১২
বিশেষ কোন ঢেউ না তুলে দূর্গাপুজো শেষ হল। আজ একাদশীতে পরিমল গাঙ্গুলির নামে তুলসী দেওয়া হয় গোপীনাথের কাছে। তিনি আমাদের মন্দিরে সেই ভয়াবহ চুরির পরে তাঁদের পৈতৃক মন্দিরের শালগ্রাম দান করেছিলেন। আর আমাদের পূজারী মন-ঠাকুর তাঁকে গলায় বেঁধে, উপবাসে থেকে, এমনকি শৌচাগারে না গিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। আজ মন্দিরে বিশেষ পুজো হবে। নিত্যদিনের চাইতে ঘটাও একটু বেশি হবে। এছাড়া দিন চলল আগের মতোই।
আমাদের বাজারে একজন পূর্ব মেদিনীপুরের মাছওলা আছে। মাঝে মাঝে সে সামুদ্রিক মাছ পেলে কর্তাকে খবর দেয়। আজ একেবারে বাড়ি বয়ে এসে সে দিয়ে গেছে এক অদ্ভুত মাছ। শহরের বাজারে খুবই দুর্লভ। কর্তা বলেন খুরুট মাছ। এ মাছ কেমন করে রান্না করতে হয়, অনেকদিন আগে একজনের কাছে শুনেছিলাম বটে। কিন্তু এখন পরিষ্কার মনে পড়ছেনা। শেষে মেজ ননদকে ফোন করে রেসিপি জানলাম। মেজদি দুরকম বলে দিল। বেশ নাদুস নুদুস মাছ। আট পিস হবে। প্রথম রেসিপি খুরুট মাছের ঝাল। আর দ্বিতীয়টা হল খুরুট মাছের কাবাব। এখন অসুখের সময়ে ফ্রিজে রেখে বাসি খেতে মানা করছে সকলে, তাই দু'রকমই রেঁধে ফেলব বলে মনস্থ করলাম। একমনে তোড়জোড় করছি, মেয়ে এসে বকবক শুরু করল।
— অ্যাই এত বকবক করছিস, কোন পড়া নেই?
— আছে তো, সেই বারোটার সময়ে ইতিহাস ক্লাস হবে। এখনও দেড় ঘণ্টা বাকি।
— কোন চ্যাপ্টার পড়ানো হচ্ছে এখন?
— ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম।
— ক্লাসে মন দিয়ে পড়া শুনিস তো? নাকি সেদিনের মত দুষ্টুমি করিস?
— কোন দিনের মত?
— ঐ যে সেদিন দেখলাম। মিস পড়াচ্ছেন, স্ক্রীন শেয়ার করছেন। আর তোদের একজন বন্ধু ভিডিও অন করে আঙুল দিয়ে সকলকে গুলি করছে, বাকিরা যে যেখানে ছিল, সব লুটিয়ে পড়ল গুলি খেয়ে!
— হা হা হা হা। আইন অমান্য আন্দোলন পড়ানো হচ্ছিল তো, তাই সুপর্ণা ইংরেজ হয়ে সবাইকে গুলি করছিল। আমরা তো নিরস্ত্র, তাই পড়ে গেলাম। মিস স্ক্রীন শেয়ার করছিলেন বলে দেখতে পাননি।
— ভগবান! আমার ক্লাসে একজনকে, ‘পড়া কি শুনেছ’ - জিজ্ঞেস করলাম, সে গুগল মিট লীভ করে গেল। বেশিরভাগই কিচ্ছু শুনছেনা, শুধু ক্লাসে ঢুকে বসে থাকে।
— কিছু করার নেই মা, অনলাইন ক্লাসে ওগুলো মেনে নিতে হবে, কার বাড়িতে কী পরিস্থিতি তুমি কি জান?
— না তা জানিনা বটে।
— মা তুমি কখন স্বাধীনতা সংগ্রামী দেখেছ?
— সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামী না দেখলেও, তাঁদের কাছের লোকেদের দেখেছি।
— যেমন?
— যেমন শিখাদি। মায়ের ইস্কুলের বন্ধু। আমাদের নিবেদিতা ইস্কুলে প্রাথমিকে ইংরেজি পড়াতেন, লোকনাথ বলের মেয়ে।
— লোকনাথ বল কে?
— চট্টগ্রামের জালালাবাদের যুদ্ধে তিনি মাস্টারদার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। ওঁর ভাই টেগরা সেই যুদ্ধেই মারা যায়। আমরা ওঁর বাড়িতে প্রায়ই যেতাম। শিখাদির মা তখন বেঁচে ছিলেন, ভীষণ আমুদে একজন দিদা। ঐ বাড়িতে লোকনাথ বলের একটা বড় অয়েল পেন্টিং ছিল। ছোটবেলায় দেখলে গায়ে কাঁটা দিত আমার।
— ওঃ আর কাউকে জানো?
— পারিবারিক সূত্রে লেডি অবলা বসুর গল্প জানেন, এমন মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি।
— কী বলছ মা? বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের স্ত্রী?
— বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের স্ত্রী বটে, তবে সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়।
— তাহলে?
— অবলা বসুকে নিয়ে সব গবেষণা এখনও হয়নি বাবু। হয়তো আজও অনেক কিছু বাকি আছে। আজীবন নারীশিক্ষার প্রসার, মেয়েদের অধিকার, এমন কি ভোটাধিকার, তাদের স্বয়ম্ভরতার জন্য তিনি জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
— তাই নাকি? তারপর।
— আসলে কী জানো বাবু, লকডাউনে আমাদের ছাত্রছাত্রীরা, আমরা - সকলে তো খুব মুষড়ে পড়েছি। আমাদের কলেজে অনলাইনে কাউন্সেলিং হচ্ছিল। সেখানে ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট বললেন সকলকে বেশি করে জীবনীমূলক বই পড়তে হবে। মহাপ্রাণদের আত্মত্যাগের কথা, কষ্টের কথা মনে মনে আলোচনা করলে মনে খুব জোর আসে। সরাসরি গুলিগোলা না হলেও অবলা বসুর লড়াই তো মেয়েদের স্বাধীনতা সংগ্রামই, তাই না?
— নিশ্চয়ই, তারপর তুমি কী শুনেছ, সেটা বল।
— আমাদের নিবেদিতা ইস্কুলের ছাত্রী ছিলেন শ্যামশ্রী সেন। আমার মায়ের ব্যাচ মেট। ছোটবেলা থেকে এক ক্লাসের বন্ধু। ১৯৬৫ সালের হায়ার সেকেন্ডারি ব্যাচ। তাঁর মায়ের নাম অরুণা সেন। অরুণার বাবা মানে শ্যামশ্রী মাসির দাদু হলেন শিশির কুমার দাশগুপ্ত। ওঁদের আদি বাড়ি হল, ভরাকর, দারোগা বাড়ি, ঢাকা বিক্রমপুর। দাদুর এক বোন আশালতা সেনগুপ্ত - বালবিধবা। শিক্ষিত পরিবার তো, তাই গৌরীদান হয়নি। চোদ্দ বছর বয়সে বিবাহ দেওয়া হল অনেক দেখে শুনে। সেযুগের তুলনায় পরিণত বয়সেই বিয়ে ধরা যায়। কিন্তু বিধি বাম। বিয়ের ছ-মাস পরে আশালতা বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এলেন। এই শিশির কুমার আর আশালতার সম্পর্কে পিসিমা হলেন অবলা বোস ও সরলা রায়।
— নিজের পিসি?
— না, একেবারে সরাসরি সম্পর্ক নয়, তুতো পিসি। অবলার বাবা দুর্গামোহন দাশ বা খুড়তুতো ভাই চিত্তরঞ্জন দাশ - এঁরাও মূলে দাশগুপ্তই ছিলেন, পরে তাঁরা শুধু দাশ পদবী ব্যবহার করতেন, একথা আমাকে শ্যামশ্রী মাসিই বলেছেন। এঁদের আদি বাড়িও ঢাকা - বিক্রমপুরে।
— তারপর?
— লেডি বোসের নিজের সন্তান ছিলনা। তাই কিশোরী আশালতা বিধবা হয়ে বাপের বাড়ি ফিরে আসার পর, তাকে তিনি দত্তক নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আশালতার পরিবার রাজি হয়নি।
— কেন?
— লেডী বোস ব্রাহ্ম। আশালতা হিন্দু বিধবা। হয়তো সেই কারণে। যাই হোক, লেডি বোস আশালতাকে ইস্কুলে ভর্তি করলেন।
— উনি ব্রাহ্ম হয়েছিলেন?
— অবলা নিজে নয়, তাঁর বাবা ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। সেই সূত্রে মেয়েও ব্রাহ্ম হলেন।
— আশালতা কোন ইস্কুলে ভর্তি হল?
— সেটা শ্যামশ্রী মাসি বলতে পারেননি। বার বার বলছিলেন ওঁর মা যদি বেঁচে থাকতেন সব কথাই বলতে পারতেন। অবলা তো অনেকগুলি ইস্কুলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একদিকে তিনি ব্রাহ্ম গার্লসের সম্পাদিকা, আবার বেলতলা গার্লস, গোখেল মেমোরিয়াল, মুরলীধর কলেজ প্রতিষ্ঠাতেও ওঁর ভূমিকা ছিল বলে শুনেছি। অবলা নিজে কিন্তু বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়ে আর বেথুন ইস্কুলে পড়েছেন। ঐ বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয় তৈরিতে আবার যুক্ত ছিলেন অবলার বাবা দুর্গামোহন। যা হোক, লেখাপড়া শেষ করিয়ে, সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ শেষে আশালতাকে দিয়ে তিনি টিচার্স ট্রেনিং করালেন।
— তখন এসব ট্রেনিং ছিল?
— অবলা তো নিজেই নারী শিক্ষা সমিতি, মহিলা শিল্প ভবন, বিদ্যাসাগর বাণীভবন টিচার্স ট্রেনিং স্কুল, বিধবাদের জন্য ফান্ড, তাঁদের ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা - সব কিছু তৈরি করেছিলেন। আশালতার জন্য তিনি বিদ্যাসাগর বাণীভবন থেকেই প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করেছিলেন।
— বা-বা, বিরাট ব্যাপার! অবলা উনি ছিলেননা মা, সবলার চেয়েও বেশি সবলা।
— তা যা বলেছিস, পড়াশোনা শেষ হলে, আশালতার জন্য তিনি কর্পোরেশন ইস্কুলে চাকরির ব্যবস্থা করলেন। এমন বহু মেয়েকেই তিনি উদ্ধার করেছেন বাবু। তাদের সামনে আশার আলো জ্বালিয়েছেন, দুর্ভাগ্যের অন্ধকার দূর করেছেন। আশালতার আর এক বান্ধবী ছিলেন জ্যোতি সেনগুপ্ত। তাঁরও জীবনকাহিনী একই রকম। তাঁরা একসঙ্গে থাকতেন, ইস্কুলে পড়াতেন। শ্যামশ্রী মাসি ছোটবেলায় এই আশা দিদা আর জ্যোতি দিদাকে দেখেছেন। পাটভাঙা ধবধবে মলমলের থান প্লিট করে পরা, মাথায় ঘোমটা, গা ঢেকে বড় করে আঁচল টানা - এমনভাবে শাড়ি পরে তাঁরা আসতেন।
— তুমি এসব কথা কীকরে জানলে?
— কীকরে জানলাম মানে? শ্যামশ্রী মাসির মুখেই শুনেছি। রিইউনিয়নে দেখা হয়, প্রাক্তনী সভার আমরা তো সদস্য।
— অবলা বসুর সম্পর্কে আর একটু কিছু বল না মা। শুনতে বেশ লাগছে।
— অরুণার বিয়েতে লেডি বোস বেনারসী উপহার দিয়েছিলেন। সেটা শ্যামশ্রী মাসি মায়ের তোরঙ্গে দেখেছেন। অরুণারা গরমকালে কার্শিয়ঙের বাড়িতে বেড়াতে যেতেন। তখনকার দিনে বড় বড় পরিবারে এমন হাওয়া বদলের বাড়ি থাকতো। লেডি বোস ঐ সময়ে তাঁদের দার্জিলিঙের বাড়িতে থাকতেন। অরুণারা মাঝে মাঝেই সপরিবারে সেখানে যেতেন। তখন আপনভোলা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বাগানে ঘুরে ঘুরে গাছগাছালি নিয়ে ওঁর নানা খেয়াল, পরীক্ষা নিরীক্ষা, মৌমাছি পালন - এসব ছোট্ট অরুণা আর তার ছোট ভাই বসন্তকে ঘুরে ঘুরে দেখাতেন।
— ইশশ। কী মজা গো মা, আমি যদি ছোট্ট অরুণার বন্ধু হয়ে ঐ বাগানে ঘুরতে পারতাম!
— অবাস্তব কথা তো কল্পনা করে লাভ নেই বাবা! বাস্তবের মাটিতে হাঁটো।
— অবলা বসু এতো কিছু করেছেন মা, কিন্তু ঘরকন্নার কাজ, রান্নাবান্না এসব থেকে কি উনি পার পেয়েছেন? নাকি সবই করতে হয়েছে, সময় হত ওনার?
— লেখালেখি, চিঠিপত্র যা পাওয়া যায়, তাতে মনে তো হয় তিনি দুদিকই সামলেছেন। রবিঠাকুর তাঁর হাতের চমৎকার মাছের ঝোলের কথা লিখে গেছেন।
— তাহলে সেই তো মেয়েলি জীবনই হল মা!
— মেয়েলি জীবনকে মেয়েদের জন্য উপভোগ্য, সম্মাননীয় করে তোলার জন্যই যে ওঁর সংগ্রাম বাবু। নিজে সে জীবন না বাঁচলে, মেয়েদের দুঃখ বুঝতেন কী করে, আর দুঃখ দূরই বা করতেন কীকরে।
— সেটা ঠিক, আচ্ছা মা, অবলার তৈরি - এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন কী অবস্থা?
— ভালোই অবস্থা। বেঁচে আছে, কাজের মধ্যে দিয়ে জ্বলজ্বল করছে।
— সত্যি?
— হ্যাঁ, সব সত্যি। তুই কি এটা জানিস, যে ফেসবুকে আমি একজন অশীতিপর বন্ধু জুটিয়েছি, তাঁর সঙ্গে বেথুন কলেজের প্রাক্তনীদের প্রদর্শনী আনন্দমেলাতে কলেজ ছুটি নিয়ে গিয়ে দেখা করেছি। তিনি ঐ নারী শিক্ষা সমিতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত!
— মানে? কে বন্ধু? তুমি ফেসবুকে এইসব করছ? বন্ধুর নাম কী?
— রমা চট্টোপাধ্যায়। ফেসবুকে লেখালেখি, কমেন্ট করতে গিয়ে আলাপ। পরে কী জানতে পারলাম জানিস? উনি আবার সেন বাড়িতে শ্যামল মামার দাদা অ্যাটর্নী অমল সেনের স্ত্রী মানে কাজল মামীমার বাল্যবন্ধু। এই রমাদির বাবা বীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এ. বি. টি. এর সম্পাদক ছিলেন ১৯৫২ পর্যন্ত এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল হেড মাস্টার অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেছিলেন। প্রথম টেস্ট পেপার ছাপার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশে খুলনার দেবীপুর গ্রামে তাঁর বাড়ির পাশের রাস্তার মোড়টির নাম আজও “বীরেনবাবুর মোড়”।
— সেকি! এতো ভারী আশ্চর্যের কথা। তুমি কোথায় শুনলে? উনি বলেছেন?
— রমাদির অনেক বইয়ের মধ্যে একটার নাম “বীরেনবাবুর মোড়”। ঐ আনন্দমেলাতেই কিনলাম। সেখানে পড়েছি।
— ধন্য তুমি মা! আ—চ্ছা - আমাদের পরিবারের পূর্বপুরুষদের বাদ দিয়ে এমন কেউ আছেন, যিনি প্রত্যক্ষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন! আমাদের খুব কাছে, অথচ আমি জানিনা।
— হুম, আছেন তো।
— কে গো?
— তোদের গ্রামের বাড়ির লাগোয়া সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী কে বল দেখি।
— মণি দিদা, পুতুল দিদা।
— ঠিক। ঐ মণি পিসি, পুতুল পিসির মেসোমশাই ত্রিবিক্রম মাইতি ইংরেজের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন। পুতুল পিসিরা প্রতিবেশী, কিন্তু ত্রিবিক্রম তোর আত্মীয়। এই ত্রিবিক্রমের বিধবা স্ত্রীকে তুই দেখেছিস খুব ছোটবেলায়। মনে করার চেষ্টা কর। সাদা থান পরা খুব বৃদ্ধা একজন।
— উনি কি পুতুল দিদার মাটির দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে থাকতেন?
— ঠিক ঠিক।
— উনি মানে বাবা যাকে মামা বলে ডাকত? বলতো মামাকে প্রণাম কর।
— একদম ঠিক।
— কিন্তু মেয়েকে মামা কেন বলতো গো?
— আরে ওদিককার ভাষায় মামা মানে জেঠিমা। বিয়ের আগে তোর ঠাকুমা, ঠাকুরদার সঙ্গে যেদিন আমার প্রথম দেখা হয়, সেদিন ঐ মামা সঙ্গে ছিলেন।
— কিন্তু মা, পুতুল দিদা বাবার পিসি। পিসির মাসি তো বাবার দিদা হবে। দিদা কীকরে জেঠিমা হয়?
— হা হা, প্রতিবেশীর পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক হয়ে এরকম জট পাকিয়ে গেছে।
— মানে?
— মানে হল, তারিণীপ্রসাদের প্রতিবেশী ছিলেন জিতেন্দ্রনাথ দাস মহাপাত্র। তারিণী তাঁকে কাকা বলে ডাকতেন। এঁর স্ত্রী হলেন সরস্বতী। তোর ঠাকুমা আর ঠাকুরদা সরস্বতীকে ‘কোটি কুশমা’ মানে ছোট দিদা বলে ডাকতেন। এঁদের দুই মেয়ে — বড় শৈলবালা আর ছোট সুশীলাবালা। এঁরা দুজন তোর বাবা কাকার দিদা হলেন। এপর্যন্ত ঠিক আছে তো?
— হুম।
— এই শৈলবালার সঙ্গে বিয়ে হল কাঁজিয়া গ্রামের ত্রিবিক্রম মাইতির। এই ত্রিবিক্রম হলেন মোক্ষদার নিজের ভাইপো, মানে তারিণীর শ্যালক পুত্র, অর্থাৎ তোর ঠাকুরদা অমরেন্দ্রনাথের মামাতো দাদা।
— মানে বাবার জেঠু।
— ঠিক। জেঠুর বৌ শৈলবালা জেঠিমা। কিন্তু তাঁর বোন সুশীলাবালা "মেনাদি" মানে মেনা দিদা। বাপের বাড়ির দিক থেকে যিনি দিদা, তিনিই শ্বশুরবাড়ির সূত্রে হলেন মামা, মানে জেঠিমা। এবারে পরিষ্কার?
— জলের মত।
— মামা কিন্তু কলকাতায় প্রথম দেখায় আমার ভালো রকম ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন।
— যেমন?
— এই ভাত করতে পারি কিনা, ভাতে নুন কতটা লাগে?
— ভাতে নুন দেয়?
— আরে ওটা পরীক্ষা।
— ওরে বাপরে। খুব কড়া তো!
— ভীষণ শক্ত পোক্ত ছিলেন, শরীর মন দুদিক থেকেই। নিজে ফ্রিডম ফাইটার পেনশন পেতেন, তাতেই নিজেরটা নিজে চালিয়ে নিয়েছেন আজীবন। বালিকা বয়সে বিধবা, অনেক জ্বালা, কষ্ট সয়ে মনটা পাথর হয়ে গিয়েছিল। আসলে আজ সকাল থেকেই মামার কথা ভাবছিলাম জানিস!
— কেন?
— এই যে মাছটা দেখ, চিনিস?
— না তো, কী মাছ এটা?
— খুরুট মাছ, ভোলার দূর সম্পর্কের ভাই।
— মাছের নাম চুরুট? সমুদ্রের?
— আরে দুর, চুরুট নয় খুরুট। হ্যাঁ, সমুদ্রের। সুন্দরবনে নদী থেকেও ধরা পড়ে। জোয়ারের জলে নদীতে ঢুকে পড়ে।
— খেতে কেমন?
— দারুণ টেস্ট, খেয়ে দেখবি!
— এর সঙ্গে মামার কী সম্পর্ক?
— সম্পর্ক আছে। মামাই একদিন আমাকে জোর করে ওঁর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভাত খেতে বসিয়ে দিয়েছিলেন। আর ওঁর হাতেই আমি প্রথম খুরুট মাছের ঝাল আর কাবাব খাই।
— এই মাছে কা-বা-ব হয়?
— কাবাব মানে মাছ ভেজে ঘরোয়া দিশি কাবাব। মাছের মুখের ভিতরটা দেখ।
— এ কী, এগুলো কী?
— মুখের ভিতর দাঁত। এই মাছের দাঁত থাকে বলে অনেকে বলে দাঁতনে মাছ। তোদের বাড়ির দিকে বলে খুরুট।
— ইশশ, দাঁত-নে আর খুরুট দুটোই খুব বিচ্ছিরি নাম। আমি যে নামটা দিলাম - ওটাই চলবে, চুরুট মাছ।
— তাই হোক, স্বাদে পরিচয়, নামে কী? লোকজন শুনে অবাক হবে, মাছের নাম চুরুট।
— জানো মা, আমি একটা খরগোশ চিনি, তার নাম পাখি।
— কী যা তা বলছিস!
— সত্যি গো মা, বিশ্বাস কর। লকডাউনের আগে আমরা শেষ যেবার গ্রামে গেলাম, সেদিন দিদির ইস্কুল ছুটি পড়েনি বলে কাঁথির ফ্ল্যাটে ছিল, আমি বায়না করাতে কাকামণি আমাকে বাইকে করে কাঁথিতে রেখে এল না!
— হ্যাঁ, হ্যাঁ।
— সেদিন বিকেলবেলার কথা। বক্সি বাজারে কালীমন্দিরের বাঁক পেরিয়ে বেশ কিছুটা গেলে পঞ্চায়েত অফিস।
— ঠিক।
— ওখানে পঞ্চায়েতে মৌরসীপাট্টা কুকুরগুলো কাকামণির বাইকের আওয়াজ শুনে ঘৌ ঘৌ ভৌ ভৌ করে এল, তারমধ্যে ঘাড়কাটাও ছিল। ওদের দোকান থেকে বিস্কুট খাইয়ে, আমরা জঙ্গলের রাস্তা ধরলাম।
— বেশ।
— এবারে ডানে ঝোপঝাড়, বাঁদিকে আড়িয়া। রথতলার মাঠ, হীরাকোনিয়ার মাঠ পেরিয়ে কিছুটা গেলেই ডানদিকে কয়েকটা বাড়ি আছে।
— তুই তো দেখছি তেপান্তরের গল্প ফেঁদেছিস, খরগোশ কই?
— আরে শোনোই না। ঐ বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি, তখন হঠাৎ গেল গেল বলে চেঁচিয়ে উঠে, কাকামণি ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষল। হঠাৎ ঝাঁকুনি তো, প্রস্তুত ছিলাম না। তার মধ্যেই দেখলাম পড়িমরি করে লম্বকর্ণ একটা খরগোশ ঝুপ ঝুপ করে লাফিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। আর ডানদিকের বাড়ি থেকে আমার বয়সী একটা ছেলে একটা ছোট থালায় ভাত নিয়ে "পাখি পাখি! কোথায় গেলি" বলে শির ফুলিয়ে চেঁচাচ্ছে আর দৌড়চ্ছে।
— আর পাখি এই ঝোপ, সেই ঝোপ, সামনে পিছনে লুকোচুরি করেই যাচ্ছে। কিন্তু বেশি দূরে পালিয়ে যাচ্ছে না।
— তারপর?
— গাড়ি যাচ্ছে রাস্তায়, যদি চাপা পড়ে যায়, আমরাও চেষ্টা করছি পাখি ধরার।
— ইন্টারেস্টিং, শেষটা বল।
— শেষে একটা সামনের ঝোপের আড়ালে পাখি যেই গেছে, ছেলেটা একপাশ দিয়ে আর অন্যপাশে কাকামণি বুলেট দিয়ে ঘিরেছে। তখন ধরা পড়ে গেল। তাই বলছি, মাছের নাম দিলাম চুরুট, আর সেই ছেলেটা খরগোশের নাম দিয়েছে পাখি। এরকম আর ভূভারতে দুটি পাবেনা।
— অবশ্যই পাব।
— কীকরে?
— শীতকালে আজকাল বিশালাকার বেগুন ওঠে বাজারে, দেখেছিস? ওগুলোর নাম ডাব — ডাব বেগুন।
— হা হা হা, সে কী গো?
— আরও আছে। আমাদের আড়বালিয়ায় ডাবে যখন শাঁস একটু পেকে ওঠে, মানে চামচে খাওয়ার মত নরম নয়, আবার কোরার মত শক্তও নয়, মাঝামাঝি - তখন সেই শাঁস কে বলে রুটি। ঐ রকম ডাবকে বলে রুটি শাঁস ডাব।
— চমৎকার! ওমা, এইসব অদ্ভুত নাম দিয়ে মুখে মুখে ছড়া কাটবে?
— চল।
— শোনো মা,
মাছকে বলি চুরুট
আর খরগোসটা পাখি -
— চমকে গেল দুকান আমার,
থমকে গেল আঁখি।
— বেগুন হল ডাব আর ডাবে
শাঁসের নাম রুটি।
— ক্ষ্যামা দাও রে, থামাও এবার
লকডাউনের ছুটি।
— বাহ, হাইফাই দাও মা হাইফাই। হাত দুটো তোলো, ওরম না, আমার মত করে, এবারে আমার হাতে মারো, হাইফাই!