ডন জিওভানি অপেরা। আর এইখানে ম্যাজিক দেখাতে আসছেন ইটালির খাঁটি বোলোনিজ রাঁধুনি মাসিমিলানো মুরলী মরসিয়ানি। সেই কবে ইটালি থেকে চলে এসে অরোভিলে বাস করছেন তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। কিন্তু বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন ইটালির বোলোনা (Bologna)- কে। হাসিখুশি মোটাসোটা গায়ে উলকি আঁকা মাসিমিলানো যত্ন করে পাশে বসে অতিথিদের বিশুদ্ধ বোলোনিজ রান্না পরিবেশন করেন। দাম একেবারে ঠিকঠাক। কোনো কোনো ডিশ নিজেই রান্না করে নিয়ে আসেন। আমরা বাঙালি কলকাতার লোক জানতে পেরে গোলগাল চকচকে হাসি হাসি মুখে বলে ওঠেন মাছের ঝোল। সে কী, তুমি স্প্যাঘেটি বোলোনিজ ছেড়ে মাছের ঝোল খাওয়াবে নাকি? আরে না না, আমার বউ বাঙালি।
মাসিমিলানোর রেস্তোরাঁয় সবকিছু অরগ্যানিক। তাজা। পাস্তা পিৎজা স্প্যাঘেটি লাসানে। মাসিমিলানো জানিয়ে দিতে ভোলেন না পাস্তা আসে খোদ ইটালি থেকে। নিজেই বানান জেলাতো আর তিরামিসু। দেশের জন্য গভীর দরদ আর অসম্ভব ভালো রসবোধ মিশিয়ে খাবার বানান তিনি। তাই এটা নিছক খাবারের দোকান নয়, আরও অনেক বেশি কিছু।
বুটিক বুটিক বুটিক
পন্ডিচেরি শুধু খাদ্যররিক নয় ফ্যাশন-পাগলদেরও স্বর্গরাজ্য। শহরের প্রায় সব জায়গায় বিশেষ করে হোয়াইট টাউনে ছোটো বড়ো বুটিক ছড়িয়ে আছে। গেলেই যে কিনতে হবে তার কোনো মানে নেই। চোখের আরামও তো বটে। ফ্রেঞ্চরা প্রচুর বুটিক চালায়। রাস্তার ওপরেই অরবিন্দ আশ্রমের অরোশিখা। ধূপ সুগন্ধি মোমবাতির সুগন্ধি লন্ঠনের স্বপ্নজগত। আশ্রমের ‘কটেজ’ বাড়িতে তৈরি হয় অনেক রকমের ধূপ। পাশ দিয়ে যাবার সময় মাট্টিপাল, কেতকী, পারিজাত, অম্বর, চন্দন, নির্বাণ, অদিতি সমস্ত ধূপের গন্ধ মিলেমিশে একটা ঝিমধরানো সুগন্ধ নাকে লেগে থাকে অনেকক্ষণ। কটেজে একটা ছোটো ছাদখোলা রেস্তোরাঁ আছে। এখানকার মিষ্টি খুব চমৎকার। বিশেষ করে কটেজের গোলাপজাম। আর কাজুবাদামের টফি।
পন্ডিচেরির সবকিছু কেমন যেন বেশি বেশি সুন্দর। যেন সুরুচি আর সৌন্দর্য দিয়ে একটা প্যাকেজিং করা হয়েছে। ছোটো ছোটো ডিটেইলগুলো বাদ যাচ্ছে না। আর অর্কেস্ট্রা মাস্টারের মতো কার অদৃশ্য আঙুল হেলানোয় এই মেলোডি দিনের পর দিন বছরের পর বছর এক ভাবে চলছে? যিনি আড়ালে থেকেও ভীষণ ভাবে স্পষ্ট। ‘Friction de Foucaud’ এই লোশনটি ব্যবহার করতেন তিনি। ইওরোপের গোলমেলে পরিস্থিতিতে ফ্রান্স থেকে সেটা আনানো মুশকিল হয়ে পড়ল। আশ্রমের Senteurs ল্যাবরেটরিতে প্যারিস থেকে রসদপত্র নিয়ে অল্প অল্প করে কাজ শুরু হল। নিষ্ঠা আর শক্তি জোগালেন তিনি। আজ এই ল্যাবরেটরির ‘Fluers en flacon’ বিপণনকেন্দ্রটি না ঘুরে এলে পন্ডিচেরির ভালোলাগা ষোলো আনা পাওয়া যাবে না। কত রকমের পারফিউম, কোলন, লোশন, এসেন্সিয়াল অয়েল, সাবান। কত রকমের প্রসাধনী। সবটাই নিজেদের তৈরি। গুণগত উৎকর্ষ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। আর এত রকমের সুগন্ধ যে হতে পারে তার কোনো ধারণাই ছিল না এত দিন। প্রত্যেকটি সুগন্ধির সঙ্গে নিবিড় যোগ শরীরের মনের এবং চেতনার। ওপিয়াম অর্থাৎ কিনা আফিম। মারাত্মক সুগন্ধ। ডিফিউজারে গরম জলের সঙ্গে মিশিয়ে খালি সুইচটা টিপে দাও। ঘরের মধ্যে আলো-আঁধারি আর তুমি গন্ধবিধুর সমীরণে মাথার জট খুলছ একটার পর একটা, কুণ্ডলী পাকানো স্নায়ুগুলো স্নিগ্ধ হচ্ছে, শান্ত হচ্ছে একটার পর একটা…।
ইতিমধ্যে প্রমেনাদ বিচে সূর্য গলে পড়ে বিশাল ইম্প্রেশনিস্ট ক্যানভাস বানিয়ে ফেলেছে। প্লে গ্রাউন্ডের দিকে হেঁটে চলি।
ক্যাফের টুনি বাতিগুলো জ্বলে উঠছে, ভেসে আসছে কফির কড়া গন্ধ। বাতাস উষ্ণ আর্দ্র। ঠান্ডা প্রায় পড়েই না। গরমে অবশ্য জ্বালিয়ে মারে।
শর্টস টি শার্ট, বেশির ভাগ আশ্রমিকরা ছেলে বুড়ো মেয়ে সবাই এই পোশাকই পরে। মেয়েরা অবশ্য শাড়ি সালোয়ার-কামিজও পরে বিশেষত বড়োরা, বয়স্করা। প্লে গ্রাউন্ডে তিনি অনেকটা সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। রীতিমতো টেনিস খেলতেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় নব্বই। শরীরকে সতেজ সুন্দর সুদৃঢ় করা, তাকে সচেতন করা, তার মধ্যে দিব্য চেতনাকে নামিয়ে আনা। তাই শরীরচর্চার দিকে আশ্রমের এতটাই মনোযোগ। সত্তর আশি নব্বই-এর বৃদ্ধদের শরীরচর্চা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। তিনি বলতেন বৃদ্ধ না হবার একমাত্র উপায় আন্তর-চেতনাকে সমৃদ্ধ করা। এখানকার দুটি বিশাল জিমনাসিয়াম, তার সাজসরঞ্জাম, আর যাকে বলে ডকুমেন্টেশন দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত। এত বড়ো ব্যায়ামাগার আমি জানি না আর কোথাও আছে কি না। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরাও সমান তালে তৈরি হচ্ছে। জেন্ডার ডিস্ক্রিমিনেশনের কোনো বালাই নেই। তুমিও হাঁটতে শুরু করো সমুদ্রকে পাশে রেখে। ওদিকে আশ্রমের ডাইনিং হলে তখন ডিনার লাগল বলে। এত তাড়াতাড়ি? না ইচ্ছে হলে যাবার দরকার নেই। এ খাবার বড়ো বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্ন উচ্চমানের। কিন্তু ওই, একদিন খাবার পরেই মন বিদ্রোহ করতে পারে। পন্ডিচেরিতে থাকার জায়গার কোনো অভাব নেই। বিলাসবহুল থেকে সাধারণ সব রকম হোটেল গেস্টহাউস, কোনো কোনো ফ্রেঞ্চ বাড়িতে হোম স্টে। আমার পছন্দ আশ্রমের গেস্টহাউস। অনেকগুলো গেস্টহাউস এদের আছে। ভারী সুন্দর। তবে টিভি থাকবে না। খুব বিলাসিতা কিছু থাকবে না আর রাত্রে নির্দিষ্ট সময়ে দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আশ্রমের চৌহদ্দির মধ্যে থাকা যাবে। হেঁটে হেঁটেই সবকিছু দেখা হয়ে যাবে।
শোনা যাবে সমুদ্রের গান, বাতাসের সংগত আর তারাদের করতালি। আসরের মধ্যমণি হয়ে বসবে চাঁদ, ভাগ্য ভালো থাকলে। জলের গভীরে অনেক গভীরে নানকৌড়ি শঙ্খের দল নড়ে চড়ে বসবে। আর তুমি সেই সিম্ফনি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে।
পন্ডিচেরির প্রাণকেন্দ্র শ্রী অরবিন্দ আশ্রম। শ্রীমা সেই রহস্যময়ী ঈশ্বরী এখানকার মূল চালিকাশক্তি। আশ্রমের নয় যেন পুরো শহরের। আলিপুর বোমার মামলা এক বিপ্লবীকে রূপান্তরিত করেছিল ঋষিতে। গোপনে এখানে চলে আসেন অরবিন্দ, শুরু হয় তাঁর যোগসাধনা। তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক অনুগামী শিষ্যমণ্ডলী, এরা প্রায় সবাই ছিলেন এক একটি উজ্জ্বল রত্ন। নীরদবরণ, দিলীপকুমার রায়, অমলকিরণ, নিশিকান্ত রায়চৌধুরী, চম্পকলাল, মাধব পণ্ডিত—বিদগ্ধ, গুণী, প্রতিভাবান সব ব্যক্তিত্ব নিবিড় অধ্যাত্মসাধনায় মগ্ন ছিলেন তখন। অতিমানস সাধনায় শ্রী অরবিন্দ যখন সকলের অন্তরালে চলে গেলেন তখন বিপুল কর্মভার মাথায় তুলে নিলেন মা। মধুময়ী মা তখন সকলের হৃদয়ের রানি। কর্মব্যস্ত তাঁর প্রতিটি মুহূর্ত। মায়ের অমিতশক্তি আশ্রমকে নিয়ে গেল আন্তর্জাতিক স্তরে।
তুচ্ছতম কাজটির মধ্য দিয়েও বয়ে যাবে দৈব মাধ্বীধারা। দেবতা নেমে আসবেন প্রতিদিনের জীবনে। চেতনার রূপান্তর।
মানুষের ঢল নামে আশ্রমে, প্রতিদিন, সমাধিবেদিতে প্রণাম জানাতে আসে। এখানেই শায়িত আছেন শ্রী অরবিন্দ আর মা। Without him, I exist not; without me he is unmanifest.
এতটুকু তালভঙ্গ নেই, নেই কোনো শব্দ। নীরবে ধূপ পুড়তে থাকে। গাছের ছায়ায় ঢাকা বেদি ঘিরে অগুন্তি মানুষ নীরবে বসে। সন্ধ্যা তখন গাঢ় হয়েছে। প্রার্থনা ধ্যান আত্মনিবেদনের নম্র উচ্চারণে স্নিগ্ধ পরিবেশ সব ক্লান্তি মুছে দেয়, সব ক্ষত ধুয়ে দেয়, সব বিষণ্ণতা মিলিয়ে গিয়ে জড়িয়ে থাকে এক অদ্ভুত ভালোলাগার রেশ। মাথার ওপর ধূপের ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে, পাতা উড়ে উড়ে এসে পড়ে সমাধির ওপর।
“আসক্তি ও বৈরাগ্যের মাঝখানে এসে বসে
অচিন পাখিটি
সুখ আর দুঃখের সমদূরে, রোদ্দুরে ছায়ায়
সমুদ্রের চিঠি
আগুন ও জলের কাছাকাছি কালো সেই ঘোড়া
আঁচড়ায় বালি
গন্তব্য ও গন্তব্যহীনতা শুয়ে আছে জড়াজড়ি
মুগ্ধ করতালি
শিখুক সমস্ত প্রশ্ন, এসো পাশে বসো
দু দণ্ড সময়
প্রিয়সখী বয়ে যাও বাতাসের মতো
কেউ কারো নয় ”
এটা শেষ হয়ে গ্যাছে দিদি? আর পর্ব পাব না?