খাতি নাতি বেলা গেল
শুতি পালাম না।
দুয়ার দিয়া হাতি গেল
দেখতি পালাম না।
ছড়াটা ছোটবেলায় শুনেছিলাম মায়ের মুখে। সত্যি সত্যি ঘর-বার সব কিছু সামলাতে সামলাতে মেয়েদের জীবনে সময় বড় আক্রা, তাই দুয়ার দিয়ে হাতি চলে গেলেও দেখতে যাবার সময় হয় না। আর ঘর-বার সব কাজের আসল উদ্দেশ্য হল পেটপুজো। এ পুজোয় ত্রুটি চলে না। হেঁশেলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলে ব্যক্তির, পরিবারের, এলাকার, জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি। আর টাঁকশাল, হাতিশাল, ঘোড়াশালের মতো পাকশালের গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। সেখানে উচ্চকোটির ব্রাহ্মণ্য রান্নার সঙ্গে ব্রাত্যজনের চণ্ডালি রান্না অনায়াসে সহাবস্থান করে। সেজন্য, আজ একটু পাকশালার গল্প বলি।
রোজকার পাঁচালি
আমি বড় হয়েছি পাতিপুকুরের সরকারি আবাসনে। ছোটবেলায় আমাদের মত কোয়ার্টারগুলোতে চৌকো চৌবাচ্চার মত মাটির উনুন করা ছিল। উনুনের মুখে দেওয়ালে ছিল ধোঁয়া বেরনোর পাইপ। উনুন ধরানোর সময় একটা মোটা লোহার ঢাকনা দিয়ে চাপা দেওয়ার নিয়ম ছিল, যাতে উনুনের ধোঁয়া বাইরে না গিয়ে, পাইপ দিয়ে বেরিয়ে যায়। কিন্তু পাইপ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাই ঢাকনাটা কোনো কাজে আসত না। আমার কাছে, মায়ের রোজ সকালে উনুন ধরানোটা, ছিল ভীষণ কষ্টের। কারণ আমি কোনোরকম ধোঁয়া সহ্য করতে পারিনা, ভীষণ শ্বাসকষ্ট হয়। তবে একবার উনুন ধরে গেলে আর চিন্তা নেই। একটা পিঁড়িতে উবু হয়ে বসে মা রান্না করত। রান্না হয়ে গেলে ভিজে ন্যাকড়া দিয়ে উনুন নিকোনো হত আর উনুন থেকে একটা সুন্দর সোঁদা গন্ধ উঠত, ঠিক বৃষ্টি পড়লে যেমন হয়, তেমন। আমার বোন ঐ গন্ধের লোভে উনুন চাটত। অনেক বারণ, বকাঝকা করলেও তাকে থামানো যেত না। উনুনে সোঁদা গন্ধ উঠলেই, পিলপিল করে দৌড়ে ছোট্ট জিভ বার করে উনুন চেটে দিত। ভাঁড়ে রসগোল্লা বা দই এলেও সেই সব ভাঁড় কামড়াত। এত দুরন্ত, সামলানো যেত না – বাবা ওর নাম দিয়েছিল বিলবিলে বাহাদুর। সকলে যখন জিজ্ঞেস করত, বাবা কি নাম দিয়েছে? – গরবিনী উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করত – বিব্বিলে ভা-দুর। আমি বইপত্র নিয়ে থাকতাম, রান্নাঘরের দিকে অত নজর ছিল না, কিন্তু বোনের ছিল। দুপুরবেলা যখন কেউ দেখত না, ও-ই গিয়ে শিক দিয়ে, বড়দের মত উনুন খোঁচাত। একবার ড্রয়ারে লাল-নীল ক্যাপসুল দেখে, টুক করে জল দিয়ে খেয়ে নিয়েছিল। বাড়িতে বস্তা করে কয়লা, ঘুঁটে দুই-ই থাকত। পরের দিকে অবশ্য কোক-কয়লা এল। সব বাড়িতেই কয়লা-ভাঙা হাতুড়ি থাকত। গুঁড়ো কয়লা মেখে গুল দেওয়া হত।
সকালের মূল রান্নার পর্ব মিটে গেলে, বিকেলের চা, জলখাবার, রাতের রান্না সব কেরোসিনের স্টোভে হত। আমার বাবা রোজ সন্ধ্যেবেলায় স্টোভ খুলে, মুছে, পলতে পরিয়ে, পরদিনের জন্য রেডি করত। আর খবরের কাগজ দিয়ে, হারিকেনের চিমনিও মুছে রাখতে হত, কারণ বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেও, লোডশেডিংটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রদীপের, হারিকেনের সলতে আর স্টোভের পলতে – বারবার জেনে নিতাম মায়ের কাছে। পলতে সলতে গুলিয়ে যেত আমার।
কোয়ার্টারের দেওয়ালে সিমেন্টের তাকে মা ঠাকুর পেতেছিল। রোজ সন্ধ্যেবেলা ধূপ দেখিয়ে এলাচদানা আর জল দিত ঠাকুরকে। ধূপ দেওয়ার সময় হলেই একলাফে মায়ের সামনে সামনে ঘুরতাম – ওমা, ওমা, আমায় একটু পুজো কর। মা-ও হেসে আমার আর বোনের সামনে ধূপ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লক্ষ্মী-সরস্বতী পুজো করত। পুজো শেষ হওয়ার পর মিনিট পাঁচেক গেলেই দু’জনে এলাচদানাগুলো পেটে পুরতাম। কিন্তু বৃহস্পতিবারের পর্ব একটু দীর্ঘ ছিল। সেদিন এলাচদানার বদলে ঠাকুরের থালায় গুড়ের বাতাসা আয় আয় করে ডাকত। মা আসন পেতে, লাল পাড় ছালের কাপড় পরে, লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তে বসত। সন্ধ্যেগুলোয় কারেন্ট থাকা ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। বেশিরভাগ দিনই হারিকেনের আলোয় মায়ের দু’পাশে ঘেঁষে বসে পাঁচালি শুনতাম। গরম, ঘাম, মশা – এগুলো কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হত। চারিপাশে মন্দ মন্দ মলয় বাতাস বইত। ঘরের আকাশে অকাল-পূর্ণিমার জোছনার সিঁড়ি নেমে আসত। সেই সিঁড়ি বেয়ে লক্ষ্মী ঠাকরুণকে পিঠে নিয়ে নেমে আসত ধবধবে সাদা প্যাঁচা।
রান্নার প্যাঁচ
বাবা রোজ সকালে বাজারে যেত, কখনো আমিও সঙ্গে যেতাম। বাবা ঘুরে ঘুরে বাজার করত। পোনা মাছের ঝোল বা ঝালটাই বেশি হত। তবে ইলিশ, ট্যাংরা, পার্শে, চিংড়ি, তেলাপিয়া এগুলোও বাদ যেত না। মায়ের ইস্কুল যাবার তাড়াহুড়ো থাকত। বাবা আমাদের ইস্কুলের বই আর টিফিন গুছিয়ে, ভাত খেয়ে ন’টার মধ্যে বেরিয়ে যেত। মা রান্না করে, বাসন ধুয়ে, আমাদের রেডি করত। তারপর তিনজন একসঙ্গে ইস্কুলের উদ্দেশে পাড়ি দিতাম। তাও এক-একদিন ব্যাজ, বেল্ট কিছু পরতে ভুল হয়ে গেলে, প্রার্থনার সময়ে শাস্তির লাইনে দাঁড়াতে হত। খুব তাড়া থাকত বলে মা প্রেসার-কুকারে রান্না পছন্দ করত। কুকারে দু’পলা সর্ষের তেল গরম করে, পাঁচফোড়ন, কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, তাতেই আলু-পটল নেড়ে নিয়ে হলুদ, নুন আর ধনে গুঁড়ো দিয়ে, কষে জল দিয়ে, প্রেসার কুকার ঢাকা দিয়ে দিত। একটা সিটি পড়লেই, ঢাকা খুলে ভাজা মাছগুলো দিয়ে ঝোলটা দু’মিনিট ফুটিয়ে নামিয়ে নিত। মাছের ঝোলে মা আদাবাটা বা জিরে গুঁড়ো ব্যবহার করত না। পটলের বদলে কাঁচকলা, সজনে ডাঁটা, বেগুন – যখন যেমন থাকত, তাই দিয়েই মাছের ঝোল হত। আর মাছের ঝাল করতে গেলেও ঐ পাঁচফোড়ন, কাঁচালঙ্কাই দেওয়া হত, কিন্তু তারপর ঐ তেলেই এক টিপ হলুদ, নুন আর জল দিয়ে দেওয়া হত। আর তাতে ভাজা মাছ দিয়ে ফোটানো হত। ছুটির দিনে মাছের ঝালে সর্ষে বাটা বা পোস্ত বাটা পড়ত। কখনো ক্বচিৎ সর্ষে, পোস্ত মিশিয়েও দেওয়া হত। মাছের ঝোল আর ঝালের তফাৎ হল – ঝালে কোনো জিরে, ধনে পড়ত না। আর বেগুনের ঝোলে মাঝে মাঝে হাল্কা করে সর্ষের জল দিত মা। যেদিন বাবা রান্না করত, মাছের ঝাল নামানোর আগে ফুটন্ত কড়ায় অল্প একটু রসুন বাটা দিয়ে দিত। মা কিন্তু রোজকার রান্নায় পেঁয়াজ, রসুন আর শুকনো লঙ্কার ব্যবহার এড়িয়ে চলত। মায়ের ধারণা ছিল, ওসব বেশি খেলে আমাদের শরীর গরম হয়ে যাবে। তবে মা বলত, রান্নায় স্বাদ করতে হলে, নামানোর আগে আর একবার ফোড়ন দিতে হয়। মায়ের ছোটবেলায় দিদা নাকি এভাবে দু’বার ফোড়ন দিয়ে রান্না করত। আর যেহেতু শীতকাল ছাড়া টমেটো পাওয়া যেত না, তাই এখনকার মতো সবেতে টমেটো দেওয়ার চল ছিল না। একটু বড় হলে আমি মাঝেমধ্যে রান্না করার চেষ্টা করতাম বটে, কিন্তু সফল হতাম না। বেগুন ডুবছে না বলে ঝোলে একগঙ্গা জল দিয়ে ফেললাম। মাছের ঝাল করতে গিয়ে তেলে হলুদ দিয়ে খুন্তি নেড়ে যাচ্ছি, আমার বিস্ফারিত চোখের সামনে হলুদ পুড়ে কুচকুচে কালো হয়ে গেল। মাকে এসে আবার কড়া মেজে নতুন করে বসাতে হল। আবার একদিন ঢিমে আঁচে মাছ ভাজতে গিয়ে মাছ পুড়িয়ে ফেললাম। রান্না শেখার প্রতি হতাশ হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু অবাক কাণ্ড, আমার অত দুরন্ত বোন বেশ রান্না শিখতে লাগল। মা হাসত, কিন্তু রাগ করত না।
বাবা এক একদিন বাজার থেকে মোটা দাঁড়াওলা কাঁকড়া আনত। সেদিন কষিয়ে কাঁকড়ার কালিয়া রান্না হত। মাছ বা কাঁকড়ার কালিয়া হলে, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শুকনো লঙ্কাবাটা সবই পড়ত। কার্পণ্য করা হত না। মা বলত, কাঁকড়া ভাজাও মাছের মত হবে। গনগনে আঁচে একপিঠ লাল হলে, উল্টে দিয়ে আর এক পিঠ লাল করতে হবে। বেশি নাড়ানাড়ি বা ঢিমে আঁচ এখানে চলবে না। কখনও আবার সর্ষে দিয়ে কাঁকড়ার ঝাল বা নারকেল দুধ দিয়ে কাঁকড়ার মালাইকারিও হত। বাবা কইমাছ খেতে ভালোবাসত। তাই তেলকইটাও হত।
পাতিপুকুরে পাইকারি মাছের বাজার আছে। তাই বাড়িতে মাছ নানারকম আসতে কোনো অসুবিধে ছিল না। চিংড়িটা আকার প্রকার ভেদে মা নানাভাবে রান্না করত। ঝোলের লম্বা আলু, লম্বা করে ঝিঙে, আর মোটা করে পেঁয়াজ কেটে চিংড়ি দিয়ে ঝোল করত মা। এটা এখন আমার কর্তা খুব পছন্দ করে। ঝিঙে, পেঁয়াজ, আলু একসঙ্গে প্রথমে ভেজে নেওয়া হয়। তার পর তেল ছেড়ে গেলে, সবজিগুলো খুন্তি দিয়ে চারপাশে সরিয়ে মাঝখানটা ফাঁকা করে দিত মা। তেল গড়িয়ে এসে মাঝখানে জড়ো হত। সেখানে জিরে, তেজপাতা, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া হত। তারপর নুন হলুদ দিয়ে কষে জল দিয়ে ঢাকা দেওয়া হত। আলু সেদ্ধ হলে ভাজা চিংড়ি দিয়ে আরও দু’-তিন মিনিট ঢাকা খুলে ফোটানো হত। আমরা ঝাল খেতে পারতাম না বলে, ঝোল ফোটার সময়ে মা ফোড়নের শুকনো লঙ্কা তুলে ফেলে দিত। এতে মিষ্টি পড়ত না, তবে খেতে মিষ্টি মিষ্টি লাগত। মা বলেছিল, ঐ মিষ্টত্ব আসে পেঁয়াজ থেকে। এই রান্নায় পেঁয়াজটাকে মশলা নয়, সবজি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া একপলা সর্ষের তেল গরম করে, তাতে পাঁচ ফোড়ন, একটু রসুন ছেঁচা আর দু’টো কাঁচালঙ্কা-ছেঁচা ফোড়ন দিয়ে, ঐ তেলেই নুন-হলুদ-মাখা ছোটো চিংড়ি ভেজে নিত মা। তারপর জল দিয়ে ফুটিয়ে পাতলা ঝাল করত। এই রান্নাটা খুব ভালো লাগে আমার। এছাড়া শুধু পাঁচ ফোড়ন, কাঁচা লঙ্কা, টমেটো, হলুদ, নুন দিয়েও ঝাল করত। লোকজন এলে একটু তরিবত করার জন্য শুকনো লঙ্কা আর সর্ষে বাটা যোগ করে দিত। চিংড়ি মাছের মালাইকারিতে কিন্তু মা পেঁয়াজ দিত না, নারকেল-কোরা-বাটাও না। সর্ষের তেলে জিরে, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে চিংড়িগুলো ভেজে নিত। তারপর হলুদ, আদাবাটা, জিরেবাটা, নুন, মিষ্টি দিয়ে কষে, নারকেল দুধ দিয়ে ফোটাত। কাঁচালঙ্কা দিয়ে মাছের ঝাল বা ঝোলে মা নামানোর দু’মিনিট আগে ফুটন্ত কড়ায় একটু কাঁচা তেল ছড়িয়ে দিত। ঐ ঝাঁঝটা রান্নায় মিশে গিয়ে বেশ ভালো লাগত। এইসব রান্নায় মিষ্টি পড়ত না। কিন্তু কালিয়া বা মালাইকারি জাতীয় তরিবতের রান্নায় মিষ্টি পড়ত, আর নামানোর আগে কাঁচা তেল দেওয়া হত না। আমি বিয়ের পরে রান্না করতে গিয়ে, ল্যান্ডলাইনে ফোন করে করে মায়ের কাছ থেকে পদ্ধতি জেনে নিতাম। নিজের মনে একটা ব্যাকরণ ঠিক করে নিয়েছিলাম।
রাতের দিকে মা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডালনা করত। নানারকম উপকরণ দিয়ে ডালনা হত, যেমন - পাঁপড়ের ডালনা, পেঁপের ডালনা, পটলের ডালনা, কাঁচকলার ডালনা, শীতকাল হলে ফুলকপির ডালনা, গ্রীষ্মের শুরুতে এঁচোড়ের ডালনা, ছুটি থাকলে ছানার ডালনা – এইরকম হত। আর সব যুগের হিট আইটেম ডিমের ডালনা তো ছিলই। কখনও সখনও আলু কড়াইশুঁটির দমও বানানো হত। তবে ডিমের ডালনা বাকি পৃথিবী আলু সেদ্ধ করে করলেও, বাড়িতে মা জিরে, তেজপাতা, গরম মশলা ফোড়ন দিয়ে আলু ভেজে করত।
আলুর দম আর ধোঁকার ডালনা আমাদের বাড়িতে রান্না হত না। তার কারণ হল, বাগবাজারে একটা ছোট্ট দোকান ছিল। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত সেখানে শালপাতার খুরিতে গোল গোল ছোটো আলুর লাল টকটকে দম বিক্রি হত। কাঠি ফুটিয়ে আলু তুলে খেতে হত। আর ফড়িয়াপুকুরে টকি শো হাউসের রাস্তায় আর একটা ছোট দোকানে ধোঁকার ডালনা বিক্রি হত। ও দু’টো জিনিস খেতে ইচ্ছে হলে বাবা দোকান থেকেই আনত। আমরাও ইস উস করে নালে ঝোলে হয়ে উদরপূর্তি করতাম। এছাড়া ঘুগনি আর ছোলার ডাল নিয়েও একই কথা। ইস্কুল থেকে ফেরার পথে, বাগবাজার স্ট্রিটে একটা ছোটো দোকানের বেঞ্চে বসে আমরা – মানে মা, আমি, বোন – প্রায়ই ঘুগনি খেতাম। আর শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে দীনেন্দ্র স্ট্রিটের মুখের দিকে হেঁটে এলে, বাঁদিকের ফুটপাতের ধারে বেশ কিছু মিষ্টির দোকান ছিল। ওখানে আমরা কচুরি আর ছোলার ডাল খেতাম। ছোটবেলায় যখন প্রেশার কুকার ছিল না, তখন বাড়িতে ঘুগনির মটর, ছোলার ডাল সেদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব ছিল। কারণ আবাসনে যে জল কলে আসত, তা হল লালচে, কষা, ভূগর্ভস্থ জল। ঐজন্য বৃষ্টি নামলেই অনেক বাড়ির গিন্নি মাঠে হাঁড়ি-কুড়ি বসিয়ে দিতেন। কিন্তু নিবেদিতা ইস্কুলের চাকরির জন্য মায়ের পক্ষে ওসব করা সম্ভব ছিল না। দোকান থেকে আর কয়েকটা জিনিস খুব খেতাম, পাঁচমাথার মোড়ের গোলবাড়ি থেকে ডিমের ডেভিল আর মুগের লাড্ডু। অন্য সব দোকানে লম্বা করে কাটা অর্ধেক ডিমের ডেভিল হত। কিন্তু গোলবাড়ির ডেভিলে আস্ত ডিম থাকত। মুগের লাড্ডু আমি এত ভালোবাসি বলে, আজও আমার মেজ-নন্দাই যখন পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদা থেকে আমাদের বাড়িতে আসেন, তখন বড় কৌটো ভর্তি করে স্পেশাল সাইজের মুগের লাড্ডু অর্ডার দিয়ে বানিয়ে আনেন আমার জন্য। ওঁর চেনা দোকানে ওটা ভালো করে। আরও একটা জিনিস ছিল। শ্যামবাজার আর বাগবাজারের সন্ধিস্থলে দ্বারিকের দোকানে, বিরাট উনুনে ফেনা-ওঠা দুধ ফুটত। লোকে এক গ্লাস দুধ কিনে খেত, আর তাতে রসগোল্লার রস মিশিয়ে পরিবেশন করা হত। ঐ দুধের গেলাস বড় প্রিয় ছিল, মাঝে মাঝে খেতাম। সেদিন বহু বছর পরে গিয়েছিলাম ঐ দোকানে – ঠাটবাট সব পাল্টে গেছে। ছানার মুড়কি আর ক্ষীরের চপ কিনলাম কন্যাকে খাওয়াবো বলে। ছোটোবেলায় ক্ষীরের সিঙাড়া খুব ভালো লাগত। সেটা ছেলেবেলাতেই লুকিয়ে আছে। আজ আর খুঁজে পাই না।