১
‘যে আনন্দ বাতাস বহে
যে আনন্দ সাগর জলে
যে আনন্দ ধূলির কণায়’
সে আনন্দে জীবন চলে।
আজ দুপুরে একটা দারুণ জিনিস রান্না হয়েছে – বড়ার টক। বাড়ির সকলের ফেভারিট, এমনকি আমারও। আমার বাপের বাড়িতে এমন স্বর্গীয় আইটেমের চল ছিল না।
স্নান করে খেতে যাবার আগে কর্ণা জিজ্ঞেস করে,
- আজ কী মেনু গো জেঠিমা?
- সারপ্রাইজ। ডাল, ছাতুভাজা, ফ্যাসা মাছভাজা, আমুদী মাছের ঝাল আ-র...
- আর?
- বড়ার টক।
- ই-য়া-য়া (দুই মেয়েই লাফাতে থাকে)
ছাতু মানে ছোলার ছাতু নয়, খড়ে জন্মানো প্রাকৃতিক মাশরুম – এ’কথা তো আগেই বলেছি। ফ্যাসা মাছ উপকূলের মোহনা অঞ্চলে প্রচুর ধরা হয়। লম্বাটে পাতলা চেহারা আর ভীষণ কাঁটা। নুন-হলুদ মাখিয়ে কড়া করে ভাজলে বেশ স্বাদু। দুই মেয়ের প্রিয় মাছের তালিকায় একে আছে পমফ্রেট, আর দুইয়ে আছে এই ফ্যাসা। মাছের গায়ে শাঁস কিছু নেই। কাঁটাও ছাড়ানো যায় না। কড়া করে ভেজে হাতে ধরিয়ে দিলে ছোট থাকতেই ওরা খেলতে খেলতে ছাল, কাঁটা সমেত পাঁপড়ের মত কুটকুট করে খেয়ে নিত। আর আমাদের গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার রুনাদা, একটা শেষ হলেই এসে আর একটা ধরিয়ে দিত। সেই থেকে ফ্যাসা মাছ খাওয়া ওদের অভ্যেস।
আজ রুনাদা নিজে রান্না করেছে। সবাই ডবল ভাত খাবে, এমনই তার হাতের গুণ। রুনাদা খুব ছোট থেকে এবাড়িতে আছে। আমার শাশুড়ির আবিষ্কার। রঞ্জা, কর্ণার বাবাদের, পিসিদের কোলেপিঠে করেছে। শ্বশুর, শাশুড়ি গত হবার পর রুনাদাই এখানকার জমিজমা, মন্দির, নিত্যভোগ সবদিক খেয়াল রাখে। বয়স হয়েছে তো, তাই আগের মত আর হৈ হৈ করে রোজ রান্না করতে পারে না। এক-এক দিন ইচ্ছে হলে করে। আজ সেই বিশেষ দিন।
আমুদী মাছটাও বেশ সুস্বাদু। বিয়ের আগে খাওয়া দূরস্থান, এসব মাছের কখনও নামও শুনিনি আমি। একটু ছোট আকারের লালচে স্বচ্ছ ধরণের চেহারা মাছটার। নুন-হলুদ মাখিয়ে ভাজা হয়, তবে ফ্যাসার মত কড়া করে নয়। সর্ষের তেলে কয়েক দানা চিনি ফেলে শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেওয়া হয়। পেঁয়াজ কুচো, আদা রসুন বাটা, হলুদ, লঙ্কা গুঁড়ো দিয়ে কষে তেল ছেড়ে গেলে টমেটো বাটা মেশায় রুনাদা। আবার মশলাটা কষে। এইভাবে দু’বার করে কষে ধৈর্য ধরে এক একটা রান্না করে রুনাদা, আমি দেখি। এবার অল্প জল দিয়ে মাছগুলো ঢেলে দেয়। এবারে বেশ ছ’-সাতটা নধর কাঁচালঙ্কা আস্ত আস্ত ঝোলে ফেলে চাপা দিয়ে দেয়। আর এমন চৌখস, উনুন থেকে কড়া নামিয়ে দেবে ঠিক সময়ে, কিন্তু ঢাকা খুলবে না। পুরো ভাপটা ঠান্ডা হয়ে রান্নার ঝোলে ঢুকে যাবে। আর খাওয়ার সময়ে ঝোলে একটা অসাধারণ কাঁচালঙ্কার গন্ধ বেরোয়, কিন্তু ঝাল হয় না। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি রান্নায় ঐ কাঁচালঙ্কার ফ্লেভার আনার, এখনও সফল হতে পারিনি। এমনও ভেবেছি, যে গ্রামের বাড়িতে গাছ থেকে লঙ্কা ছিঁড়ে আনে বলে এমন সুবাস হয়। রুনাদা মন্দিরের একপাশে ছোট করে নানারকম সবজি চাষ করে। তেজপাতা গাছ লাগিয়েছে। বস্তা করে তেজপাতা পুরে রাখে আমাদের জন্য। কিন্তু গাছের টাটকা বলে নয়, আমাদের শহরের বাড়িতে এসেও রুনাদা রান্নায় ঐ মাত্রা যোগ করে, একেবারে বাজারে কেনা, ফ্রিজে রাখা সাত বাসি লঙ্কা দিয়ে। নিজে করলে আসলে ধৈর্য থাকে না আমার। ঠিক একবার ঢাকা খুলে ফেলি – লঙ্কার গন্ধ হচ্ছে তো! ব্যস, ঝুপ করে আমার নাকে হাত বুলিয়ে, ফুস করে লঙ্কার ভাপ উড়ে পালায়, ঝোলে আর ঢোকে না। কিন্তু এমন ধৈর্য ধরে করে বলে রান্না শেষ করতে অনেক সময় লাগে রুনাদার। বড় ননদ, মেজ ননদ রেগে যায়। বলে ‘ধুর! রুনাটা বড্ড নিটির পিটির করে’।
খাবার টেবিলে হৈচৈ জমে উঠেছে। কর্ণা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, “বড়ার টক কীকরে করে গো রুনা জেঠু?”
ওপাশ থেকে উত্তর ভেসে আসে, “লোহার শিক দিয়ে।”
অমনি রান্নাঘরে একটা হাসির হিল্লোল বয়ে যায়। সকলেই জানে এই উত্তরের মানে। রঞ্জা, কর্ণা যখন আরও ছোট ছিল, তখন রুনাদা ওদের এই রসুইঘরে ছুটোছুটি খেলাধুলোয় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। আর রুনাদা কিছু বললে, বাড়ির কোনো লোক তার উপরে কথা বলে না। ঐ বারণ ছিল বলেই দুষ্টু মেয়েদুটো পা টিপে টিপে রান্নাঘরের রোয়াকে রুনাদার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকত। রুনাদা সবই বুঝে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকত। তারপর আচমকা একটা শিক টেনে নিয়ে গলায় একটা হো হো শব্দ তুলে ওদের তাড়া করত। ঐ হো হো ছাপিয়ে শোনা যেত কচি গলার খিলখিল আর পায়ের দুপদাপ। এরপর আধঘণ্টা শান্ত, আবার পুনরাবৃত্তি। এটাই ছিল ওদের খেলা।
আমি বলি, “জানিস কি, যে বড়ার ঝোলও হয়?”
- কী করে হয়? তুমি খেয়েছ? আমরা তো খাইনি।
- রেসিপিটা তো মাত্র কিছুদিন আগে জানলাম। আমার বাপের বাড়িতে ডালের বড়া হলে গরমভাতে শুকনো খাওয়া হত। চ্যাপ্টা ফ্রাই প্যানে অল্প সর্ষের তেল দিয়ে তাতে গোলা গোলা মুসুর ডাল বাটা বসিয়ে দেওয়া হয়। বাটাতে নুন, হলুদ, কাঁচা লঙ্কা, ইচ্ছে হলে পেঁয়াজ কুচি মেশানো যায়। তারপর খুন্তি দিয়ে উল্টে এ’পিঠ ও’পিঠ হালকা ভাজা করে তোলা হয়। অনেকে একে চাপটি বলে। চাপটি দিয়ে পান্তা ভাতও ভাল লাগে। পাতলা ডালের সঙ্গেও খাওয়া যায়। মাঝে মাঝে খেলে বেশ মুখ ছেড়ে যায়।
- বড়ার ঝোলের কথা কিছুদিন আগে কে বলল?
- সে এক কাণ্ড। মাস কয়েক আগে ফিল্ড শেষ করে উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরছিলাম। একে ক্লান্ত, তায় ট্রেন দশঘণ্টা লেট। দোতলার ওয়েটিং রুম নতুন, ঝকঝকে আধুনিক। ঢুকতেই মন ভাল হয়ে গেল। লাগোয়া আধুনিক ওয়াশরুম। প্রতিটি ফ্ল্যাশ কাজ করছে। ছেলেমেয়েরা, গানের লড়াই, অঙ্গভঙ্গি দেখে সিনেমার নাম অনুমান – ইত্যাদি খেলা শুরু করে দিল।
- একদম নতুন তার মানে।
- হ্যাঁ। এদিকে সবাই যখন মশগুল, পঞ্চাশ-ষাট জনের এক বিরাট দল রৈ রৈ করে ওয়েটিং রুমে ঢুকে পড়ল। নারী-পুরুষ উভয়েরই মলিন পোষাক, সঙ্গে বড় বড় পোঁটলা, রুক্ষ চুল। একজন সর্দার মত লোক মাঝে মাঝে এসে হম্বিতম্বি করে যাচ্ছিল। সব দেখে ভক্তি হচ্ছিল না। এরপর তারা নতুন ইংরেজি কেতার ওয়াশ রুমের মেঝে ব্যবহার শুরু করল, স্নান শুরু করল, ওয়েটিং রুমও জলে ভাসতে লাগল।
- এ বাবা!
- আমাদের বিরক্তিটাও তখন রাগে পরিণত হল। একদল রাগী প্যাঁচা হয়ে আমরা সোফায় বসে রইলাম, উঠে হাঁটাহাঁটি করলে সিট চলে যাবে। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা অমূলক – ঐ দলটার দেখলাম সোফার দিকে কোনো নজর নেই। তারা মেঝেয় বিছানার চাদর পেতে গুছিয়ে বসল। কাঠ হয়ে বসে বসে কী আর করা, দীর্ঘ সময় যেতে যেতে মনে প্রশ্ন জাগল, এরা কারা? যাচ্ছে কোথায়? বল্লরীদি আর আমি তখন মহিলাদের সঙ্গে টুকটাক কথা শুরু করলাম। তখন জানতে পারলাম, উত্তর দিনাজপুরের বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকনৃত্য ও লোকগীতির শিল্পী যোগাড় করে একটি সংস্থা চলেছে সরকারি অনুষ্ঠান সফল করার জন্য।
- আচ্ছা!
- হ্যাঁ রে, সব ভীতু ভীতু মুখ, গালভরা সরল হাসি, আমরা দুটো কথা জানতে চেয়েছি বলে তাদের কী আনন্দ। পোঁটলা থেকে মুড়ি আর তরকারি নিয়ে বললে, ‘খাবে? সেই তো কত রাত অবধি বসে থাকবে।’ হায়রে ভারতবর্ষ! লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল। আমার দেশের লোকশিল্পী ইংরেজি কেতার ওয়াশরুমের ব্যবহার জানে না, তাই আমাদের তাদের মর্যাদা দিতে বেধেছিল।
- কী তরকারি?
- সেই তরকারি হল বড়ার ঝোল।
- ও! খেয়েছিলে?
- না খাইনি, তবে ঝোলের বেশ সুন্দর রং দেখে কীকরে করে জেনে নিয়েছিলাম। পরে এক দু’বার করেছি। বেশ লাগে।
- আমি খাইনি কেন মা?
- কে জানে, বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলি মনে হয়।
- কীভাবে বড়ার ঝোলটা হয় বল তো জেঠিমা।
- বেশি কিছু না। বড়াটা মুসুর ডালের না করে মটর ডালের করেছিল ওরা। আলু-পটল ভেজে জিরে গুঁড়ো, কাঁচা লঙ্কা বাটা দিয়ে কষে নেড়ে জল দিতে হবে। ঝোল ফুটে উঠলে বড়া দিয়ে নামিয়ে নিতে হবে। ঝোল ঢুকে বড়াগুলো বেশ টোপা টোপা, টইটম্বুর হয়েছিল। আর ওদের টিফিন বক্সে পাশে গন্ধরাজ লেবু দেখেছিলাম। পাতলা ঝোল লেবু দিয়ে ভাল লাগে।
- এরকম গল্প করে বললে মা, আমার যে কষ্ট হচ্ছে।
- দেশের মানুষের গল্প শুনে এই যে কষ্টের অনুভূতি, এটাই ভালবাসা।
- আন্দুলকে তুমি ভালবাসো জেঠিমা? চাকরি করতে গিয়ে ভালবেসে ফেলেছ? কত খুঁটিনাটি কাহিনী যোগাড় করেছ।
- হ্যাঁ, ভালবাসি।
- কষ্ট হয়?
- ঠিক কষ্ট নয়। একটা অন্য ভরসার অনুভূতি।
- কীরকম?
- একবার ইউনিভার্সিটির প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা নিতে কলকাতার নামী কলেজের দু’জন অধ্যাপিকা এলেন। পরীক্ষা শুরুর দেড়ঘণ্টা আগে এসে আন্দুল রাজবাড়ি, অন্য নানা জায়গার ছবি তুলছিলেন। আমাদের বললেন, “বাবা! এ ক’দিন নিজেদের কলেজের মুখ দেখতে হবে না। বিরাট বাঁচোয়া।’ আমাদের কিন্তু এমন হয় না। আমরা যখন ফিল্ডে যাই, হাওড়া থেকে ট্রেনে উঠি, দূরপাল্লার ট্রেনটা হু হু করে আন্দুল পেরোয়, ছেলেমেয়েরা চেঁচায়, “ম্যাডাম! আন্দুল!” আমরা স্টুডেন্ট, টিচার জানলায় হামলে পড়ে দেখি, যতক্ষণ আন্দুল দেখা যায়।
- হো হো হো, কী মজা।
- আবার এমনও হয়েছে। আমি হাওড়ার কোনো প্রত্যন্ত কলেজে গেছি পরীক্ষা নিতে। ওখান থেকে কারোর গাড়িতে ফিরছি। সন্ধে হয়ে এসেছে। এবারে আমি কোনো কনভিনিয়েন্ট পয়েন্টে নামব, সেটা ভাবতে ভাবতে, হঠাৎ দেখি জায়গাটা অঙ্কুরহাটি। অমনি হাঁচোড় পাঁচোড় করে নেমে পড়েছি। এবার কোনা এক্সপ্রেস ওয়ের বাস ধরে বাড়ি ফিরতে পারতাম। কিন্তু কী মনে হল, ট্রেকারে করে নেচে নেচে আন্দুলে এসে নামলাম। উফ্ফ্, শান্তি! এখানে হোঁচট খেলেও কেউ বলবে, “ম্যাডাম লাগল?” তারপর সিক্সটি ওয়ান বাস ধরে ঝ্যাকড় ঝ্যাকড় করে সন্ধে রাতে বাড়ি ফিরলাম।
- আন্দুল তোমায় তুকগুণ কিছু করেছে জেঠিমা। তান্ত্রিক টান্ত্রিক কিছু আছে ওখানে।
- তা যদি বলিস, তবে বলি এখন আছে কিনা জানি না। তবে এককালে তন্ত্র সাধনায় আন্দুলের নামডাক ছিল।
- সে কি গো মা, একথা তো আগে কোনোদিন বলনি।
- আগে কথা ওঠেনি, বলা হয়নি।
- এবারে বল। কুইক মার্চ।
- দত্ত চৌধুরীদের কথা তোদের বলেছিলাম।
- হ্যাঁ হ্যাঁ।
- ১৬৫০ সাল নাগাদ দত্তচৌধুরীরা রঘুনাথ তর্কতীর্থ নামে এক পণ্ডিত ব্রাহ্মণকে সরস্বতী নদীর ধারে বাস্তু ও স্থাবর সম্পত্তি দান করেন। এঁর মূল পদবী বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্তু উপাধি ভট্টাচার্য। তিনিই জমিদারদের কুলপুরোহিত হন। এর প্রায় একশ’ বছর পরে ঐ বংশে জন্ম নেন শ্রী ভৈরবীচরণ ভট্টাচার্য। তিনি আন্দুলের মহাকাল শিবমন্দিরের নিচে এক কুঠুরিতে পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে তন্ত্রসাধনা করতেন। ভৈরবীচরণের এক কন্যা শঙ্করী ছোটবেলায় জ্বর হয়ে মারা যায়। ১৭৫০ সালে ভৈরবীচরণ শ্রী শ্রী শঙ্করী সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির তৈরি করেন।
- মন্দিরগুলো এখনও আছে?
- হ্যাঁ সব আছে। আন্দুলের এক রাজাও তন্ত্রসাধনা করতেন।
- তাই নাকি? তাঁর নাম জানো?
- হ্যাঁ। তাঁর নাম রাজা বিজয়কেশব রায়। তাঁর সভাকবি ছিলেন প্রেমিক মহারাজ।
- প্রেমিক মহারাজ কে?
- প্রেমিক মহারাজ হলেন শ্রী মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। ভৈরবীচরণের ভাইয়ের বংশকে আন্দুলে বলে ‘মেজো তরফ’। সেই মেজো তরফের বাড়িতে দুর্গাদালান আছে। এই বাড়িটি স্থানীয়রা বলেন ‘মাঝের বাড়ি’। এই মেজ তরফের প্রাণপুরুষ হলেন প্রেমিক মহারাজ। তাঁর মাঝের বাড়িকে আন্দুলের বাইরের লোক ‘প্রেমিক ভবন’ নামে চেনে। এই প্রেমিক ভবন কালীকীর্তন ও সংস্কৃতি চর্চার পীঠস্থান বা আখড়া। প্রেমিক মহারাজের লেখা গানগুলোর সুর দিতেন কৃষ্ণধন মল্লিক। এই প্রেমিক মহারাজ আন্দুল রাজবাড়িতেই কালীকীর্তন সমিতি স্থাপন করেন।
- মা, বইমেলায় রামকৃষ্ণ মিশনের স্টলে যে কালীকীর্তনের সিডি বিক্রি হচ্ছিল, সে কি এঁদের গাওয়া?
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস।
- কিন্তু প্রেমিক মহারাজ নাম কেন হল?
- উনি যে কালীকীর্তনগুলো লিখেছিলেন, তাতে নিজের নাম না লিখে প্রেমিক লিখতেন। সেই থেকে ভক্তরা প্রেমিক মহারাজ বলে ডাকতে শুরু করল। ওঁর সন্ন্যাসজীবনের নাম বশিষ্ঠানন্দ।
- কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ হল?
- সেখানে সেতু হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বিবেকানন্দ।
- আন্দুলে চৈতন্যদেব ছিলেন, আনন্দ ধূল হয়েছিল, ওখানে বিবেকানন্দও আছেন?
- হ্যাঁ। আন্দুলে আনন্দ ধূলি, বিবেকানন্দেও সেই আনন্দ আর আন্দুল রাজবাড়ির নামও আনন্দধাম। বিবেকানন্দের অনুষঙ্গ ওখানে অনেক ভাবেই আছে। শুনতে চাস?
- শুনতে তো হবেই, বলে ফেল। উনি সন্ন্যাসী সূপকার, শংকর লিখেছেন। রুনাজেঠুর ভাল ভাল রান্না খেতে খেতে ওঁর কথা শুনি।
- স্বামিজীর ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় পাওয়া যায় এই ভট্টাচার্য পরিবার সিমলের দত্তদের কুলগুরু।
- সে কি গো মা, এঁরা তো দত্তচৌধুরীদের কুলগুরু। সেই থেকে হাটখোলার দত্তদেরও গুরু হতে পারেন, যেহেতু ওরা এই দত্তচৌধুরীদেরই শাখা। তবে কি হাটখোলার দত্ত আর সিমলের দত্তরা আত্মীয়? লীলাবতীর মামার বাড়ি তো হাটখোলা দত্তবাড়ি বলেছিলে, তাই তো?
- হ্যাঁ। লীলাবতীর মা মানে ব্রাহ্ম নেতা রাজনারায়ণ বসুর স্ত্রী নিস্তারিনী ঐ বাড়ির মেয়ে।
- সিমলের দত্তরা যদি হাটখোলার দত্তদের আত্মীয় হয়, তবে সেই সূত্রে হয়তো লীলাবতীর বিয়েতে বিবেকানন্দ গিয়েছিলেন। এটা হতে পারে, তাই না মা?
- মা ভবতারিণী জানেন। আমি জানিনা, সূত্র পাইনি এখনও। আত্মীয় না হলেও বন্ধু বা গুরুভাই তো বটেই।
- ইলাবরেট জেঠিমা ইলাবরেট। ভাব সম্প্রসারণ কর। যাহা জানো বলে ফেল। নইলে হয়তো উত্তেজনায় তোমার গলাটাই টিপে ফেলব।
- এক এক করে আয়। আন্দুল রাজবাড়ির কিছু ইতিহাস আমি জেনেছি নিজের তাগিদে। এককালে এই বংশের সঙ্গে আমার পূর্বপুরুষদের নানা সূত্রে যোগাযোগ তো ছিল। আমাদের কলেজের ফিজিক্সের প্রফেসর ছিলেন সুদেববাবু, সুদেব দাস। উনি আন্দুল রাজবাড়ির জামাই। ওঁর শ্যালক অমিতাভ মিত্র রাজবাড়িতেই থাকেন এখনও। তবে ওঁরা ছোট তরফ। রাজবংশ এখন বড় তরফ আর ছোট তরফে ভাগ হয়ে গেছে। মাঝখানে বিশাল বিশাল থামওলা নাচঘর, আর দুই পাশে দুই কাছারি বাড়ি। ঐ দুপাশেই বর্তমান শরিকেরা থাকেন। নাচঘর এখন নষ্ট হয়ে গেছে। আন্দুলের লোকেরা বলে সত্যজিৎ রায়ের জলসাঘরের অল্প কিছু দৃশ্যের শ্যুটিং এখানে হয়েছিল।
- তাই নাকি?
- সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। উইকিপিডিয়া বলে যে মূল শ্যুটিং হয়েছিল নিমতিতার রাজবাড়িতে, সেখানে কিন্তু আন্দুলের কথা লেখা নেই। তবে আন্দুল রাজবাড়ি দেখতে খুব সুন্দর। সুদেব বাবুর সঙ্গে আমরা ভিতরে গিয়েছিলাম। তিনতলার বারান্দা থেকে নাচঘরের ভিতরটা দেখেছিলাম।
- কেন, নাচঘরটা ভিতরে গিয়ে দেখা যায় না?
- ভেঙ্গে পড়ছে তো, তাই যাওয়া সম্ভব নয়।
- সারানো যায় না মা?
- শরিকদের পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। সরকারিভাবে হবে শুনছি সেই কবে থেকে। রাজবাড়ি হেরিটেজ তকমা পেল। মিউজিয়াম হবে, কত কথা শুনলাম। আজ পর্যন্ত কাজ কিছু হল না। যাক গে। আন্দুলের ইতিহাস বিষয়ে মুখে মুখে গল্প শুনেছি অনেক। ইন্টারনেটেও বহুরকম তথ্য আছে। আর অথেনটিক সোর্স যদি চাস, তবে জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমারের বংশ পরিচয় তৃতীয় খণ্ডে দীর্ঘ আলোচনা আছে।
- সুদেবমামা কার, মানে কোন রাজার জামাই?
- ধৈর্য ধরে শোন, তবে তো বুঝবি, কোন রাজা, কী বৃত্তান্ত।
- বল, বল।
- রাজা বিজয়কেশবের দুই রানী। প্রথমজন পাথুরিয়াঘাটার জমিদার শিবনারায়ণ ঘোষের মেয়ে নবদুর্গা। এঁর কোনো সন্তান হয়নি। দ্বিতীয়জন কুমোরটুলির ভবদায়িনীচরণ মিত্রের মেয়ে দুর্গাসুন্দরী। এঁর একটি মেয়ে হয়েছিল, সে একেবারে শিশুকালেই মারা যায়। এদিকে ১৮৭৯ সালে রাজার মৃত্যুর পর রাজ্যপাট দেখবে কে? দুই রানীই ঠিক করলেন পুত্র দত্তক নেবেন। এই কথা রাজবাড়ির দুঁদে অ্যাটর্নি নিমাইচরণ বসুর মাধ্যমে আর এক অ্যাটর্নি বিশ্বনাথ দত্ত জানতে পারেন। তিনি তখন তাঁর দুই ছেলে নরেন আর মহেনকে দত্তক দেবেন বলে আবেদন করেন।
- নিমাইচরণ? ইনি কি সেই নিমাইচরণ, যাঁর এজলাসে ভূপেন বোস আর নরেন দত্ত আইনের কাজ শিখতেন?
- একদম। সেই নিমাইচরণ। তবে কাজ শেখাটা আরও পরে হবে। তখনও শুরু হয়নি।
- কী বলছ গো মা? বিবেকানন্দ আন্দুল রাজা হতেন?
- হলেন কই? ভুবনেশ্বরী দেবী রাজি হননি।
- ভাগ্যিস রাজি হননি। কিন্তু এটা কেমন ভাবনা, যে পুত্ররত্নকে দত্তক দিয়ে দেবেন?
- অসুবিধে কী? দত্তচৌধুরীরা রয়েছে, কুলগুরু রয়েছেন। ছেলের অনেক কিছু করার ক্ষমতা আছে বুঝেছিলেন নিশ্চয়ই, তাই বড় আকাশে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের দৃঢ়তায় সিরাজদৌল্লার রক্তলাগা ঐ সম্পদের ছোঁয়া থেকে বিবেকানন্দ বেঁচে গেলেন। তখন তিনি ষোলো বছরের কিশোর।
- আচ্ছা, ওটা তো গেল। রাজপরিবারের কী হল?
- রাজপরিবারে দু’জন রানী দত্তক চেয়েছেন। একজন রানী যদি ছেড়ে দিতেন তো কথা ছিল। কিন্তু দু’জনেরই রাজমাতা হবার সাধ। লোভী ইংরেজ ডামাডোল দেখে ঝোপ বুঝে কোপ মারল। প্রিভি কাউন্সিলে মামলা হয়ে গেল, এক এস্টেটে দুই দত্তক অবৈধ বলে রায়ও বেরিয়ে গেল।
- তারপর?
- তারপর ইংরেজ খুঁজে পেতে বিজয়কেশবের এক পিসতুত ভাই, রাজকন্যা ত্রিপুরাসুন্দরীর ছেলে ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্রকে রাজসিংহাসনে বসাল।
- পিসতুতো ভাই আবার কোথা থেকে এল?
- আরে বাবা, বংশে কি শুধু ছেলেরা থাকে নাকি? মেয়েরাও তো থাকে। তাদের কথা বংশ লতিকায় লেখা হয় না। বিজয়কেশবের বাবা রাজা কাশীনাথ রায় তাঁর মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন বড়িশা সমাজের মুখ্য কুলীন বাবু কালীপদ মিত্রের সঙ্গে। এঁদের ছেলে ক্ষেত্রকৃষ্ণ। তবে যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে তাঁর বেশ বয়স হয়েছে। ১৮৮০ সালে ক্ষেত্রকৃষ্ণ যখন রাজা হলেন, তখন তাঁর বয়স প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই। ইংরেজ হয়তো ভেবেছিল এই রাজার এন্তেকাল হলেই সব দখল করবে। কারণ আগের রাজারা কেউই খুব বেশি দিন বাঁচেননি। কিন্তু তা হলনা। এইরাজা পরের সাতাশ বছর রাজত্ব করলেন। এইভাবে রাজবংশ প্রথমে কর, তারপর রায়, শেষে মিত্র হল।
- প্রথমে কর কী করে?
- দত্তচৌধুরীদের এক শরিক কাশীশ্বর তাঁর জামাই গৌরীশঙ্কর বসুমল্লিককে আন্দুলে নিয়ে আসেন।
- বসুমল্লিক?
- হ্যাঁ, এই বসুমল্লিকরাই পরে হাওড়ার দশ আনার জমিদারীর কিছু অংশ কিনে এখন যেখানে বঙ্গবাসী, ঐ অঞ্চলে চলে যান। ওঁদের প্রাসাদের ফটক থেকেই আজকের মল্লিক ফটক নামটা এসেছে। আর আজকের মঙ্গলাহাটও ঐ মল্লিকরাই বসিয়েছেন। ঐ পর্বটা এখন ছাড়, যেটা বলছি সেটা শোন। গৌরীশঙ্কর আবার তাঁর ভগ্নীপতি ভুবনেশ্বর করকে আন্দুলে নিয়ে আসেন বসবাসের জন্য। এই করেরা শিক্ষিত পরিবার ছিল। পাণ্ডিত্য, কর্মকুশলতা এসব গুণ থাকার কারণে বাংলার নবাবের কাছ থেকে রায় উপাধি পেয়েছিল, ভূসম্পত্তিও বেড়ে গিয়েছিল। এইবংশে কয়েক পুরুষ পরের রামচরণ রায়েরও এমন গুণ ছিল। সেই সময়ে মুঘল সাম্রাজ্য টিমটিম করছে। পড়তির দিকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে তার প্রভাব বাড়াচ্ছে। ক্ষমতার গন্ধ শুঁকে রামচরণ হয়ে গেলেন কোম্পানির দেওয়ান। শেষ পর্যন্ত পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের হার এবং হত্যার পর কোম্পানি তাঁর কোষাগার লুঠ করে। নবকৃষ্ণ দেবের মত রামচরণ ও বিপুল নবাবী সম্পত্তি হস্তগত করেন। এবং একই সময়ে শোভাবাজার রাজবাড়ি ও আন্দুল রাজবাড়ির উথ্থান হয়। অর্থ ও ক্ষমতার জোরে সম্পন্ন কায়স্থদের সঙ্গে নিবিড় বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। রামচরণের পুত্র রামলোচন লর্ড ক্লাইভের সুপারিশে দিল্লির তৎকালীন বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে রাজা উপাধি লাভ করেন অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে।
- বুঝলাম ভুবনেশ্বর কর, রামচরণ রায়, রাজা রামলোচন রায়।
- হ্যাঁ। জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুমারের বংশ পরিচয় বইয়ে আর একটা কথা পড়লাম। এই রামলোচন নাকি নন্দকুমারের ফাঁসির মামলায় ওয়ারেন হেস্টিংসের পক্ষে সাক্ষী দিয়েছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংসের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন বর্ধমানের রাজা নন্দকুমার। সেই রাগে মিথ্যে মামলায় ফাঁসিয়ে বিচারের প্রহসন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাঁকে খিদিরপুরে প্রকাশ্য রাস্তায় ফাঁসি দেয়। ট্রাফিক আইল্যান্ডের মাঝখানে সেই ফাঁসির কুয়ো আজও আছে। কেবল কলকাতার মানুষ তার তাৎপর্য ভুলে গেছে।
- ওমা, বড়িশা বিবেকানন্দ কলেজ থেকে ফেরার পথে তুমি যে আইল্যান্ডটা দেখিয়ে বলেছিলে, এটা দেখে রাখ, সেইটা?
- হ্যাঁ সেইটা। আজকের ফ্যান্সি লেনের নামটা কোনো শৌখিনতা থেকে আসেনি। আসলে তা নন্দকুমারের ফাঁসির বার্তা বহন করে। রামলোচনের পুত্র কাশীনাথের বিয়ে হয় শোভাবাজার রাজবাড়ির কন্যার সঙ্গে। তাঁদের পুত্র রাজনারায়ণ কিন্তু ডিরোজিওর ইয়ং বেঙ্গল দলের সদস্য, প্রেসিডেন্সির ছাত্র। বহু ভাষাবিদ এবং রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা। বংশের ইতিহাস বোধহয় এভাবেই ঘুরে যায়।
- আচ্ছা, বেশ!
- এই রাজনারায়ণের ছেলে তান্ত্রিক রাজা বিজয়কেশব রায়।
- আ – চ্ছা। এরপরেই রায় থেকে মিত্র।
- তোরা কীরকম দেখ। প্রশ্ন করেছিলি প্রেমিক মহারাজের কালীকীর্তন সমিতির সঙ্গে রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পর্ক কী। আমি সেটার উত্তর দিচ্ছি। তোদের কি প্রশ্নটা মনে আছে?
- ও -ও, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওটা বল।
- ১৮৯৭ সালে বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার পরে সেখানে এই কালীকীর্তন পরিবেশনের জন্য নাকি স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং আন্দুলে এসে কালীকীর্তন সমিতিকে কীর্তন পরিবেশনের নেমন্তন্ন করে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, যতদিন এই কালীকীর্তন সমিতি থাকবে, ততদিনই যেন এই ধারা বজায় থাকে, সেই আবেদনও রেখেছিলেন। প্রথম বছর এই কীর্তনে খুশি হয়ে শ্রী শ্রী মা সারদা দেবী নিজের হাতে পরিবেশন করে গায়কদের ভোগ খাইয়েছিলেন বলেও আন্দুলের লোকেরা বলে। সেই থেকে আজও শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবে বেলুড় মঠে কালীকীর্তন পরিবেশিত হয়।
- প্রেমিক মহারাজ নিজে গিয়েছিলেন?
- ওঁর মৃত্যু সাল ১৯০৯। এখন উনি নিজে কোনোদিন গিয়েছিলেন কিনা, আমি জানি না।
- জেঠিমা তুমি যা জানো, সেটাই আমি হজম করতে পারছি না।
- ওগুলো হজম করতে হবে না। এবার বড়ার টক খা।
- রুনাজেঠু তো বললই না বড়ার টক কিভাবে হয়।
- আমি বলছি শোন। বড়াটা মুসুর ডাল বেটে ভেজে নিতে হবে, আগে যেমন বলেছিলাম। তবে বড়া যখন টকে পড়বে, তখন কিন্তু তাতে কোনো পেঁয়াজ কুচো দেওয়া যাবে না। এবার যা নিয়ম, তেলে পাঁচফোড়ন, শুকনো লঙ্কা ফেলে ডুমো ডুমো কুমড়ো ভেজে নিতে হবে। এবারে নুন হলুদ দিয়ে একটু কষে জল দিতে হবে। ঝোল ফুটে উঠলে টক মেশানোর পালা। এটা কাঁচা তেঁতুল দিয়ে করা হয়েছে। অনেক লোকের রান্না বলে তেঁতুলের ক্বাথ মেশানো হয়েছে। অল্প লোকের রান্না হলে খোসা সমেত কাঁচা তেঁতুল ফেলে দিলেও অসুবিধে হয় না। টকের ঝোলের স্বাদ এসে গেলে বড়াগুলো তাতে ফেলে এক ফুট দিয়ে নিতে হবে। ব্যস। বড়ার টক তৈরি।