২
পলিত অলকে প্রখর তপন,
তোমার বেদনে আমার কাঁদন,
তোমার চোখেতে সবুজ তুলিতে
আঁকি শালের বন।
নবীন পথিক ঝুমকো লতা
জীবন তো নয় নীরবতা,
তোমার ঝুলিতে দিলাম গুণিতে –
ঝিনুক ভরা ধন।
– তুমি রাঁচী গেছ মা?
– হুম, অনেকবার। বড়দাদুর ছেলেরা তো এখনও ওখানেই থাকে। ওটা তো মায়ের বড়মামার বাড়ি ছিল। এখন আমার মামার বাড়ি।
– ওখানে কী আছে?
– ছোটোনাগপুর মালভূমির সৌন্দর্য, অনেকটা বিভূতিভূষণের লেখায় যেমনটা পাওয়া যায়, তেমন। দূরে-কাছে অনুচ্চ পাহাড়, ছোট-বড় টিলা, বুনো ঘাস, শহর ছাড়িয়ে জঙ্গল, বুনো গন্ধ, চড়াই-উৎরাই লালমাটির পথ। রাত নামলে জোছনা এত উজ্জ্বল, যেন রোদ্দুর।
ট্রেন মুরি স্টেশনে এলেই মায়ের মুখ ঝলমলিয়ে উঠত। মায়েদের ছেলেবেলায় মুরিতে নাকি রেলগাড়ি বদল করতে হত। মায়ের কাছে মুরি মানেই রাঁচী এসে গেল। বড়দাদুর মধ্যে মা লাবণ্যকে খুঁজে পেত। আর বড়দাদুও বলত, ‘দিদি ছিল আমার মা। তোমরা এলে আমি দিদিকে খুঁজে পাই।’ বড়দাদুরা থাকত কড্রু, এ জি কলোনিতে। এক-একদিন বাসে টিকিট কেটে ঘুরতে যেতাম। মালভূমির প্রান্তে তিন ধাপ, তিন ধাপে তিন জলপ্রপাত – হুড্রু, জোনা আর দশম। কোডার্মার অভ্রমাখা চিকচিকে মাটি, তিলাইয়া বাঁধের নীল জল। শাল, পিয়ালের জঙ্গল।
– শুনেই তো দেখতে ইচ্ছে করছে।
– হুম, আমরা তো আর শুধু জঙ্গল দেখতে যেতাম না। যেতাম মামার বাড়ির আদর খেতে। বড়দিদা অনেক রকম খাবার বানাতে পারত। আমার বড়দিদাও কিন্তু বোস বাড়ির মেয়ে, তবে এদেশীয় নয়, ঢাকা বিক্রমপুরের বোস। আমরা গেলে বড়দিদা কেক বানাত, কখনও ইডলি বানিয়ে খাওয়াত। সেযুগে আমরা জানতাম না এধরনের খাবার বাড়িতেও বানানো যায়। কোনোদিন রাঁচী শহরের মধ্যেই ঘুরে বেড়াতাম। রাস্তার খাবারও খেয়েছি মন ভরে – লিট্টি চোখা, ধুসকা, বাঁশের আচার, দেহাতি চিকেন। একবার মামারা রাজরাপ্পার মন্দির থেকে বলির মাংস নিয়ে এল। বড়দিদা রান্না করল পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া। ওভাবে যে পাঁঠার মাংস রান্না করা যায়, সেও আমার রাঁচীতেই দেখা। আর মাংস রাখতে হলে আমরা তো ফ্রিজে রাখি। রাঁচীতে শীতকালে কাঁচা মাংস একরাত রাখতে হলে বালতি করে ঢাকা দিয়ে বারান্দায় রাখা হত। বাইরে যা ঠান্ডা, ওটাই ফ্রিজের কাজ করবে বলে। আরও একটা জিনিস রাঁচীতে শিখেছিলাম। যদি দু’-তিন দিন ধরে ট্রেন বা বাস জার্নি করতে হয়, আর বাইরের খাবার খেতে অসুবিধে থাকে, তাহলে দুধ দিয়ে ময়দা মেখে লুচি করতে হয়। তিনদিন ঠিক থাকে, খারাপ হয় না। সঙ্গে আচার নিতে হবে। নইলে তরকারি অতদিন তো থাকবে না।
– দাঁড়াও মা। দুটো প্রশ্ন। লিট্টি চোখা তো খেয়েছি। ধুসকাটা কেমন খাবার? আর পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া মাংস রান্না হবে কীভাবে? আঁশটে গন্ধ হবে না? বাঁশের আচার কী? বাঁশের কৌটোর মধ্যে আচার?
– না রে বাবা। অনেক প্রশ্ন করে ফেলেছিস। একে একে উত্তর দিতে হবে। তুই যে লিট্টি চোখা খেয়েছিস, সে হল কলকাত্তাইয়া লিট্টি। খোদ ঝাড়খন্ডী লিট্টি তো আর খাসনি। খেলে বুঝতিস।
– কীরকম?
– লিট্টি আসলে বিহারী খাবার, ঝাড়খণ্ডেও খুব চলে। ওখানে ঘুঁটের আগুনে বড় বড় লোহার কড়ায় লিট্টি সেঁকা হয়। সেঁকার পর ঘিয়ে চোবানো হয়।
– বাড়িতে নিজেদের মতো করা যায় না মা?
– হ্যাঁ, তা যাবে না কেন। পুরোপুরি না হলেও বাড়িতে যা হয়, সেটাও মন্দ নয়। যদি আড়াইশো ছোলার ছাতু নিস, তাতে একটু আচারের তেল ময়ান দিতে পারিস তো খুব ভালো, না থাকলে একটু সর্ষের তেল আর গন্ধরাজ বা কাগজি লেবুর রস দিতে হবে। তারপর একটা বড় পেঁয়াজ, পাঁচ-ছ’ কোয়া রসুন, দুটো কাঁচা লঙ্কা আর ধনেপাতা কুচো করে ছাতুতে মেশানো হয়। আধ ইঞ্চি আদা কুরিয়ে নিতে হবে। এবারে এক টিপ জোয়ান, একটু কালোজিরে, অল্প একটু হিং আর স্বাদ-মতো নুন ঐ ছাতুতে মেশাতে হবে। এবারে হাত ভালো করে ধুয়ে, একটু জলের ছিটে দিয়ে সব উপকরণ দিয়ে ছাতুটা খুব ভালো করে মাখতে হবে। এভাবে ছাতুর পুর হয়ে গেল। মুখে ফেলে স্বাদটা দেখে নিতে হবে কোনোটা কম বেশি হয়েছে কিনা। সব ঠিক থাকলে এবারে লিট্টি বানানোর পালা। আটা মেখে লেচি কাটতে হবে। আটাতেও একটু ময়ান দিতে হবে। তারপর আটার গুঁড়ি দিয়ে ছোটো গোল করে বেলে নিয়ে হাতে করে বাটির মতো করতে হবে। পরতটা খুব মোটা যেন না হয়। পাতলা হবে কিন্তু ছিঁড়বে না এমন চাই। এবারে এর মধ্যে ছাতুর পুর ভরে বাটির মুখ বন্ধ করে লেচিটা হাতের চাপে অল্প একটু চ্যাপ্টা করে দিতে হবে। যদি লিট্টি সেঁকার গোল গোল গর্তও’লা চাটু থাকে তো খুব ভালো। তার মধ্যে লিট্টিগুলো সাজিয়ে দিতে হবে। গ্যাস ওভেনে মাঝারি আঁচে দশ মিনিট সেঁকলে হয়ে যায়। যদি ও’রকম চাটু না থাকে, তবে রুটি-সেঁকা চাটুতে প্রাথমিকভাবে সেঁকে নিয়ে আবার রুটি বা পাঁউরুটি-সেঁকা জালিতে রেখে লিট্টিগুলোকে সেঁকতে হবে। সেঁকা হয়ে যাবার পর প্রতিটা লিট্টির ওপরে এক চামচ ঘি ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। গরম লিট্টিতে ঘি টেনে নেবে। ঘিতে ডোবালে চপচপে হয়ে যায়। আমাদের অভ্যেস নেই, সহ্য হবে না। লিট্টি করার আগেই কিন্তু চোখা বানিয়ে রাখতে হবে, পরে করলে ঠান্ডা লিট্টি খেতে হবে। আমাদের কলকাতার লিট্টিওলারা আলু টমেটোর ভর্তা বানায়। আর রাঁচীতে ওরা আলু টমেটোর সঙ্গে বেগুনও দেয়। তিনটে সবজি প্রেশার কুকারে একটা সিটি দিয়ে তারপর একটু ঘেঁটে দিতে হবে। সেদ্ধ ঝোলের সঙ্গে মেশাতে হবে পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচা লঙ্কা, ধনেপাতা কুচো আর কাঁচা সর্ষের তেল। খুব বেশি ঝোল থাকবেনা, আবার বেশি টাইটও হবে না। বেশ রসরস হবে।
– আচ্ছা, ও’তরফে তোমার ক’জন মামা জেঠিমা? কতদিন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, তুমি কতদিন আগে শেষবার রাঁচী গেছ?
– মায়ের মামার বাড়ির তরফে আমার তিনজন মামা। বড়জন পিঞ্চু মামা। বড়র পরে বাকি দু’জন জমজ মামা – ছুকু মামা পুকু মামা। আমার থেকে খুব একটা বড় নয়, বন্ধুর মতো। আর যোগাযোগ নেই কী বলছিস রে। এই তো কয়েক বছর আগে পিঞ্চু মামাকে বলে ফরাক্কায় এনটিপিসি-র থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট দেখে এলাম স্টুডেন্টদের নিয়ে।
– মানে, তোমাদের ঢুকতে দিল?
– কলেজের চিঠি দিয়ে পারমিশন নিয়েছি, ঢুকতে দেবে না কেন?
– বুঝতে পারছিস না দিদি, একে চিঠি, তায় মামা। দু’পায়ে দুই চাকা দিয়ে ঢুকে গেছে।
– খুব বুঝেছি, তা কী দেখলে?
– এনটিপিসি-র ক্যাম্পাসের ভেতর রেললাইনে মালগাড়ি করে কয়লা আসে। আর মালগাড়ি যেখানে দাঁড়ায়, তার নিচে কনভেয়ার বেল্ট পাতা। মালগাড়ির বগিগুলোর মেঝে খুলে যায়, আর কয়লাগুলো কনভেয়ার বেল্টে চড়ে এগিয়ে যায়, সব অটোমেটিক। মানুষকে হাত লাগাতে হয় না।
– বাব্বা, তারপর?
– তারপর একটা লোহার পাকানো সিঁড়ি দিয়ে উঠছি তো উঠছি। হাঁপ ধরে যাচ্ছে। ওঠার পর দেখি বিরাট হলঘর। অন্ধকার মতো। অল্প আলো ছোট্ট ছোট্ট কয়েকটা জানালা। পায়ের তলায় কাঠের পাটাতন। আর সেখানে ভীষণ ভীষণ গরম আর একটা বুকচাপা দমবন্ধ কষ্ট – বলে বোঝানো যাবে না। হলের ভিতরে সোজা হেঁটে গিয়ে একটা কাচের অফিস। ভেতরে কনকনে ঠান্ডা। তারপর সেই অফিসে বসে আমরা একটু থিতু হলাম। এবারে আবার আমাদের সেই গরম ঘরে নিয়ে গেল। তখন চোখ সয়ে এসেছে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। এবারে হলটা দেখলাম ভালো করে। যেখানটায় আমি দাঁড়িয়েছিলাম, পিঞ্চু মামা বলল, টুম্পা পায়ের দিকে তাকাও। দেখে চমকে গেছি। মেঝেতে ফাঁক, তলা দেখা যাচ্ছে। তার ভিতরে সাতটা সূর্য নাকি আগ্নেয়গিরি জ্বলছে। সে কী আগুন! লাল, কমলা, হলুদ, সোনালি – সহ্যের অতীত ভয়ঙ্কর, কিন্তু চোখ সরানো যায় না, সম্মোহন করে রাখে। আমরা ফার্নেসের ওপরে দাঁড়িয়ে। ঐ যে পাকানো সিঁড়ি দিয়ে অতটা উঠলাম, ওটা আসলে ফার্নেসের গা দিয়ে রয়েছে।
– তোমার খুব মজা না জেঠিমা, কলেজের চিঠি থাকলেই সব দেখা যায়। আমি দেখাচ্ছি মজা। বাকিরা বুঝি ফেলনা? আমি চিঠি দেব। দেবই দেব।
– কাকে?
– কাকে আবার প্রধানমন্ত্রীকে, যাতে আমরা গেলেও ঢুকতে দেয়।
– প্রধানমন্ত্রী অবধি যাবার দরকার কী? তোর ইস্কুলের প্রিন্সিপালকে বল একটা ট্যুর অ্যারেঞ্জ করতে। সেটা তো অনেক সহজ। ছাত্রছাত্রীরা হল দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ, প্রায়োরিটি।
– মায়ের কলেজের চিঠির লাভ আমিও ভোগ করেছি রে দিদি।
– তুইও? কী করে?
– মায়ের পিজি স্টুডেন্টদের সঙ্গে ভুবনেশ্বরে ফিল্ড সার্ভেতে গিয়েছিলাম। পিজির দাদা দিদিগুলো অনেক বড় ছিল তো, আমার ব্যাগ বয়ে দিত। মা এদিকে আমায় নিয়ে গেছে নিজের লাগেজ নিজেকে বইতে হবে, রোদে কাজ করতে হবে, বায়না করা যাবে না – এইসব শর্তে।
– চমৎকার! তারপর?
– দাদা দিদিগুলো আমায় জিজ্ঞেস করত, ম্যাডাম বাড়িতে কী করে রে, তোকে বকে? – এইসব নানা কথা। আমিও তো শয়তান। বাড়ির কথা কিচ্ছু বলতাম না। বললে মা যদি পরেরবার না নিয়ে যায়।
– হা হা হা, জেঠিমা, বোনু স্যায়না ছুয়া না না স্যায়না ঝিও। দাদা দিদিদের দিয়ে ব্যাগও বওয়াচ্ছে আর গোপন কোন খবরও দিচ্ছে না। কিন্তু কলেজের চিঠির ব্যাপারটা কী?
– আরে কাজ হয়ে গেলে তো সাইট সিয়িং থাকে। ধৌলি পাহাড়ে সম্রাট অশোকের শিলালিপি কাচের বাক্স করে ঢাকা দেওয়া আছে। বাইরে থেকে দেখতে হয়।
– জানি তো। আমরাও তো তাই দেখেছি।
– কিন্তু কলেজের চিঠি দিয়ে আমরা দু’জন দু’জন করে কাচের বাক্সে ঢুকেছিলাম। শিলালিপির পাথরের গন্ধ নিয়েছি, হাত দিইনি। আমাদের সম্পদ।
– এ্যাঁ!
– আবার মায়ের ফিল্ডে যাওয়া নিয়ে আমি বিপদেও পড়েছি রে দিদি।
– কেন কেন?
– মা গেল দারিংবাড়ি। আমার তখন সামনে অ্যানুয়াল, তাই নিয়ে যায়নি। এদিকে মা নেই বলে, কষে রাস্তার ঘুগনি খেয়ে আমার পেট খারাপ হয়ে গেছে, ইস্কুল কামাই।
– বাঃ বা, সুবোধ গোপাল মেয়ে!
– মা আমায় দারিংবাড়ির ছবি পাঠাচ্ছে। আমি শুয়ে শুয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছি। এদিকে ইস্কুলে মিস জিজ্ঞেস করেছেন রঞ্জাবতী অ্যাবসেন্ট কেন? বন্ধুরা অমনি বলে দিয়েছে বেড়াতে গেছে। তারপর তিনদিন পর যেই না ইস্কুলে গেছি, ক্লাস টিচার ম্যাম কী বকা দিলেন – সামনে এক্সাম, কেন মাউন্টেনে গেছ? যত বলি, আমি যাইনি, উনি শুনছেনই না।
– ঠি–ক হয়েছে, ড্যাডাং ড্যাং, সেবার যাসনি, আগে তো গেছিস। তুই যাবি কেন, আমি যখন যেতে পারছি না। আর জেঠিমা, তোমায় আমি এবার চিবিয়ে খাব বলে দিচ্ছি।
– ঠিক আছে, তাই খা। রাঁচীর গল্প শেষ। আমি উঠলাম।
– আরে একী একী। রাঁচী শেষ হল কীকরে? শুধু তো লিট্টি চোখা হল। ধুচকা না কী একটা, তারপর দেহাতি চিকেন, বাঁশের আচার – সব তো রয়ে গেল।
– ধুচকা না, ধুসকা। ওগুলো আবার পরে হবে।