১
“আমার নৌকা ভাসাইয়া জলে
চেয়ে থাকি বসি তীরে।
ছোট ছোট ঢেউ উঠে আর পড়ে,
রবির কিরণে ঝিকিমিকি করে,
আকাশেতে পাখি চলে যায় ডাকি,
বায়ু বহে ধীরে ধীরে।”
কুমুদিনী স্মৃতি ফুটবল – খাদ্য উৎসব শেষ। পরদিন সকালে বক্সিবাড়ির দোতলার চওড়া বারান্দায় রোদে বসে আছি মায়েতে মেয়েতে। রোজকার মতোই আবার শুরু হয়েছে আড্ডা আর গুলতানি। এবাড়ির লোকেরা অবশ্য দোতলাকে বলে ছাদ। কেন যে এমন বলে, জিজ্ঞেস করলে তারা হাসে, অর্থাৎ উত্তর নেই – এটাই অভ্যেস।
– মা বললে না তো আমার রান্নাটা কেমন হয়েছিল?
– কেন, সবাই তো ভালই বলেছে।
– তবু, তুমি তো বলোনি।
– তোর ইলিশের ঝালটা আর একটু নুন দিলেই নোনতা হয়ে যেত।
– মানে?
– মানে, তুই প্রশংসা শুনতে চাইছিলি। কায়দা করে সমালোচনার ঢঙে বললাম – ঠিক ছিল।
– কামড়ে দেব মা তোমায়, হাঁ-আঁ-আঁ…
– ঐ মৌমাছি আসছে, হাঁয়ের ভেতর মৌচাক বানাবে।
– আর জেঠিমা আমারটা?
– তোর ডাব চিংড়িটা আর সামান্য এক পরত নুন হলে ঠিক ছিল। একটু আলুনি হয়েছিল।
– অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ…
– চেঁচাস না, উনুনে ঢোকানোর আগে চামচে তুলে একটু চেখে নিতে হত।
– তরকারিতে নুন কম বেশি হলে কী করতে হয় গো মা?
– কম হলে খুব একটা অসুবিধে নেই, দিয়ে খাওয়া যায়। বেশি হলে বিপদ।
– বেশি হলে কী করব?
– রান্না অনুযায়ী হবে। ধর, মাংসের ঝোলে নুন বেশি হয়েছে। তখন গরম জল মিশিয়ে ঝোল পাতলা করতে পারিস। যদি দেখিস আর জল মেশালে গামছা কাঁধে ঝোল পুকুরে নামার অবস্থা হবে, তখন এক দেড় চামচ টক দই, এক চিলতে হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো আর ময়দা মিশিয়ে দিতে পারিস। টকে নুন টেনে নেবে, ঝোলও পাতলা হবে না। দইয়ে হলুদ, লঙ্কা মিশিয়ে দিলে রংটাও হাল্কা হবে না। আবার ধর ঘুগনি জাতীয় কিছুতে নুন বেশি হলে তেঁতুল গোলা জল বা লেবুর রস মেশানো যেতে পারে। যদি টমেটো দেওয়া রান্না হয়, তবে টমেটো ঘিসনিতে ঘষে পিউরি বানিয়ে আলাদা ফোড়ন কড়ায় একটু ফ্রাই করে মিশিয়ে দেওয়া যেতে পারে। হাল্কা ফ্রাই না করলে আবার কাঁচা টমেটোর গন্ধ উঠবে।
তবে হাল্কা পাতলা মাছের ঝোলে, ডালনায়, দমে নুন বেশি হলে আমার মা চাকা করে আলু কেটে ঝোলে ফেলে দিত। আলুতে নুন টেনে নেয়।
– চাকা করে কেন?
– দুটো কারণ। একদম চাকা আলুভাজার মতো পাতলা কাটলে হবে না। চাকা কিন্তু একটু মোটা করে কাটতে হবে। ওভাবে কাটলে সারফেসটা বেশি থাকে। তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়। আসলে নুন বেশিটা তো আমরা বুঝতে পারি রান্নার একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে। তখন আবার এক প্রস্থ আলু দিয়ে ফোটাতে গেলে তো বাকি উপকরণের দফারফা হবে। তাই এই কৌশল।
– রান্নাটা হাল্কা, পাতলা, অথচ আলু দিয়ে নয়, তখন কী করব জেঠিমা?
– তখন আলু ফেলে নুন টানিয়ে নিবি। তারপর হাতা দিয়ে টুকটুক করে আলুগুলো তুলে নিবি। পরের বেলার রান্নার সময়ে কিছু একটায় আলুগুলো চালিয়ে দিবি।
– হুম, আলু ফেলা যাবে না?
– ফেলবি কেন? মশলাদার তরিবতের রান্নায় অনেক সময় বেশ কিছুটা মশলা বা কাই থেকে যায়। সেগুলোও কায়দা করে পরের বেলায় মিশেল দিয়ে দিতে হয় কখনও সখনো।
– কাই? কাইটা কী? হি হি।
– খুব হাসি পাচ্ছে, না? আমাদের উত্তর কলকাতায় গ্রেভিকে বলে কাই। তোদের এখানে যে তরকারির গ্রেভিকে বলে জুস, তার বেলা? শুনে আমারও দমফাটা হাসি আসে। বলে মাছের টকের জুস নেবে? মাংসের জুস নেবে? আমিও মনে মনে বলি, হ্যাঁ, মাংসের অরেঞ্জ জুস দাও। মাছের টকের ম্যাঙ্গো জুস দাও। মুখে কিছু বলি না।
– জেঠিমা, তুমি উত্তর কলকাতার হতে পারো, কিন্তু আমরা মেদিনীপুরের মেয়ে।
– তাতে কী? তুই যদি কাই শুনে হাসিস, আমিও জুস বলে খোঁটা দেব।
– দিদি শান্তি, মা শান্তি। কাইও না, জুসও না। গ্রেভি চলুক। ওটা আন্তর্জাতিক। কিন্তু মা, একটা কথা আছে। একটা রান্নার গ্রেভি, অন্য রান্নায় চার্জ হলে, গন্ধটা যে ছিটকোবে, সেটায় গোলমাল হবে না?
– হবে তো, নিশ্চয়ই হবে, বুঝতে পারলেই অনেক অধৈর্য অশান্ত খাদক চেঁচাবে, গুষ্টির তুষ্টি করবে।
– হি হি, বাবা যেমন করে, তাহলে?
– তাহলে বুদ্ধি করতে হবে। যে মশলাটা বেঁচেছে, এমন রান্নায় সেটা মেশাতে হবে, যাতে উপকরণগুলো কমন। হিং দেওয়া নিরামিষ ছানার ডালনায়, তুই যদি এখন ডিমের কষার গ্রেভি মেশাস, সেটা কি চলবে? এমনভাবে মিশেল দিতে হবে, যাতে কেউ খেয়ে বুঝতে না পারে। আর যদি না হয়, তো ফেলা যাবে। পরিবারের হেলথ হাইজিন তো রান্নাঘরে। তার সঙ্গে তো আপস করা যায় না।
– তাহলে এই মিশেলের দরকার কী, যখন অধৈর্য, অশান্ত খাদক গালি দেবে?
– অধৈর্য, অশান্ত খাদকের চেঁচানি তুই বন্ধ করতে পারবি না। ওরা চায় ভাল ভাল রান্না হোক। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যখন তেল-মশলা তাড়াতাড়ি ফুরোবে, আবার কিনতে হবে, তখনও ওরা চেঁচাবে। তাই ওসব ভেবে লাভ নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কখন কীভাবে আয় দেখতে হবে, খরচ কমাতে হবে, বা খরচ করতে হবে, সেগুলো রান্নাঘরের সিদ্ধান্ত। আর সঠিক সিদ্ধান্ত – অভিজ্ঞতা আর হাতের জাদুর ওপরে নির্ভর করে। বুঝলি কিছু?
– বুঝলাম মা, বুঝলাম। ঐ যে ঠাকুমা তোমায় বলেছিল না। সংসারের সব কথা কিছু মানুষকে বলতে নেই, ওটাই হক কথা।
– জেঠিমা, সংসারে মেয়েদের অনেক ইধার কা মাল উধার করতে হয়, বলো!
– এ্যাই, আমি হেঁশেলের কথা বলছি, সংসারে ইধার কা মাল উধার? সে তো অন্য মানে হয়ে গেল। একটি মেয়ে আমাকে বাড়িতে ফেসিয়াল করতে আসত, অনেক দিন আগে। সে একটা কথা বলেছিল। কথাটা হচ্ছে, “বৌদি, নিজে হাজার টাকা রোজগার করে অত আনন্দ নেই, যত আনন্দ বরের পকেট থেকে দশ টাকা নিয়ে।”
– এ্যাঁ, এ বাবা, ছ্যা, ছ্যা। তুমিও জেঠুর পকেট কাটো জেঠিমা?
– আমাদের বাড়িতে অন্য কেত্তন হয় রে দিদি। মা মাঝে মাঝে ঐ ডিসট্যান্স ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়ে বা স্টাডি মডিউল লিখে কিছু বাড়তি ইনকাম করে। আর আমি জানতে পারলেই মাকে ভজিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যাই। বাবার জন্য খাবার নিয়ে আসি। খাবারটা দিলেই, বাবা চুপি চুপি আমায় জিজ্ঞেস করে, “কী রে, গরম গরম খবর আছে?” আমি তখন খবর চালাচালি করে, সব বাবার কাছে ফাঁস করি। বাবা অমনি পরদিন সকালে ধর্নায় বসে।
– “খবর পেলাম আজ বাজারে বড় বড় গলদা এসেছে, ভাল ভেটকি উঠেছে। দু’হাজার টাকা দাও তো।”
মা চুপচাপ। যখন কিছুই হচ্ছে না, বাবা সেই অফিসে একসঙ্গে চাকরির দিনে ফিরে যায়, তুই তোকারি শুরু করে দেয়।
– “হাজার টাকা দে অন্তত।”
মা চুপচাপ। বাবা বলে চলে, “আচ্ছা, ঠিক আছে, গোটা পাঁচশো দে। দুশো দিবি না, কী হাড় কেপ্পন রে?” আমিও ধুয়ো ধরি, চাইছে যখন দিয়ে দাও না মা। মা আর কী করবে, হেসে ফেলে। এইভাবে মায়ের ঘাড় ভেঙে দু’বার খাই।
– এ্যাঁ, এ কী বলে গো জেঠিমা।
– শোন ভাল করে, তোর বোনটি কী চিজ।
– জেঠিমা, ও জেঠিমা, আমি তো কলেজে ভর্তি হলে, শহরে তোমার কাছে থাকব। তখন, তোমার ঘাড় ভেঙে চারবার করে খাব।
– হা হা হা, হো হো হো। দু’জন একসঙ্গে খাব।
এই না বলে রঞ্জা গান ধরে,
“তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার খ্যাঁটন ভাল চাই...
মনোহরণ সুবাসভরণ স্বাদের রাঁধন চাই...
না না না না না...”
– ওরে, রবিঠাকুরকে আর কষ্ট দিস না তুই।
– জেঠিমা, তুমি সেদিন তোমার গল্পে বিবেকানন্দকে ডেকে এনেছিলে বটে, তোমার গল্পে কিন্তু রবি ঠাকুর নেই।
– কে বলেছে তোদের, রবি ঠাকুর নেই?
– আছেন?
– হ্যাঁ আছেন, আর খুব স্পষ্টভাবেই আছেন।
– কীরকম?
– বিশ শতকের একেবারে গোড়ায় একজন কুমুদিনীকে পাচ্ছি, যাঁর মা লীলাবতীর বিয়েতে, রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দ দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন। আর সেই কুমুদিনীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুত্বও ছিল।
দুই মেয়েই সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, কী বললে?
– মা আমার হাতটা চেপে ধরো দেখি, আমি মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি।
– এখনই অজ্ঞান হোস না। পরে বুঝলাম, ঐ কুমুদিনী আমাদের কুমুদিনী নন।
– তোমার বোঝাটা যে ঠিক, নিশ্চিত হচ্ছ কীভাবে? যাকগে সে যাই হোক, লীলাবতীর বিয়ের গল্পটা বলো। তারপর কী হল?
– বিয়ের গল্পটা তো আর বিশদে জানিনা রে বাবু। অন্তর্জালে লেখা আছে ঐ বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল ১৮৮১ সালে। কিন্তু আমাদের কুমুদিনীর জন্ম আমার হিসেবে ১৮৭২-৭৩-এ। তাই বিয়ে অন্তত ১৮৭১-এ হতেই হবে। এই ১৮৮১ নাকি ১৮৭১ – কোনটা ঠিক এই ভাবতে আমার মনে ঘোরতর সংশয় উপস্থিত হল।
– কী সংশয়?
– মনে হল যে, লীলাবতীর মেয়ে আর আমার মায়ের ঠাকুমা এক মানুষ তো নাকি আলাদা?
– সে কী! তারপর?
– আবার খোঁজাখুঁজি শুরু করলাম। কিন্তু সংশয় নিরসন হওয়া দূর, সন্দেহ বাড়তে লাগল।
– কীরকম?
– রাতের পর রাত আমার কাটে নির্ঘুম। অন্তর্জালের গোলোকধাঁধায় ঘুরে মরি। এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটায় গুগল। গণক যন্ত্রের পর্দায় ফুটে ওঠে ছবি – ‘বোঝবার ভুল’-এর প্রচ্ছদ। যে বই আমার কাছে আছে। মা তুলে দিয়ে গেছে আমার হাতে। সঙ্গে আরও কিছু বই ‘আভা’, ‘লহরী’, ‘সাহিত্যচিন্তা’। পাশে লেখা “বঙ্গলক্ষ্মী কুমুদিনী বসু (মিত্র) - writer, editor, parents Krishna Kumar Mitra। জীবনকাল ১৮৭৮ – ১৯৪৩।”
– ১৮৭৮? তাহলে মা লীলাবতীর বিয়ে ১৮৮১-এ তো হতে পারে না।
– দু’জন আলাদা হলে হতে পারে। আরও লেখা আছে যে, ১৯০৭ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত তিনি ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকা এবং ১৯২৫ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন। নামের পাশে লেখা আছে, লেখিকা, সম্পাদিকা। রচনার প্রকার হিসেবে লেখা আছে সাহিত্য ও সাংবাদিকতা। সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের ওয়েবসাইটে দেখছি ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ের প্রথম যুগের স্বনামধন্য ছাত্রীতালিকায় প্রথমটিই তাঁর নাম।
– আচ্ছা!
– কিন্তু সেকালের মেয়েদের কলেজ খুঁজে দেখছি ওনার নাম পাচ্ছি না। বেথুন কলেজের ওয়েবসাইটে কামিনী রায়ের নাম আছে, কুমুদিনীর নেই। তাহলে কলকাতায় বসে গ্র্যাজুয়েশন করলেন কোথা থেকে? আমাদের কুমুদিনীর শ্বশুরবাড়িতে অনেক শিক্ষিকা আসতেন শুনেছি মায়ের কাছে, এমনকি মেম টিচারও। তবে কি প্রাইভেটে পরীক্ষা দিলেন? পরে অবশ্য জানতে পারলাম, তিনি বেথুন কলেজ থেকেই গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন।
– কী করে জানলে?
– কুমুদিনীর বাবা কৃষ্ণকুমার মিত্রের আত্মজীবনী পড়ে।
– তাই নাকি? তারপর?
– খুঁজতে খুঁজতে এবারে আমি একটা পিএইচডি থিসিসের সন্ধান পেলাম। ২০০৭-এ প্রকাশিত সুতনুকা ঘোষের লেখা। এখানে পরিষ্কার করে লেখা আছে যে লীলাবতী মিত্র অল্পবয়সে বিবাহের কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাই কন্যাদের শিক্ষার বিষয়ে খুবই যত্নবান ছিলেন। এই রিপোর্টের ৯৪ পাতায় লেখা আছে, কোনো এক কুমুদিনীকে তাঁর স্বামী বাড়িতে প্রাইভেটে পড়িয়েছেন। কিন্তু সেই কুমুদিনীর পাশে কোন পদবি নেই। তাহলে কাকে ধরব? আবার পাশে সোর্সও লেখা নেই, যে সেখান থেকে দেখব। তার ওপর লেখা আছে স্বামী ব্রাহ্ম। আবার ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকার লেখাগুলো থেকে দেখছি – এই কুমুদিনী সহিংস বিপ্লবী আন্দোলনকে তাঁর লেখায় সমর্থন করেছেন এবং সেযুগের এমন সমর্থনকারী মহিলাদের তালিকায়, ভগিনী নিবেদিতার নামও আছে।
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ রে, এই দেখ রেফারেন্স, মোবাইলে আছে।
(Ref. Becoming a Bengali Woman: Exploring Identities in Bengali Women’s Fiction, 1930-1955, Sutanuka Ghosh, Ph. D Thesis, School of Oriental and African Studies, University of London, July 2007)
– বাঃ, তাহলে তো এই ধন্দটারও নিষ্পত্তি হয়ে গেল।
– না হল না। ইনি আমার মায়ের ঠাকুমা কিনা, সেটা তো বোঝা বাকি।
– তা বটে। কন্টিনিউ।
– indianculture.gov.in-এ দেখছি তাঁর লেখা ‘লহরী’ কাব্যগ্রন্থটি পড়া যাচ্ছে। ১২৯৩ বঙ্গাব্দের ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে নভেম্বর প্রথম সংস্করণ ঢাকা থেকে শ্রী গোপীনাথ বসাক কর্তৃক মুদ্রিত হল। প্রকাশক অতুলচন্দ্র বসু। বই থেকে জানা যাচ্ছে, ‘লহরী’র কিছু কবিতা ‘সাধারণী পত্রিকা’, ‘ঢাকা প্রকাশ’ এবং ‘সারস্বত পত্র’-এ প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলির সঙ্গে আরও নতুন কবিতা একত্রিত করা হয়েছে। আরও লেখা রয়েছে, “লেখিকার বয়স অল্প এবং ইহাই তাঁহার প্রথম উদ্যম। প্রায় আড়াই বৎসর হইল, লেখিকা যখন বালিকা, তখনই তাঁহার কবিতা ‘সাধারণী’তে প্রকাশিত হয়।” একজায়গায় লেখা আছে যে, শ্রীযুক্ত বাবু অক্ষয়চন্দ্র সরকার, কবিতার দুই একটি স্থল সংশোধন করে দিয়েছেন। শেষে লেখা আছে, “এই সমস্ত পর্যালোচনা করিয়া সহৃদয় পাঠক, কবিতায় যে কোনো ত্রুটি থাকুক, মাপ করিয়া লইবেন।” সবই তো পড়ছি, গুগল অনুযায়ী যদি ধরে নিই, কুমুদিনীর জন্মসাল ১৮৭৮ অর্থাৎ ১২৮৫ বঙ্গাব্দ, তবে ‘লহরী’ প্রকাশিত হওয়ার সময়ে তাঁর বয়স হবে আট বৎসর। এবং বইয়ের ভাষ্য অনুযায়ী কিছু কবিতা আরও আড়াই বছর আগে থেকে ‘সাধারণী’তে প্রকাশিত হচ্ছে, অর্থাৎ ছয় বছর বয়স থেকে? তাহলে তো সেটা অস্বাভাবিক প্রতিভা। কিন্তু তেমন কিছু বইতে লেখা নেই। আর কবিতাগুলিও প্রণিধানযোগ্য।
– কেমন কবিতা মা?
– দেখাচ্ছি দাঁড়া। এই যে আমি স্ক্রিনশট তুলে রেখেছি।
– ওরে বাবা, এ যে লম্বা লম্বা কবিতা। তুমি পড়ে শোনাও মা।
– পড়ছি শোন। ১৪ নম্বর কবিতা এইরকম –
“...হেসে আয় প্রভাবতী,
আর না কাঁদিবে সতী,
ভারতের চিরদুঃখী কুমারী-কুমার গণে;
শ্বেতাঙ্গ চরণে পড়ি,
কত সুখ হরি হরি,
বুঝিবে হাসিবে, সবে এ শুভ মাহেন্দ্রক্ষণে...”
ইত্যাদি অনেক কবিতাতেই বিদেশি শাসন বিরোধিতার নির্যাস পাওয়া যাচ্ছে।
বেশ কয়েকটি কবিতা রয়েছে, যেগুলির শিরোনাম ‘আর্য সঙ্গীত’। সেরকম একটা পড়ছি শোন –
“অসীম উচ্ছ্বাস ভরে,
মধুর অমিয়া ধারে,
গাও সবে জয় জয় ভারত জননী;
জগতের প্রতি স্তরে
ঘোষিবে প্রদীপ্ত স্বরে,
সে মহাসঙ্গীত স্রোত দ্রুত প্রতিধ্বনি।
হৃদয়ের অভ্যন্তরে, আছে গো লুকায়ে
এখনও বীরপণা,
সে পূর্ব্ব শোণিত কণা,
আছে পূর্ব্ব তেজ বহ্নি ভস্ম আচ্ছাদিত;
আবার তেমতি ভাবে,
নব জ্যোতি আবির্ভাবে,
শিরায় শিরায় বেগে হবে প্রবাহিত।”
অল্পবয়সে লেখা জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থে যে জাতীয়তাবোধ এবং শব্দচয়ন দেখা যাচ্ছে, তা কি ছয় বা আট বছরের মেয়ের হওয়া সম্ভব? লেখাপড়া তো শুরুই হয় ওই বয়সে। তাছাড়া সেকালে জন্মসালের নথিও থাকত না। আচ্ছা এই ‘লহরী’ বইটি সত্যি সত্যি কি আমার কুমুদিনীর লেখা? নাকি ইনি অন্য কেউ? অথচ বোঝবার ভুল এবং ‘লহরী’-র ডিজাইন, অক্ষর, ফন্ট সব একরকম। কিন্তু প্রকাশক হিসেবে যাঁর নাম রয়েছে, তিনি কে? কে এই অতুলচন্দ্র বসু? এনার নাম তো আমার চেনা নয়। বাবলিদিও চিনতে পারছে না।
– তারপর তারপর?
– southasiaarchive.gov.in-এ ‘সুপ্রভাত’ পত্রিকার কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে, যেখানে মুখবন্ধ সমেত বেশ কিছু প্রবন্ধের লেখিকা শ্রী কুমুদিনী মিত্র। তাহলে কি কুমুদিনী সিটি কলেজের অধ্যাপক বাবার পরিচিতি কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন? কারণ উনি যদি মায়ের ঠাকুমা হন, ঐ সময়ে বিয়ে হয়ে কুমুদিনী বসু হয়ে যাবার কথা। লেখাগুলো বেশ বিভিন্ন রকমের, যেমন – ‘গুরু অঙ্গদ’, ‘শিশু জীবন’, ‘গার্হস্থ্য প্রসঙ্গ’, ‘স্বাস্থ্য প্রসঙ্গ’, ‘প্রাপ্ত গ্রন্থাদির সমালোচনা’ প্রভৃতি। ‘লহরী’ ছাড়াও তাঁর লেখা অনেকগুলি বইয়ের নাম পাচ্ছি। যেমন ‘শিখের বলিদান’, ‘অমরেন্দ্র’, ‘পঞ্চপুষ্প’, ‘আভা’, ‘সাহিত্যচিন্তা’। আর ‘বোঝবার ভুল’ উপন্যাস ও ‘পূজার ফুল’ আমার নিজের বাড়িতেই আছে। ‘আভা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হচ্ছে ১৩১১ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লা থেকে। লেখা আছে “চাকলা রাধাকিশোর যন্ত্রে শ্রী নীলাম্বর দত্ত কর্তৃক মুদ্রিত”। অন্তর্জালে ‘আভা এবং ‘সাহিত্যচিন্তা’ বইদুটি পড়াও যায় দেখছি। কিন্তু ‘আভা’ পড়তে গিয়ে আমার মনে ধন্ধ জাগছে। মুখবন্ধে লেখা আছে, এই লেখিকাই কিছু বৎসর আগে ‘লহরী’ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু বাকি বইগুলোর তো নাম দেখছি না। আরও লেখা আছে, লেখিকার পিতা শ্রীযুক্ত বাবু মদনমোহন মিত্র ত্রিপুরাধীপ স্বর্গীয় বীরচন্দ্র মাণিক্য বাহাদুরের সভাকবি ছিলেন। লেখিকার স্বামী শ্রীযুক্তবাবু অতুলচন্দ্র বসু। প্রকাশক শ্রী মহিমচন্দ্র দেব বর্ম্মা। আর বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে “পরম পূজ্যপাদ স্বাধীন ত্রিপুরেশ্বর শ্রী শ্রীযুক্ত মহারাজা রাধাকিশোর দেববর্ম্মা মাণিক্য বাহাদুরকে”। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের পরিবারের কারোর ত্রিপুরার রাজার সঙ্গে মোলাকাত হয়েছে, এ আমি কস্মিন কালেও শুনিনি। আর আমাদের কুমুদিনী বসুর স্বামী তো শরৎচন্দ্র বসু। আমার মায়ের তিনি ঠাকুরদা। যদিও বাবলিদি বলছে, তখনকার দিনে এখনকার মতো সার্টিফিকেটের ব্যাপার ছিল না, তাই এক লোকের দু’তিন রকম নাম থাকত। আচ্ছা মেনে নিলাম ওর কথা। আরও এগোনো যাক।
এবারে ‘সাহিত্যচিন্তা’ বইটি ডাউনলোড করে পড়তে বসলাম। কিন্তু একী! এ বই তো ওনার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়েছে। মুখবন্ধের লেখা ধরলে এই কুমুদিনীর মৃত্যু হয়েছে ১৯২৫ সালের আগে। কিন্তু আমার কুমুদিনীর মৃত্যু ১৯৪২ বা তার একটু পরে, মানে আমার ছোট মামার যখন দু’বছর বয়স, তখন। সব থেকে বড় কথা হল, লেখিকার একটা ছবি আছে, বইতে। সে ছবি যত অস্পষ্টই হোক, তাঁর ছবি আমাদের পারিবারিক অ্যালবামে রাখা কুমুদিনী বসুর সাথে মেলে না। তার মানে আমার প্রাথমিক খটকাই ঠিক। ‘সাহিত্যচিন্তা’য় পাওয়া যাচ্ছে, এই কুমুদিনীর লেখা বইগুলি হল, ‘লহরী’, ‘অমরেন্দ্র’, ‘পঞ্চপুষ্প’, ‘আভা’ ও ‘সাহিত্যচিন্তা’।
উফফ, একটা শান্তি পেলাম। তার মানে সমকালে দু’জন কুমুদিনী আছেন এবং বাকি বইগুলো দ্বিতীয় কুমুদিনীর লেখা। দু’জনেই বিয়ের পরে বসু, বিয়ের আগে মিত্র এবং লেখিকা। বইয়ের নকশাও এক। বইগুলো না পড়লে তফাত বোঝা যাবে না।
– এ তো গোয়েন্দা গল্প জেঠিমা। নাম মিলে গেছে বলে গুগল সব গুলিয়ে গ আর ঘেঁটে ঘ করে ফেলেছে।