৭
আমাদের ইস্কুলের একশ পঁচিশ বছর এসে পড়েছে। বিভিন্ন প্রাক্তনী ব্যাচের ব্যস্ততা তুঙ্গে। আমরা সাতাশির ব্যাচ ঠিক করলাম, কলকাতায় প্লেগ মহামারী আর বর্তমান করোনা মহামারীর তুলনা করে একটা আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার করব। ১৮৯৮ সালে ইস্কুল প্রতিষ্ঠার সময়ে প্লেগের থাবায় আহত হয়েছিল শহরটা, তাই এই আলোচনার উদ্যোগ। বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুরা মিলে সময় বের করে আমরা কাজ শুরু করলাম। মাতাজীরা বললেন, নিবেদিতার ডাকে সেযুগের যুবকেরা, মহিলারা প্লেগ নিবারণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এই করোনা মহামারীতে নবীন প্রজন্ম কীভাবে অংশ নিয়েছে, সেটা তাঁরা শুনতে চান। আমার কলেজের ছাত্রী পারমিতা কোভিডে প্রচুর কাজ করেছে, ভাল লিখতে পারে আর বলার ভঙ্গিটিও ভাল, ও বক্তা হিসেবে নির্বাচিত হল। আর এক বান্ধবীর বোনও নির্বাচিত হল। সঙ্গে দেশ বিদেশে সমাদৃত প্রথিতযশা প্রাক্তনীরা তো ছিলেনই। ছাত্রীর ছাত্রী বলবে, কী বলবে, কীভাবে বলবে অশেষপ্রাণা মাতাজী - যিনি এসবের উদ্যোক্তা তিনি ভীষণ খুশি আর উত্তেজিত। এদিকে আমার মনে যে সেই ছোটবেলার ভয়, কী জানি সব ঠিক করে সময়ের মধ্যে ও বলতে পারবে তো! মিশনে কেউ নির্দিষ্ট সময়ের এপাশ ওপাশ করতে পারেনা। আমি পারমিতাকে নিয়ে রাত জেগে জেগে গুগল মিটে প্র্যাকটিস করাতে শুরু করলাম। যাই হোক অনেক টেনশন, ঝক্কি, আনন্দ আর তৃপ্তির মধ্যে দিয়ে ওয়েবিনারটা ভালোভাবেই উৎরে গেল। মাতাজী বললেন বক্তা আর উদ্যোক্তাদের একদিন আসতে হবে, মুখোমুখি আলাপ আর প্রসাদ পাওয়ার জন্য। বিদেশ থেকে যাঁরা বলেছিলেন, তাঁদের প্রতিনিধিরা এলেন। কতদিন পরে আমি পায়ে পায়ে আবার ইস্কুলে গিয়ে দাঁড়ালাম, আগে মায়ের সঙ্গে যেতাম, কারণ আমার মা মানে সকলের কৃষ্ণকুমারীদি এই ইস্কুলেই পড়াত। এখন এলাম সকন্যা। সিস্টার যে বাড়িতে থাকতেন, সেই ১৬ নম্বর বোসপাড়া লেনের বাড়িটা এখন মিউজিয়াম হয়েছে। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। একটা জিনিস লক্ষ্য করে খুব অবাক হলাম। আসলে ছোটবেলা থেকে যত মিউজিয়াম দেখেছি, সবগুলোতেই বার্তা দেওয়া ছিল, যেন দূরে দূরে থেকে দেখি, ভুলেও হাত দিয়ে ছুঁতে যাওয়ার স্পর্ধা না করি। আর এখানে ঢুকতেই সামনে বড় করে লেখা আছে, ‘নির্দ্বিধায় স্পর্শ করুন’। পড়ার ঘরে সিস্টার বসে আছেন, লুকোনো প্রোজেক্টরের কৌশলে ডান হাত নড়ছে, যেন লিখছেন মন দিয়ে, আর দেওয়ালে ফুটে উঠছে তাঁর সই, লেখা, আঁকা ছবি। বার-উঠোনে তেপায়ায় ছোট ছোট সব এল ই ডি মনিটরে ছবি ফুটে উঠছে। এই উঠোনে কখনও সারদানন্দের কথকতা শুনছেন বাগবাজারের মেয়ে-বৌরা চিকের আড়ালে বসে, কখনও বা চা চক্রে বসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবির সঙ্গেই কানে গল্প বলে চলে একটি কণ্ঠ। দেশ কাল গুলিয়ে যাচ্ছে, মনে হয় বা সেযুগেই চলে গেছি হঠাৎ। বাড়ির অলিগলিতে খালি গল্প শোনা যায়, ঐ তো সিস্টার খৃস্টান বলে ওপরের জানলা দিয়ে সরস্বতী পুজো দেখছেন, জানলার ধারে একটি রুমাল ঝোলানো রয়েছে সূঁচ সুতো সমেত, সিস্টার সেলাই করছিলেন, যদি কেউ চায় রুমালে সেলাইটা আর একটু এগিয়ে দিতে পারে। ঐ যে সারদা মা ইস্কুল শুরুর দিন পুজো করছেন ঠাকুর দালানে। সিস্টারের নোট বুক, পড়ানোর খাতা সব রয়েছে সাজানো। বইগুলোর রেপ্লিকা তাক থেকে টেনে একটা জায়গায় রাখলেই, বিশাল স্ক্রীনে খুলে যায় পাতা, স্ক্রিনের ওপরেই হাত দিয়ে পাতা সরিয়ে সরিয়ে বইটা পড়ে ফেলা যাবে যদি সময় থাকে। এক জায়গায় হাত দিয়ে স্ক্রিনের ওপরে প্রদীপ জ্বালানো যায়, প্রদীপটা যাঁর ছবির তলায় নিয়ে যাব, ভেসে উঠবে তাঁর জীবনী। এছাড়াও আরো অনেক কিছু। ভিতরের উঠোনটায় গিয়ে আমার মেয়ে অস্থির হয়ে ছুটে বেড়াতে লাগল। কানের পাশে গল্প চলছে কোথায় সিস্টারের বসার জায়গা, সারদা মায়ের ব্যবহৃত সিঁড়ি, ছাদের ওপরে একটি তৈরি করা নিমগাছ, যেমনটি বিবরণে পাওয়া গেছে। সেযুগের ইঁট আর পাইপগুলো সব অবিকৃত, বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। আমি নিজেও চমৎকৃত, এত ইন্টার্যাক্টিভ ডিজাইন একটা ছোট্ট পারসোনালিয়া মিউজিয়ামের! কচি মনকে ভীষণ প্রভাবিত করবে সেটা স্বাভাবিক। অশেষপ্রাণাজী মেয়েকে দেখছেন। আমার আবার সেই ছোটবেলার ভয়, এইরে! এবারে ও আর আমি দুজনেই বকুনি খাব। এসব জায়গায় অস্থিরতা ছোটাছুটি ওনারা পছন্দ করবেননা।
- ও মা! এসব কী হচ্ছে, আমার মনে হচ্ছে কাঁদতে কাঁদতে এখানে ছুটি। আমি কেমন যেন দাঁড়াতে পারছিনা।
মেয়েকে ফিস ফিসিয়ে বলি,
- কী হচ্ছে, বুঝতে পারছিসনা বাবু? আমাদের পরিবারে আর জি কর, কুমুদিনী, লাবণ্য, কৃষ্ণা, শারদা পেরিয়ে ষষ্ঠ প্রজন্ম তুই সিস্টারের সামনে দাঁড়িয়েছিস। প্রথমবার এলি তো, সিস্টার তাই আলতো করে একটু পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন তোর, শান্ত হয়ে এই অনুভূতিটা উপভোগ কর।
আমি অবাক হয়ে দেখি অশেষপ্রাণাজী ওকে বা আমকে কাউকেই বকছেননা তো! কৃষ্ণকুমারীর নাতনী আর শারদার মেয়ে এই পরিচয়টাই কি ওঁকে স্নেহে অন্ধ করে দিচ্ছে?
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে মেয়ে প্রশ্ন করল,
- মা, তোমরা সবাই এই ইস্কুলে পড়েছ, তাহলে আমাকে কেন ভর্তি করনি? ওখানে গিয়ে আমার ভেতরটা এখনও উথাল পাথাল করছে।
- তোকে? এখানে? হুঁঃ, তুই যা হাতে পায়ে দস্যি, শেষে ইস্কুল থেকে আমাকে বলত, শারদা, তোমার মেয়েকে ফেরৎ নাও আর সঙ্গে তোমার মাধ্যমিকের সার্টিফিকেটটাও ফেরত দিয়ে যাও।
- মা, ভালো হবে না বলে দিচ্ছি, আমি কি এতটাই খারাপ?
- দস্যি হওয়া তো খারাপ নয়, কিন্তু এখানে মাঠ নেই, তুই মানিয়ে নিতে পারবি কিনা, তাই ভয় হয়েছিল, তাছাড়া অনেকটা দূরও হয়ে যায়।
- তোমার মেয়ে হয়েছে শুনে ইস্কুল থেকে কিছু বলেনি?
- হ্যাঁ, শ্রদ্ধাপ্রাণাজীর ভান্ডারায় এসেছিলাম মাকে সঙ্গে নিয়ে, তখন মাতাজীরা বলেছিলেন।
- তাহলে? ভর্তি করলেনা কেন?
ওকে আর কী বলি! সবটা সত্যি না বলে এড়িয়ে যেতে হয়। এই ইস্কুলে মা ফার্স্ট হত, আমি ফার্স্ট হয়েছিলাম, এই প্রত্যাশার চাপ আমার বোনের পক্ষে ভালো হয়নি। ও অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমি চাইনি অতীতের কোন ফাঁস অবোধ বয়সে আমার মেয়ের গলায় বসুক। এই ইস্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পরিবারের ইতিহাস। যেদিন ভালো মন্দ জ্ঞান হবে, বুঝতে শিখবে, সেদিন চাইলে কাছে আসবে। তাই এই ইস্কুল থেকে মেয়েকে দূরে রেখেছিলাম। কিন্তু নিয়তিকে কে অস্বীকার করবে? অমোঘ টানে এই ইস্কুল ওকে আকর্ষণ করছে। মাতাজী ওকে একটা সিস্টারের ছবি দেওয়া আলো দিয়েছেন, প্লাগে লাগিয়ে জ্বালাতে হয়, নানারকম আলো হয়। বাড়ি ফিরেও মেয়ে দেখি সেটা নিয়ে মশগুল। ঘর অন্ধকার করে নানা ভাবে আলোর খেলা দেখছে।
- মা, তোমাদের ইস্কুলের প্রসাদের খিচুড়িটা ভালো, বেশ অন্যরকম। একটুও ঝাল নেই। আর পায়েসটাও দারুণ। কে রান্না করে?
- হোস্টেলে রান্না হয়। আসলে মিশনের রান্নার একরকম রীতি আছে। তাই খেতে অন্যরকম লাগে।
- তুমি কোথায় কোথায় খেয়েছ?
- বেলুড় মঠে, নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে, বেনারস মিশনে।
- সব জায়গায় খিচুড়ি একরকম?
- হুঁ, মোটামুটি এক। তবে বেলুড়ে বা নরেন্দ্রপুরে অনেক লোকের ব্যাপার, তাই ওখানে সব মেশিনে রান্না হয়।
- মেশিনে?
- হ্যাঁ রে। নরেন্দ্রপুরে দেখেছি, সারিবদ্ধ বিশাল বিশাল ডেকচিতে ভাত ডাল সব্জি রান্না হচ্ছে। পাইপে করে ডেকচিতে জল ঢুকছে। সরাসরি কোন আগুনের ব্যবস্থা নেই। ডেকচির নিচে আর ওপরে নানা পাইপের সারি। নিচের পাইপ দিয়ে বাষ্প এসে রান্নার জ্বালানির কাজ করছে। আর উপরে প্রতিটি ডেকচির মাথায় সব পেল্লাই চিমনি, সব পাইপ সংযোগে সারিবাঁধা। সেখান দিয়ে রান্নার ভাপ বাইরে চলে যাচ্ছে। রান্নাঘরে ধোঁয়া বসে থাকার জো টি নেই।
- বাপরে! কিন্তু তুমি ছেলেদের ইস্কুলে ঢুকলে কীকরে?
- যখন কোন উৎসব উপলক্ষে প্রতিযোগিতা হয়, তখন গিয়ে দেখেছি। আগে ইস্কুলে পড়তে, ওখানে প্রতিযোগী হয়েছি, আবার এখন যাই, ছেলেমেয়েদের নিয়ে।
- বুঝলাম, তারপর?
- ভাজাভুজির জন্য আছে দুখানা বিরাট কড়া, তার মাপমতো স্টোভের ওপর। খোঁজ নিলাম, সেখানেই ফোড়ন দিয়ে ডালে ঢেলে দেওয়া হয়। আমার খুঁটিনাটি প্রশ্ন শুনে এক সংগঠক কাম প্রাক্তনী বললেন, সত্যিই তো একথাগুলো তো মাথায় আসেনি, কীভাবে হয়! তাঁকে আর কিছু বলিনি, মনে মনে হাসি, পুরুষ আর নারীর যে এখানেই তফাৎ। যাই হোক, একটু এগিয়ে দেখি আলাদা প্রকোষ্ঠে দেড় মানুষ উঁচু রুটি করার মেশিন। ওতে একঘন্টায় এক হাজার রুটি হয়। লেচি করে ওপর থেকে ভিতরে গড়িয়ে দিলে নিচ দিয়ে রুটি হয়ে বেরিয়ে আসে। মাথায় প্রশ্ন আসে, এত লেচি করার আটা মাখে কে? বেশি চিন্তা করতে হয়না। মানুষ রাঁধুনি পরিচয় করিয়ে দেন যন্ত্র রাঁধুনির সঙ্গে, যিনি রোজ আটা মাখেন। আমি এতটাই অভিভূত যে তিনি লেচি করেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হলনা। এছাড়া আলুর খোসা ছাড়ানোর জন্য, নানা মাপে আলু ও সব্জি কাটার জন্য, হলুদ গুঁড়োনোর জন্য আলাদা আলাদা যন্ত্র রাঁধুনিরা তৈরি হয়ে আছেন, তাঁরা ভারি ব্যস্ত।
- হা হা হা হা, এতো দারুণ ব্যাপার। এবারে ইস্কুলের খিচুড়িটা কেমন ভাবে করে সেটা বল।
- ঐভাবে নিশ্চিত তো বলতে পারবোনা। তবে একটা আন্দাজ আছে। গোবিন্দভোগ চাল আর মুগের ডাল দিয়ে হয়। প্রথমে ডাল সেদ্ধ শুরু হয়, তার মধ্যে চাল ছাড়া হয়। যে ঋতুতে যেমন সবজি পাওয়া যায় - গাজর, কড়াইশুঁটি, বীন, ফুলকপি, শাক, আলু সব সেদ্ধ থাকে। তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন থাকে। হোস্টেলের রান্নায় গরম মশলা দেওয়া হয়, আর এঁচোড় বা অন্যান্য নিরামিষ সবজিতে হিংয়ের গন্ধটা খুব পেতাম। ঘি দেওয়া হয়। তবে অনুপাতে তেল মশলা কম থাকে।
- একটা বেশ আলাদা স্বাদ পেলাম।
- এয়ার টাইট ডেকচিতে বা বয়লারে ভাপে একসঙ্গে সেদ্ধ হয় তো। ওপর থেকে ফোড়ন ঢালা হয়। তারপরে খাওয়ার সময়ে পরিচ্ছন্ন সুন্দর পরিবেশ থাকে। সব মিলিয়ে স্বাদটা আলাদা লাগে। তবে ভোগ রান্নার নির্দিষ্ট কিছু অনুপান তো আছেই যা গোপন, যারা রান্না করে, তারা বলেনা, সে মিশনই হোক বা আমাদের ডেমুরিয়ার জগন্নাথের মন্দির।
- হুম, জানো মা, মিউজিয়ামে আমাকে দেখে অনেকে বলাবলি করছিল, কৃষ্ণকুমারীদির নাতনি। কিন্তু দিদার নাম তো কৃষ্ণা।
- হুঁ, ইস্কুলের নাম আলাদা। শ্রদ্ধাপ্রাণাজী বদলে দিয়েছিলেন।
- কেন?
- শুনেছি ক্লাস ওয়ানে দাদু মায়ের সব খাতার লেবেলে লিখে দিয়েছিল কৃষ্ণা কুমারী বসু। তখন লক্ষ্মীদি মানে শ্রদ্ধাপ্রাণাজী বললেন কৃষ্ণা কুমারী বলে ডাকতে অসুবিধে, আমরা ওকে কৃষ্ণকুমারী ডাকব। সেই থেকে নাম বদল। ইস্কুলের পরে কলেজেও তো মা বিদ্যাভবনে মানে সারদা মিশনের কলেজেই পড়েছে। তাই সেখানেও সকলে জানে কৃষ্ণকুমারী। ঐ মানুষটা যদি হাল ধরে না থাকতেন কৃষ্ণকুমারী হারিয়ে যেত, আমি, তুই কেউ আসতাম না।
- তুমি শ্রদ্ধাপ্রাণাজীকে দেখেছ মা?
- হ্যাঁ, তিনিই উদ্যোগ নিয়ে আমাকে নিবেদিতা ইস্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন।
- মানে? তোমার মা বাবা ভর্তি করেনি? এই ব্যাপারটা আবার কী?
- ব্যাপার আর কী, বাগবাজার মাল্টিপারপাস ইস্কুলে প্রথম কিন্ডারগার্টেন বিভাগ খুলল, আর বাবা শখ করে আমাকে সেখানে ভর্তি করে দিল। মা তখন নিবেদিতা ইস্কুলে প্রাইমারীতে পড়ায়। ওয়ান থেকে ওখানে আমার মর্নিং স্কুল, এদিকে মায়ের ইস্কুল ডেতে। মর্নিং স্কুল ছুটি হলে, মা আমাকে নিয়ে নিবেদিতায় আসত। বিকেলে মার সঙ্গে বাড়ি যেতাম। সারাটা দিন ছোটবাড়ির মানে প্রাইমারীর বড়দি ত্যাগপ্রাণা মাতাজীর পাশে বসে থাকতাম। সকলে ওঁকে ডাকত বড় গীতাদি। তিনি আলমারি খুলে আমাকে নানারকম বই দিতেন। কখনও কী পড়লাম জিজ্ঞাসা করতেন, গল্পের কোনো ঘটনা বা চরিত্র ভালো না মন্দ সে বিষয়ে আমার মতামত জানতে চাইতেন। কখনো রিডিং পড়তে দিতেন। আবার কখনো কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে বলতেন। এক একদিন এক একরকম।
- বাব্বা ঐটুকু বাচ্ছা তুমি ভোরবেলা বেরিয়ে, সারাদিন বসে বিকেলে বাড়ি ফিরতে! কতবছর এমন চলল?
- বেশিদিন নয়। কারণ ঘটনাটা বোধহয় বড়বাড়িতে লক্ষ্মীদির কানে কেউ তুলেছিল। বা তিনি নিজেও দেখে থাকতে পারেন।
- কীকরে দেখলেন?
- আসলে মাঝে মাঝেই বড়বাড়িতে আমার ডাক পড়ত। বড়বাড়ির কোনো শিক্ষিকা কৃষ্ণকুমারীর মেয়েকে এখনো দেখেননি একথা জানাজানি হলেই মনে হয় আমার ডাক পড়ে যেত। আমি বেণুমাসির পিছন পিছন বড়বাড়িতে স্টাফরুমে যেতাম। সেখানে দেখতাম গম্ভীর হয়ে মায়ের শিক্ষিকারা বসে আছেন। আমি গেলেই যিনি দেখেননি, তাঁর সঙ্গে পরিচয় সারা হত। তারপরে বিভিন্ন জন বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন।
- কী প্রশ্ন?
- যেমন ধর, ‘একটা বাংলা কবিতা বল। আজ কি দিয়ে ভাত খেয়েছ? কে রান্না করেছিল? বাবা বেশি বকে না মা? কে বেশি ভালোবাসে? ইস্কুলে কিভাবে এলে আজ? বোনের সঙ্গে ঝগড়া করো? কে বেশি দুষ্টু? ছুটির দিন কি করো? কটা গল্পের বই পড়া হয়েছে? বইগুলো কী নাম বলো। আমাদের পড়তে দেবে? একটা গল্প বলো’ - এইসব।
- হি হি হি হি, তুমি ভয় পেতেনা?
- না, সাধ্যমতো উত্তর দিতাম। কেবল গল্পের বই দিতে রাজি হতামনা। ওঁরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটা অন্তত বই চাইতেন। আর একটা কমন প্রশ্ন ছিল, তুমি কি মা সারদা? আমি প্রবল বেগে মাথা নেড়ে প্রমাণ করতাম, মোটেই না। আমি তালব্য শ এ শারদা। দিদিরা মুখ ঘুরিয়ে নিতেন, বা বই খাতা দেখতেন।
- হা হা হা হা, হাসি চাপতে সবাই মুখ ঘুরিয়ে নিতেন, বুঝেছি। তারপর?
- একদিন মা নিজের ক্লাসের ফাঁকে বলে গিয়েছিল, লক্ষ্মীদি তোকে ডেকেছেন। খুব সাবধান, উনি গুণী মানুষ, প্রণাম করবি। আমি গেলাম, বেণু মাসির সঙ্গে। খুব লম্বা চওড়া চেহারা। সামনে যেতেই গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘তুমিই কৃষ্ণকুমারীর মেয়ে? ফর্সা পায়ে জুতোর বেল্টের দাগ হয়ে গেছে, মোজা পরবে।’ ছোটো মানুষ হলেও, জলদ স্বরের পিছনে একটা স্নেহের ফল্গু অনুভব করতে পেরেছিলাম। তিনি আমায় গল্পের ছলে নানা কথা জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন লিখতে পারি দেখাতে বললেন। তারপরে তো চলে এসেছি। সপ্তাখানেক পর একদিন মা আমাকে সকালে ঘুম থেকে ওঠায়নি। বেলায় উঠে আমি তো অবাক। মা বলল আজ থেকে আমার সঙ্গে বেরোবি। আমার ইস্কুলেই পড়বি। আমি বললাম, পরীক্ষা দিতে হবে? মা চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বলল, তোর পরীক্ষা দুজন নিয়ে নিয়েছেন। তোর অনেক ভাগ্য, লক্ষ্মীদি মর্নিং স্কুল করে সারাদিন বসে থাকিস বলে নিজে তোর পরীক্ষা নিয়েছেন, বলে দিয়েছেন, যে আর মাল্টিপারপাসে যেতে হবেনা। শারদা তালব্য শ হলেও নিবেদিতাতেই পড়বে।
- আরে বাঃ। তারপর?
- তারপর আর কী? নিবেদিতার মেয়ে হয়ে গেলাম। ভবিতব্য। বিধি বেঁধে ফেলল বংশ পরম্পরার সুতোয়।
- এটা তো খুব মজা গো মা, মায়ের ইস্কুলে পড়া। তুমি যদি কলেজ ছেড়ে আমার ইস্কুলে পড়াতে কত ভালো হত!
- একটুও ভালো হতনা। এ যে কী জ্বালা, যে ভুগেছে সে জানে। ইস্কুলে মাকে দিদি বলতে হত। কোন দুষ্টুমি তো দূর, পান থেকে চূণ খসলে মার কাছে খবর চলে যেত।
- ওরে বাবা, এতো ভারি মুশকিল।
- এগুলো কিছুই নয়। প্রাইমারীতে মা যেসব বিষয় ক্লাসে পড়াত, তার খাতা দেখার সময়ে আমার নম্বর কমিয়ে দিত।
- কেন?
- যদি কেউ বলে নিজের মেয়ে তো, তাই বেশি দিয়েছে।
- এ বাবা!
- সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল অন্য জায়গায়। ফার্স্ট সেকেন্ড হলে কিছু বন্ধু ভাবত, দিদির মেয়ে তো, নিশ্চয়ই কোশ্চেন জেনে পরীক্ষা দিই। ইস্কুল থেকে মাধ্যমিকে প্রথম হবার পরে তাদের সন্দেহ নিরসন হয়েছিল হয়ত, কী জানি!
- হুম, এগুলো সত্যিই জ্বালা।
- তারপরে ছুটি হলেও বাড়ি ফিরতে দেরী হত। মার সব অফিসিয়াল কাজ শেষ না হলে বসে থাকতে হত।
- কী করতে তখন?
- বড় বেলায় একটা সুবিধে ছিল, লাইব্রেরীতে বসতাম। আর ছোটবেলায় অন্যরকম একটা মজা ছিল।
- কীরকম?
- কোনো কোনোদিন খুব দেরি হলে, বড় গীতাদি মানে ত্যাগপ্রাণা মাতাজী বেণু মাসিকে বলতেন ওকে ছাদে নিয়ে যাও। তিনতলার ছাদ ছিল একমানুষ সমান দেওয়াল, সরু থাম আর জাল দিয়ে ঘেরা, মাথায় টিনের চাল। ওখানে রোজ সকালে আমাদের প্রার্থনা হত। বেনু মাসি ছাদের এক কোণে দুই হাঁটু মুড়ে, হাঁটুর দুপাশে দুই হাত বেড় দিয়ে বসে থাকত। কখনো মাথাটা দুই হাঁটুর মাঝে ডুবিয়ে রাখতো। মনে হত কী যেন সব আকাশ পাতাল ভাবছে। আর আমি একা একাই সেখানে ছুটোছুটি করতাম। মাঠ তো ছিলনা ইস্কুলে, ঐ ছাদেই টিফিনে সবাই খেলা করতাম। ছাদের ভিতরের থামগুলো নিয়ে আমরা বন্ধুরা একটা খেলা বানিয়েছিলাম - থাম - থাম খেলা। চারটে থাম ছুঁয়ে আমরা কজন থাকতাম আর একজন চোর মাঝখানে থাকতো। আমরা কেবলই এথাম থেকে ওথাম ছুটে বেড়াতাম। ঐসময়ে চোর যাকে ছুঁয়ে দেবে সে চোর। কিন্তু থাম ছুঁয়ে ফেললে আর চোর হবনা।
- দাঁড়াও ব্যাপারটা আমি একবার ভেবে নিই। দুটো থামের মধ্যে দূরত্ব কত?
- মেপে তো দেখিনি, ফুট দশেক হবে। আমি একটু নিটির পিটির ছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে দৌড়ে অত পারতাম না, তাই এথাম ওথাম বেশি করতামনা। সাহস সঞ্চয় করতে করতে টিফিনের ঘন্টা পড়ে যেত।
- হে হে হে। আমি যদি থাকতাম, সবাইকে হারিয়ে দিতাম। তারপর?
- একা একা ছাদে তো আর চোর হবার ভয় নেই। তাই কেবলই ছুটতাম। ছাদের জাল দিয়ে বড়বাড়ির জানলা দিয়ে ক্লাস দেখার চেষ্টা করতাম। বড়বাড়ির পাশেই ছিল পদ্মাদের বাড়ি।
- পদ্মা কে?
- আমার একটা বন্ধু। আমার মামারা আর পদ্মার বাবা কাকা সব ছোটোবেলার পাড়ার বন্ধু ছিল। পদ্মার চেহারা বড়সড় ছিল। সে ঘোষণা করত যে অন্য স্কুলে ফোর অবধি পড়ে নাকি এখানে ওয়ানে ভর্তি হয়েছে। তাই আমরা যেন তার কথা সব মেনে চলি।
- হা হা হা হা।
- আমি বিশ্বাস করে তার নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলাম। নিজে এতটাই ছোটোখাটো ছিলাম, যে এক ক্লাসে পড়লেও অবলীলায় পদ্মা আমায় চ্যাংদোলা করে কোলে তুলত। আমি একা একা ছাদের জাল দিয়ে পদ্মার বাড়িতে কে কি করছে, পদ্মা তার বড় চুলে শ্যাম্পু মাখছে, এসব লক্ষ্য করতাম। বেণুমাসি দুই হাঁটুতে থুতনি ডুবিয়ে বসে আছে দেখলে মাঝে মাঝে ‘ও বেণুমাসি’ বলে চমকে দিতাম। কখনও ছোটো ছাদ খুলে দাও না, বলে বায়না করতাম।
- ছোটো ছাদ?
- হ্যাঁ, ছোটোবাড়ির ছাদের যে ধারটা নিবেদিতা লেনের দিকে, তার উল্টো দিকে, মানে বাড়ির পিছনের ধারে ছাদের কোণে লাগোয়া একটা ছোট বারান্দা ছিল। সেটায় টিনের চাল, ঘেরা জাল কিচ্ছু ছিলনা। রোদ পড়ত। দু চারটে ফুলের টব ছিল। ফুল ফুটতো। কিন্তু সেখানে আমাদের ছাত্রীদের যাওয়ার উপায় ছিলনা। একটা জালের দরজা দিয়ে আলাদা করা ছিল। তালা দেওয়া থাকত। আমরা বলতাম ছোটো ছাদ। ইস্কুলের সময়ে ওখানে যাওয়া মানা ছিল। কিন্তু ইস্কুলের পরে? খুব বায়না করলে কখনো সখনো বেণুমাসি ছোটোছাদ খুলে দিত। সেই নিষিদ্ধ এক চিলতে জায়গায় পা রাখা ছিল, একটা সাম্রাজ্য পাওয়ার সমান। আমি যে ছোটোছাদে গেছি, একথা বন্ধুদের কখনো বলিনি।
- হুম, দিদির মেয়ে হবার সুযোগ নিয়েছ! বেণুমাসিও কাউকে বলে দেয়নি?
- কী জানি!, না মনে হয়। দুঃখী মানুষ তো, এসব নিয়ে ভাবার সময় ছিলনা।
- দুঃখী কেন?
- জেনেছিলাম, মানে হঠাৎ করে জানতে পেরেছিলাম।
- কী?
- ক্লাস টুতে পড়ি যখন, একদিন মা ইস্কুল ছুটির পরে বাড়ি না গিয়ে কাজ করছিল। ছোটোবাড়ির ছুটি আগে হয়ে যেত। বড়বাড়িতে দেরি করে হত। আমি মাকে বললাম, বাড়ি যাবেনা? মা খাতা থেকে মুখ না তুলে ছোট্ট উত্তর দিল, 'দেরি হবে। আজ রামনবমী'। সেই রামনবমীর দিন কিন্তু আমার ছাদে যাওয়া হলনা। বদলে বড় গীতাদি, আমাদের বড়দি ওনার কাঠের দেরাজ থেকে একটা বই বার করে আমাকে বললেন 'পড়'। দেখলাম সেটা ছোটোদের রামায়ণ। আমি পড়তে বসে গেলাম। ছুটির পরে সেদিন খুব একটা মন বসছিলনা। ওয়ানে আমাদের ছড়া ও ছবিতে রামায়ণ ছিল। সেই সূত্রে রাম লক্ষ্মণ, তাড়কা রাক্ষসী হনুমান সবার সাথে পরিচয় হয়েছিল। সেদিন বইয়ে মন বসছিলনা কারণ, ঐ যে মা বলল আজ রামনবমী। দেরি হবে। মানে কিছু ঘটবে। সেটা কী? রামনবমী কী? - বসে বসে এসব ভাবনার জাল বুনছিলাম। একসময়ে বড়বাড়ির ছুটির ঘন্টা শোনা গেল। মাও ব্যাগ গুছিয়ে বলল, ওবাড়ি চল। ওবাড়ির দেউড়ি পেরিয়ে প্রশস্ত ঠাকুরদালান। মাঝখানে দন্ত্য স- এ সারদা মায়ের সিংহাসন। ডানদিকের দেয়ালে বুদ্ধমূর্তির সামনে কিছুটা এগিয়ে একটি চেয়ারে বসে আছেন লক্ষ্মীদি। সামনে প্রশস্ত সতরঞ্চিতে হোস্টেলের মেয়েরা, দিদিরা বসে আছে। তারপরে সময় কীভাবে কেটেছে জানিনা, মাতাজী রাম লক্ষ্মণের গল্প বলছেন। আজ শ্রীরামের জন্মদিন। আমি দেখছি অযোধ্যার রাজবাড়িতে কত তোড়জোড়। কিন্তু উৎসব বন্ধ। বিশ্বামিত্রের সঙ্গে দুই ভাই বেরিয়ে পড়েছেন, দশরথের চোখে জল। তিন মাতা বিলাপ করছেন। রাক্ষসের সঙ্গে লড়াই করে বীরপুরুষেরা ফিরবে তো? আমার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে, যেন সত্যি সত্যি ঘটছে ঘটনাটা। পাশে দেখি বেণুমাসি বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
- কেন কাঁদছে কেন? তুমি ছোট বলে সত্যি ভাবছিলে, বেণুমাসী তো বড়।
- তখন তো বুঝিনি। একটু বড় হলে পরে মা বুঝিয়ে বলেছিল, একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে বেণুমাসি আর তার ছেলেকে শেয়ালদা স্টেশনে বসিয়ে দিয়ে আসছি বলে, বেণুমাসির বর আর ফিরে আসেনি।
- সে কী?
- হ্যাঁ রে বাবু। বেণুমাসীকে লক্ষ্মীদি আশ্রয় দিয়েছিলেন। শুধু বেণুমাসী নয়, শুনেছি এমন বহু অনাথ আতুর মেয়েদের তিনিই ছিলেন আশ্রয়।
- উনি কি ইস্কুলের হেড মিস্ট্রেস ছিলেন?
- আমাদের সময়ে তিনি ছিলেন ইস্কুলের সেক্রেটারি। পরে হয়েছিলেন সারদা মঠের তৃতীয় অধ্যক্ষা।
- ও, তাহলে তো লক্ষ্মীদি মানে শ্রদ্ধাপ্রাণাজী খুব বিখ্যাত মানুষ।
- হ্যাঁ সে তো বটেই, কিন্তু এসব মানুষের জীবনই হল উদাহরণ, যেমন কঠিন, নিয়মানুবর্তীতায় অবিচল, তেমনই কোমল, করুণায় ভরা। খ্যাতির জন্য ওঁরা কিছু করেননা। তবে হ্যাঁ রামকৃষ্ণ মিশন মানে পুরুষ মঠ অনেক বেশি বিখ্যাত। রামকৃষ্ণ মিশনের কথা যেভাবে মানুষ জানে, পত্রপত্রিকায় লেখা বেরোয়, সারদা মঠের উল্লেখ মিডিয়া তো সেভাবে করেনা। তাই তুই যে মানে ভেবে খ্যাতির কথা বলছিস, তত মানুষ শ্রদ্ধাপ্রাণাজীকে চেনেনা।
- কেন, এরকম হবে কেন?
- এও ধরে নে সমাজের একরকম পুরুষতান্ত্রিকতা। এই সমাজেই চলতে হয়। যাই হোক, কী জানিস! আজকাল যখন রামনবমী আসে, কাগজে কত খবর বেরোয়, আমি তখন মনে মনে চলে যাই ইস্কুলে, শ্রদ্ধাপ্রাণাজীর সামনে বসি, কৌশল্যা, কৈকেয়ী, সুমিত্রার দুঃখে নিঃঝুম সেই ঠাকুরদালান মনে এক অদ্ভুত আবেশ ছড়িয়ে দেয়।
- তুমি এমন বলছ মা, মনে হয় যেন আমিই ছিলাম, লক্ষ্মীদিকে দেখেছি।
- মা যে ইস্কুলে পড়াত, মাকে পড়ানোর জন্য লক্ষ্মীদিই বলেছিলেন। সুযোগটা পেয়ে মাও নতুন ভাবে জীবন শুরু করেছিল। আসলে মা বি এ পাশ করেছিল বিয়ের পরে, কিন্তু আরও পড়া হলনা বলে হাহুতাশ করত। মাকে সান্ত্বনা দিতাম। পড়ানোর সুযোগ পেয়ে আবার নিজেকে লেখাপড়ার চর্চায় ডুবিয়ে দিতে পেরেছিল। মা মারা যাবার পরে মায়ের ছাত্রীরা ইস্কুলের গ্রুপে কত কী লিখেছিল। অনেকে আমার সঙ্গে কখনও দেখা হয়ে মায়ের কথা উঠলে কেঁদে ফেলেছিল।
- দিদাকে ছাত্রীরা কত ভালোবাসত মা, তোমার গর্ব হয়না?
- তা হয়, আবার একটা ইনসিকিওরিটিও হয়।
- বুঝেছি, তোমাকে পাত্তা না দিয়ে, স্টুডেন্টদের বেশি পাত্তা দিয়েছে, তাই হিংসুটেপনা, তুমি আমার সঙ্গে তো ঐ কান্ডই কর। কতবার বলেছি স্টুডেন্টদের নয়, আমাকে পাত্তা দাও।
- দূর পাগল! আমি কি তুই নাকি, মায়ের স্টুডেন্টদের সঙ্গে হিংসুটেপনা করব। আমার মনে হয়, আমি কি আমার ছাত্রছাত্রীদের মনে কোনদিন ঐরকম জায়গা জুড়ে বসতে পারব? মনে হয় এজন্মে আর হলনা। পরের জন্মে আবার চেষ্টা করতে হবে।
- হুম, বুঝলাম, কিন্তু একটা কথা বল, এত কষ্ট করে দিদা যখন গ্র্যাজুয়েট হল, কত ইচ্ছে ছিল আরও পড়ার, হলনা কেন?
- বিধির বিধানে হয়নি। হায়ার সেকেন্ডারির পর বিয়ে হয়ে গেল আমার বাবার সঙ্গে। কলেজে ভর্তি হয়েও আড়বালিয়ায় মানিয়ে নিতে কিছুদিন আবার পড়ায় ছেদ পড়ল। নতুন সংসারে সংগ্রাম, আমরা দুবোন জন্মালাম। সেই নিয়ে আবার কলেজে পড়া। পাশ করতে করতে আমি ইস্কুলে ভর্তি হলাম, তারপর মা পড়াতে শুরু করল। ফর্মাল পড়াটা আর এগোলনা।
- বিয়েটা আর একটু দেরীতে হলেই হয়তো এম এ পড়াটা হয়ে যেত, তাই না মা? জোর করে বাড়ির লোক বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল?
- ধুর, মা, বাবা তো প্রেম করে বিয়ে করেছে। দারিদ্র্য, অভিভাবকহীনতা, অশোকনগরের কষ্ট এসব জানতে পেরে আমার জাঁদরেল পিসি বিয়ে দিয়ে মাকে আড়বালিয়ায় নিয়ে এল।
- যে পিসিদিদার ধান্যকুড়িয়ার গাইন বাড়িতে বিয়ে হয়েছিল, সেই পিসি।
- সেই আমার একমাত্র নিজের পিসি।
- আরিব্বাস, প্রেম করে বিয়ে জানতাম, ডিটেলটা জানা হয়নি। আড়বালিয়ার গেরামের ছেলের সঙ্গে প্রেমটা হল কোথায়?
- হি হি, গেরামের ছেলেরা মানে বাবা, জেঠুরা কলকাতায় এসে জীবন জীবিকার লড়াই করছিল। বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল কাশীপুরের লকগেট রোডে।
- যেখানে বিকাশচন্দ্র পরিবার নিয়ে উঠে গিয়েছিল দাঁতি সেনের বাড়ি ছেড়ে?
- একদম ঠিক ধরেছিস।
- পুরোটা এবার শুনতেই হবে মা, বলো বলো।
- পুরোটা আবার পরে হবে। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, বাবা মায়ের প্রেম আর বিয়ে সব কথাই লক্ষ্মীদি জানতেন। মা যখন বিদ্যাভবনে কলেজে ভর্তি হয়, তখন লক্ষ্মীদি বাবাকে দিয়েই অভিভাবক হিসেবে সই করিয়েছিলেন, আর সেটা বিয়ের আগেই।
- কী বলছ মা! এত প্রোগ্রেসিভ, সেই যুগে!
- লক্ষ্মীদি কি যে সে লোক! এক বিশাল বটগাছ। পরিস্থিতি বুঝে কষ্টিপাথরে বাবাকে যাচাই করে নিয়েছিলেন নিশ্চয়ই।
- আমি আশ্চর্য হয়ে যাই, তোমার প্রতিটা গল্পের ভিতর একটা করে আকাশ কুসুম গোঁজা থাকে কীকরে বলোতো!
- ঐ ইংরেজি কথাটা ভাব - ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান….
- ফিকশন! একটা কথা জানো মা আমি মিউজিয়ামে তোমার ঐ ফিজিক্যাল সায়েন্সের টীচারের ঘরে গিয়েছিলাম।
- কোন টীচার?
- সন্ন্যাসিনী।
- সুদীপ্তাদি, মানে অশেষপ্রাণাজী? একা একা! বলিস কীরে! কী সাহস!
- হ্যাঁ জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিলাম দুটো কথা।
- কী কথা?
- একটা ফাঁকা বিশাল বই আছে না, কাছে গিয়ে পাতা ওল্টালেই সিস্টারের লেখা চিঠি, ওনার ছাত্রীর সিস্টারকে লেখা চিঠি সব ফুটে উঠছে, ওটা কীভাবে হচ্ছে? আর সেকেন্ড হল, বাড়িটায় সব সাজানো আছে, শোবার ঘর, বসার ঘর, পড়ার ঘর, কিন্তু রান্নাঘরটা কোথায়?
- কী উত্তর পেলি?
- বইয়ের ওপর লুকোনো প্রোজেক্টর আছে। আমি আবার ফিরে গিয়ে পরীক্ষা করে দেখে এসেছি। আর অতদিন আগে সেই সময়ে ঠিক কোথায় রান্না হত, সেটা নিশ্চিত বোঝা যায়নি, পরে যারা থাকতেন, অনেক কিছু বদলে দিয়েছিলেন, তাই রাখা হয়নি।
- ভালো।
- জানো মা, আমি যখন চলে আসছি, উনি আমার হাত ধরে এই জায়গায় জপ করছিলেন চোখ বুজে।
- মণিবন্ধে মানে এখানে নাড়ি ধরে?
- হ্যাঁ।
- ভালো হয়েছে, চঞ্চলতা তবে কমবে এবার, পড়ায় যদি মনটা বসে।
- আমার আবার ওখানে যেতে ইচ্ছে করছে। তোমরা নাকি ছোটবেলায় বাড়িতে কিছু হলে সারদা মাকে গিয়ে নালিশ করতে!
- হুঁ, বড় দিদিরাও যেত, তাই আমরাও যেতাম। দিদিরাই বলেছিল, কোন মন খারাপ থাকলে, বকুনি খেলে ইস্কুলের মাকে বলে এলে একটা সুরাহা হবে। তাই আমরা চুপিচুপি ঠাকুরদালানে গিয়ে মাকে বলে আসতাম।
- আশ্চর্য তো! আমি যদি বলি তাহলে হবে কিছু?
- যদি বিশ্বাস থাকে হবে। এ হল মনের চাপ হালকা করা। আত্মবিশ্বাস বাড়ানো। অলৌকিক তো নয়। আসল লোক বলে গেছেন, 'প্রাচীন ধর্ম বলে গেছে ঈশ্বরে বিশ্বাস কর, আর নবীন ধর্ম বলছে নিজেকে বিশ্বাস কর।'
- নিজেকে বিশ্বাস?
- হ্যাঁ। ভবিষ্যতে এমনও দিন আসবে যেদিন আমি তোর পাশে থাকবোনা। সেদিন কোন কারণে আত্মবিশ্বাস নড়ে গেলে ঐ মা থাকবেন, গিয়ে বলবি, সুরাহা নিশ্চয়ই হবে।
"এই সব স্বাদ;
—এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
এক দিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;"