বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে চাকরি করতে গেলাম সল্টলেকের ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্টে। সরকারি প্রোজেক্টে অস্থায়ী গবেষণাভিত্তিক কাজ। মাইনে কম, তবে গালভারি একটা নাম আছে – প্রোজেক্ট সায়েন্টিস্ট। সেখানে ল্যাবরেটরিগুলোয় একঝাঁক আমার মতই ছেলেমেয়ে, বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে স্নাতকোত্তর। নানান কাজ শিখতে লাগলাম। আর টিফিনের সময়টা বেশ মজা হত। সবাই জড়ো হতাম। প্রথমে যে যা আনবে, সব ভাগাভাগি হবে। তারপর নিচে অন্য অফিসের ক্যান্টিন থেকে খাবার আনানো হত, শেষে ফল কাটা হত। চায়ের চিনি রাখা থাকত। সব খাওয়ার পরে, যদি কারোর মনটা মিষ্টি মিষ্টি করত, তখন সে খানিক ঘুর ঘুর করে, দু’চামচ চিনি খেয়ে নিত। পাশের ল্যাবে হিটার ছিল। সেখানে বোরোসিলের বিকারে চায়ের জল, গলা ব্যথা হলে গার্গলের জল, সবই ফোটানো হত। গার্গলের কথাটা উঠল, তার কারণ আছে। শীতকালে সল্টলেকের তাপমাত্রা কলকাতার কেন্দ্র থেকে বেশ কম। ল্যাবটা বেশ উঁচু ফ্লোরে। চারপাশে ফাঁকা। কনকনে হাওয়া দিত। তাই অনেকেরই ঠান্ডা লেগে যেত। একবার আমাদের ল্যাব থেকে মীনাক্ষীদি বিকারে ঠান্ডা জলে চিনি দিয়ে নিয়ে গেল চায়ের জল ফোটাবে বলে। এক মিনিট পরে নাচতে নাচতে ফুটন্ত জল নিয়ে চলে এল। সকলের হাঁ মুখের সামনে বলল, যে ওই ল্যাবের চায়ের জল ফুটছিল। আমি টুক করে আমাদের বিকারটা হিটারে বসিয়ে ওদের ফুটন্ত জল নিয়ে চলে এসেছি। কিন্তু একাজের ফলং ফলং ফলাঃ ভালো হল না। আমাদের নুনে পোড়া চা খেয়ে ওয়াক থু করতে হল। আর ও ল্যাবের কৃষ্ণেন্দুদা যে গার্গলের জল বসিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, সে মিষ্টি মিষ্টি গার্গল করতে বাধ্য হল।
অতগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রায়ই, কারোর না কারোর জন্মদিন এসে পড়ত আর আমরা হৈ হৈ করে তার পয়সায় রেস্তোরাঁয় খেতে যেতাম। বাইরে খাওয়া মানেই তখন চাইনিজ খাবার। অনেক কিছু নতুন শিখলাম কলিগদের পাল্লায় পড়ে। নুডলস হাক্কা না গ্রেভি – প্রথম প্রথম বোকা হলেও চটপট শিখে গেলাম, হাক্কা মানে ভাজা ভাজা, শুকনো। আর গ্রেভি মানে ঝোল ঝোল, ওতে তেল কম। আমার গ্রেভিটাই ভালো লাগে। তারপর প্রদেশ-অনুযায়ী চাররকম স্টাইল আছে, হুনান, ক্যান্টনিজ, সেজুয়ান আর মাঞ্চুরিয়ান। তার মধ্যে প্রথম দুটো ভালো লাগেনি। মনে হয় কারোরই ভালো লাগে না। তাই কলকাতায় সেজুয়ান আর মাঞ্চুরিয়ানই বেশি চলে। সেজুয়ানটা দেখতে লাল, আর স্বাদে ঝাল। মাঞ্চুরিয়ান রূপে কালো, জিভে ভালো। আর একটা জিনিস খেলাম, চপসুয়ে। মুচমুচে শক্ত নুডলস। সবজি আর সসের কারির সঙ্গে মিশিয়ে খেতে হয়। তবে চাইনিজ চপসুয়ের থেকেও আমেরিকান চপসুয়েটা রসনায় ঝঙ্কার তুলল বেশি। নিজামের আভিজাত্য থেকে বেরিয়ে ততদিনে কলকাতার ফুটপাত শাসন করছে এগরোল। তারপর রাইস নুডলস – সেটাও বেশ ভালো। আর একদিন এক্সাইড মোড় থেকে একটু এগিয়ে, মোমো প্লাজা বলে একটা দোকানে একরকম থাইল্যান্ডের খাবার খেলাম। চিকেন স্টিমড মোমো আর থুকপা। এখন অবশ্য এক্সাইড মোড়ে হলদিরামের উল্টোদিকে ফুটপাথেই মোমো খাই। দারুণ করে। শুধু যে এসব খেতে শিখলাম তাই নয়, উপকরণগুলো কোথায় পাওয়া যায়, সেগুলো খোঁজখবর শুরু করলাম। বাড়িতে শখ করে চাইনিজ রান্নাও শুরু করলাম একটু আধটু করে। বেলা দে-র রান্নার বই কিনলাম শখ করে। ক্যাপসিকাম, পার্সলে পাতা, লেমন গ্রাস, চিজ, কর্ন ফ্লাওয়ার, রকমারি সস – এই ধরণের উপকরণ বাড়িতে আগে কখনও ব্যবহার হত না। কিন্তু এগুলো আমি খুঁজে খুঁজে কিনে আনতে শুরু করলাম। ছুরি কিনলাম মাপ মত, কাঁটা চামচ কিনলাম; খোসা ছাড়ানো পিলার, আইসক্রিম জমানোর কাপ কিনলাম। স্যালাড, স্যুপ, ন্যুডলস আর রকমারি যন্ত্রপাতির হাত ধরে, আমাদের রান্নাঘর একটু একটু করে বদলাতে শুরু করল। বাবার তো রান্না নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বাতিক ছিলই। এখন আমি একটু ধুনোর ধোঁয়া দিতে, সেটা আবার চাগিয়ে উঠল। লেকটাউনে মিলন সঙ্ঘের মেলায় নানারকম স্টলের মধ্যে এইসব সবজি কাটার যন্ত্রপাতির স্টলও আসত। কেটে কেটে দেখানোর লোকও থাকত। বাপ মেয়ে দেখে-শুনে, চোখে চোখে যুক্তি করতাম। যেটা মনে হত ব্যবহার করা সম্ভব, সেটা কিনে ফেলতাম। তখন তো ইউটিউবের যুগ আসেনি। বাড়িতে পার্সোনাল কম্পিউটার কিংবা হাতে হাতে স্মার্ট ফোন ভবিষ্যতের গর্ভে। তাই রান্নার বই কিনে, অভিজ্ঞ লোককে জিজ্ঞেস করে, কষ্ট করে রেসিপি যোগাড় করতে হত। তবে যোগাড় হয়েও যেত। কীভাবে হত, সেটা বলি বরং।
আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমার বৃত্তটা বেশ বড় হয়ে গিয়েছিল। সেখানে গ্রাম থেকে আসা প্রথম প্রজন্মের মেধাবী পড়ুয়া যেমন ছিল, তেমন – কলকাতার অতি ধনাঢ্য পরিবার, আত্মীয় স্বজনেরা ইউরোপ আমেরিকায় থাকে, নিজেরাও ছুটিছাটায় সেখানে চলে যায় – এমন পড়ুয়াও ছিল। আর আমাদের ভূগোল বিষয়টাই এমন, প্র্যাক্টিকাল করতে গিয়ে, ফিল্ড সার্ভের সময় একসঙ্গে থাকতে গিয়ে, ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। আর হাজারটা গল্পের মধ্যে রান্না খাওয়ার কথা হবে না, এটা কি হয়? বিভিন্ন জেলায়, বিভিন্ন রাজ্যে, বিভিন্ন দেশে রান্নার স্টাইল তো আলাদা হবেই। ঐ স্বদেশ-বিদেশ মিলিয়ে থাকা ট্যাঁশ বন্ধুদের থেকে শিখলাম পাস্তা রান্না, হোয়াইট সস কী করে বানাতে হয়। মেয়নিজ, চিজ – এগুলো ব্যবহার করে কী করে স্যান্ডুইচ, বার্গার বানাতে হয়। আর শিখলাম নাইফ কাটের কেতা। যেমন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের লম্বা কাঠির মত আলু কাটার নাম জুলিয়ান কাট। পেঁয়াজটা বসিয়ে ছয় বা আট বার ব্যাস বা রেডিয়াস বরাবর ছুরি চালিয়ে, তারপর কাত করে স্লাইস কাটার মত ছুরি চালালেই পেঁয়াজ কুচি কুচি হয়ে যায়। একে বলে ফাইন চপ। পদ্ধতিটা জেনেই মনে পড়ে গেল রাস্তায় ঝালমুড়িওলা আর আলুকাবলিওলারা এভাবেই মিনিটের মধ্যে পেঁয়াজ কুচো করে ফেলে। আর গ্রামের বন্ধুদের কাছে শিখলাম চালকুমড়ো পাতার পাতুরি। পুর-ভরা উচ্ছেভাজা, পুর-ভরা কাঁকরোলভাজা। উচ্ছের মুখটা ছোট করে কেটে ভিতরের বীজ বার করে নিতে হবে। তারপর পেঁয়াজ ভেজে, সর্ষে, পোস্ত, নারকেলবাটা দিয়ে কষে পুর বানিয়ে নিতে হবে। ঝাল, নুন, মিষ্টি – পরিমাণ মত। এবারে চামচের ডাঁটি দিয়ে উচ্ছেগুলোর মধ্যে পুর ভরে কড়া করে ভেজে নিতে হবে। কাঁকরোলের নিয়ম প্রায় এক। কিন্তু এক্ষেত্রে কাঁকরোলটা লম্বায় অর্ধেক করে কেটে নিতে হবে। এবারে ঐ অর্ধেকটা কুরিয়ে নিয়ে পুর ভরতে হবে। কাঁকরোলের ভিতরের কোরানো অংশ আর বীজগুলো থেঁতো করে ঐ পুরের সঙ্গেই কষা হবে। এবারে পুরভরা কাঁকরোলগুলো বেসনে ডুবিয়ে ভাজতে হবে। চালকুমড়ো পাতার পাতুরি আমাদের বাড়িতে কোনোদিন হয়নি। কিন্তু বড়বেলায় খেয়ে ভীষণ ভালো লেগে গেল। পাতাগুলো নুন মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। তাহলে পাতা থেকে বাষ্প বেরিয়ে পাতাটাকে মজিয়ে বেশ নরম করে দেবে। পাতাটা ভালোভাবে মোড়া যাবে। এবার কাঁচা পেঁয়াজকুচি, সর্ষের তেল দিয়ে চটকে মজিয়ে নেওয়া যায়। তার সঙ্গে নুন, হলুদ, লঙ্কা মিশিয়ে পাতার সিম্পল পুর করাই যায়। তবে আগের মত সর্ষে, পোস্ত, নারকেল বাটা দিয়ে পেঁয়াজটা কষে নিলে স্বাদটা রাজকীয় হয়ে যায়। আর তার সঙ্গে ভাজা চিংড়ির বাটা মেশালে স্বাদটা খানদানি হয়ে ওঠে। এবারে দুটো করে চালকুমড়ো পাতা একসঙ্গে নিয়ে, তার ওপরে পরিমাণমত পুর রেখে পাতা মুড়ে নিতে হবে। আর চাটুতে তেল বুলিয়ে সেঁকার মত করে খুন্তি দিয়ে চেপে চেপে পাতা-মোড়া পাতুরিগুলো এপিঠ-ওপিঠ করে ভাজতে হবে। কিন্তু আঁচটা খুব ঢিমে রাখতে হবে, বাড়ালে চলবে না। এখন ইউটিউবের ভিডিওগুলোয় কেতা করে নাইলনের ব্রাশ দিয়ে তেল বোলানো দেখায়। কিন্তু মা এমন তেল বুলিয়ে নেওয়ার দরকার হলে, বেগুন বোঁটা দিয়ে চাটুতে তেল মাখাত, বা কোনোদিন বেগুন না থাকলে, খোসাসমেত আলু মাঝখান থেকে কেটে, সেই কাটামুখটা দিয়ে তেল মাখাত। আমি এখনও সেই প্রথাই ধরে রেখেছি। এই পাতুরি ভাজার সব চেয়ে সুবিধে হল, কোনো সুতো, দড়ি কিচ্ছু লাগবে না। এমনিই সুন্দর মুড়ে থাকবে, কিন্তু মচমচে হবে। পরে আমার এক অধ্যাপিকা বন্ধু একটা খুব দরকারি পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেইমত বাড়িতে ইলিশের পাতুরি করতে গেলে আমি আর বাজারওলাদের পিছনে পড়ি না একটু কলাপাতার জন্য। আমার কর্তামশাইয়ের বাগানের শখ। ফ্ল্যাটের বারান্দায়, জানলায় মাচা বেঁধে শাকপাতি, শসা সব ফলান। তাই চালকুমড়ো, কুমড়ো, লাউ যখন যেমন পাই, টুক করে পাতা কেটে নিয়ে ওতেই পাতুরি বানাই। একেবারে পাতাসমেত খাওয়া যায়। শহরে কলাপাতা পাওয়া ভীষণ মুশকিল। তাই ইলিশ পাতুরির জন্য অন্তত আমার বাড়িতে এখন নো কলাপাতা বিজনেস।
ব্রেবোর্ন কলেজে পড়তে একজন বন্ধু পেয়েছিলাম – হিমানী। ওরা পঞ্জাবী। দমদমে থাকত। সায়েন্স কলেজেও পড়েছি একসঙ্গে। মাঝেমধ্যেই ওর বাড়ি যেতাম। তখনই দেখেছিলাম, ওরা ময়দা খায় না। আটার মোটা লুচি তৈরি করে। সেটাই হল পুরি। হিমানীর মা গরম গরম লালচে পুরি ভেজে থালায় দিতেন। আকৃতিতে একটু ছোট, একেবারে গোল গোল বলের মত। এমন শুধু পুরি কখনও আমাদের বাড়িতে হত না। মা মাঝে মাঝে করত ডালপুরি। ছোলার ডাল সেদ্ধ করে কড়াতেই শুকিয়ে নেওয়া হত। এবারে গোটা জিরে, ধনে, একটু গরম মশলা শুকনো খোলায় ভেজে গুঁড়িয়ে নেওয়া হত। এবারে সাদা তেলে একটুখানি আদাবাটা আর হিং দিয়ে ডাল আর ভাজা মশলা দিয়ে নেড়ে একদম শুকনো করা হত। তারপর ময়দার লেচি কেটে তার মধ্যে পুর দিয়ে বেলে নেওয়া হত, তারপর তেলটা কষকষে গরম করে তাতে ফুলো ফুলো ডালপুরি ভাজত মা। আর আমরা উত্তর কলকাতার লোক। তাই এটা জানতাম যে দোকানের কচুরি কাঁচা বিউলির ডাল বাটার পুর দিয়ে করা হয়। আর ঐ পুর যখন পাঁচফোড়ন দিয়ে ভাজা হয়, তখন তার নাম হয় রাধাবল্লভী। তবে এসব বাড়িতে করার কোনো ব্যাপার ছিল না, প্রয়োজনও না। কারণ শ্যামবাজার, বাগবাজারে তো বটেই, পাইকপাড়া, দত্তবাগান, পাতিপুকুর সর্বত্রই কচুরি, রাধাবল্লভীর দোকান ছিল। কচুরির সঙ্গে ছোলার ডাল অথবা খোসাওলা আলুর তরকারি, আর রাধাবল্লভীর দোসর হল আলুর দম। কোনো কোনো দোকানে কচুরির সঙ্গে সিঙাড়ার চাটনির মত চাটনিও দিত। তবে হ্যাঁ, বাড়িতে একটা জিনিস কালেভদ্রে হত, শীতকালে কড়াইশুঁটির কচুরি। কালেভদ্রে, কারণ অনেক তরিবত লাগে। ডালপুরিতে ডাল সেদ্ধ হয়, কিন্তু কড়াইশুঁটির কচুরির ক্ষেত্রে গায়ের জোর দিয়ে কড়াইশুঁটিগুলো কাঁচা বাটতে হয়। মা চাকরি করে অত পেরে উঠত না। তবে অফিসের এক বিবাহিতা সহকর্মিনীর বাড়িতে গিয়েছিলাম দরকারে। সে মিনিট পনেরোর মধ্যে আমার সামনেই গরম গরম কড়াইশুঁটির কচুরি ভেজে সঙ্গে তেলের আচার দিয়ে প্লেটে সাজিয়ে দিল। আমি তো তাজ্জব। রহস্যটা ভালো করে বুঝে নিলাম। ছুটির দিন দেখে, ময়েন দিয়ে ময়দা মেখে, তালটার ওপরে তেলহাত বুলিয়ে ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। আবার বেশ কিছুটা কাঁচা কড়াইশুঁটি, দুটো কাঁচা লঙ্কা, পরিমাণমত নুন, একটু চিনি, গোটা জিরে আর কয়েক টুকরো আদা – মিক্সিতে বেটে নিয়েছে। তারপর সাদা তেলে হিং ফোড়ন দিয়ে এই বাটাটা খুব ভালো করে নেড়ে পুরো শুকিয়ে নিয়েছে। তারপর এই পুরটাও ফ্রিজে রেখে দিয়েছে। বাড়িতে কোনো অতিথি এলে, কয়েকটা লেচি কেটে পুর ভরে কচুরি ভেজে দিয়ে দেয়। আমাকে জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলাম তিনটে খাব। তিনটে কচুরি ভেজে আচার দিয়ে সাজিয়ে দিতে মেরে কেটে পনেরো মিনিট। ওর এই পদ্ধতিটি আমি মাথায় তুলে নিলাম। ঐ সহকর্মিনীকেও গুরু মানলাম।
হিমানীর বাড়িতে শিখেছিলাম আলু পরোটা, বেসনের লাড্ডু, বেসনের বরফি, রাজমা আর ‘ডি লা গ্র্যান্ডি বল্লে বল্লে’ তড়কা। আলু সেদ্ধ করে তাতে নুন একটু হলুদ দিয়ে মেখে রাখতে হবে। পেঁয়াজ ঝিরিঝিরি করে কেটে মুচমুচে করে ভেজে নিতে হবে। আর শুকনো লঙ্কা ভেজে হাত দিয়ে চটকে নিলে চিলি ফ্লেক্স হয়ে যাবে। এবারে পেঁয়াজ আর লঙ্কা ঐ আলুতে মেখে নিতে হবে। আটা ময়ান দিয়ে মেখে নিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। বড় লেচি কেটে ছোট মোটা রুটির মত বেলে নিতে হবে প্রথমে। এইবার খানিকটা আলুর পুর ঐ রুটির মধ্যে রেখে, চারপাশ মুড়ে, আবার আর একটা পুর ভরা লেচি বানিয়ে নিতে হবে। এবারে ঐ লেচি দিয়ে একটা পুর ভরা গোল পরোটা বেলে নিতে হবে। প্রথমে ঐ পরোটা রুটির মত হাল্কা সেঁকে নিয়ে, পাশ দিয়ে একপলা ঘি অথবা সাদা তেল দিয়ে ভাজতে হবে। আলু-পরোটা এত সুস্বাদু, বাঙালি ঘরে গ্রহণযোগ্য হতে কোনো অসুবিধেই হয়নি। আমার মা সাধারণ তিনকোণা পরোটা করার সময়ে, প্রথমে সেঁকে নিয়ে, পাশ দিয়ে আধপলা তেল দিয়ে, একটা পরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে চেপে চেপে খুব সুন্দর পরোটা করত। আমার সেরকম খাওয়াই অভ্যেস। কিন্তু পরে দেখলাম, নানা জায়গায় নানা রীতি। ওয়েটল্যান্ড ম্যানেজমেন্টে থাকতে থাকতে কলেজ সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেলাম কলকাতার এক মহিলা কলেজে। সেখানে ক্যান্টিনের দিদি মোটা পরোটা বেলে লুচির মত ছাঁকা তেলে পরোটা ভাজত। এদিকে ময়ান কম। তেল জবজবে মোটা বেশ বড়সড় গোল পরোটা, এদিকে ছিঁড়তে একেবারে রবারের মত। সহকর্মিনীরা ঐ বিশেষ পরোটার নাম দিয়েছিলেন গলোটা। অর্থাৎ গলায় আটকে যায় এমন পরোটা, সমাস করে গলোটা। টিফিন হলেই এই নিয়ে হাসাহাসি হত। আবার যখন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ফিল্ডে যাই, প্রাতরাশে ভাজাভুজি আমার ভালো লাগে না। যেদিন পরোটা হয়, সেদিন ট্রাভেল এজেন্টের রাঁধুনি ময়ান দেওয়া ময়দায় শুধু সেঁকে আমায় পরোটা করে দেন। ওটা খুব ভালো লাগে। বাড়িতেও অন্যদেরটা ভেজে দিই, নিজেরটা আমি এভাবে সেঁকে নিয়ে খাই। পরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে দেখি, সেখানকার রাঁধুনি দিদিও গলোটা ভাজে, পরোটা নয়। যাক, শ্বশুরবাড়ির গল্প এখন তোলা থাক, পরে আবার হবে।
হিমানী আমাকে বেসনের লাড্ডু বানাতে শিখিয়েছিল। বেসনটা প্রথমে একটু শুকনো খোলায় নাড়তে হবে। বেশ সুন্দর একটা গন্ধ উঠবে। এবারে অল্প অল্প করে ঘি মেশাতে হবে। খানিক পরে চিনির রস মেশাতে হবে। নাড়তে নাড়তে বেশ নাড়ু পাকানোর মত চিট ধরবে। একটুখানি হাতে নিয়ে, গোল পাকিয়ে দেখতে হবে, যে কোনো আকৃতি দেওয়া যাচ্ছে কিনা। যদি দেওয়া যায়, তবে আঁচ নিভিয়ে ঠান্ডা হতে দিতে হবে। এবারে দু’হাতের চেটোয় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বড় বড় নাড়ু পাকানোর মত লাড্ডু পাকাতে হবে। আর বরফি করতে হলে কানা-উঁচু থালায় মণ্ডটা সমান করে রেখে, ঠান্ডা হলে, ছুরি বা খুন্তি দিয়ে কেটে নিতে হবে।
এবারে তড়কার তরিবৎটা বলে দিই। বাঙালি ঘরে এটা এখন অতি প্রয়োজনীয় রেসিপি। গোটা মুগ কলাই কয়েকঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। সঙ্গে ইচ্ছে হলে অল্প রাজমাও মিশিয়ে দেওয়া যায়। যদি দোকানের মত ঘন তড়কা খাওয়ার ইচ্ছে হয়, তবে কিছুটা রাজমা আলাদা ভেজাতে হবে। ভিজিয়ে রাখা মুগ কলাই অল্প হলুদ আর নুন দিয়ে প্রেসার কুকারে সিটি দিয়ে সেদ্ধ করে নিলে খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। এবারে তড়কার মশলা বানাতে হবে। ফ্রাই প্যানে দু’পলা তেল দিয়ে, তাতে আস্ত রসুন কোয়া বেশ কয়েকটা, গোটা জিরে, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, গোটা গরম মশলা আর কয়েক টুকরো আদা লাল করে ভাজতে হবে। এতে টমেটো কুচো যোগ করতে হবে। ভাজা গন্ধ উঠলে আঁচ বন্ধ করে কিছুটা ধনে পাতা আর অল্প পুদিনা পাতা ঐ মশলার ওপরে দিয়ে খুন্তি দিয়ে নেড়ে তেলে মিশিয়ে নিতে হবে। পাতাগুলো তেলে মজবে কিন্তু ভাজা হবে না, মানে এদের গন্ধ অটুট থাকবে। এবারে পুরো জিনিসটা ঠান্ডা করে মিক্সিতে পিষে নিতে হবে। পেষার আগে এতে ভেজানো রাজমা কিছুটা মেশাতে হবে। সব মিলিয়ে মিশ্রণটা খুব মিহি হতে হবে। ইচ্ছে হলে কাঁচা লঙ্কাও মেশানো যায়। যার যেমন মর্জি। বাটার পর পরিমাণটা অনেকটাই হবে, আর একটা খুব সুন্দর মশলার গন্ধ উঠবে। এইবার কড়ায় তেল দিয়ে বেশ খানিকটা ঝিরিঝিরি পেঁয়াজ খুব ভালো করে ভাজতে হবে। ভাজা হলে ঐ তেলে আমি হলুদ, কাশ্মীরি লঙ্কার গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো আর অল্প গরম মশলা পাউডার দিয়ে কষে নিই। তেলে এই মশলাগুলো কষলে একটা বেশ সুন্দর কালচে লাল রঙ ধরে। এবারে মিক্সি থেকে পুরো মশলাটা কড়ায় ঢেলে দিতে হবে। নেড়েচেড়ে, তেল ছাড়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে। তেল ছেড়ে দিলে সেদ্ধ মুগ কলাই জল সমেত কড়ায় ঢেলে দিতে হবে। এবারে ভালো করে কিছুক্ষণ ফোটাতে হবে, যাতে গোটা মুগটা মশলার সঙ্গে মিশে একটু বেশ মাখা মাখা হয়ে আসে। একেবারে শেষে ছোট ফোড়ন-কড়ায় এক পলা ঘি দিয়ে, তাতে কসুরি মেথি ফোড়ন দিয়ে, মুগের মধ্যে ঢেলে দিতে হবে। নুন-মিষ্টি – স্বাদ মত। বাড়ির তড়কা রেস্তোরাঁকে হার মানাবে। কসুরি মেথিটা শুকনো খোলায় নেড়ে নিলেও গন্ধটা খুব সুন্দর ওঠে। ঘি দিতে না চাইলে, ঐ ড্রাই রোস্টেড কসুরি মেথিও মিশিয়ে নেওয়া যায়। ইচ্ছে হলে একপলা ঘি গরম করে ওপরেও ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
হচ্ছিল অফিসের গল্প, চাইনিজ খাবারের গল্প, কোথা থেকে কী সব উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে উঠে পড়ল। অফিসের ছুটি হলে বিবাহিতা সায়েন্টিস্টরা রাস্তায় ঝালমুড়ি, ফুচকা যা পাওয়া যায়, খেতে দাঁড়িয়ে যেত। অগত্যা আমাদেরও খেতে হত। বাকিরা বলত, রোজ রোজ রাস্তার খাবার খাও কেন? ওরা বলত, বাড়ি গিয়ে কাজে লেগে পড়তে হবে। কেউ তো খাবারের থালা নিয়ে বসে নেই। এত খিদে পেয়ে যায়, তখন আর অন্যদের যত্ন করা যায় না। ঘর-বার সামলাতে গেলে, মুখে হাসি রেখে এনার্জি ধরে রাখতে গেলে – রাস্তায় খেয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমি চাকরি করলেও, তখনও বাবার হোটেলে খাই। মা খাবার নিয়ে বসে থাকে, অদূর ভবিষ্যতে কী হবে ভেবে কেঁপে যেতাম।