এতো বড় ধাঁধাঁ আলমিত্রা এর আগে আর কখনো দেখেনি। ঘুম থেকে উঠে দেখে সকাল রোদে ভেসে যাচ্ছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। দরজা খোলা। আলমুস্তাফা ঘরে নেই। আলমিত্রা ভাবল তিনি বোধহয় বাইরে আছেন কোথাও। দুবাটি গরম সুপ আর একটি বড় রুটি নিয়ে অ্যাপ্রিকট গাছের নিচে বসে থাকতে থাকতে তার বড় অদ্ভুত লাগে! বুকের মধ্যে কেমন একটা তোলপাড়। তিরতিরতির চোখের পাতা কাঁপে! হঠাৎ কী হল কে জানে! মনের মধ্যে সংকেত বাজনা। আলমিত্রা দৌড়ে চলে গেল সমুদ্রের ধারে। ঢেউ এর গায়ে ছলকে ছলকে উঠছে রোদ্দুর। তার আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। আলোর ওপরে জলের বাষ্পের মধ্যে নীলচে আভা! সেই নীল সোনালি আভার মধ্যে আলমিত্রা দেখল জাহাজটি মিলিয়ে যাচ্ছে ওই আবছায়ার মধ্যে! আলমুস্তাফা তবে চলে গেলেন! আমাকে বলে গেলেন না! আবার করে তার দেখা পাবো? শেষ হল না যে শেবা সলোমনের কাহিনি। অকস্মাৎ এক শূন্যতা ছেয়ে ফেলে আলমিত্রাকে। জাহাজটা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত আলমিত্রা তাকিয়েই রইল সমুদ্রের দিকে! আলমুস্তাফা কি জানতেন আজ তাঁর জাহাজ আসবে?
অরফালিসের মন্দিরে ধাপে বসে বাঁশি বাজায় যে কাঙাল ভিখিরি, সে এসে একটা ভাঁজ করা কাগজ দিয়ে বলল, ওই দরবেশ বুড়োটা চলে গেছে। এই কাগজটা ধর। ও দিতে বলেছে তোমাকে!
আলমিত্রা কাগজের ভাঁজ খুলল।
“আলমিত্রা, জাহাজ আসার খবর আমি কীভাবে পেলাম জানতে চেও না। এই পৃথিবীর রোদে জলে হাওয়ায় মিশে মিশে পুড়ে পুড়ে ভিজে ভিজে বাঁচে যে ভবঘুরে সে অনেক কিছুরই আভাস পায়। তুমি আরো জানতে পারবে ক্রমশঃ। এই পৃথিবীর রহস্য সংকেত তোমার কাছে প্রতিনিয়তই উন্মোচিত হবে! নিজেকে তার জন্য প্রস্তুত রেখো!
তোমাকে আবার কবে দেখবো জানিনা। যখন দেখবো আরো বুড়ো হয়ে যাব, তুমি আরো বড় হয়ে যাবে। তরুণী হয়ে যাবে।
যে অংশটুকু বাকি ছিল এই কাহিনির, লিখে গেলাম। এই কাহিনিকে মরে যেতে দিও না। আলো হাতে, প্রেম বুকে নিয়ে, চোখে স্বপ্ন নিয়ে, হৃদয়ে সাহস নিয়ে আমরা সবসময় মানুষের পাশে পাশেই থেকেছি। তাপিতকে শান্ত কর। ভ্রান্তকে পথ দেখাও আলমিত্রা। তোমার কাছে এসে যেন লোকে শান্তি পায়। মাছি হয়ো না, মৌমাছি হও।
তুমি স্বেচ্ছায় আমার পথ বেছে নিয়েছ। আমি চলে যাবার পর থেকেই শুরু হোক তোমার পথ চলা। শেবার রানির বাকি কাহিনি লিখে গেলাম। রানির মত হও। একাকী, সাহসী, ব্যতিক্রমী, নির্জন ।
চিরশুভার্থী
আলমুস্তাফা।”
অরফালিসের মন্দিরের চত্বরে খয়েরি চুল তার এলোমেলো ওড়ে। চোখের তারা নীল।
তার সামনে অর্ধচন্দ্রাকারে বসে আছে একদল নারী পুরুষ। নানা বয়সের। সেই ভিখিরিটাও আছে। এরা কেউ মন্দিরে পুজো দিতে এসেছিল, কাছপিঠেই থাকে সবাই, কেউ কেউ দোকান বাজার করতে এসেছে, সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল অনেকে। সময়টা খুব সুন্দর। শেষ বিকেল। আলো আছে, কিন্তু তেজ কমে গেছে। সমুদ্রবায়ু বইছে দিনের শেষে।
খয়েরি চুল নীল চোখের মেয়েটি কখনো বসছে, কখনো বা উঠে দাঁড়াচ্ছে। একটা ডাঁটি ওয়ালা ফুল দিয়ে এলো চুল বেঁধে নিচ্ছে। সে কিছু বলে চলেছে ওদের। কোনো সুদূরের গল্প। একবার সে একটু থামল।
সামনের নারী পুরুষের দল বলে উঠল, "আহা আহা! তারপর? “
আলমিত্রা বলল, “তারপর ধাঁধাঁর খেলায় রাজা রানির দিন কাটতে লাগল। দিন থেকে মাস, মাস থেকে বছর!”
রাজা সলোমন আর শেবার রানি একে অন্যের কাছাকাছি। ঘুচে যাচ্ছে যত আবডাল। রানি যা জানতে চাইছেন রাজা বলে যাচ্ছেন। রানির যা ইচ্ছে রাজা পূরণ করছেন। আর কিছুই লুকোনো নেই রাজার কাছে। আর রানির? তারও সব দেখা হয়ে গেছে। বোঝা হয়ে গেছে। রাজার জ্ঞান। রাজার ঐশ্বর্য। রাজার ঘর গেরস্থালি। প্রাসাদ, পোশাক, খাদ্য সম্ভার। প্রাচুর্যের বন্যা দেখে রানি বলেছিল, “রাজা, আমি আপনার সম্বন্ধে যা শুনেছি আপনি তার থেকে অনেক অনেক বড়! আপনার সঙ্গে যারা রয়েছেন তারা সবাই ভাগ্যবান। আপনার সহস্র রানিরা আপনাকে পেয়ে ধন্য! ঈশ্বর আপনাকে ইস্রায়েলের রাজা বানিয়েছেন। আপনার মত ন্যায় পরায়ণ আর বিচক্ষণ আর কে আছে?”
এই বলে রানি রাজাকে দিলেন সুদূর থেকে বয়ে আনা তাঁর উপহার। এতো বিপুল উপহার নিয়ে রাজার কাছে এর আগে আর কেউই আসেনি। রানি রাজাকে কী দিলেন?
এইটুকু বলে আলমিত্রা সামনে বসে থাকা উৎসুক মুখগুলোকে ইশারা করে, “বল বল,তোমরা! আজ দুইদিন ধরে গল্প শুনছো। দেখি কেমন মনে আছে?”
সঙ্গে সঙ্গেই চকচক করে ওঠে মুখগুলো। গল্প বলায় ওরাও ভাগ নেবে আলমিত্রার সঙ্গে। কী আনন্দ! কলকল করে বলে ওঠে, সোনা সোনা সোনা। অনেক সোনা।
আর ওই যে মন্দিরে জ্বলছে ওই ধুনো, এই অ্যাত্তো! এই বলে দুদিকে দুই হাত ছড়িয়ে দেয়! আলমিত্রা হেসে ওঠে। তার মাথার ওপরে একটা হুপু পাখি দোল খায়। আলমিত্রা বলে “সে অনেক অনেক পরিমাণ! তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না। সার সার উট বয়ে এনেছিল।”
সাধারণ মানুষগুলোর কাছে “অনেক” বলতে কী বোঝায় সে তারাই জানে শুধু।
“ওই ধুনোটার নাম ফ্যাঙ্কিন্সেন্স। আর কী দিয়েছিল রানি?”
ওরা চেঁচিয়ে উঠে বলে “মশলা মশলা।” আর হাততালি দেয় খুশি হয়ে।
“পেরেছি, পেরেছি সব মনে আছে আমাদের!”
“এরপর কী হতে পারে? আন্দাজ করতে পারছ না তোমরা? আমাকে বল। কোনদিকে যাবে এবারে গল্প?” আলমিত্রা ওদের উস্কে দেয়।
একটা বাচ্চা কোলে মেয়ে বলে ওঠে, “ভাব করিয়ে দাও না দুজনায়! আমরা ওদের ভালোবাসার কথা শুনি!”
আলমিত্রা বলে, “হ্যাঁ, ঠিক, দুজনায় ভাব হয়ে হল।”
গোধূলির কনে দেখা আলোয় সমবেত নারী পুরুষের মনে দীপ্র রানির প্রেমিক রূপ এঁকে দিচ্ছে আলমিত্রা।
— সং অফ সলোমন। সলোমনের গান। গানের সেরা গান। রাজা সলোমন নিজে লিখেছিলেন নাকি?
— আমি কেমন করে জানবো? হয়তো বা।
— সে কী রাজা, নিজে কী লিখেছেন জানেন না!
— তুমিই বলে দাও হে আবহমান সময়। তুমি তো সর্বজ্ঞ। তোমার অজানা কি কিছু আছে?
— সলোমনের গানে এতো স্বর্ণমহিমা, সুগন্ধিমহিমা আর ফ্র্যাঙ্কইন্সেন্সের কীর্তন করেছেন রাজা! কেন? রানি এনে দিয়েছিল নিজহাতে। তাই? আপনার দেশে সোনার চাহিদা আর সুগন্ধির চাহিদা বিপুল! আপনার ধর্মে ও কর্মে, স্বর্ণ ও সুরভি। সোনার আভায় আর রজনের গন্ধে ভরে আছে সেই গানের পথ। আপনিই করেছেন রাজা! আপনি কী কী লিখেছেন মনে আছে? না থাকলে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। আপনি বলেছিলেন ‘বধূর সৌন্দর্য যেন রজন সুগন্ধির ধোঁয়ার মত অনুপম। আহা! ম্যড় ও ফ্র্যাঙ্কইন্সেন্স যখন একসাথে মিশে যায় সেই তো আমার বধূর শোভা!’ বলেন নি? সুরভির ঘন আড়ালে নিজের প্রেমকে লুকোতে চান, রাজা? আর প্রেমিকের সেই মনোরম উদ্যান যেখানে বেদানার লাল দানা ফেটে রক্তিম-চৌচির! কর্পূরে মিশেছে দারুচিনি সুবাস। জাফরান, স্পাইকনারদ, ক্যালামাস, ঘৃতকুমারী। গন্ধে বিভোর বিতান । এইসব বহুমূল্য সুগন্ধ নিয়ে তো একজনই আপনার কাছে এসেছিল। তবে তাকে কেন রেখেছেন রহস্যমদির করে?
লেখেন নি যে ‘আমার বধূর রূপ সোনা আর রত্ন আভায় ঝলসে উঠছে।’
তার কৃষ্ণভ্রমর মুখে, তার আরব -আঁখিপল্লবে চুম্বন এঁকে দেন নি, রাজা? কেন আড়াল করেছেন, সবকিছু?
— আহ! থামো সময়, থামো। তুমি জানো আমার রানিদের সংখ্যা! ওরা সবাই আমার সম্পত্তি! হ্যাঁ সম্পত্তি! ফ্যারাও থেকে হিট্টাইট, সব সব রাজকুমারীদের আমি ভোগ করেছি! কিন্তু তাদের কাউকে নিয়ে আমি সলোমনের গান বাঁধি নি। কিন্তু সে ছিল আলাদা, একদম আলাদা। আমি আসলে জানতামই না যে এমন মেয়েও হয়। সে আমার চোখে চোখ রেখেছে। সে চাহনি তীব্র! সে তার মেধার দ্যুতিতে আমাকে চমক লাগিয়েছে! সে আমার সঙ্গে সমানে সমান হয়ে মাথা তুলে চলেছে। সে ছিল অনাঘ্রাত ফুল । বলেছিল তাকে যেন স্পর্শ না করি! মেয়েরা আমাকে পাবার জন্য ব্যাকুল হত। আর এই মেয়ে বলে বসল, আমাকে স্পর্শ করবেন না রাজা! নারী নয়, এক চাবুকের মত মানুষকে আমি ক্রমশ চিনেছি, ওহে সময়! তাকে কি ভালো না বেসে পারা যায়? বল?
— হ্যাঁ। ঠিক। জানেন রাজা, কৃষ্ণ নামে প্রাচ্যে এক নেতা ছিলেন, আপনার বহু বহু আগে। তিনি আপনার মতোই কূটনীতিক। তাকে ঘিরে থাকত তার অজস্র সঙ্গিনীরা। রাধা নামে এক মেয়ের সঙ্গে ছিল তার প্রেম!
— তাঁর কথা এখানে কেন? কী প্রসঙ্গে আমার সঙ্গে তাঁর তুলনা?
— ওই যে, যে ধাঁধাঁ - পোশাক দিয়ে আপনি সলোমনের গান ঢেকে রেখেছেন, সেখানেও সেই একই ধাঁধাঁ। মানুষ আর ঈশ্বরপ্রীতি। এই মোড়কে আপনার প্রেমকেও ঢেকেছেন রাজা।
আপনার গানে একটি শ্যামলা মেয়ে আছে। সে বলেছিল, ও জেরুজালেমের মেয়েরা, আমি কালোভোমরা, কিন্তু অপরূপা। আমি কালো বলে মুখ ঘুরিও না। রোদে পুড়ে গেছি আমি। আঙুরবাগিচা পাহারা দিতে দিতে রোদে ঝলসে গেছে অঙ্গ আমার, জানো?
আসলে রানিই ছিল সেই লুকোনো কালো মেয়ে। ধারালো কালো সুন্দরী। আপনি তাই লিখলেন, রোদে পুড়ে গেছে অঙ্গ আমার! রানি দীর্ঘ পনেরশ মাইল পথ রোদে পুড়ে তেতে আপনার কাছে এসেছিল। তাকে আপনি কামনা করেছিলেন। নইলে তাঁর লোমশ পা পরিষ্কার করায় আপনার এত মাথা ব্যথা কেন? তাই আপনার রানির প্রতি আকর্ষণ ঢাকলেন অন্য চাতুরী করে।
— কী চাতুরী তুমি দেখলে সময়? কী চাতুরী?
— আপনার প্রেম ঢেকে দিলেন ধাঁধাঁর রহস্যের কুয়াশায় । হেঁয়ালিতে হেঁয়ালিতে ভরিয়ে দিলেন আপনার গাথা। তকমা এঁটে দিলেন এ হল মানুষ মানুষীর প্রেম কথা নয়। নিবিড় তীব্র কামনার এই প্রেম আসলে মানুষ ও ঈশ্বরের প্রেম!
— কেন আমি এমন করব, কেন? বলতে পারো তুমি, সময়?
— বোকা সাজছেন কেন রাজা? আপনাকে ঈশ্বরপুত্র হতে হবে যে! ঈশ্বরপুত্র সলোমন, ইস্রায়েলের রাজা, মহানুভব ন্যায়পরায়ণ। একেশ্বরবাদের প্রচারক। শিক্ষক। ধর্মগুরু। ভবিষ্যৎ আপনাকে এইভাবেই মনে রাখুক, তাইতো চেয়েছেন আপনি রাজা। আপনি যাই বলুন, সলোমনের গান বিশুদ্ধ ঈশ্বরপ্রীতির স্মারক নয়। এ হল মানুষীর জন্য এক মানুষের গভীর হৃদয়। এবং কামনা!
মানুষগুলো হাঁ করে আলমিত্রার কথা শোনে। হড়বড় করে বলে ওঠে, তারপর? আলমিত্রা বলে, “তারপর আর কী? শেবার রানি রাজাকে বলত আমাকে স্পর্শ করবেন না রাজা! এদিকে রাজা তো মনের গভীরে রানির প্রেমে পড়েছেন। তার প্রেম এখন মেধার শৃঙ্খল ভাঙতে চাইছে। তাই রাজার চাই কৌশল!
এক দিন রানিকে বিশেষ ভোজ খাওয়ালেন রাজা। বললেন, বেশ রানি। আমরা কেউ কাউকে স্পর্শ করব না। এমনকি আমাদের নিজস্ব জিনিসপত্রকেও না। এসো আজকের ভোজসভায়। রানি সানন্দে রাজি।রাজার ভোজকক্ষ ঘন বেগুনি পর্দায় সাজানো হল। মর্মর মেঝেতে দুর্মূল্য গালিচা! সুগন্ধি গুঁড়ো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘরের কোনায় কোনায়। রাজার বিপুল ভোজের আয়োজন । খাওয়া আর শেষ হয় না। জলে মিশানো হয়েছে সির্কা। খাবারে প্রচুর গোলমরিচ। এই খাবারে পিপাসা হয় খুব। এতো রাত হয়ে গেল যে রাজা রানিকে বললেন, আজ এখানেই থেকে যাও। রাতে যে যার ঘরে ঘুমোতে গেলেন। মাঝরাতে রানির প্রবল জল তেষ্টা পেল। এতো খাওয়া হয়ে গেছে! কিন্তু কী আশ্চর্য! ঘরের কোথাও জলের পাত্র নেই। এতো রাতে জল পাই কোথা? পাশের ঘরে সলোমন ঘুমোচ্ছেন। পর্দার ঝালরের ভেতর দিয়ে রানি দেখল মাথার কাছে জলের পাত্র। রানি দ্রুত ঘরে ঢুকে পাত্র নিয়ে জলপান শুরু করা মাত্র রাজা জেগে উঠলেন। যেন তিনি জেগেই ছিলেন! চতুর হাসি দিয়ে রাজা বললেন রানি আমার জিনিস স্পর্শ করলে! শর্ত ভাঙলে? তাহলে আমিও ভাঙি। রাজা রানিকে জড়িয়ে ধরলেন।
শ্রোতাদের ভেতর থেকে বাচ্চা কোলে মেয়েটি বলে উঠল, তারপর? রানির কোলে ছেলে এলো?
আলমিত্রা একটু চুপ করে বলল, হ্যাঁ, এলো । রাজা সলোমন বললেন, "সেই অনাগত যখন আসবে, আমার কাছে একবার পাঠিয়ো তাকে, রানি। “
ওরা জিজ্ঞেস করলো, পাঠিয়ো বলল কেন? রানি কি তাহলে রাজার কাছে থাকে নি?
আলমিত্রা বলল, “ না, থাকেনি। রানি চলে গেল তার দেশে, তার রাজ্যে, তার মারিব শহরে। থাকতে সে আসেই নি জেরুজালেমে।
কয়েক বছর আগে এক উদগ্র জ্ঞানমৃগ তাকে খেপিয়ে তুলে দীর্ঘ অভিযানে বের করে এনেছিল। সেই পিপাসা তাঁর মিটে গেছে। ব্যবসা বাণিজ্যের যে সব কূট অভিসন্ধি তাকে বিচলিত করে রেখেছিল সেগুলো নিয়ে আর বিশেষ চিন্তার কারণ নেই। তবে তাকে ভালো মূল্য দিতে হয়েছে এতো মসৃণ মিটমাটের জন্য। এতো চিরকালের রাজনীতির খেলা! সলোমনের শরীরী প্রেম নয়।
রানিকে সমর্পণ করতে হয়েছে তাঁর ধর্ম। রাজা চেয়েছিলেন দক্ষিণের রানির মাথা নত হোক একেশ্বরের পায়ে। পাগান দেবতা নয়, সূর্য দেবতা নয়।জিহোবা।
রানি তাই এক অর্থে একেশ্বরবাদের রাজার অধীন হল। একসময় রানির ঝমকালো বিশাল সিংহাসনে লোভ দিয়েছিলেন রাজা। আজ্ঞাবাহী জিন উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল সেই সিংহাসন, রাজার কাছে। এই হেঁয়ালির মানে রানি একপ্রকারে রাজার কাছে মাথা নোয়ালেন। “
সমুখের শ্রোতার দল হতাশ হয়ে পড়লো । বলল, কেন? কেন? কেন?
আলমিত্রা বলল, কারণ রানির বুদ্ধি। ধর্মটুকু বদলে নিলে যদি সব কিছু শান্তভাবে চলে মারিবের জনগণ যাতে সুখে থাকে, তাদের রানি হয়ে সে এটুকু দেখবেনা? রাজনীতিতে এসব হামেশাই চলে।
তারপর সে নিজে যে ভাবে এসেছিল একদিন সেই ভাবেই বিদায় নিল। রানি বাড়ি ফিরবে। দীর্ঘ পথ বেয়ে।
“বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল ।” না পাঁচকান হবে না কোন কথা। নীরবে স্বমহিমায় রানি ফিরে যাবে তাঁর রাজ্যে।
একদিন যেমন ধাপে ধাপে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে রাজা রানিকে অভ্যর্থনা করেছিলেন তাঁর প্রাসাদে সেই ভাবেই তাঁর প্রিয় নারীকে বিদায় দিলেন মরুভূমির পথে ।
"কেমন লাগল গল্প? বলবে না তোমরা?”, আলমিত্রা গলা তুলে বলে।
সামনের মুখগুলো বেবাক। এ কেমন শেষ হল মেয়ে? এ কেমন হল, বল? এ কেমনধারা গল্প? মাথামুণ্ডু নেই!
আলমিত্রা বলল, “কেন? নিজের সম্মানে ফিরে গেল রানি। আত্মসম্মানে। সে এক দেশের রানি। এই তাঁর পরিচয়। সেই দেশ তাঁর কর্মভূমি। কেন সে থেকে যাবে রাজা সলোমনের বৌ হয়ে, প্রাসাদে, বাকি জীবন ধরে? এক হাজার মেয়ের মধ্যে হাজার এক হয়ে?
আলমুস্তাফা কী বলেন জানো,
‘সময় বদলাতে পারে না
ঋতু বদলাতে পারে না
কাকে?
নারী হৃদয়কে। যদি সে অনন্তে লীন হয় তাও সে ধ্বংস হয় না।
মেয়ের হৃদয় যেন যুদ্ধভূমি,
উপড়ে ফেলা হয়েছে গাছ,
জ্বলে গেছে ঘাস, পাথর রক্তে লাল।
মাটিতে পুঁতে ফেলেছে করোটি আর হাড়।
তবু সে শান্ত, নীরব
যেন কিছুই হয় নি চারপাশে।
যেন আবার বসন্ত আর শরত আসবে, নিয়ম মাফিক।
আবার শুরু হবে তাদের নির্মাণ।’ ”
সন্ধের অন্ধকারে সামনের দেহগুলো নড়ে চড়ে বসে! তারা এক অদ্ভুত কথা শুনল বটে আজ! এই গল্পটা ভালো না মন্দ তারা ঠিক জানে না। কিন্তু তারা ভাবছে! খুব মন দিয়ে ভাবছে। মন থেকে মুছতে পারছে না। ফেলতেও পারছে না। অদ্ভুত এক অস্বস্তি!
“ ভবো তোমরা। আমি চলি।”
আঁধার টপকে টপকে আলমিত্রা চলেছে। হাতে একটি ঢাকা লন্ঠন। একটা দীর্ঘ ছায়া পড়ছে মাটিতে। সেই দীর্ঘ লুণ্ঠিত ছায়া তাকে পথ দেখায়। আরো দূরের পথ! সমুদ্রের হাহাকার - বাতাসে বেজে চলেছে ভিখিরির বাঁশি। ভিখিরি বাজাচ্ছে,
“একলা পথের চলা আমার, করব রমণীয়। মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিও।”
অসাধারণ
অপুর্ব!
অপূর্ব
অপূর্ব
কী অদ্ভুত সুন্দর!
দারুণ দারুণ!!
দারুন