২২
আমরা মনখারাপের সঙ্গে লড়াই করার জন্য কলেজে মাঝেমাঝেই মনোবিজ্ঞানীদের নিয়ে ওয়েবিনার করছিলাম, যাতে তাঁরা আমাদের বাঁচার কোন পথ বাতলে দিতে পারেন। তাঁরা বলেছিলেন বই পড়তে, বিশেষ করে জীবনীমূলক বই। পরীক্ষা শেষ হবার পর, আমি পূর্ব দিনের মহামারীগুলি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম স্বামী বিবেকানন্দের লেখা প্লেগ ম্যানিফেস্টোর প্রথম কয়েক লাইন বাদ দিলে প্রায় পুরোটাই যেন করোনার সাবধানতার সঙ্গে মিলে যায়। সেই একই পরিচ্ছন্নতার বার্তা, টাটকা আর পুষ্টিকর খাবারের পরামর্শ। ডাক্তার আর জি করের প্লেগের ওপরে লেখা একটি বই হাতে এলো। নতুন করে ছাপা হয়েছে। দ্বিতীয় কুমুদিনীর বাবা কৃষ্ণকুমার মিত্রের আত্মচরিত পড়লাম। হজরত মহম্মদের ওপরে লেখা তাঁর বইটি আন্তর্জালে খুঁজে পেলাম। অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে জগৎ ভুলে পাগলের মত কেবল পড়েই যেতে লাগলাম। বই থেকে মুখ তুললে যত রাজ্যের আতঙ্ক এসে ধরে, তাই কেবল বইয়ের আড়ালে আড়ালে আমার দিন কাটতে লাগল। অবাক হলাম যে দীর্ঘ লকডাউনে বহু মানুষ অতীত চর্চা করছেন, পুরোনো বইগুলি পুনঃপ্রকাশিত হচ্ছে। এই ফিরে দেখা, পুনরুদ্ধার, এগুলি লকডাউনের কালো মেঘের মাথায় বিদ্যুতের রুপোলি রেখা। এরই মধ্যে একদিন বেশ সকালে হঠাৎ এক ছাত্রী ফোন করে খুব কুণ্ঠিত হয়ে আমাকে একটা প্রশ্ন করল।
- ম্যাডাম আপনাকে একটু বিরক্ত করে ফেললাম, আসলে একটা ভীষণ দরকার, তাই আপনার কথা মনে হল, কিছু মনে করবেন না।
- মনে করার কী আছে, কী বলবে বলে ফেল।
- মানে ম্যাডাম জিজ্ঞেস করছি যে…
- হ্যাঁ বল।
- অসুস্থ লোকের জন্য মাগুর মাছের স্টু কীভাবে হয় জানেন ম্যাডাম?
প্রশ্নটা শুনে প্রথম ধাক্কায় চমকে গেলাম। ওকে বাড়িতে বলে দেবার কেউ নেই? ওর সমস্যাটা কী?
দ্বিতীয় ঝটকায় মনে হল, মাকে একবার জিজ্ঞেস করে কনফার্ম হয়ে ওকে বলব। তিন নম্বর ঢেউয়ের চাপে ধরাশায়ী হলাম, যখন মনে পড়ল মা নেই, চট করে কিছু জিজ্ঞেস করার আর কেউ নেই আমার। বুকটা হু হু করে উঠল। এ যে কী শূন্যতা, তা যে নিজে না ভুগেছে, সে বুঝবেনা।
- বাড়িতে তোমার কে অসুস্থ আফ্রিনা?
- ম্যাম, বাবা মা দুজনেই।
- তুমি কি এক মেয়ে?
- হ্যাঁ ম্যাম।
- তুমি রান্না করতে জান? আগে কখনও করেছ?
- না ম্যাম, আগে সেভাবে একা করিনি রান্না। মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে একটু আধটু হয়তো হাত লাগিয়েছি। বাবা বলে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। হেঁসেলে ঢুকবে পরে। তাই সেভাবে আর শেখা হয়নি।
- পাশে কোন আত্মীয় স্বজন নেই? রান্না করে কদিন পাঠিয়ে দেবেন।
- না ম্যাম আত্মীয় স্বজন সব দূরে গ্রামে থাকেন। আমরা তো বকুলতলায় থাকি। আত্মীয় স্বজন সব বাগনানের দিকে গ্রামে থাকেন।
- তুমি গ্যাস ধরাতে জান?
- হ্যাঁ, তা পারব।
- তুমি মাগুর মাছ কোথায় পেলে?
- ফোন করেছিলাম, বাজারের মাছের কাকু কেটেকুটে দিয়ে গেছেন।
- তোমার ফোনে নেট আছে, নাকি ভরে দেব?
- আছে ম্যাম।
- আমি ভিডিও কল করছি, তুমি ধর।
- বলুন ম্যাম।
- মা বাবা এখন কেমন আছেন?
- জ্বরটা দুজনেরই নেই, আগে বাবার হয়েছিল। মা তো কাল অবধি সব করেছে। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল। আজ পজিটিভ রিপোর্ট এসেছে। বাবার ঘরেই বন্দী হয়েছে। আমি এখন বাইরের ঘরে একা। মা বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না, এতটাই দুর্বল। অনেকেই বলছে জিওল মাছের ঝোল খাওয়ালে তাড়াতাড়ি ভালো হবে। তাই আনিয়েছি।
- বুঝলাম। একশ চল্লিশ কোটি মানুষের দেশে কারোর পক্ষে একা হওয়া সম্ভব নয়, বুঝেছ? কেউ একা নয়। মানুষ মনে একা হয়। মনটা ঠিক কর, একদম ভয় পাবেনা। অক্সিমিটার দিয়ে নিয়মিত চেক করছেন তো বাবা মা?
- হ্যাঁ ম্যাম।
- তুমি টেস্ট করিয়েছ?
- হ্যাঁ ম্যাম, নেগেটিভ।
- বাঁচা গেছে। কড়াটা ধুয়ে গ্যাসে চাপাও। ও কী হচ্ছে, শুধু সামনে নয় বাসনের পিছনটাও ধুতে হয়। কোন মাকড়সা হয়তো বসে আছে, টুক করে উঠে এসে ঝোলে সাঁতার প্র্যাকটিস করবে বলে। ভাত হয়েছে?
- না ম্যাম।
- তাহলে আগে মাছ নয়, ভাত চাপাও, এখন সকাল সাড়ে সাতটা। সাড়ে নটার মধ্যে সব কিছু শেষ করে দশটায় ক্লাসে জয়েন করতে হবে। ইয়োর টাইম স্টার্টস নাও। আমিও এদিকে নিজের রান্না সারি। তোমার ঘরে সব্জি কী আছে দেখাও। পেঁপে আর পটল ভাতে দিয়ে দাও। ভাত হয়ে গেলে পেঁপের টুকরোগুলো বের করে মাখন, গোল মরিচের গুঁড়ো দিয়ে মেখে দেবে। আর পটলগুলো মেখে তার সঙ্গে কয়েক ফোঁটা সর্ষের তেল, পেঁয়াজ কুচো আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখবে।
- ভাতে পেঁপে, পটল দিয়ে দিয়েছি ম্যাম।
- ঘড়িতে টাইম দেখো। পঁয়ত্রিশ মিনিট হয়ে গেলে নেড়ে নেড়ে দেখবে, ভাত হয়েছে কিনা। ফ্যান গালতে জান তো?
- হ্যাঁ।
- এবারে এদিকের গ্যাস ওভেনটায় ডাল বসাও। কী ডাল করবে?
- বিউলি করলে হবে ম্যাম? মা ভালোবাসে।
- হ্যাঁ তা হবে না কেন? ডাল ধুয়ে প্রেশার কুকারে চাপা দিয়ে দুটো সিটি দাও। আমি এদিকে আমার ভাত নামাই।
- দুটো সিটি পড়ে গেছে ম্যাম।
- খুন্তি দিয়ে সাবধানে হুইসলটা তুলে ধরে ভাপ বের করে ঢাকনা খোল। কড়ায় এক পলা সর্ষের তেল গরম কর। তিন চারটে রসুনের কোয়া থেঁতো কর। দুটো শুকনো লঙ্কা আর রসুন ফোড়ন দিয়ে ডালটা ঢেলে দাও। নুন দিয়ে স্বাদটা একবার চেখে নাও। এক চিমটে হলুদ দিয়ে দাও।
- এমন প্লেন রসুন ফোড়নে বিউলির ডাল ম্যাম?
- খেয়ে আমাকে বলবে। এখন কী আর একতাল আদা মৌরি বাটা তোমার পক্ষে সম্ভব? সকালে বাবা মাকে কী খেতে দিয়েছ?
- কিছু খেতে চাইছেনা ম্যাম। শুধু একটু জল মুড়ি।
- সেকি, দুধ কলা মুড়ি দিতে পারতে।
- শুনছেনা কোন কথা। বাবা মায়ের ওপরে আমি কী বলব ম্যাম?
- এ আবার কী কথা? এখন ওঁরা নিজেরা কথা বলছেননা। বলছে ওঁদের অসুখ। অসুখটা তো তোমার মা বাবা নয়। চাপ দিয়ে, বাবা, বাছা করে, বকে ঝকে যে করে হোক খাওয়াতে হবে।
- ঠিক বলেছেন ম্যাম, আমি এবারে ব্ল্যাকমেল করে বাবা মাকে খাওয়াব। বলব না খেলে আমিও উপোষ।
- যা করবে, বুঝেশুনে; উদ্বেগ বাড়ে এমন কিছু কোরোনা। আগে বুঝিয়ে বলবে। তুমি কী খেয়েছ সকাল থেকে।
- কিছু হয়নি খাওয়া। সময় পাইনি।
- সময় পেয়েছ। ইচ্ছে আর বিচার বুদ্ধি কম বলে খাওনি।
- এখন খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে ম্যাম।
- আমার দিকে তাকাও, এই গ্লাসে কী? নিজে রান্না করছি, তোমাকে করাচ্ছি। সঙ্গে ছাতুর শরবৎ খাচ্ছি ঘন করে। পেট্রোল না দিলে ইঞ্জিন চলবে?
- ওহ, আমারও ছাতু আছে।
- এক গ্লাস জলে তিন চার চামচ ছাতু দিয়ে নুন, মিষ্টি, লেবু দিয়ে ঢক ঢক করে গলায় ঢালো। তুমি পড়ে গেলে বাবা মায়ের কী হবে?
- ডাল ফোড়ন দেওয়া হয়ে গেছে ম্যাম।
- একটু ফুটুক, নুনটা দেখে নিয়ে নামিয়ে দেবে। ভাত দেখ।
- আপনি কী রান্না করছেন ম্যাম?
- লাউ দিয়ে ভাজা মুগের ডাল আর পার্শে মাছের পোস্ত দিয়ে ঝাল।
- এখন সাড়ে আটটা ম্যাম, আমার ভাত, ডাল দুটোই হয়ে গেছে।
- খুব ভাল। তোমার মাগুর মাছের টুকরোগুলো ক্যামেরার সামনে দেখাও তো!
ওতে লালা রয়েছে। খুব ভাল করে ধুতে হবে। মাথার শুংগুলো ভাল করে কাঁচি দিয়ে কেটে দাও।
এবারে যা বলছি মন দিয়ে শোন, দুটো মাঝারি আকারের পেঁয়াজের ওপরের খোসাটা ছাড়াও। একটা আলু চাকা চাকা করে কেটে নাও। একটা প্লেটে দুটো ছোট এলাচ, দুটো লবঙ্গ, একটু দারচিনি, একটু খানি আদার টুকরো নাও। গ্যাসে সিকি কড়া জল বসাও। তাতে প্লেটের উপকরণগুলো ঢেলে দাও। সঙ্গে এক চিমটে হলুদ, আধা চামচ করে জিরে, ধনে গুঁড়ো আর নুন দাও। চাপা দিয়ে ফোটাতে থাক।
- সব মনে থাকছেনা, ম্যাম, আর একবার বলুন।
- আমি আছি কলে, দেখছি তোমায়। তুমি শান্ত হয়ে কাজগুলো কর এক এক করে, আমি বলে বলে দিচ্ছি।
- ম্যাম আমি আগে যদি একটু রান্না বান্না শিখে রাখতাম, তাহলে এভাবে আপনাকে বিরক্ত করতে হতনা, খুব খারাপ লাগছে।
- তুমি কাজ তো সবই জানো, নইলে বলার সঙ্গে সঙ্গে করছ কী করে? আমি তোমার বয়সে কাঁচা মাছে হাত দিতে পারতামনা, শরীর কেমন করত। তাছাড়া আগে থেকে শিখে রাখা, ওসব হয়না, পরিস্থিতি শিখিয়ে নেয়।
- আপনি কবে থেকে নিজে রান্না করছেন ম্যাম?
- যখন আমি ইউনিভারসিটিতে পড়ি, তখন প্রথম শুরু। মায়ের একটা অপারেশন হয়েছিল, বাবা সারাদিন হসপিটালে, আমি কী করি, শেষে ছোবড়া ছোবড়া বাঁধাকপি কেটে, আলু কেটে, কড়াইশুঁটি দিয়ে একটা লম্বা ঝোল বানাতে শুরু করলাম। হঠাৎ কী মনে হল, চাকা চাকা মূলো কেটে ওর মধ্যে দিয়ে দিলাম।
- হি হি হি হি, কী বলছেন ম্যাম, তারপর?
- সব প্রেশার কুকারে চাপিয়ে হলুদ, নুন, জিরে, ধনে, কাঁচা সর্ষের তেল দিয়ে ফুটিয়ে রেখে দিলাম, তাই দিয়ে ভাত খেয়ে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ চলে গেলাম। ভাতটা বেরোনোর আগে বাবা করে গিয়েছিল। সায়েন্স কলেজে বন্ধুদের সব গল্প করলাম, তারা বাঁধাকপি, আলু, কড়াইশুঁটি অবধি শুনছিল, যেই না বলেছি মূলো দিয়েছি, সব আমাকে এই মারে কী সেই মারে।
- হা হা হা হা। তারপর?
- অনেক রাতে বাবা ফিরল। তখন তো আমাদের খাবার টেবিল ছিলনা। আমি পিছনে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, দেখছি বাবা আসনে বসে সেই সেদ্ধ জল দিয়ে চটকে মেখে ভাত খাচ্ছে, মুখে কোন কথা নেই।
- হা হা হা, মেয়ে যাই করুক, সেই হল বাবার ফারিস্তা।
- হুঁ, তুমি এবার নিজের রান্নায় মন দাও। যতক্ষণ জলে মশলা ফুটছে, তুমি গ্যাসের টেবিলটার ওপরে মাছের টুকরো গুলো ঘষো, কালো ছাল উঠে গেলেও ক্ষতি নেই। মাছের গায়ে কোন লালা যেন না থাকে। জলটা সাত আট মিনিট ফোটার পর দেখবে মশলার সুগন্ধ উঠছে। এবারে মাছে নুন হলুদ মাখিয়ে ফুটন্ত জলে ছেড়ে দেবে। সঙ্গে আলু আর গোটা পেঁয়াজ দুটোও দিয়ে দেবে। সঙ্গে এক পলা কাঁচা সর্ষের তেল ছড়িয়ে দাও। কড়ায় ঢাকা দিয়ে আঁচ কমিয়ে ঝোলটা কুড়ি মিনিট ফুটবে। যতক্ষণ ফুটছে তার মধ্যে তুমি রান্নাঘর গুছিয়ে ফেল। আর নিজে একটু কলা মুড়ি খেয়ে নাও। ঝোল নামিয়ে আদার টুকরোটা তুলে ফেলে দেবে। ওর রস মিশে যাবে, কিন্তু হঠাৎ মুখে পড়ে গেলে বাজে লাগবে।
- নটা দশ ম্যাম, পনের মিনিট ফুটেছে।
- ঝোলটা খুব পাতলা লাগছে?
- হ্যাঁ ম্যাম।
- ইচ্ছে হলে আধ কাপ জলে আধ চামচ কর্ন ফ্লাওয়ার গুলে ঝোলে দিয়ে দাও। আর একটু ফুটিয়ে নাও।
- হয়ে গেছে ম্যাম, নুন দেখেছি।
- কোনভাবে আঁশটে লাগছে না তো ঝোলটা?
- না ম্যাম, মশলার সুগন্ধ আছে।
- ব্যাস, নামিয়ে দাও, গ্যাসের টেবিল মোছো। সব রান্না ঠিক করে ঢাকা দেওয়া আছে কিনা একবার চেক কর। দৌড়ে চানে যাও। দশটা থেকে এম. পি স্যারের ক্লাস তো, আমারও সিক্সথ সেমেস্টার। রান আফ্রিনা রান। আমিও দৌড়লাম।
- বাই ম্যাম।
সারাদিন কেটে গেল একাজে সেকাজে, রাতে শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করি, আফ্রিনার মত সমস্যা অনেক স্টুডেন্টেরই হচ্ছে হয়ত। তারা কী করছে কে জানে? ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুমের মধ্যে এক অদ্ভুত স্বপ্ন আসে। এক সিং দরজা পেরিয়ে বিশাল এক হলঘরে ঢুকে পড়েছি আমি। সামনে সারি সারি কাঠের চেয়ার পাতা, ঘরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। মামুলি চেয়ার নয়, কারুকার্য খচিত বড় চেয়ার, যেমন দেখেছিলাম সুদেবদার সঙ্গে আন্দুল রাজবাড়িতে গিয়ে। এটা কী কোন রাজসভা? চেয়ারে কারা বসে আছেন ছায়া ছায়া? প্রাণপণে মুখগুলো দেখার চেষ্টা করে যাই, পরিচয় স্পষ্ট হয়না। আমি বার বার করে জিজ্ঞেস করি, 'এখানে আমাকে আনা হয়েছে কেন? কী বলবেন বলুন।' কেউ কথা বলেননা। বাঁপাশে একটা দরজা খুলে যায় - কেউ দাঁড়িয়ে আছেন, পিছন ফিরে, বুঝতে পারিনা কে? হঠাৎ বাইরের আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। চোখে পড়ে যায় গেরুয়া বসন, হাতে লাঠি, মুণ্ডিত মস্তক, সেই পরিব্রাজক ভঙ্গি।
জীবন দেবতা? পিছন ফিরে কেন? একবার সামনে ফের। মুখটা দেখাও। আমি কী করব? কোথাও যেতে বলছ আমাকে? উত্তর আসেনা। আমার ভীষণ কষ্ট হতে থাকে, দুচোখ ঝেঁপে ধারা নামে। ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে যায়, আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসি বিছানায়। পাশটা ফাঁকা, আমার মেয়ে কই? প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে খাট থেকে নামি, বাইরের ঘরে আলো জ্বলছে। দরজাটা সাবধানে খুলতে গিয়ে শুনি ডুকরে ওঠা কান্নার আওয়াজ। কী ও? বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে। ছুটে যাই -
- কীরে বাবু? এভাবে একা বসে কাঁদছিস কেন? হয়েছেটা কী?
মেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে আমার ওপর,
- মা গো, আমি আজ তিনজনকে হাসপাতালের বেড খুঁজে দিয়েছিলাম, তিনজনই মারা গেল। আমি একটা ব্যর্থ মেয়ে, কিছুই পারিনা। এত চেষ্টা করেও হেরে গেলাম মা।
আমি হতবুদ্ধি হয়ে যাই। ওকে একটু জল খাইয়ে, শান্ত করে কথাবার্তা শুরু করি।
- তুই বেড খুঁজে দিস? কবে থেকে?
- আমরা ইস্কুলের বন্ধুরা মিলে খুঁজি। ইলেভেন টুয়েলভের বড় দিদিরাও আছে। অন্য ইস্কুলেরও সব রয়েছে, কলেজের দাদা দিদিরাও আছে। শুধু তো বেড নয়, অক্সিজেন, ওষুধ সব। কর্ণা দিদিও আছে।
- ও তো কাঁথিতে।
- আরে অনলাইনে যেকোন জায়গা থেকে যে কেউ যোগ দিতে পারে।
- সেইজন্যে সারাদিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকিস? আমি তো ভাবি তুই 'কে - ড্রামা' দেখিস!
- আগে দেখতাম।
- আমি যে বকাবকি করি, কিছু তো বলিসনা!
- ভেবেছিলাম রাতে তো ঘুমোইনা, মানে ঘুমোই, সব পালা করে জাগি - এসব শুনলে তোমরা বকবে, করতে দেবেনা। (মেয়ে ফোঁপাতে থাকে)
সব শুনে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরি, আমারও পাঁজর ভেঙে কান্না আসে। ওরে বাবু, তুই বুঝতে পারছিস না, তোর এই কান্না, এই হার আসলে শারদা, কৃষ্ণা, লাবণ্য, কুমুদিনী, আর. জি. কর, সিস্টার - সবার জিৎ। হঠাৎ আমার মোবাইলের নোটিফিকেশন ঝন ঝন করে ওঠে। চমকে যাই, এত গভীর রাতে কে আমাকে মেসেজ করছে? দেখি একটি নতুন ছাত্র, গতবছর অনলাইনে ভর্তি হয়েছে, ওকে একবারই দেখেছি আমি, ওরাই ‘প্রয়াস’ তৈরি করে ত্রাণ দিয়েছিল। একটি সদ্যজাত শিশুর ছবি পাঠিয়েছে। আমিও চটপট মেসেজ করি -
- কী হয়েছে ফয়েজুর?
- ম্যাম, চেন্নাই থেকে এক ভদ্রলোক ফ্যামিলি নিয়ে আসছিলেন কলকাতায়, রাস্তায় স্ত্রীয়ের প্রসব বেদনা উঠে গিয়েছিল, আমি নেটওয়ার্কে খবর পেয়ে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম, বাচ্চাটা কিছুক্ষণ আগে ঠিকঠাক সুস্থ ভাবে জন্মেছে ম্যাম, ভদ্রলোক এক্ষুনি ছবি পাঠালেন, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে ম্যাম, আমি কাকে জানাব, তাই আপনাকে পাঠালাম।
- খুব ভাল কাজ করেছ ফয়েজুর, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করবেন। প্রাউড অফ ইউ।
নিজের মনে স্তব্ধ হয়ে থাকি। আমি বুঝতে পেরেছি সভায় ওই ছায়ারা কারা? ওঁরা আমারই পূর্ব পুরুষ। ভর্ৎসনা করলেন, সতর্ক করলেন আমাকে। খামতি থেকে যাচ্ছে আমার। আমার চারপাশে তরুণদল ঠিক বুঝেছে, এই মুহূর্তে কী দরকার। আমি মূর্খ, তাই শুধু ভেবেছি, যেন তেন লেখাপড়া করানোই আমার কাজ। কিন্তু এখন তা যথেষ্ট নয়, দরকার আরও বড় কোন উদ্যোগ, যেখানে আমার সন্তানেরা হবে সেনাপতি, আর আমরা থাকব পিছনে। ঝড়, কেটে গিয়ে মনটা খুব শান্ত লাগে আমার। অন্ধকার কাটতে আর অল্প সময়ই বাকি। এই সকাল থেকে আমি আমার জীবনটাকে একটু হলেও পালটে দেব।
গান গায় নীল পালকের পাখি
জীবনে ভোর হঠাৎ আসে।
অচেনা সফল ছেলের ম্যাম
কেন যে অশ্রু জলে ভাসে।
ছুট দেয় নদীচড়ার রোদ
অযথা ঘাসফুলে আর কাশে।
একটা বিফল (?) মেয়ের মা
পুলকে কাঁদন জিতে হাসে।