আবার পাকশালায় ফিরে আসি। আমি আমার নিজের মত রান্নার রুলবুক ঠিক করে নিয়েছিলাম। ঝোল আর ডালনা – দু’টোরই সাধারণ উপকরণ আলু। কিন্তু আলুর আকৃতি আলাদা। ঝোলের আলু লম্বা, ডালনার আলু ডুমো আলুর মত, কিন্তু তার চাইতে আকারে বড়। মানে, মাঝারি সাইজের আলু চার টুকরো করলে যেমন হয়, তেমন। দু’টোর ফোড়নও আলাদা। ডালনায় মা গোটা জিরে, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিত। তার পর সবজি ভেজে হলুদ, নুন, জিরে গুঁড়ো, কখনও গরম মশলা গুঁড়ো দিয়ে কষে জল দিয়ে ফোটাত। রান্না নামানোর আগে হিং মরিচ ফোড়ন দিত। আর আমার ধারণা মত, ডালনার নাম দম হয়ে যেত, যখন ডালনা উনুন থেকে নামিয়ে তাতে ভাজা মশলা গুঁড়ো মেশানো হত। তবে এঁচোড়ের ডালনা না করে যেদিন পাঁঠার মাংসের মতো রান্না হত, সেদিন এঁচোড়ের নাম হত গাছপাঁঠা। আমাদের ইস্কুলের হোস্টেলে আবার এঁচোড়ের একরকম মাখা মাখা তরকারি হত, ঝোল থাকত না। ছোট ছোট চৌকো টুকরো করে এঁচোড় কাটা হত, কিন্তু কোনো ফিতে অংশ থাকত না, আলুও না। কিভাবে করা হত, সেটা তো জানিনা, তবে দারচিনি আর ঘিয়ের গন্ধ পেতাম। আর মাঝে মাঝে সয়াবিন এলে, সেটাও মাংসের মতো রান্না হত। আমরা বলতাম সয়াবিনের মাংস। সয়াবিন যে সাধারণ ভাবে রান্না করা যায়, সেটা আমরা ছোটবেলায় জানতাম না।
ইস্কুলের পরীক্ষার সময় যখন অনেক খাতা-দেখা থাকত, বা মা খুব ক্লান্ত থাকত, তখন বেশি ঝামেলায় না গিয়ে, মা হয় কাঁচালঙ্কার তরকারি করত, নতুবা বড়ির ঝাল। পাঁচফোড়ন, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে ডুমো আলু ভালো করে হলুদ নুন দিয়ে কষে, জল দিয়ে ফুটিয়ে নিত। ঝোলে কয়েকটা আস্ত কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিত মা। তারপর হিং ফোড়ন দিয়ে, কাঁচা তেল ছড়িয়ে নামাত। আলু হাল্কা গলে যেত। একেবারে মাখামাখাও নয়, আবার বেশি ঝোলও থাকত না। কাঁচাসোনা রঙের সেই লঙ্কার গন্ধওলা গরম ঝোলটা যেন অমৃত লাগত খেতে। আর আলু বাড়ন্ত হলে, একই রেসিপিতে আলুর বদলে বড়ি দিলে হয়ে যেত বড়ির ঝাল। আর আলু, বড়ি দু’টোই দিলে, নাম হত বড়ির তরকারি। বেশি তো চাহিদা ছিল না আমাদের। সন্ধ্যে হলে ঘুম পেয়ে যেত। রাত্তিরে বাবা ঘুম থেকে তুলে খেতে বসিয়ে দিত। মা যেদিন আর রান্না করে উঠতে পারত না, সেদিন বাবা দুধভাত খাইয়ে দিত। সকালের তরকারির আলুর নোনতা টাকনা দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে দুধভাত খেতাম।
সকালে তেতোর পর্বও ছিল ষোলো আনা। পলতা পাতা ঝুরঝুরে করে ভেজে নুন দিয়ে ভাতে মেখে খেতে বেশ লাগত, কিন্তু উচ্ছে ভাজা খেতে চাইতাম না। আর করলাভাজা হলে তো নয়ই। মা তাই উচ্ছে ঝিরিঝিরি করে কেটে বেশ পাঁপড়ের মত ভাজত। কখনও ডুমো আলু দিয়ে উচ্ছে চচ্চড়ি করত। তবে নিম বেগুনটা একটু বেশি তেলে কচি লালচে নিমপাতা দিয়ে ভাজলে আমার ভালো লাগত। এখনও লাগে। কলেজের গাছে কচি নিমপাতা পাড়া হলে আমি আগে থেকে বলে রাখি, একটা আঁটি যেন আমার জন্য থাকে। এছাড়া হত শুক্তো। উচ্ছে, আলু, বেগুন, কাঁচকলা, গাজর, শিম, বিন – যখন যেমন সবজি বাড়িতে থাকে – সব দিয়েই শুক্তো করা যায়। পাঁচফোড়ন আর রাঁধুনি ফোড়ন দিয়ে শেষে নামানোর আগে কাঁচা আদাবাটা, কাঁচা দুধ দিয়ে দিত মা। তারপর একটু ঘি ছড়িয়ে, মিনিট দুয়েক ফুটিয়ে, নামিয়ে নিত। নিমপাতা ভেজেও শুক্তো হত। আমরা বেশি তেতো খেতে চাইতাম না বলে মা উচ্ছেভাজা অথবা নিমপাতা ভাজা রান্নার শেষের দিকে মেশাত আর অল্প মিষ্টি দিত।
অল্প মশলায় চচ্চড়ি বা সবজি রান্নাতেও মা সিদ্ধহস্ত ছিল। আর সবকিছু খুব চটপট একা হাতে সেরে ফেলত। আমি যখন ইউনিভার্সিটি পাশ করে ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্টে প্রোজেক্ট সায়েন্টিস্ট হলাম, তখন টিফিনে রুটির সঙ্গে লাউ-বড়ি বা নারকেল-কোরা দিয়ে চালকুমড়ো নিয়ে গেলে সহকর্মিণীরা হৈ হৈ করে খেয়ে নিত। মা পালংশাকের ঘন্ট আর লালশাক-ভাজাটাও দারুণ করত। সর্ষে ফোড়ন দিয়ে, নুন মিষ্টি সহযোগে, একটু কাঁচা পোস্ত ছড়িয়ে অথবা চিংড়ি দিয়ে লালশাক ভাজা এখন আমার কন্যা এবং কর্তা দুজনেই খুব পছন্দ করে।
আলু, বাঁধাকপি আর কড়াইশুঁটির চচ্চড়িটা মায়ের হাতে খুব খুলত। একবার মা আমাকে আর বোনকে বাঁধাকপি আর রুটি দিয়েছিল খেতে। বোন খেতে খেতে উঠে গিয়েছিল। আর আমি নিজেরটা গবগবিয়ে খেয়ে, বোনের প্লেট থেকে একটু বাঁধাকপি খেলাম। তারপর আর একটু খেলাম, আবার একটু – এই করতে করতে বোনের থালায় শুধু রুটি পড়ে রইল। বোন ফিরে এসে, পাতে তরকারি নেই দেখে, গগন ফাটিয়ে কান্না শুরু করল। মানে গগন ফেটেছিল কিনা ঠিক দেখিনি, তবে আমাদের ঘরটা কাঁপছিল। মা বিশ্বাস করতে পারেনি, ভোলাভালা আমি বোনের বাঁধাকপি খেয়ে নিয়েছি। আর হাওয়া গরম দেখে ভয়ে আমিও স্বীকার করতে পারিনি। মা যত বোনকে বোঝায়, তুমি খেয়ে গেছ, সে কিছুতেই মানে না আর ছোট তো, গুছিয়ে মাকে বোঝাতেও পারেনা, শুধু চেঁচায়। শেষে মা আবার তার পাতে বাঁধাকপি দিতে সে চুপ করল।
মা মাছের মুড়ো খেতে খুব ভালোবাসত। তাই বাবা সবসময় মাথাসমেত গোটা পোনা মাছ কিনত। মুড়োর ডাল, মুড়ি ঘন্ট, আলু দিয়ে কানকোর তরকারি – এইসব মা দারুণ করত। শীতকালে মা করত বিট ভাজা। ঝিরিঝিরি করে বিট কেটে, নুন মিষ্টি দিয়ে ভেজে, তাতে পোস্ত ছড়িয়ে দিত, আর পাতিলেবুর রস ছড়িয়ে দিত। টক-মিষ্টি-মুচমুচে বিটভাজা বেশ খেতে। কচি ঢেঁড়শ দিয়ে আর একটা খুব সাধারণ রেসিপি ছিল, ওটা বাবা খেতে ভালোবাসত, আর এখন করলে, মেয়ে পারলে প্রায় পুরোটাই খেয়ে নেয়। ঢেঁড়সগুলোর মুখ কেটে, কড়ায় অল্প জলে মা সেদ্ধ বসাত। ঐ জলে নুন আর এক টিপ হলুদ দিয়ে দিত। ঢেঁড়স নরম হলে জল ফেলা হত না। ঢেঁড়সের ক্বাথ মিশে একটা বেশ সবজেটে পিচ্ছিল কাই তৈরি হত। আলাদা কড়ায় এক চামচ সর্ষের তেলে হিং আর মরিচগুঁড়ো ফোড়ন দিয়ে ঢেঁড়সের ওপরে ঢেলে ঢাকা দিয়ে দু’মিনিট ফোটাত মা। তারপর লেবুর রস ছড়িয়ে নামিয়ে দিত।
বাবা পেঁপে খেতে ভালোবাসত বলে, মাঝেমধ্যেই গোটা সর্ষে-ফোড়ন দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি পেঁপে ছেঁচকি করত। আর বাবা তো খুব ভোরবেলায় বাজার যেত, তখন আমরা সবসময়ে ঘুম থেকে উঠতাম না। টাটকা পেঁপের বোঁটা থেকে আঠা ঝরত, সেই আঠা চামচে কাচিয়ে বাতাসায় দিয়ে মা বিছানায় এসে আমাদের মুখে পুরে দিত। বলত, পেঁপের আঠায় নাকি লিভার ভালো হয়। সত্যি ভালো হয় কিনা জানি না, তবে ভোরবেলার সেই অদ্ভুত স্বাদ মনে করতে ভারি ভালো লাগে।
ডাল রান্নায় মায়ের একটা বেশ হাতযশ ছিল। তখনকার দিনে বাড়িতে ফোনও ছিল না, আর আত্মীয়-স্বজনের জানিয়ে আসার বালাই ছিল না। বেলা-অবেলায় যখন তখন বাড়িতে আত্মীয় বন্ধু এসে পড়ত। আর মা রান্না করতে বসত। কিন্তু তারা খোঁজ নিত, ডাল করেছ তো? সপ্তাহের সাত দিন মা সাত রকম ডাল করত। ডাল রিপিট হত না। ভাজা মুগ, কাঁচা মুগ, মুগ মুসুর মিশিয়ে বা শুধু মুসুর ডাল – এইভাবে হত। সর্ষের তেলে ফোড়নে কখনও জিরে, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা, কখনও পাঁচফোড়ন কাঁচালঙ্কা, কখনও বা গোটা সর্ষে, কারিপাতা ফোড়ন, অথবা ঘিয়ে পেঁয়াজ ফোড়ন, নতুবা রসুন ফোড়ন দিয়ে মা ডাল করত। উচ্ছে দিয়ে তেতোর ডাল, কাঁচা আম বা আমড়া দিয়ে টক ডাল, নানারকম সবজি দিয়ে ডাল, ঢেঁড়সের ডাল, মুলোর ডাল ইত্যাদি নানারকম ডাল করত মা। তবে ডালে মা মিষ্টি দিত। তাই আমিও দিই। তবে মধুমেহর জন্য চিনি দিতে পারি না আজকাল। আখের গুড়ের গুঁড়ো, স্টিভিয়া গুঁড়ো, বাজারি সুগার-ফ্রি – সবই রেখেছি পাকশালায়। যখন যেমন, তখন তেমন ব্যবহার করি। যেদিন মা বিউলির ডাল আর আলুভাতে করত, সেদিন ওটা দিয়েই প্রায় সব ভাত খাওয়া হয়ে যেত। শিলে মা বেশ খানিকটা, বলা যেতে পারে – তাল খানিক কাঁচা মৌরি আর আদা বাটত। সেই গন্ধে বাড়ি ম ম করত। সবাই বুঝে যেতাম, আজ বিউলির ডাল হবে। মৌরি আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে আগে থেকে সেদ্ধ করা ডালটা জলসমেত কড়ায় ঢেলে দিত মা। এই ডালে কিন্তু মিষ্টি পড়ত না। ডাল ফুটে উঠলে, শেষের দিকে ঐ পুরো আদা মৌরি বাটাটা কড়ায় দিয়ে দিত। তারপর মিনিট তিন-চার ফুটিয়ে নামিয়ে নিত। ডালে মা হলুদ দিত না, তাই আমিও দিইনা।
আমাদের গ্রামের বাড়ি বসিরহাটের আড়বালিয়ায়। সেখানে একরকম ছোটো দানা লালচে কমলা রঙের পাতলা পাতলা ভাঙা মুসুর ডাল পাওয়া যেত। দোকানে বলত, মারুতি-ভাঙা ডাল। ঐ ডালে মা ফোড়ন না দিয়ে, শুধু ডালসেদ্ধ করত। কাঁচা ডালে জল দিয়ে, তাতে কাঁচা সর্ষের তেল, নুন, মিষ্টি, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে বসিয়ে দিত। সে ডালে কি যে ছিল! ঐ সেদ্ধ ডাল যেন অমৃত লাগত খেতে। আমার বিয়ের পরেও কিছু বছর আড়বেলেতে ঐ ডাল পেয়েছি। আমার কর্তাও ঐ ডালসেদ্ধর প্রেমে মজেছিলেন। কিন্তু এখন আর পাই না। আর মাঝে মাঝে মা রাতে সাদা কাপড়ে ডাল বেঁধে ফুটন্ত ভাতের হাঁড়িতে ফেলে দিত। তারপর সেই টাইট ডালের বল কাঁচা সর্ষের তেল আর নুন দিয়ে মাখা হত। বেশ খেতে লাগত।
যতদিন আমাদের উনুনে রান্না হত, মাকে দেখতাম কড়া থেকে পাত্রে তরকারি ঢালার সময়ে খুন্তি দিয়ে উনুনের আঁচে তরকারির ছিটে দিত। জিজ্ঞেস করলে বলত, উনুন তো আমাদের খেতে দেয়, তাই উনুনকেও খেতে দিতে হয়। এটা হল অগ্নিদেবকে সম্মান জানানোর প্রথা। তবে বাড়িতে কুকিং গ্যাস আসার পর এই প্রথার অবলুপ্তি ঘটল।
হিট আইটেম
রান্নার গল্পই যদি বলতে বসেছি, তবে স্পেশাল আইটেম খাসির মাংসের কথা তো বলতেই হয়। মাছ যেমন কলের তলায় খুব ভালো করে ধোওয়া হত, মাংস কিন্তু ওভাবে মোটেই ধোওয়া হত না। মা বলত,
মাছ ধুলে মিঠে
মাংস ধুলে সিঠে।
যদি দেখে মনে হয় মাংস ধুতে হবে, তবে জল গরম করে ঢেলে দিতে হবে। মোদ্দা কথা হল, শুরু থেকে শেষ, খাসির মাংস রান্নার কোনো পর্বেই ঠান্ডা জলের স্পর্শ চলবে না। মা যখন রান্না করত, তখন, পেঁয়াজবাটা, আদাবাটা, রসুনবাটা, দই, হলুদ গুঁড়ো, সর্ষের তেল, লঙ্কাবাটা সবকিছু মাংসে মেখে নিয়ে ঘন্টা দু’-তিন রেখে দিত। তারপর কষতে শুরু করত। মাংসে বড় বড় পিস আলু দেওয়া হত। মা পাতলা ঝোলটাই বেশি করত। আর বাবার রান্নার পদ্ধতি ছিল আলাদা। বাবা মাংসে আলু দিত না। আমরা খুব চেঁচামেচি করলে, মাংস নামানোর আগে ওপর থেকে লম্বা মুচমুচে আলুভাজা করে ছড়িয়ে দিত। বাবা মাংসটা শুধু সর্ষের তেল, হলুদ, দই, একটু পাতিলেবুর রস আর লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে ম্যারিনেট করত। বাকি মশলা কড়ায় কষত। বাবার অফিস কলকাতার ডালহৌসিতে ছিল। অফিসপাড়ায় অজস্র স্ট্রিট-ফুডের দোকান থেকে বাবা নানারকম আইডিয়া নিয়ে আসত, আর মাংস রান্নায় নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করত। বাবাই প্রথম বাড়িতে মাটন দো-পেঁয়াজা রান্না করেছিল। ঐ অফিসপাড়া থেকেই বাবা বিরিয়ানি রান্না শিখেছিল, আর খুব সহজ উপায়ে আমাকে বিরিয়ানি রান্না শিখিয়ে দিয়েছিল। মাংসটা বাবা প্রথমে আগের বলা উপায়ে ম্যারিনেট করত, আর তার সঙ্গে আদা-রসুন বাটাটাও মিশিয়ে দিত। মাংস যতক্ষণে ম্যারিনেট হচ্ছে, সেই সময় বড় বড় আলুর টুকরো নুন হলুদ মাখিয়ে ভেজে নিত। যতজন খাবে, ততগুলো ডিম সেদ্ধ করে নিত। ইচ্ছে হলে কেউ ডিমটাও নুন হলুদ, কাশ্মীরি লঙ্কা গুঁড়ো মাখিয়ে নেড়ে নিতে পারে। দেখতে সুন্দর লাগবে। এবারে ভাতটা রেডি করার পালা। একটা ডেকচিতে ফুটন্ত জলে লম্বা কাঁটার মতো বাসমতী চাল দিয়ে দিতে হবে। তবে বেশি তরিবত চাইলে আখনির জলে চাল ফোটানো যেতে পারে। আখনির জল মানে গরম মশলার ফ্লেভার-ওলা জল। একটা পরিষ্কার কাপড়ে বেশ খানিকটা গরম মশলা বেঁধে, জলে ফেলে, ঢিমে আঁচে ঢাকা দিয়ে ফোটাতে হবে। যদি কারোর কাছে টি-পটে চা ভেজানোর জন্য চেন দিয়ে ঝোলানো ঢাকা ছাঁকনি থাকে, তার মধ্যে গরমমশলা দিয়ে ফোটানো যেতে পারে। জল ধীরে ধীরে লালচে হয়ে আসবে। জল থেকে দারুণ গরমমশলার ফ্লেভার পাওয়া যাবে। আশপাশের বাড়িতেও সে গন্ধ ঢুকবে। সেই জলে চাল দিয়ে ভাত করতে হবে। তবে খুব সতর্ক থাকতে হবে। অন্য কাজে মেতে গেলে চলবে না। বাসমতী চাল পুরো সেদ্ধ হবার আগে একটু শক্ত অবস্থায় নামাতে হবে। বেশি সময় লাগে না। ফ্যান গালার আগে দু’হাতা ফ্যান একটা বাটিতে তুলে রাখতে হবে। পরে কাজে লাগবে। আমি অবশ্য বাসমতী চালের এই ফ্যান এক ফোঁটাও নষ্ট করি না। ফ্রিজে রেখে দিই। পরে এই ফ্যান দিয়ে মেয়েকে স্যুপ বানিয়ে দিই। দারুণ হয়। এবারে ভাতটা থালায় রেখে পাখা চালিয়ে একটু শুকোতে দিতে হয়। এইসব করতে করতে মাংস ম্যারিনেট হয়ে গেছে। মাংসটা এক্ষেত্রে রেওয়াজি হতে হবে, নইলে তুলতুলে হবে না। এবারে, একটা বড় সাইজের প্রেশার কুকারে প্রথমে সাদা তেল আর ঘি দিত বাবা। তাতে গরম মশলা থেঁতো ফোড়ন দিয়ে ভালো করে ভাজা ভাজা করে গন্ধ উঠলে, তাতে ম্যারিনেট করা মাংস দিয়ে হাল্কা কষে বাবা প্রেশারে সিটি দিয়ে মাংস গলিয়ে নিত। এবারে বিরিয়ানি সাজানোর পালা। নিচে মাংস তো প্রেশার কুকারে আছেই। তার ওপরে একস্তর ভাত, একটু ঘি, কয়েকটা আলু আর ডিম দিতে হবে। আর গুঁড়ো মশলা ছড়াতে হবে, এক দু’ ফোঁটা করে জাফরানের জল দিতে হবে। এই গুঁড়ো মশলা আগে থেকে করে রাখতে হবে। শা’ জিরে, শা’ মরিচ, জায়ফল, জয়িত্রী, কাবাব-চিনি শুকনো তাওয়ায় নেড়ে গুঁড়িয়ে রাখতে হবে। আর একটা বাটিতে জাফরান কয়েক দানা ভিজিয়ে রাখতে হবে। আমরা কোনোদিন দোকানের রেডিমেড বিরিয়ানি মশলা ব্যবহার করিনি আর গোলাপজল বা ক্যাওড়ার জল কখনও দিইনি। বাবা পছন্দ করত না। এখন আমার কর্তাও পছন্দ করে না। যাই হোক, এইভাবে স্তরে স্তরে সব কিছু সাজিয়ে, ওপর থেকে ঐ দু’ হাতা ফ্যান ভাতে দিয়ে দিত বাবা। এবারে প্রেসার কুকারের ঢাকা বন্ধ করে আঁচ কমিয়ে পুরো জিনিসটা দমে বসিয়ে রাখতে হবে। মিনিট দশেক যথেষ্ট। এবারে আঁচ থেকে প্রেশার কুকার নামানোর পরে আর একটা কৌশল আছে। আমার তো অত গায়ের জোর নেই। যারা হাঁড়িতে বা ডেকচিতে বিরিয়ানি করে, তাদের গরম পাত্রটা তুলে ধরে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে মাংস মেশাতে হয়। বিয়ের আগে খাওয়াটাই মুখ্য ছিল, কিভাবে কি হচ্ছে, অত কিছু তো দেখতাম না। বিয়ের পর আমি বাবাকে বলেছিলাম, কি করে করব, আমি তো পারব না বাবা। বাবা বলেছিল, তোকে এমন কৌশল শিখিয়ে দেব, যে খুব ভালোভাবে পারবি। শুধু একটা বড় সাইজের প্রেশার কুকারে রান্না করবি, হাঁড়িতে বা ডেকচিতে নয়। দরকার হলে, মানে একবারে না ধরলে দমটা দু’ বারে দিবি। সেই কৌশলটাই এখন বলছি। দমে বসানো প্রেশার কুকার আঁচ থেকে নামিয়ে ভাপ বের করা যাবে না। প্রেশার কুকারটা উল্টে দিয়ে কিছুক্ষণ রাখতে হবে। এতে নিচের মাংসের ঝোল আর টুকরো ওপরদিকে উঠে আসবে। কিন্তু এই ওল্টানোটা দু’দিকে দু’বার হবে, যোগ চিহ্নের মত। প্রথম অভিমুখটা হল, একবার ডান হাতে হাতল আর বাঁহাতে সাপোর্ট ধরে ফরোয়ার্ড - ব্যাকোয়ার্ডে রোল করে উল্টে রাখতে হবে, আর মিনিট তিন-চার পরে একবার হাতলের দিক দিয়ে সাইড-ওয়ার্ড ওল্টাতে হবে। এবারও কয়েক মিনিট ওভাবে রেখে, তারপর সোজা করে রাখলে, বিরিয়ানি পরিবেশনের জন্য রেডি হয়ে যাবে।
আমার মা মাখনে গোটা গোলমরিচ, তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে মাটন স্টু আর ভেজিটেবল স্টু খুব ভালো করত। একটু ধনে গুঁড়ো দিত। সামান্য উপকরণে কিভাবে যে অমন স্বাদ হত, কি জানি? আমার মেয়ে খুব ছোট বয়সে খেলেও, এখনো তার দিদার স্টুয়ের কথা মনে আছে। তখন মাংস বলতে পাঁঠার মাংসই আমরা জানতাম। মুরগি খাওয়ার চল ছিল না। মাঝে মাঝে বিবেকানন্দের বাড়ির পাশে, চাচার দোকানে, আমরা দেবভোগ্য মাটন শিক কাবাব খেতে যেতাম। আজ ঐ দোকান রাস্তার উল্টোদিকে চলে গেছে। ছোটবেলার স্বাদেরও ভরাডুবি হয়েছে।