২
“তোমারে পাছে সহজে বুঝি
তাই কি এত লীলার ছল –
বাহিরে যবে হাসির ছটা
ভিতরে থাকে আঁখির জল।”
আলোচনাটা তখনকার মতো এখানেই ইতি টানতে হল। কারণ নিচে একটা হৈ হৈ রৈ রৈ রব উঠল। আর “রঞ্জা, কর্ণা কইরে, ও বৌদি দেখে যাও। ছাদ থেকে নেমে এসো” - এইসব ডাক শোনা যাচ্ছিল। এখানকার লোকে দোতলাকে বলে ছাদ। কী না কী হল, দেখতে আমরা ছাদ থুড়ি দোতলা থেকে দুদ্দাড় করে নেমে এলাম। নেমে দেখি ভগবান আজ খুবই সদয়, দু'খানা বেশ বড় সাইজের রুই মাছ ধরা পড়েছে সদর পুকুর থেকে। দুটোই কেজি তিনেক করে হবে। জাল থেকে ছাড়িয়ে বালতিতে রাখা হয়েছে। মাছ দুটো দমে গেছে বটে এখনও মাঝে মাঝে লেজের ঝাপটা দিচ্ছে। কর্তা আত্মহারা। এবারে গ্রামের বাড়িতে এসে আজ এতবড়ো সাফল্য মিললো। আর বাকি সবাই খুব খুশি, কারণ রোজ নোনা মাছের টক হয়, আজ রয়্যাল রুই মাছের টক হবে।
মেদিনীপুরের কুয়োয় কলকাতার ব্যাঙ ঢুকলে তার অবস্থা বোধহয় খুব সুবিধের হয়না। অন্তত আমার হচ্ছিলনা। ঝকঝকে টাটকা রুই দেখে আমার চোখে বড় বড় আলুর টুকরো দিয়ে মাছের কালিয়া, পোস্ত, ধনেপাতা, কাঁচালঙ্কা দিয়ে রুই মাছের ঝাল, দইমাছ - এইসব ভাসছিল। দিবাস্বপ্নে রান্নাগুলোর সুবাস ভেসে আসছিল। তরকারি ভরা বাটিগুলো নেচে নেচে এসে ঘুরপাক খেতে খেতে মিলিয়ে যাচ্ছিল। টক এখন খেতে শিখেছি বটে, কিন্তু শেষ পাতে চাটনির মতো চেটে খাই। টক দিয়ে টকটক করে পুরো ভাত মারার ক্ষমতা আমার এখনও জন্মায়নি। এ জীবনে জন্মাবে বলে মনে হয়না। আর আমি হওয়াতে চাইওনা। আমি এখানে সংখ্যালঘু। আর সেই সেন্টিমেন্টেই প্রাণপণ টকের পায়ে মাথা না নোয়ানোর চেষ্টা করি, মানে নিজের আইডেন্টিটি বজায় রাখার চেষ্টা করি।
বাকিদের হঠাৎ নজর পড়লো আমার দিকে। কেউ একজন হয়তো দয়া পরবশ হয়ে জিজ্ঞেস করলো, বৌদি কী খাবে দেখো। কিন্তু একার জন্য রান্না করাটা বিড়ম্বনা। আমি মেয়েদের দিকে তাকাই। মেয়েরা সমস্বরে বলে ওঠে
- আমরা খাবো সেন বাড়ির ঝোল।
শুনে চমকে যাই,
- মানে?
- মানে আবার কি মা! সেই লম্বা করে আলু আর পটল, নইলে বেগুন, নইলে কাঁচকলা দিয়ে জিরে ধনের পাতলা ঝোল।
- ঐ ঝোলের কি ব্র্যান্ড নেম হয়ে গেল, সেনবাড়ির ঝোল?
- হ্যাঁ হ্যাঁ ব্র্যান্ডনেম। আমাদের তিনজনের ঐ রকম ঝোল করবে মা।
- আচ্ছা জেঠিমা, জিরে ধনের পাতলা ঝোলে তো তেল একদিকে জল একদিকে হয়না। কিন্তু রান্নাঘরের পিসিরা যে পেঁয়াজ ঘ্যাঁটের মাছের ঝোল করে, তার জল তেল আলাদা ঘোরে কেন?
- না না, ব্যাপারটা সেরকম নয়। ওরা মাছের টক ভালোবাসে, ওটা রোজ করতে করতে চোখ বুজে ঠিক ঠাক করে ফেলে। আর এখানে কালিয়া, ঝোল, ঝাল, ডালনা, দম - এইসব পার্থক্যের ধারণা নেই। আর মাছের ঝোল যেটাকে বলে, তাতে সর্ষের তেলে পেঁয়াজ বাটা দিয়ে কষে হলুদ, নুন, লঙ্কা, জিরে গুঁড়ো দিয়ে জল ঢেলে দেয়। ঐ গ্রেভিতে ভাজা মাছ ফেলে ফুটিয়ে নেয়।
- কোনো সব্জি নেই।
- হ্যাঁ, এরকম ঝোলে ওরা সব্জি দেয়না, টকে সব্জি দেয়। আমরা যেভাবে মাছের ঝাল করি টকের রেসিপিটা তার সঙ্গে মেলে। আমরা আবার মাছের ঝালে সব্জি দিইনা।
- আচ্ছা পেঁয়াজ ঘ্যাঁটে জিরের কথা বললে, ধনে দেবেনা।
- না এদিকে ধনে তেমন ব্যবহার হয়না, বা এবাড়িতে যারা রান্না করে, তারা ধনের ব্যবহার জানেনা।
- কিন্তু আমি জানতে চাই, এখানকার পেঁয়াজ দেওয়া মাছের ঝোলে তেল জল আলাদা লাগে কেন?
- সেটা রেসিপির দোষ নয়। আমরা কুচো পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করি, শহরে অতো বাটাবাটি করবে কে? এখানে এরা পেঁয়াজ বাটা দিয়ে রান্না করে। কিন্তু অনেক লোকের রান্না তো, বেগার ঠেলা যেমন তেমন করে দেয়। পেঁয়াজ বাটা আর বাকি মশলা ভালো করে কষেনা। কোনো সব্জির ক্বাথও সঙ্গে মিশছেনা। কাঁচা মশলায় জল ঢেলে দেয় বলে অমন লাগে। হোটেলে দেখবি এই ধরণের রেসিপিতে মাছ রান্না হয়। কিন্তু মশলা কষা থাকে বলে ভালোই লাগে।
- সেনবাড়ির ঝোল আর মাছের ঝালের তফাৎটা কি?
- তফাতের বদলে তুলনা বলছি।
১। দুটোতেই তেলে পাঁচফোড়ন আর লঙ্কা ফোড়ন পড়ে। কাঁচা লঙ্কা অথবা শুকনো লঙ্কা - আপরুচি খানা। মা কাঁচা লঙ্কা দিত, আমিও তাই।
২। ঝোলে নানারকম সব্জি দেওয়া যাবে। কিন্তু ঝালে সেটা হয়না। ঝালে আমার মা মাঝে মাঝে আলু বা বেগুন, অথবা শীতের সময়ে পেঁয়াজ কলি বা কচি শিম ভেজে দিতো, যেকোনো একরকম।
৩। আজকাল সারাবছর টমেটো পাওয়া যায় বলে, দুটোতেই টমেটো দেওয়ার চল হয়েছে। আমাদের ছোটবেলায় টমেটোর এত ব্যবহার ছিলনা।
৪। হলুদ দুটোতেই কমন।
৫। ঝোল বা ঝাল হবে নোনতা স্বাদের। কোনো মিষ্টি পড়বেনা।
৬। ঝোলের মশলা হচ্ছে প্রধানত ধনে; জিরে দিলে খুব অল্প, মা জিরে দিতনা। ডালনা বা দমে জিরে হল প্রধান, কিন্তু ঝোলে নয়। বেগুন দিয়ে ঝোল হলে হাল্কা সর্ষে ধোওয়া জল দেওয়া যাবে।
ঝালে শুধু হলুদ লঙ্কা দিলেও স্বাদ হবে। আবার সর্ষেবাটা বা পোস্তবাটা দিয়ে ঘন করলেও চলবে, দুরকম বাটা মিশিয়েও দেওয়া যাবে। কিন্তু কোনোভাবেই ধনে জিরে পড়বেনা।
- আচ্ছা, বুঝলাম।
রান্না চান, খাওয়া সব করতে বেলা গড়ায়। আমাদের উঠোনে ঢোকার মুখে বাঁ ধারে গোয়াল, আর ডান পাশে আছে এক জোড়া দেবদারু গাছ, কবেকার কে জানে। তাদের মোটা মোটা গুঁড়ি, আকাশ ছোঁয়া শিষ আর চিকন চিকন পাতা। জোড়ার মধ্যে বামের গাছটি মাথায় সামান্য খাটো। ওরা আমাদের অনেক পূর্বপুরুষকে দেখেছে। তাই বাড়িতে ওদের শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। সবাই ডাকে রাধাকৃষ্ণ। সূর্য যত ঢলতে থাকে রাধাকৃষ্ণের মাথার দিকের পাতাগুলি কমলা রোদে চিকমিক করে, আর তলার দিকটা ছায়া ছায়া হয়। আমি দুই মেয়ে নিয়ে হাঁটতে বেরোই। নীল আকাশের নিচে ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে বালিয়াড়ি ঢাকা রাস্তা ঢেউ তুলে দিগন্তে মিশে যায়।
কর্ণা বলে, জেঠিমা সেই যেখানে থেমেছিলে, তারপর বল।
- এভাবে রাস্তায় হবেনা। কোথাও একটা বসতে হবে।
- ঐ পুকুর পাড়ে চলো মা। শান বাঁধানো আছে।
- চল। পিঁপড়ে দেখে বসবি। যেটুকু জানা গেল, তাতে তো আমার প্রশ্নের উত্তর হলনা। প্রথমজন আমার পূর্বপুরুষ নন। কিন্তু দ্বিতীয় জনের পরিচয়টা কি? খুঁজতে খুঁজতে এবারে কুমুদিনী বসুর "মেরী কারপেনটার" নামে একটা বই পেলাম। কিন্তু বইয়ের ভিতরে লেখিকার নাম কুমুদিনী মিত্র বি. এ.।
বইটির ভূমিকা লিখেছেন স্বনামধন্য শিবনাথ শাস্ত্রী। এবং শেষেও সেযুগের বিখ্যাত মানুষদের লেখা রিভিউ ছাপা আছে। তার প্রথমটাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা। রবীন্দ্রনাথের লেখায় বোঝা যাচ্ছে যে এই লেখিকাই কিছুকাল আগে শিখের বলিদান বলে আর একটি শিশু পাঠ্য বই রচনা করেছেন, তা তিনি জানেন এবং দুটি বইয়েরই প্রশংসা করছেন। আরও আটখানি রিভিউ লিখেছেন যথাক্রমে -
The Indian Social Reformer, Bombay, 15th July, 1906, শ্রী গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, বামাবোধিনী পত্রিকা, প্রবাসী, Amrita Bazar Patrika, ED. C. Woodley, Principal, L.M.S College, Bhowanipur, Florence Sypett, Superintendent, London Mission Christian Girls' School, Bhawanipur এবং বাবু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।
- বলো কি গো মা? আমি কত রাতে উঠে তোমায় জিজ্ঞেস করেছি কী করছো? তখন তো কিছু বলোনি।
- কী বলবো? তখন আমি ঘোরের মধ্যে থাকতাম।
অমৃত বাজার পত্রিকা এবং সুরেন ব্যানার্জীর দীর্ঘ রিভিউ থেকে জানা যাচ্ছে যে লেখিকা সঞ্জীবনী পত্রিকার সম্পাদক ও দেশপ্রেমিক কৃষ্ণ কুমার মিত্রের মেয়ে। ভালো কথা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই কুমুদিনী মিত্র আর আমার মায়ের ঠাকুমা কি একই ব্যক্তি? গুগল বলছে, যিনি মিত্র তিনিই বসু।
- আচ্ছা, দ্বিতীয় কুমুদিনী তবে লীলাবতীর মেয়ে। তারপর?
- এবারে অন্তর্জালে আর একটা বই খুঁজে পেলাম - সাহিত্যে নারী: স্রষ্ট্রী ও সৃষ্টি, লিখেছেন অনুরূপা দেবী। সেখানে অনুরূপা দেবী, কুমুদিনী বসুর লেখা দুটি বইয়ের উল্লেখ করেছেন, পূজার ফুল ও শিশু পাঠ্য শিখের বলিদান। গুগলে দেখছি অনুরূপা দেবী (১৮৮২ - ১৯৫৮) কুমুদিনীর সমসাময়িক। তাহলে তিনি নিশ্চিত হয়েই লিখে থাকবেন।
এখন যুক্তি সাজালাম -
১। পূজার ফুল আমার কাছে আছে। মায়ের ঠাকুমা কুমুদিনীর লেখা।
২। অনুরূপা দেবী বলছেন পূজার ফুল এবং শিখের বলিদান একজনের লেখা।
৩। মেরী কার্পেন্টার বইয়ের শেষে ছাপা রিভিউতে দেখছি এই লেখিকাই শিখের বলিদান লিখেছেন এবং তিনি কৃষ্ণকুমারের মেয়ে।
এবারে নিশ্চয়ই বলা যেতে পারে, আমার কুমুদিনী লীলাবতীর মেয়ে। এবং রঞ্জাবতী তাঁর ছয় প্রজন্মের পরের উত্তর পুরুষ।
দুই মেয়ে হাততালি দিয়ে ওঠে।
- কিন্তু এখানে একটু গোলমাল আছে। শিখের বলিদান প্রকাশিত হয়েছে ১৯০৬ সালে। অনুরূপা দেবী সে বইকে ১৯২৫ এর সময়সীমাতে কেন ফেলবেন। উনিও ভুল করেননি তো?
- একটা কথা আছে জেঠিমা। কুমুদিনীর অন্য বইগুলো তোমার কাছে নেই কেন?
- আমার দাদুর উড়নচন্ডীপনার জন্য মামার বাড়ির পরিবার খুব গরীব হয়ে যায়। কুমুদিনীর লেখা দুটি মাত্র বই পূজার ফুল ও বোঝবার ভুল আমার মা আমাকে দিয়ে যেতে পেরেছেন। ঐ বই দুটি আমার জ্ঞাতিদের বাড়িতেও আছে। সেনবাড়িতেও আছে। এবং মা বলে গিয়েছেন, ওনার লেখা ছাপা হয়েছে এমন আরও বই বাড়িতে ছিল, গাঁটরি গাঁটরি পত্রিকা ছিল, পুরষ্কার ছিল। উনি নাকি সাহিত্য সরস্বতী উপাধি পেয়েছিলেন। তাছাড়া খবরের কাগজের কাটিং ছিল। কিন্তু দারিদ্র্যের জন্য পরিবার তার দাম দিতে পারেনি। বাড়িতে বেশিরভাগ সব উইয়ে কেটে নষ্ট করেছে। ইতিহাস নষ্ট হয়ে গেছে।
- ইশশ, গ্রেট লস জেঠিমা, গ্রেট লস।
- ভগবানকে ধন্যবাদ দাও মা, তাও কিছুটা তো জানা গেছে।
- হ্যাঁ রে, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক স্মৃতি হারালেও সামাজিক স্মৃতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিয়েছে। তবে তোরা একটা ভুল করছিস। এখনও কিন্তু সব সমস্যা মেটেনি।
- আবার কিসের সংশয়?
- আছে। অনেক কিছু আছে।
- বলো তাড়াতাড়ি।
- এখন আর নয়। অন্ধকার নেমে আসছে। বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি আমরা। গল্প আবার পরে হবে।
- সূর্য এখন দিগন্তের নিচে, সাত ঘোড়ার রথে করে পৃথিবীর অন্য কোনায় ফুটিয়ে তুলছেন ভোরের আলো। আকাশে তবু একটা মরা আলোর আভাস। সেই আলোয় কুমুদিনীর উত্তরসূরীরা চিনে নেয় নীড়ে ফেরার পথ।
“তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে –
বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে।
কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি
আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে?”