পখালরাজা বাঁশি বাজালে খলবল করে নড়ে ওঠে জলে ভেজানো ভাত। ফুলো ফুলো ঢুলো ঢুলো। সামান্য টোকো ঝাঁজো বাস। সামান্য মজে ওঠা। সামান্য ঘোলা জল। ব্যাস। সেই সঙ্গেই পরিতৃপ্তির আয়োজনের শুরু। সেই সঙ্গেই রাজার সভা সাজানোর কাজও শুরু।
পখাল হল উৎকলপ্রাণরস, দারুব্রহ্মের পরেই। উঁহু, বাংলার পান্তাভাতের সঙ্গে ওড়িশার পখালের জাতিগত দিক থেকে সাদৃশ্য থাকলেও পান্তা কোনোদিনই বাঙালির অন্তরের সম্পদ হয়ে ওঠেনি। সেই জায়গায় স্বমহিমায় আদরে মধুরে ভালোবাসায় প্রেমে পখাল, পান্তাভাতকে টপকে গেছে।
আমাদের পান্তাবুড়ি আর ওদের পখালরাজা, সে রাখাল রাজার মতো গরম কালে বাঁশি বাজালেই আপামর উৎকলবাসী গেয়ে ওঠে জয় পখালরাজার জয়।
প্রবল গরম। দাবদাহ। ঝলসে যায় যেন। দীর্ঘ গ্রীষ্ম। অন্নপ্রধান দেশ। কাজেই জলের জমিতে ঘুমিয়ে থাকা পখাল ভাত বুকে এবং মুখে তুলে নিয়েছে ওড়িশা। পখাল, ওড়িশার জীবন, ওড়িশার সিগনেচার ডিশ।
যদি ভালো ভেবে দেখা যায়, পখাল একটা বিরাট লেভেলার। রাজা প্রজা, ধনী নির্ধন, সাধু ভণ্ড, সৎ অসৎ, সাহসী দুর্বল, মন্ত্রী জনগণ সব্বাইকে এক পাল্লায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সেটা কী? নিঃশর্ত পখালপ্রীতি। এই একটিমাত্র বিষয় যেখানে কোন মতপার্থক্য চলবে না। রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনটুনির ঘরেও সেই ধন আছে! নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, পখালরাজের চরণে। এমনকি স্বয়ং শ্রীজগন্নাথদেবও স্নেহ করেন তাকে।
কবে থেকে কলিঙ্গদেশে পখালপ্রীতির ইতিহাস শুরু তা জানা নেই তবে এই নিবিড়প্রেম গড়ে তোলে দেশের জলবায়ু এবং অবশ্যই আর্থ সামাজিক অবস্থান।
ঘাম প্যাচপেচে তীব্র গরমে পখালভাতের খাদ্যগুণ এখন চিকিৎসকদের নিদানের মধ্যেও ঢুকে গেছে। ভুঁড়ি মুড়ি অর্থাৎ পেট ও মাথা দুইই ঠাণ্ডা রাখে পখাল। বাইরে রোদের জুলুম, কিন্তু দেহটি শীতল রেখেছেন পখালরাজা। আর ঠান্ডা শরীরে ঠান্ডা মাথায় একটি সুখনিদ্রা। ওড়িশায় খুব হিট স্ট্রোক হয়। কাজেই মেহনতি মানুষ এবং যারা বাইরে কাজে বের হন এবং যারা ঘরে বসে হাঁসফাঁস করেন সকলের দাওয়াই হল পখাল। যারা কায়িক পরিশ্রম করেন তাঁদের প্রয়োজনীয় পুষ্টিও যোগায় পখাল। পরিশ্রম করলে মোটা হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
কত রকমের পখাল হয়? মোটামুটি দেখা গেছে পখাল হয় তিন/চার ধরণের।
বাসি পখাল। রাতভোর ভিজবে। মজবে। ভাতে জলে গাঢ় প্রেম। ঈষৎ টোকো গন্ধ। খট্টা খট্টা। পেঁয়াজ লঙ্কা লেবু, দুই তিন ফোঁটা সরিষার তেল দিয়ে গরাস গরাস। হাপুস হুপুস।
দহি পখাল। এই পখালের জলে টক দই মেশানো হয়। দই এর সঙ্গে অনেকে কুচি কুচি শসা, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ মিশিয়ে দেয়। বাহার আনতে লেবু পাতা, পুদিনা পাতা।
সাজা পখাল। সদ্য রান্না করা ভাত ঠাণ্ডা করে জল ঢেলে নুন মিশিয়ে বানানো। এই ভাতকে সারা রাত ভিজিয়ে রাখলেই বাসি পখাল তৈরি।
ছুঁক দিয়া পখাল বা বঘড়া পখাল। সাজা পখাল, দহি বা বাসি পখালে ফোড়ন দিতে হবে। তাহলেই ছুঁক দিয়া পখাল হাজির। কী কী দিয়ে? সরিষার তৈল, সুখিলা লঙ্কা, পঞ্চ ফুটন (পাঁচ ফোড়ন) অথবা বেসর বা সরষে। নুন। আদা ও আম্বকসিয়া ছেঁচা (আমাদা ছেঁচা) লেবু পাতা অথবা টক কমলা লেবুর পাতা হাত দিয়ে কচলে (হাত পেষা) ছেঁড়া এবং ভুরসুঙ্গাপত্র (কারিপাতা)
উফ। লেবু পাতা, আমাদা, কারিপাতা, লঙ্কা আর সর্ষের তেলের ঝাঁজ আর মাদক জোলো ভাত, মুখের ভেতরে তো তখন ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি! লাভা নয় লালারসের বিচ্ছুরণ।
পখালের জল বা তোরানি চুমুক দিয়ে শেষ করতে হয়। ওর মধ্যেই প্রাণরস। একেবারেই ফেলবার নয়। খোদ ডাক্তাররা বলেছেন।
এখন কথা হল পখালরাজা তো একা একা সভা সাজাতে পারেন না। তার পারিষদবর্গ চাই। যার যেমন সামর্থ্য, যার যেমন রুচি।
তবে যা কিছু দিয়েই সাজালে হবে না। রাজার পছন্দ ভর্তা, ভাজা, ছেঁচা।
টমেটো ভর্তা, আলু ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, শুঁটকি চিংড়ি ভর্তা, বেগুন ভর্তা। আবার বেগুন ঢ্যাঁড়শ ঝিঙে ছোট ছোট করে কেটে ভর্তা। ভর্তার শেষ নেই।
ভাজার মধ্যে কখারু ফুল ভাজা। অর্থাৎ কুমড়ো ফুল ভাজা। চাল ভিজিয়ে বেটে আদা রসুন লঙ্কা জিরা মিশিয়ে কখারু ফুল ভাজতে হবে। সজিনা ছুঁই ভাজা। রুহি মাছ বা যে কোন মাছ ভাজা। বেশ মচমচে করে। শাক ভাজা।
এছাড়া আছে ছেঁচা। বড়ি ছেঁচা আর বড়ি চূড়া। বড়ি সর্ষের তেলে ভেজে হাত দিয়ে ছোট ছোট টুকরো করে ভেঙে নিয়ে পেঁয়াজ রসুন লঙ্কা চেঁছে সর্ষের তেল দিয়ে ভালো করে মাখা। ছেঁচার মধ্যে সবজি পুড়িয়ে হাতে চটকে নেবার ব্যাপারটাও আসবে, তেল নুন লঙ্কা লেবু আদা রসুন ছেঁচা ইত্যাদি দিয়ে। ছেঁচাতে খাবারের তেজ ঝাঁজ বেশ খোলতাই হয়।
ভুবনেশ্বরের গীতাঞ্জলি আপা একবার বলেছিল পত্রপোড়াও খাওয়া হয়।
পত্রপোড়া অর্থাৎ পাতুরি। গীতা আপা বলেছিল সর্ষে বাটা লঙ্কা রসুন কখনো নড়িয়া (নারকেল) বাটা দিয়ে চিঙ্গুরি (চিংড়ি) কুচিকুচি ঝিঙে (জনি) এমনকি ছাতু (মাশরুম) কখারু পত্রে অর্থাৎ কুমড়ো পাতায় ভালো করে মুড়ে কাঠের আগুনের ঢিমিঢিমি আঁচে বা যে কোনো ঢিমি আঁচে রেখে দিতে হবে। তারপর তা দিয়ে গামলা গামলা পখাল হাওয়া হয়ে যাবে।
আমি বললাম আজকাল তো আরও অনেক কিছু পখালের সঙ্গে দেয় আপা।
গীতা আপা বলল, পখালের সঙ্গে জোর করে যাকে তাকে জুড়ে দিলে তো হবে না। মানানসই হতে হবে। ভর্তা, ছেঁচা ভাজাই পখালরাজার সঙ্গে জমে ভালো। বুঝি পাইলা?
ফাইভ স্টার হোটেল থেকে পথের ঝুপড়ি, আলিশান বাড়ি থেকে কুঁড়ে ঘর সর্বত্র পখালের অপ্রতিরোধ্য উপস্থিতি। বিশেষ করে গরমের সময়।
তবে এই প্রসঙ্গে টঙ্ক তরানির কথাটি না কহিলে আখ্যানটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। টঙ্ক তরানি হল পখালের জল। ভাতের সাদা জলে মিশে থাকে দই, জিরা নুন,লেবুপাতা কারিপাতা তুলসী পাতার সুগন্ধ, আদা আর আমাদার সোহাগ, লঙ্কার ঝাঁজ আর লেবুর আদর।
এ হল গরমকালে শ্রী জগন্নাথদেবের মহাপ্রসাদ। পুরীর মন্দিরে আনন্দবাজারে কিনতে পাওয়া যায়, ভাঁড়ে করে। অসহ্য গরমে অতি উপাদেয়!
পখাল কিন্তু উচ্চারণে পখাল +অ। আর ওড়িশা ল এর উচ্চারণ, সে বেশ খটোমটো!
পখাল দেবভোগ্য। আগেই লিখেছি।
শ্রী জগন্নাথদেব, বলভদ্র ও সুভদ্রা গরমকালে তিনবার পখাল খান।
শ্রী জগন্নাথদেবের জন্য যে পখাল বানানো হয় তাহলো মোটামুটি এই ধরণের,
সুবাস পখাল, এই পখালের সুগন্ধ চিত্ত হরণ করে। আদা ভাজা জিরা মিশে বেশ একটা আমোদিনী আমোদিনী গন্ধ তৈরি হয়।
এরপর আছে চুপুড়া পখাল, পানি পখাল, দহি পখাল, মিঠা পখাল। মিঠা পখালে চিনি বা গুড় মেশানো হয়।
মল্লিফুল পখাল, নামটি কী সুন্দর! দুপুরে যে পখাল দেওয়া হয় তাতে জুঁই ফুলের সুবাস মিশে থাকে।
ঘিয়া পখাল, এতে ঘি মেশানো হয় অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে। রাতে দেওয়া হয় এই ভোগ।
পখালের সঙ্গে কাচ্চা কদলী ভাজা থাকে অনুপান হিশেবে।
পান্তাভাতের রকমফের অনেক রাজ্যেই দেখা যায় কিন্তু ওড়িশার মত হৃদমাঝারে কেউ স্থান পায় নি।
গীতা আপা বলে, এ হল আমাদের পরম্পরা। কথাটা শুনতে ভালো লাগলো। একটা প্রায় হারিয়ে যাওয়া শব্দ!
ওড়িশার প্রাণের ধন পখালকে সম্মান জানিয়ে মার্চ মাসের কুড়ি তারিখে পালন করা হয় পখাল দিবস। ভাবলে খুব ভালো লাগে। একটি আপাত সাধারণ খাবার কত অসাধারণ হয়ে উঠেছে মানুষের ভালোবাসার জোরে। কোনো ভাণ নেই ভণিতা নেই, পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কিম্ভূতকিমাকার সাজার ইচ্ছে নেই, নাকউঁচুমি নেই। কোন সৌখিন বাসমতি তুলাইপাঞ্জি গোবিন্দভোগ নয় বাড়ির ঘরেলু চালেই পখাল বানাতে হবে।
ভূগোল জল হাওয়া পরিবেশ রুচি সামর্থ্য যে খাদ্যাভ্যাস তৈরি করে দেয় তাতেই আমাদের প্রাণের আরাম,মনের আনন্দ আত্মার শান্তি। একটা পুরো অঞ্চল বা জাতির মেজাজ মর্জি নিয়ে সে দিব্যি সময়ের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়।
এক সময় ভুবনেশ্বর থেকে হামেশাই বাড়ি যাওয়া হত। সে রকমই একবার ট্রেনে সামনের বার্থ এ মা আর মেয়ে যাচ্ছে, ওরাও কলকাতারই । কথায় কথায় আলাপ জমে ওঠে। ভদ্রমহিলা জানান তার স্বামী চাকরিসূত্রে এখানেই থাকেন। প্রথম দিকে খাবার নিয়ে খুব কষ্ট পেয়েছেন। ভাল রান্নার বা কাজের লোক ছিল না। এদিকে নিজেও রাঁধতে বাড়তে জানেন না। দিনের পর দিন বেজার মুখে থাকার পর, একদিন কাজের ছোকরাটি জানাল, বাবু কাল দুপুরে আপনার জন্য একটা দারুণ খাবার বানাবো । তখন প্রচন্ড গরম পড়েছে। বাবুর তো খুশি আর ধরে না। ছুটির দিন, বাবু সক্কাল সক্কাল চিরতার জলটল খেয়ে রেডি। কখন দুপুর হবে, কখন খেতে বসবেন ! কিন্তু রান্নাঘর থেকে কোন সাড়া শব্দ আসছে না কেন? ছ্যাঁক ছোঁক চটর পটর। তার গিন্নি তো রান্না করতে করতে ঘেমে নেয়ে জল হয়ে যান। এইসব ভাবনাচিন্তার মধ্যেই ছোকরা খাবার জন্য ডাকতে আসে। বাবু কোনরকমে প্রায় ছুটেই খাবার টেবিলে যান। কিন্তু খাবার কোথায়?
“কই রে? কোথায় দিয়েছিস?”
ছোকরা সব কটা দাঁত বের করে ইশারায় দেখিয়ে দেয়। বাবু দেখেন টেবিলের ওপর একটা মাঝারি সাইজের স্টিলের বাটি,থালা দিয়ে চাপা। আর কিছু নেই। রাগে দুঃখে বিস্ময়ে হতাশায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে বাবু দেখেন স্টিলের বাটির সাদাটে শান্ত ঘোলা জলে ঘুমিয়ে আছে একরাশ মোটা মোটা ফুলো ফুলো ভাতের দানা, বোধহয় রাত থেকেই, আর তার চার পাশে ছোট্ট ছোট্ট বাটিতে নানান অনুপান আলুসেদ্ধ,বড়িভাজাগুঁড়ো, টক দই, লঙ্কা পেঁয়াজ।
“এটা কী? ইয়ার্কি পেয়েছো?”
“আজ্ঞা, পখাল। এই গরমে পখাল ছাড়া আর কীই বা খাবেন বাবু? আমাদের ছেলে বুড়ো মেয়ে মদ্দ সবাই পখাল পেলে আর কিছুই চায় না। তাই ভাবলাম আপনিও যদি...”
আমরাও শখের পান্তা খেতাম। ভাতের মধ্যে সামান্য ঠান্ডা জল দিয়ে আলুসেদ্ধ শুকনো লঙ্কা পোড়া, পেঁয়াজ কুচি সরষের তেলের ঝাঁজ দিয়ে যে লোভনীয় খাদ্যটি তৈরি হত তার কাছে কোথায় লাগে পোলাও কালিয়া!
“বউঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভাল, খাওয়াতে ভালবাসতেন, এই খাওয়াবার সখ মেটাতে আমাকে হাজির পেতেন।ইস্কুল থেকে ফিরে এলেই তৈরি থাকত তাঁর আপন হাতের প্রসাদ। চিংড়িমাছের চচ্চড়ির সঙ্গে পান্তা ভাত যেদিন মেখে দিতেন, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে সেদিন আর কথা ছিল না”
(ছেলেবেলা, রবীন্দ্রনাথ)
ছবি - লেখক
মসুর ডালের বড়াটি ও পান্তার সঙ্গে দারুণ মানায় ।
বাঃ, ভারী ভালো লাগলো।