৪
“... যদি
ঢেউয়ের মত ফুলতে পারো
খুশির দোলায় দুলতে পারো
হৃদয় দুয়ার খুলতে পারো
আশার আবির গুলতে পারো
দ্বন্দ্ব বিভেদ ভুলতে পারো
তৃপ্ত-তুফান তুলতে পারো তবে
সুখের স্বর্গ নামবে দুখের ভবে!”
আজ এ’বাড়িতে আর দুপুরের রান্নার ঝামেলা নেই। কারণ সাতসকালেই তল্পিতল্পা গুছিয়ে চললাম মেজ ননদের বাড়ি বেলদায়। বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন। ননদের ছোটছেলের বিয়ে। মেয়েরা তো মহা উৎসাহে ঢাউস ব্যাগ গুছিয়ে চলেছে। আমরা বড়রাও অবশ্য কম কিছু নিইনি। একেবারে বৌভাত কাটিয়ে ফিরব।
বিয়েবাড়ি সারাদিন তো আনন্দেই কাটল। বিকেল পেরোনোর আগেই আমরা তো সাজনগোজন শুরু করে দিলাম, বরযাত্রী যেতে হবে। বাসে করে যাব একসঙ্গে। আমি মামীমা, মানে হবু কনের মামীশাশুড়ি বলে কথা।
গোধূলি পেরিয়ে সন্ধে নামল। আমাদের কাজলের টান, আঁচলের ভাঁজ সব একেবারে টিপটপ। কর্তামশাই এমন বেরোনোর সময়ে সবসময়ে তাড়া দিয়ে দিয়ে অশান্তির সৃষ্টি করে। কোথাও যাওয়ার আগে ঝগড়া না করলে তার ভাত হজম হয় না। কিন্তু ননদ নন্দাইয়ের সামনে এত সাহস তার হবে না। কিন্তু বাড়ির লোকের হেলদোল নেই। ব্যাপারটা কী? খবর নিয়ে জানলাম, বাস ছাড়বে রাত বারোটার পরে। বিয়ের লগ্ন রাত দুপুরে। এদিকে এমনই দস্তুর। শুনে তো আমাদের মাথায় হাত। আসলে শহরে আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মীদের বিয়ে মানে সন্ধে ছ’টার মধ্যে পৌঁছে রাত ন’টার মধ্যে বাড়ি। এখানে যে এমন হবে না, সেই কথাটা মাথায় আসেনি। যাই হোক, বাস ছাড়ল তা রাত সাড়ে বারোটা হবে। ঘুম ঘুম চোখে বিয়েবাড়ি পৌঁছলাম, তখন সময় কত – আন্দাজ পৌনে দুটো হবে। পৌঁছনোর পরে খাতির যত্ন তো খুবই হল। দুটোর সময়ে হাতে গরম গরম জলখাবার পেলাম। তারপর আড়াইটে নাগাদ ভোজসভা। তখন অবশ্য চকমকি আলোয় ঘুমটুম সব উড়ে গেছে। প্রথমেই এল ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন। আমি তো চমৎকৃত। খিদেও পেয়ে গেছে জোর। রাতদুপুরে তাড়াতাড়ি কাজ সারার জন্য বোধহয় এই ব্যবস্থা। পাত শেষ করতে না করতে এসে গেল ফলের চাটনি। বাঃ! নির্ঝঞ্ঝাট খাওয়া দাওয়ার পাটটি বেশ পছন্দ হল।
অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিলাম, ছোট জা আমাকে চোখ মটকাচ্ছে। ওর অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিসের চাকরি, তায় আবার দূরে দূরে বদলি হতে হয়। তাই ছুটি খুব কম পায়। আমি যখন শ্বশুরবাড়ি আসি, ওর মেয়ে হয়ে যায় আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। ছোট জা আজ অনেক ব্যবস্থা করে তবে আসতে পেরেছে। একটু দূরে আছে বলে ওর ইশারা বুঝতে পারিনি, খাওয়ার দিকেই একতানমন হয়ে ছিলাম। পরে কথা বলে বুঝলাম, জা আমার খাওয়া দেখে ইশারা করছিল, এখনই অতটা পরিমাণ খেয়ে না নিতে। ওর কথাটাকে সত্যি করে, চাটনির পরে এল সাদা ভাত আর ঘি। তারপর একে একে পোস্ত ছড়ানো লাল শাক ভাজা, মুড়োর ডাল, ছ্যাঁচড়া, মাছের কালিয়া, পাঁঠার মাংস, ঘন টমেটোর চাটনি, দই, মিষ্টি, পান। এমন দুই পর্বের খাওয়া দেখে, খেয়ে আমার মনটা ভীষণ অবাক, আর পেটটা খুব ক্লান্ত হয়ে গেল।
বাড়ি যখন পৌঁছলাম, রাত ভোর হতে বেশি বাকি নেই। ফিরে তো শুয়ে পড়েছি। পরে সকালে উঠে সকলের কথা শুনে বুঝলাম, এ অঞ্চলে এইরকম খাওয়াদাওয়ার প্রথা হল শহরের চুঁইয়ে পড়া প্রভাব। শহুরে আত্মীয়-বন্ধুর সন্তুষ্টির জন্য প্রথম পর্ব, আর ঐতিহ্য বজায় রাখতে দ্বিতীয় পর্ব। যা হোক, একটা নতুন রকম অভিজ্ঞতা তো হল। তিনদিন খুব হৈচৈ, হো হো হা হা, দুই মেয়ের নাচানাচি, লাফালাফি চুকিয়ে, নতুন আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে আলাপ, ভাবসাব করে আমরা আবার আমাদের ভদ্রাসনে ফিরে এলাম। আর অন্তত তিনদিন পেটটাকে সামাল দিতে সেনবাড়ির ব্র্যান্ডেড ঝোল খেয়ে থাকতে হল।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পরে একটু আড্ডা না দিলে খাবার হজম হয় না। আড্ডা দিতে গিয়ে, গ্রামের ওপর শহরের প্রভাব কেমন বাড়ছে, তার আরও কিছু খবর জানতে পারলাম। যেমন, আজকাল আমাদের গ্রামে যে বাড়িতে বিয়ে লাগে, তাদের বাড়িতে সেই উপলক্ষে চার থেকে সাতদিন নাকি ডিজে ভাড়া করা হয়। দিনের সংখ্যাটা নির্ভর করে সামর্থ অনুযায়ী। সন্ধে হলেই গ্রাম ঝেঁটিয়ে বাচ্চা, বুড়ো, মেয়ে, বৌ সেখানে জোটে ঝিনচ্যাক আলো আর মিউজিকে ভেসে উদ্বাহু নাচানাচির জন্য। ডিজের আওয়াজে কান পাতা দায় হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগে থেকে নাচ প্র্যাকটিস পর্যন্ত হয়। আমরা যখন বাড়ি ছিলাম না, আমাদের ফাঁকা দুর্গাদালানে এমন কিছু মহড়া হয়েও গেছে। শুনে তো আমি তাজ্জব। কিন্তু গ্রামে এমন সংস্কৃতি কীভাবে এল? কর্তামশাই বললেন, পুরোনো শিক্ষিত পরিবারগুলি সব শহরমুখী। বাড়ি তালা পড়ে থাকে। উৎসবে অনুষ্ঠানে লোক আসে। গ্রামে ধীরে ধীরে নব্য সচ্ছল শ্রেণী তৈরি হয়েছে। সেখানে টেলিভিশন সংস্কৃতি প্রবল। কথাটা ঠিকই। শহরেও টেলিভিশন সংস্কৃতি আছে। দেখছি তো চারপাশে। শহরে আমাদের বাড়ির পাশেই ভাড়া দেওয়া হয়, এমন দু’-দুটো বিয়ে বাড়ি আছে। সেখানে গায়ে হলুদে মেয়েরা সব দারুণ সেজে হলুদ শাড়ি পরে আসে। এ যেন এক নতুন হলুদ হোলি বাংলায় জাঁকিয়ে বসছে। কিন্তু তাতে কোনো দূষণ নেই। সাতদিন ধরে কানফাটানো ডিজে চললে তো ভারি মুশকিল। আশেপাশে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া আছে, বয়স্ক মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষা আছে, পশুপাখির ঘুম আছে। কর্তা বললেন, ‘সে কিছু করার নেই। শহরে যেমন শব্দের কড়াকড়ি আছে, গ্রামে তেমন আইনের শাসন নেই।’ বুঝলাম, একটা আরোপিত সংস্কৃতি নকল করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। মেয়ে বলে,
- মা, আমরা যখন এ’বাড়ি আসছিলাম, পিকনিকের গাড়িগুলো দেখছিলে – এত জোরে গান বাজছিল, বুক ধড়ফড় করছিল।
- সময়ের হাতে ছেড়ে দিতে হবে বাবু, সময় ঠিক খারাপ বাদ দিয়ে ভালকে বেছে নেবে।
- কতদিনে হবে মা। এগুলো তো ভাল নয়।
- আমাদের কুমুদিনী যখন অন্দরমহলে লেখাপড়া শুরু করেছিলেন, বাইরের জগতে কাজ শুরু করেছিলেন, তখন কি আর সেকাজ সব লোকে খুশি মনে মেনে নিয়েছিল? তখন মেয়েদের এসব কাজ ভাল চোখে দেখা হত না। কিন্তু মেয়েদের লেখাপড়া ভাল কাজ বলে, সেটা টিঁকে গেছে। সতীদাহ খারাপ কাজ, তাই সেটা বন্ধ হয়ে গেছে।
- কিন্তু রাজবাড়িতে তো লেখাপড়ার চল ছিল মা, সেই ঢেউয়েই কুমুদিনী চর্চা করেছেন। লোকে খারাপ বলবে কেন?
- কিন্তু কুমুদিনীর লেখা তো উল্টো কথাই বলে।
- কেন? কী লিখেছেন উনি?
- ওঁর বই দুটো পড়ার চেষ্টা করিস। দেখবি ওঁর জীবন অনেকটাই বুঝতে পারবি। অনেক রাত হল, এবার ঘুমিয়ে পড়।
- আর একটা কথা আছে মা। এ’কথা সে’কথায় কিন্তু ঐ কথাটা খালি বাদ পড়ে যাচ্ছে।
- কী কথা বল তো?
- ঐ যে গো, তোমার সেজদাদুর বিয়ের গল্পটা। বর শোভাবাজারের বোস থুড়ি হাটখোলার দত্ত আর কনে আন্দুল রাজবাড়ির।
- আলাদা করে বিয়ের রসালো গল্প কিছু জানি না। দত্তক নেওয়ার ফলে সুরেনকে তো আর বোসেদের ছেলে ধরা যাবে না, হাটখোলার দত্তবাড়িরই ছেলে ধরতে হবে। হাটখোলার দত্তরা আন্দুলের দত্তচৌধুরীদের শাখা, আবার আন্দুল রাজবাড়ির শিকড়ও এই বংশে। চেনাশোনা, পাল্টিঘর এসব দেখে আকছার বিয়ে হত। তাই সম্পত্তি, উত্তরাধিকার, সম্পর্কের লতাপাতা, কোথাও কি কোনো সমস্যা ছিল? কুমুদিনীর তৃতীয় পুত্র অর্থাৎ আমার মায়ের সেজ জ্যাঠামশাইয়ের অকাল মৃত্যুর পিছনে হাটখোলার দত্ত এবং আন্দুল রাজবাড়ির অন্দরের সম্পত্তি বিবাদ থাকতে পারে, তখনকার লোকের সেই সন্দেহের শিকড় লুকিয়ে ছিল আন্দুলের এই ইতিহাসে। আর যদি সুরেনকে বোসেদের ছেলে ভাবিস, তবে বলব, বোস বংশের সঙ্গেও আন্দুল রাজবাড়ির কিছু যোগাযোগ আছে।
- কীরকম?
- রাজা রামলোচন রায়ের একজন ছোট ভাই ছিলেন। তিনি কিন্তু রাজা উপাধি গ্রহণ করেননি, বরং নামের আগে বাবু ব্যবহার করতেন। বাবু রাজচন্দ্র রায়। এই রাজচন্দ্রের তিন মেয়ে - শারদা সুন্দরী, পান্না সুন্দরী আর ভবতারিণী।
- শারদা সুন্দরী? উঁ – মা আজ থেকে তোমার নাম দিলাম শারদা সুন্দরী।
- হা হা, আমিও এরকম আমার মায়ের নানারকম নাম দিতাম।
- তারপর বল।
- প্রথম দু’জনের কোন সন্তান ছিল না। ভবতারিণীর বিয়ে হয়েছিল কোনো এক নবকৃষ্ণ বসুর সঙ্গে। এঁদের তিন ছেলে অমরেন্দ্রনাথ, অতীন্দ্রনাথ এবং সমরেন্দ্রনাথ বসু। তার মানে রাজচন্দ্রের ভাগের জমিদারির এক অংশ বোস বংশে চলে গিয়েছিল। আবার পরবর্তীকালেও দেখছি বড় তরফে, মানে ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্রের যিনি জ্যেষ্ঠ পুত্র, সেই উপেন্দ্রনাথের বড় ছেলে প্রমথনাথ এবং মেজ ছেলে মন্মথনাথ দু’জনেই বোস বংশের মেয়ে বিয়ে করেছেন। আবার সেজ ছেলে বিয়ে করেছেন শোভাবাজারের রাজা খগেন বাহাদুরের মেয়েকে।
- ঠিক আছে। তার মানে, দত্ত হোক, বোস হোক বা দেব হোক তিন দিকের যে কোনো দিক থেকেই বিয়ের সম্বন্ধ হতে পারে। কিন্তু তোমার সেজদাদুর সঙ্গে সম্পত্তি বিবাদ কেন হবে? সেই সন্দেহ লোকে করল কেন?
- আরে পাগল, অর্থ অনর্থের মূল। জমি জমা সম্পত্তি সম্পদ থাকা মানেই ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে বিবাদ, মামলা মোকদ্দমা, অশান্তি, শত্রুতা। এরকম হয়ে থাকে, তাই লোকের সন্দেহ। আমার মা গল্প করত, সেজদিদার তো শিশুকালে বিয়ে হয়েছিল, সেই বাচ্ছা মেয়ে নাকি কুমুদিনীর কোলে বসে বলত, বাপের বাড়ি যাব না মা, খেলনা পাতি দেয় না, শুধু সবাই জমিজমার আলোচনা করে।
- আহা রে বেচারা। এবারে ব্যাপারটা জলের মত পরিষ্কার হল। আচ্ছা মা, শোভাবাজারের ব্রজকুমারীর নাতনি, আন্দুলের সরোজিনীর মেয়ে প্রতিমা বাবার দিক থেকে ঘোষেদের মেয়ে, লাবণ্যও তো ঘোষ, তাই তো বলেছিলে?
- একদম, ঠিক পয়েন্টে হিট করেছিস। এত কার্যকারণ বুদ্ধি তোর, শুধু খাতায় অঙ্ক করার সময়ে বুদ্ধিগুলো কোথায় যায় বলতো?
- মা, টু দি পয়েন্ট আনসার দেবে। মৈতনায় এসে নো অঙ্ক।
- চটছিস কেন? তুই ঠিক বলেছিস। লাবণ্য আর ভারতী দু’জনেই ঐ এক ঘোষ বংশের মেয়ে। ইন ফ্যাক্ট ভারতী হল প্রতিমার ভাইঝি। আর ভারতীর তুতো বোন হল লাবণ্য।
- জেঠিমা তুমি যে বলেছিলে লাবণ্য ডাক্তার আর. জি. করের নাতনি।
- হ্যাঁ উনি দাদু, মায়ের দিক থেকে। বেতড়ের কর, বাগবাজারের সেন, শোভাবাজারের বোস আর খানাকুলের ঘোষ এদের মধ্যে রয়েছে নানান সম্পর্কের ডালপালা।
- মা, তোমার গল্প কি এবার কুমুদিনী পেরিয়ে লাবণ্যর দিকে যাচ্ছে?
- হুমম। ঠিক ধরেছিস।
- জেঠিমা, তুমি কাকে বেশি ভালবাসো? কুমুদিনী না লাবণ্য?
- কুমুদিনী ভীষণ আকর্ষণ করেন, ছোটবেলা থেকে। এখন যত বয়স বাড়ছে, টানটাও যেন বাড়ছে। তবে ওঁর ইতিহাসের, জীবনের খুব জৌলুস। চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। রাজবাড়ির বৌ, তবু পর্দানসীন নন। সেই যুগের লেখিকা, পত্রিকাতে লেখালেখি, বই লেখা, অন্যদিকে নিবেদিতা থেকে ঠাকুর বাড়ির সঙ্গে অন্তরঙ্গতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম – ইনি যেন একান্তে ভালবাসার অতীত। ধূমকেতুর মত উঠে এসে হারিয়ে গেছেন। যোগ্য উত্তরসূরী তৈরি করতে পারেননি। মৃত্যুর দেবতা বারবার এসে ধ্যানভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, বারবার বিফল হয়েছেন।
- আর লাবণ্য?
- লাবণ্যর তো অত জৌলুস নেই। ঘরোয়া। তাঁকে অনেক বেশি বুকের মধ্যে অনুভব করি।
কথার পিঠেতে সাজাই কথা,
পাড় ভাঙা যত ঢেউয়ের গাথা
আকাশ কুসুম, ছাতার মাথা –
শোনাব বল তো কাকে?
এলোমেলো পথে মেঘের মায়ায়,
চিকের ওপারে স্মৃতির ছায়ায়,
সাবধানে রাখি না যেন হারায়
শুধু খুঁজে ফিরি মা-কে।