১
আলোর নীচে আঁধার করে,
অতীত ফেরে অন্ধকারে,
ফিসফিসিয়ে শ্বাপদ স্বরে
কাঁপন ধরায় হাড়-পাঁজরে,
মুছে দিলাম আজ দুপুরে
তোমার আমার কালো।
ফুলগুলো কই ডালটা খালি,
তারার কাঁপন চাঁদের ফালি,
ভয় আক্ষেপ দুখের ডালি
কালের নিচে যতেক কালি
জোছনা মাখা রূপোর বালি
সত্যে শুধু আলো।
– এবার তবে লাবণ্যর গল্প বলো মা।
– লাবণ্যপ্রভার গল্পটা কিন্তু আন্দুল থেকেই শুরু হবে।
– তাই নাকি? বলো বলো।
– দেখ, আন্দুল রাজবাড়ির মেয়ে সরোজিনী মিত্রের বরের নাম কি মনে আছে তোদের? আগে বলেছিলাম।
– হুম, খানাকুলের ঘোষ বংশের ব্রজেন্দ্রনাথ ঘোষ।
– ঠিক এই ব্রজেন্দ্রনাথের একজন ছোটোভাই ছিলেন। এই ছোটোভায়ের ছেলে ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় ডাক্তার আর. জি. করের ছোটোভাই রাধাকিশোর করের মেয়ে যূথিকারানীর। ধীরেন্দ্র যূথিকার মেয়েই হল লাবণ্যপ্রভা আমার দিদা।
– আ-চ্ছা! একমাত্র মেয়ে?
– উঁহু। বড় মেয়ে, প্রথম সন্তান। বাপের বাড়ির সাকিন খিদিরপুর।
– আচ্ছা, আরও ভাইবোন ছিল?
– হুম। লাবণ্যর ভাই অরুণ, মায়ের বড় মামা – আমার আর এক বড়দাদু, রাঁচীতে থাকতেন। যূথিকারানীর মৃত্যুর পর ধীরেন্দ্রনাথ আরও দু’বার বিয়ে করেছিলেন। দ্বিতীয় স্ত্রীয়ের ছেলে শঙ্কর, আমার ছোড়দাদু। তৃতীয় স্ত্রীয়ের তিন ছেলে মেয়ে – মায়ের নিনামাসি, ডলিমাসি আর গনেশ মামা – আমার আরও তিন দাদু-দিদা। বড়দাদু ছাড়া সকলেই কলকাতাবাসী।
– ওঁরা সবাই এখন কোথায়?
– বড়দাদু অরুণ আর বড়দিদা শেফালি আর বেঁচে নেই। ছোড়দাদুও বেঁচে নেই। ছোড়দিদা সুমিতা আর নিনাদিদা এখনও বেঁচে আছেন, নাকতলায় থাকেন। ডলিদিদা আর গনেশদাদু বহুদিন মারা গেছেন। তখন আমি ইস্কুলে পড়ি। ওঁরা রঙ্গনা থিয়েটার হলের কাছে থাকতেন।
– সুমিতাদিদা আর নিনাদিদা এখন কেমন আছেন, মা?
– আছেন বলতে জরাগ্রস্ত, নব্বই ছুঁই ছুঁই। আর নিনাদিদা তো মানসিকভাবে সুস্থ নয়, অল্পবয়সে উত্তমকুমারকে বিয়ে করবে বলে পাগল হয়ে গিয়েছিল। তাই বিয়ে-থাও হয়নি।
– মানে? উত্তমকুমারকে বিয়ে করতে চাইতো?
– হ্যাঁ, হাসছিস? বহুমেয়েই তখন এমন পাগল ছিল। স্টার থিয়েটারে শ্যামলী দেখে নিনাদিদা পাগল হয়ে গেল। রোজ স্টারের দরজায় বসে থাকত। উত্তমকুমার কখন ঢুকবেন, কখন বেরোবেন। তারপর ধীরে ধীরে বিকার গ্রাস করলো। বলতো, উত্তমকুমার ওকে নিয়ে যাবে। মেহগনি কাঠের কারুকাজ করা পুরোনো ড্রেসিং টেবিলের বিরাট আয়নার সামনে সেজেগুজে বসে থাকতো, উত্তমের সঙ্গে বেরোবে বলে। রাতে সাতপদ রেঁধে শ্বেতপাথরের ডাইনিং টেবিলে সাজিয়ে বসে থাকতো, উত্তমকুমার এলে খেতে বসবে। বাড়ির লোক বোঝালেও শুনতো না। তখন আর নিনাদিদার কত বয়স – এই তেইশ-চব্বিশ ধর। সে যুগে মানসিক অসুখ সম্পর্কে মানুষের তো তেমন সচেতনতা ছিল না। উপযুক্ত চিকিৎসা হয়নি। ছোটোবেলায় শুনতাম নিনাদিদার হিস্টিরিয়া হয়েছে। সবাই বলতো, চেষ্টাচরিত্র করে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই নাকি হিস্টিরিয়া ভালো হয়ে যেত। সে বিয়ে আর হয়নি। আর উন্মাদ বোনের দেখাশোনা করার জন্য ডলিদিদা আর গণেশ দাদুও বিয়ে করেনি।
– হায় ভগবান, এ যে দেখছি স্টার থিয়েটারের উজ্জ্বল ইতিহাসের কোল্যাটারাল ড্যামেজ। উত্তমকুমার জানতেও পারলেন না, যে ওঁর শ্যামলীতে পার্ট করার জন্য ধীরেন্দ্রনাথের তৃতীয় পক্ষ নির্ব্বংশ হল। কিন্তু সে যুগের মেয়েরা এমন পাগল হতো? তুমি সে যুগে জন্মালে এমন পাগল হতে মা?
– হাঃ হাঃ হাঃ। সে যুগে জন্মাতে হবে কেন? এ যুগে জন্মে আমি তো আজও উত্তমকুমারের প্রেমে পড়ে আছি।
– তুমি? এখনও? প্রেমে – !!
– হুঁ। মরণ অবধি পড়েই থাকবো। আর আমি কেন? কৃষ্ণা আর লাবণ্যও তো প্রেমে পড়েছিল।
– মানে? দিদা, মা, নাতনি তিনজনকে প্রেমে পড়ানো? উত্তমকুমার এমন কে গো মা?
– সিনেমার হিরো, আর আমাদের যাপন।
– অবাক কাণ্ড! এ কী হিরো রে বাবা! আর তোমার কুমুদিনী? উনি উত্তমকুমারে মজেননি?
– না, একটু প্রবলেম হয়ে গিয়েছিল। উত্তমকুমারের প্রথম ছবি মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। সিনেমার নাম দৃষ্টিদান। আর হিট ছবিতে নাম করতে করতে ১৯৫৩, ছবির নাম সাড়ে চুয়াত্তর। পুরোটাই স্বাধীন ভারতবর্ষে। কুমুদিনী মারা গেছেন ১৯৪২-এ, পরাধীন দেশে। তবে উনি আরও দশ-বারো বছর বাঁচলে কী হতো, তা অবিশ্যি বলা যায় না।
– আচ্ছা, এবারে বলো, লাবণ্যর সৎভাই বোনেরা সব কলকাতায় রইলো, নিজের ভাই রাঁচী চলে গেলো কেন?
– সে অনেক ব্যাপার, ধীরেন্দ্রনাথের মামার বাড়ি, নিজের বাড়ি দু’পক্ষের অনেক লোক, মানে পরিবারের বিরাট অংশ, কলকাতার পাট চুকিয়ে রাঁচীতে বসবাস শুরু করে।
– কেন?
– পরিবারের কলঙ্ক ঢাকতে।
– কিসের কলঙ্ক? ঐ উত্তমকুমারের ব্যাপারটা?
– না রে বাবা। ওটা আর কলঙ্ক কিসের, ও তো অসুখ, সে নিয়ে আর কী করা যাবে? এ কলঙ্ক তার অনেক আগের যুগের কথা।
“কলঙ্ক, তুমি প্রদীপ দেখেছো? আর প্রদীপের বাটি?
জানো টলটল করে সে আমার বন্ধুর দুই চোখে?
আমি ও কাজল সন্তান তার, বন্ধুরা জল মাটি
ফিরেও দেখি না পথে পড়ে থাকা
বৈধ-অবৈধকে—
যে যার মতন রোদবৃষ্টিতে হাঁটি…”
– প্রাচীন বংশের সব ইতিহাস ভালো হয় না বাবু। ঝাড়বাতির আড়ালে কালকুঠরি, তার ভিতরে অদ্ভুত আঁধার। আঁধারে আবছায়া পূর্বপুরুষের পাপ। পারবি সহ্য করতে? ধক আছে শোনার?
ব্রজেন্দ্রনাথ ঘোষেদের বাড়ি ছিল খিদিরপুরে। অনেকরকম ব্যাবসার সাথে ছিল জাহাজের ব্যাবসা। সে যুগে ঘোষ পরিবারের অগাধ ধনসম্পত্তি। ব্রজেন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষ নাকি ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের দেওয়ান ছিলেন।
– পূর্বপুরুষ বলতে?
– ব্রজেন্দ্রের বাবা হলেন রামকুমার ঘোষ, তিনি বা তাঁর বাবা কে দেওয়ান ছিলেন সেটা ঠিক জানিনা।
– সেটা আবার কোন ব্যাঙ্ক জেঠিমা?
– ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গল হল আজকের স্টেট ব্যাঙ্কের পূর্বপুরুষ।
– আর দেওয়ান মানে কী? কোনো পোস্ট?
– দেওয়ান মানে খুব সম্ভবত ট্রেজারার।
– তুমি তো অদ্ভুত কথা শোনালে মা, ব্যাঙ্কেরও পূর্বপুরুষ হয়?
– হা হা হা, সব জিনিসের ইতিহাস আছে, আর ব্যাঙ্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস থাকবেনা, তা কি হয়?
– তাহলে তো ব্যাঙ্ক অব বেঙ্গলের দেওয়ানদের তালিকাও থাকবে জেঠিমা।
– থাকা তো উচিত। কিন্তু ইন্টারনেটে যে বইটা পড়তে পারলাম, তার নাম হল “The History of the Bank of Bengal”। লিখেছেন জি. পি. সাইমস স্কট। তাতে সব ইংরেজ অফিসারদের তালিকা আছে, ভারতীয়দের নেই। কেবল মিটিংয়ে কোনো প্রস্তাব কেউ দিয়েছেন, কেউ সেটা সমর্থন করেছেন, সেই হিসেবে কয়েকজন ভারতীয়ের নাম আছে – রাজা সুখময় রে, গোবিন চান্দার ডাট, হীরালাল শীল – এইরকম কিছু নাম।
– গো – বিন চা – ন্দার? এঁরা কারা?
– ইংরেজরা উচ্চারণ করতে পারতো না তো, তাই নামগুলো বিকৃত করতো। গোবিন্দচন্দ্র দত্ত হলেন রামবাগানের দত্তদের বংশধর। কবি তরু দত্তের বাবা। তিনি নিজেও ভাষাবিদ ও কবি।
– আর সুখময় রে?
– রাজা সুখময় পাল ওরফে রায় হলেন পোস্তার রাজা। উনি বাংলার বিখ্যাত ব্যাবসায়ী, ব্যাঙ্কার নকু ধরের নাতি। এই নকু ধরই নবকৃষ্ণ দেবকে ক্লাইভের কাছে চাকরি করতে পাঠিয়েছিলেন। আর নবকৃষ্ণ দেব পরে রাজা উপাধি পেয়ে শোভাবাজার রাজবংশের পত্তন করলেন।
– পৃথিবীটা গোল জেঠিমা। আবার সেই শোভাবাজারে এসে পড়লাম।
– এখন শোভাবাজারেই থাক, খিদিরপুরের অধ্যায়টা পরে হবে। আমি উঠি।
– আরে না না, খিদিরপুরে চলে এসেছি। কিরে বোনু বল না।
– খিদিরপুরে আছি মা, শুরু করো। ব্রজেন্দ্রনাথের তার মানে অনেক টাকাপয়সা ছিল। তারপর?
– শোন তবে। ব্রজবাবু তো দোর্দন্ডপ্রতাপ কর্তা, পরিবারে, সমাজে সকলে সম্মান করে। তার ছোটোভাই, একেবারে বিপরীত – অমিতব্যয়ী, উচ্ছৃঙ্খল, ভোগবিলাসে মত্ত। ঘুড়িতে বেঁধে টাকা ওড়ানো, নেশা, নারীসঙ্গ – সেকালে আর যা যা হতে পারে বাদ ছিল না কিছুই। মা গল্প করতো, আমরা শুনতাম। ঘোষ পরিবারে সকাল হয়েছে, অন্দরমহলের পাকশালায় বড় বড় উনুনে আঁচ পড়েছে। সকালের প্রাতরাশে গাওয়া ঘিয়ে লুচিভাজার গন্ধ নাকে আসছে। কতরকম সন্দেশ, নাড়ু, বরফি বানানো হচ্ছে।
-উফফ, গন্ধ পাচ্ছি তাই না রে দিদি? আর কি কি রান্না হচ্ছে? লুচির সঙ্গে খাওয়া হবে।
– তা ধর, বেশ কয়েক রকম তরকারি তো হচ্ছেই।
– যেমন একটু উদাহরণ তো দেবে? আলু চচ্চড়ি হচ্ছে?
– হ্যাঁ তা আলু চচ্চড়িও হতে পারে, জাফরানি ফুলকপি হতে পারে আবার খাসি মাংসের মেটে দিয়ে গন্ধরাজ মেটেও হতে পারে। কর্তাদের কত রকম পছন্দ অপছন্দ ছিল।
– আঃ, জাফরানি ফুলকপি, গন্ধরাজ মেটে! সেগুলো কীভাবে হয় গো মা?
– গন্ধরাজ মেটে রান্না করতে গেলে টাটকা রসালো গন্ধরাজ লেবু আর লেবুর পাতা চাই।
– বেশ
– মেটে টুকরো করে ধুয়ে নুন, লেবুর রস, আদা–রসুন বাটা মাখিয়ে কিছুক্ষণ রেখে তারপর প্রেশার কুকারে ভাপিয়ে নিতে হবে। এবার পেঁয়াজ সরাসরি না বেটে, কুচিয়ে লাল করে ভেজে নিয়ে সেই ভাজা পেঁয়াজ বাটতে হবে। কড়াতে সর্ষের তেল দিয়ে তাতে গোটা গোলমরিচ ফোড়ন দিয়ে আদা-রসুন বাটা আর ভাজা-পেঁয়াজ বাটা, নুন হলুদ দিয়ে ভাল করে কষিয়ে নিতে হবে, একটু পরে তেল ছেড়ে যাবে। এই সময় দুটো খানিক লেবু পাতা মিশিয়ে দিতে হবে। তারপর সেদ্ধ মেটে দিয়ে ভাল করে কষে শুকনো করে নিতে হবে। শেষে গরম মশলা গুঁড়ো আরও কয়েকটা লেবু পাতা দিয়ে আঁচ বন্ধ করে এক চামচ গন্ধরাজ লেবুর রস আর খুব সামান্য লেবুর খোসা কুরোনো রান্নার ওপরে ছড়িয়ে দিতে হবে।
– দেখো জেঠিমা, বোনু কেমন শিবনেত্র হয়ে আছে।
– জিভে জল আসছে রে দিদি। আর জাফরানি ফুলকপিটা? মা বল, একটু কানটা আরাম পাবে।
– ওটা সোজা রান্না, বিশেষ কিছু ঝামেলা নেই। ফুলকপি একটু বড় বড় করে কেটে গরম জলে প্রথমে ভাপিয়ে নিতে হবে। কড়ায় সম পরিমাণ তেল আর ঘি দিয়ে পেঁয়াজকুচো লাল করে ভেজে তুলে রাখতে হবে, তারপর ঐ তেলেই ফুলকপি ভেজে নেব। এবারে পরিমাণ মত টক দই নিয়ে তাতে আদা-রসুন-ধনেপাতা-কাঁচালঙ্কা বাটা, নুন ও চিনি মিশিয়ে ভাল করে ফেটিয়ে তাতে ভাজা ফুলকপিগুলো কিছুক্ষণ রেখে দেব। সেই ফাঁকে কাজু আর পোস্ত একসঙ্গে বেটে নেব। কড়া উনুনে চাপিয়ে তেল গরম করে দই মাখানো ফুলকপি দিয়ে ক্রমাগত নাড়তে হবে, আঁচ কম থাকবে। তারপর একটু ঝোল ঝোল করার জন্য পরিমাণ মত জল আর বাটা মশলা মেশাতে হবে। ঝোল গাঢ় হলে পেঁয়াজ ভাজা ও জাফরান ছড়িয়ে নামিয়ে নিতে হবে। ব্যস হয়ে গেল জাফরানি ফুলকপি।
– আর নাড়ু, বরফি, সন্দেশ কী যেন সব বলছিলে, ওগুলো কোথা থেকে আসতো?
– আসবে কেন? ওসব তখন বাড়িতেই হত। আমার মা তো কলাপাতায় মুড়ে পাতুরি সন্দেশ করতো। বেলের বরফি, বেলের মোরব্বা করতো। সুজির নাড়ু করতো।
– ও মা, আমি খাব।
– চুপ কর বোনু। তুই না, ভীষণ এদিক ওদিক মন দিস। এক জায়গায় মনটাকে রাখা অভ্যেস কর। খিদিরপুরের গল্পটা শুনতে দে। তুমি ওর কথায় কান না দিয়ে গল্পটা শেষ কর জেঠিমা।
– হুঁ, তারপর যা বলছিলাম। বৈঠকখানায় লোকজন যাতায়াত শুরু করেছে। ব্রজবাবু তাঁর হাতির দাঁতের মাথাওলা লাঠি হাতে কাজকর্ম দেখভাল করছেন, কিন্তু তাঁর তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে দেউড়ির দিকে। বিশ্বাসী দারোয়ান খবর দিয়ে গেল, ছোটোকর্তার গাড়ি আসছে। রাতের মেহফিল শেষ করে, স্খলিত পদক্ষেপ আর ঢুলুঢুলু চোখে ছোটো বাবু সিঁড়ি দিয়ে চুপচাপ উঠে যেতে চায়, যাতে দাদার সামনাসামনি না হতে হয়। ওঠা হল না, কাঁধে পড়ল দাদার বাঁকানো লাঠির মাথা। ভাই স্থানু। দাদা ব্রজেন্দ্রনাথের ইশারায় রান্নাঘর থেকে এল থালা ভরা ফুলকো লুচি। পাশে প্লেটে করে মরা মাছি। লুচি ফুটো করে মরা মাছি পুরে ভাইকে দাদা আদেশ করেন খেয়ে নাও। দাদার কথা অমান্য করার সাহস নেই, তাই ভাই বিনা বাক্যব্যয়ে লুচি খায়, আর কী? ছোটোকর্তার বমিতে ভেসে যায় বৈঠকখানা। এতো করেও ভাইকে শোধরাতে পারেন না ব্রজেন্দ্রনাথ। উল্টে ছোটোবাবু দাদার শাসনের শোধ তোলে তার স্ত্রীয়ের ওপর। বৌয়ের নামটা নগেনবালা না কী একটা বলেছিল মা ঠিক মনে নেই। ধরে নে বৌয়ের নাম নগেন্দ্রনন্দিনী। স্বামী রাতে ঘরে নেই, এ খবর তার ভাশুরঠাকুর জানবে কী করে, যদি বৌ না বলে দেয়। স্বামীর চাবুকের আঘাতে রক্তাক্ত হয় নগেন বৌ।
– কী বলছো মা! চাবুক?
– হুম, সেকালে চাবুকের শাসন খুব চালু ছিল রে। পুরোনো বাংলা সিনেমায় চাবুকের মার, বেল্টের মারের দৃশ্য থাকতো। ছোটোবেলায় আমরা দুষ্টুমি করলে বাবা বলতো পিঠের ছাল তুলে দেব আর মা বলতো শঙ্কর মাছের চাবুক-পেটা করব। যদিও এসব কিছুই হতো না। এখন ভাবি, যে যা দেখে, যা শুনে বড় হয়েছে, তার ভাষায় সেই পরিচয় পাওয়া যায়। আমার দাদু বিকাশচন্দ্রেরও চাবুক ছিল আর সেটা পরিবারের লোকেদের আঘাতও করতো। যাই হোক, যা বলছিলাম, নগেন্দ্রনন্দিনীর ওপর স্বামীর অত্যাচার দিনদিন লাগামছাড়া হয়ে উঠতে লাগল। তখন তার প্রাণ বাঁচানোর জন্য ব্রজেন্দ্রনাথ তাকে বাপের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। ছোটোছেলে ধীরেন্দ্রনাথকে কোলে নিয়ে নগেনবৌয়ের ঠাঁই হল বাপের বাড়িতে। বাপের বাড়িও জমিদার।
– বাপের বাড়ি কোথাকার?
– সঠিক জানা নেই, মানে মা ঠিক করে বলতে পারেনি। ঐ ঘোষ, বোস, দত্ত মিত্র কিছু একটা হবে। ধরে নে দত্ত। তাদের পরিচয় হারিয়ে গেছে, পারিবারিক শ্রুতিতে নেই।
– তারপর?
– বৌ বাপের বাড়ি চলে যাওয়ায় ছোটোকর্তার আঁতে ঘা লাগে। সে প্রতিশোধস্পৃহায় জ্বলতে থাকে। বেশ কিছু দিন পর, সে নগেন্দ্রনন্দিনীকে একটা চিঠি লেখে। চিঠিতে শুধু লেখা ছিল, ‘আমি আসছি’। সঙ্গে সে নিজের একটা ছবি পাঠায়। সাধারণ ছবি নয়, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটা ছবি। তারপর কেটে যায় আরও বেশ কিছুদিন। কোলের শিশু ধীরেন্দ্রনাথও একটু একটু করে বড় হচ্ছে। চিঠির কথা নগেনের বাপের বাড়ির লোক ভুলেও যায়। কিন্তু ছোটোকর্তা বসে ছিল না। সে তার ভাগের জমিদারী মহাল থেকে লোক বেছে বেছে গোপনে এক বিরাট লেঠেল বাহিনী তৈরি করে। তারপর সেই বাহিনী নিয়ে হঠাৎ শ্বশুরবাড়ি আক্রমণ করে। সেই বাহিনী নগেনের বাপের বাড়িতে ঢুকে দেউড়িতে সামনে যাকে পায়, তাকেই কোপ মারে। দুই বাড়ির লেঠেলদের যুদ্ধ বেধে যায়, তবে ওরা অন্দরমহলে ঢুকতে পারেনি।
– সে আবার কী? এমন হতে পারে?
– হুঁ, হতে পারে। সেকালে জমিদারে জমিদারে এমন যুদ্ধ আকছার হতো। কিন্তু এটা ছিল এক তরফা। প্ররোচনা ছাড়া। মা বলতো, এক দাসী প্রাণের বাজি রেখে উদ্যত তরোয়ালের সামনে থেকে শিশু ধীরেন্দ্রনাথকে কোলে তুলে নিয়ে খিড়কির দরজা দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে যায়। বুড়ো বয়সেও নাকি মায়ের দাদুর কাঁধে আর বাঁপায়ে তরোয়ালের কোপের দাগ থেকে গিয়েছিল, মেলায়নি, মা দেখেছে।
– কী সর্বনাশের কাণ্ড, আমি বিশ্বাস করতে পারছি না, মা।
– আমি তো আগেই বলেছিলাম, পূর্বপুরুষের পাপের ইতিহাস শুনতে গেলে বুকের পাটা লাগবে। রানী রাসমণি সিরিয়ালে দেখিসনি, অন্য জমিদার রানীকে মারার চেষ্টা করছে। হয়তো সিরিয়ালটায় অনেক কিছুই কল্পনার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে, কিন্তু ওটাই তখনকার সমাজচিত্র।
– সমাজচিত্র? ছোটোকর্তার শাস্তি হয়নি মা? জমিদার বলে টাকা দিয়ে পার পেয়ে গেল?
– না রে বাবু, যাদের মেরেছিল, তারাও তো কম বড় জমিদার ছিল না। কমপক্ষে দু’দিকে দশ বারোজন সেদিন খুন হল। তাই মামলা, বিচার সবই হয়েছিল।
– ছোটোকর্তার কি শাস্তি হল?
– সেদিন বাবলিদির সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। বাবলিদি বলছিল ছোটোকর্তার জেল হয়েছিল। কিন্তু না, বাবলিদি জানে না। সে লোক আমার দিদা মানে লাবণ্যপ্রভার ঠাকুরদা। মা আমাকে দরজা জানলা বন্ধ করে বলেছিল, ‘ছোটোকর্তার চরমদণ্ড হয়েছিল’।
– মা-আ!
– বংশের ভালো নিতে গেলে, খারাপটাও যে নিতে হবে বাবু। রঞ্জা–শারদা–কৃষ্ণা–লাবণ্য–ধীরেন্দ্র–ছোটোকর্তা–ছয় প্রজন্মের আগের পাপ ধুয়ে যাক সত্যভাষণে। মা বলেছিল, মৃত্যুর আগে সে শেষ ইচ্ছে হিসেবে স্ত্রীয়ের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল, হয়তো ক্ষমা চাইতো। নগেন্দ্রনন্দিনী দেখা করেনি। মৃত স্বামীর মুখ দেখেনি। বৈধব্য মেনে নিয়েছিল চুপচাপ। এর পরে আর বেশিদিন সে বাঁচেওনি। এই ঘটনার পরেই লজ্জা গোপন করতে ঘোষ পরিবারের একটা বড় অংশ কলকাতার পাট চুকিয়ে রাঁচীতে চলে যায়। ওখানে হয়তো কিছু জমিজমা আগে থাকতেই ছিল।
– মা, একটা কথা ভেবে হাসি পাচ্ছে, যার বাবার এমন পরিণতি, সেই পাত্রকে তিন-তিন জন সম্পন্ন গেরস্থ মেয়ে দিল? না দিলে ধীরেন্দ্রনাথ তিন-তিনটে বিয়ে তো করতে পারতো না।
– হা হা হা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে মেয়ের বাড়ি শুধু সম্পন্ন গেরস্থ তো নয়, জ্ঞানীগুণীও বটে। বেতড়ের কর বাড়ির নাতনি যূথিকারানী প্রথম বৌ। যূথিকার বাবা রাধাকিশোর নাকি ব্যাবসার কাজে বেনারসে থাকতেন। আজও রাঁচীর বাড়ির দেওয়ালে যূথিকার একটা বড় ছবি আছে, ছবিটা বেনারসে তোলা। তবে ওঁর ভাই কলকাতার কলেজে অধ্যাপনা করতেন। আসলে কী জানিস, ছোটোবাবু যখন পাপ করেছে, ধীরেন্দ্রনাথ তখন শিশু, তার তো আর কোনো দোষ ছিলনা, আর ছেলেদের গায়ে কলঙ্ক লাগে না। তার ওপরে ঘোষেরা হল কুলীন। করেরা মৌলিক কায়স্থ। কুলীন পাত্র সে যুগে মেয়ের বাবারা হাতছাড়া করতো না। ধীরেন্দ্রনাথের বদলে ধীরেন্দ্রবালা হলে বিয়ের অসুবিধা যে হতো, সেটা তো চোখ বুজেই বলা যায়। আজও কতো প্রাচীন পরিবার হয়তো এমন অনেক ইতিহাস বুকে চেপে বসে আছে।
তাছাড়া এখানে আরও একটা কথা আছে। তোদের বলেছিলাম মনে আছে কী, যে যূথিকা তার শাশুড়ির কাছে রান্না শেখার সুযোগ পায়নি? তার রান্নাতে কর বাড়ির ছাপ রয়ে গিয়েছিল। এবারে বুঝলি তো কারণটা কী?
– হ্যাঁ হ্যাঁ। এইবার বোঝা গেল, যে কর বাড়ির ঝোল হল সেন বাড়ির ঝোল। সেটা ঘোষ বাড়ি ঘুরে বোস বাড়ি, অধুনা মণ্ডল হয়ে বক্সিবাড়িতে একই রয়ে গেল।
– একদম, এরপর এই ঝোল তোদের শ্বশুর বাড়িতে থানা গাড়বে।
– দূর, কী যে বল তার ঠিক নেই। রাধাকিশোর কে?
– রাধাকিশোর ডাক্তার আর. জি. করের ছোটো ভাই।
– ওঁরা কি দুই ভাই?
– না না, চারভাই। তোদের আগেই তো বলেছিলাম। মোহনবাগানের কথা বলতে গিয়ে, পূরবী মাইমা আর ফুলরানী মাইমার কথা বলেছিলাম মনে নেই? আর. জি. কর, মানে রাধাগোবিন্দ কর হলেন বড় ভাই। তারপর রাধামাধব কর, রাধারমণ কর আর রাধাকিশোর কর।
– এঁরা কি সবাই ডাক্তার?
– না, রাধামাধব সে যুগের বিখ্যাত অভিনেতা। নাটকে অভিনয় করে তাঁর এত খ্যাতি হয়েছিল যে নাট্যাচার্য উপাধি পেয়েছিলেন। উনি নিজে বসন্তকুমারী নামে একটি নাটক লিখেছিলেন। তবে সেটি ঠিক মৌলিক নাটক নয়। শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েটের ভাবানুবাদ। এই রাধামাধবের মেয়ে শৈলজার সঙ্গে বিয়ে হয় আইনজীবী ফনীন্দ্রনাথ বসুর। এঁদের মেয়ে ফুলরানী, যাঁর সঙ্গে দাঁতি সেনের বিয়ে হয়েছিল। মানে রাধামাধবের নাতনির ছেলে হলেন শ্যমল সেন। রাধারমণ কর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারিনি, তবে ধন্য বাগবাজার বইতে একটাই লাইন আছে, যে বিলেত থেকে লেখাপড়া শিখে ফিরে এসে ইনিও নাটক করেছেন। এই রাধারমণের চার ছেলে – মোহিনীমোহন, রমণীমোহন, রজনীমোহন আর যামিনীমোহন।
– কী করে জানলে?
– পূরবী মাইমা বলেছেন। কারণ উনি রাধারমণের নাতনি প্রভাবতীর মেয়ে। ওঁর বাবার নাম দ্বিজেন্দ্রনাথ বোস।
রাধাকিশোর তো শুনেছি ব্যাবসার কাজে বেনারসে থাকতেন। তবে কী জানিস, আন্তর্জালে একটা বইয়ের কথা পড়েছি – শরীর পালন বিধি। পদ্যে লেখা। লেখক রাধাকিশোর কর। আমাদের রাধাকিশোরের বাবা দুর্গাদাস, বড়দা রাধাগোবিন্দ – দু’জনেই চিকিৎসক। কী জানি – এই বইটা আমাদের রাধাকিশোরের লেখা কিনা। এই রাধাকিশোরের মেয়ে যূথিকারানীই হলেন আমার দিদা লাবণ্যর মা।
– সে না হয় হল। নগেন্দ্রনন্দিনীর কী হল মা! বড়লোকের মেয়ে, বড়লোকের বৌ, কী লাভটা হল? জীবনটা তো ধ্বংস হয়ে গেল। যে বাপের বাড়ি আশ্রয় দিল, নিজের বর এসে তাদের খুন করে দিল। এ কী বেদনা, কত অপবাদ, শাপমুন্যি।
– ঐ জন্যেই তো এখন, শুধু দেশের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স দেখলে চলে না রে বাবু, জেন্ডার ইনডেক্সটাও দেখা হয়। যুগে যুগে, দেশে দেশে মেয়েদের যন্ত্রণার শেষ নেই। বড়লোকেরও জ্বালা, গরীবেরও জ্বালা। মধ্যবিত্ত থাকা কিছুটা ভালো। একটা আগল থাকে। বিত্তের দুই প্রান্তে অপরাধ আর অত্যাচার বাঁধনছাড়া হয়ে যায়।