৩
নরম চাঁদের আলো জ্বেলে
চরকা বুড়ি জাল বোনে।
মায়ের কথা লিখতে গেলে
কলম কাঁদে মন–কোণে।
গতকালের কথাগুলো ভুলতে পারছি না। সত্যিই কি মায়েরা চাইছেন - তাঁদের কথা লিখি? ধুর! কী সব অবাস্তব ভাবছি। আমি কি যোগ্য, এসব লিখে জানানোর জন্য? আমি কি তবে মায়েদের দ্বারা মনোনীত? নাকি বিধির দ্বারা নির্বাচিত? এত বেশি কেন আমি মানসিকভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি অতীত-চর্চায়! রাধারমণ থেকে আউলচাঁদ হয়ে গোপীনাথ, নাকি চৈতন্য – কে আমাকে এভাবে টেনে নিয়ে চলেছেন? আমি তো কৃষ্ণপন্থী নই, বিবেকানন্দকে গুরু মানি। কারণ তিনি আকাশের ঈশ্বর নন, রক্ত-মাংসে গড়া মানুষ। না, হিন্দুত্ববাদী ইন্টারপ্রিটেশন নয় – তাঁর তেজ, তারুণ্য, সমদর্শী আইডিয়াকে শ্রদ্ধা করি। আকাশে গয়না পরে দেবতা বসে আছেন, একথা আমি ছোট থেকে কোনোদিনই বিশ্বাস করিনি।
ছোটবেলায় সতীমার কাজে ঘোষপাড়া থেকে সাধক গাইয়েরা আসতেন। কানে ফুঁ দিয়ে মেয়ে বৌদের মন্ত্র দিতেন। মন্ত্র না নিলে নাকি পুজোর কাজ করা যায় না, ভোগের রান্না করা যায় না। বড়দিদি, ছোড়দিদি নিয়েছিল। ওরাই বলেছিল, যে মন্ত্রদাতা বা দাত্রী কানে ফুঁ দিয়েছে। আমার কাছে প্রস্তাব এলেও আমি নিইনি। পুজোর কাজ করলে মন থেকে করব। নীতি নিয়মে বাঁধা পড়বনা – এই আমার মত। শিক্ষাগুরুদের মানি, কিন্তু অন্য কোনো গুরুর কাছে মাথা নোওয়াব না। আর একটা কথা হল, অতীত ভাল, বর্তমানে সব খারাপ হয়ে গেছে – একথারও আমি তীব্র বিরোধী। অতীতকে সংশোধন করেই বর্তমান এসেছে, সার্বিকভাবে সে অতীতের থেকে খারাপ হতে পারে না। আমার এইসব ধ্যানধারণার তো কোনো বদল হয়নি। তবে এই অতীতচর্চা ঠিক হচ্ছে তো? কে দেবে পথের খোঁজ?
মেয়ের মনে হয়েছে, আমার গোটা জীবনটা এক অদৃশ্য জাল দিয়ে জোড়া। একথা মেয়ে আজ বলেছে বলে নয়, আমি নিজে একথা অহর্নিশি অনুভব করি। ছয়পুরুষ আগে সতী হওয়া মায়ের শিকড় ছিল কৃষ্ণনগরে। পূর্ব মেদিনীপুরে আমার বিয়ের পর এক অদ্ভুত বিধিলিপিতে নদীয়ার বাণপুরের এক গঙ্গোপাধ্যায় পরিবারের দামোদর শিলা শ্বশুরকুলে এসেছেন। এঁর সঙ্গেও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির যোগ। এসব কথা মেয়েরা জানে না। জানলে কী বলত? ঐ দামোদর প্রথম আমার শহরের বাড়িতে গৃহপ্রবেশে পুজো নেন, তারপর পরিবারে থিতু হয়েছেন। কাকতালীয় ঘটনা। ভবনাথ সেনের হাত ধরে যে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির ব্যবহার শুরু, সেই ওয়েটল্যান্ডের অফিসে আমার কর্মজীবনের সূত্রপাত, ওখানেই কর্তার সঙ্গে দেখা আর বৈবাহিক জীবনেরও শুরু। কাকতালীয় ঘটনা। আমার আন্দুল কলেজে চাকরি পাওয়াও কাকতালীয় ঘটনা। রাধারমণকে হারিয়ে গোপীনাথকে পাওয়াও কাকতালীয়। কিন্তু এক জীবনে যখন বারংবার কাক উড়ে যায়, আর তালও পড়ে – তখন সেটা একটু হলেও ভাবায়। ভুলে থাকার চেষ্টা করলেও ভেতরে কুটকুট করে কামড়ায়। আচ্ছা, আমি যে ভাবছি আমার জীবনে পূর্বপুরুষদের জীবনের নানা ঘটনার ছায়া পড়ে, এমন হয়তো সব মানুষেরই পড়ে। বেশিরভাগ মানুষ নিজেকে ধরে তাদের পূর্বতন তিন পুরুষের বেশি খোঁজ রাখে না। কেউ কেউ সেটুকুও জানে না। তাই হয়তো সেই ছায়া তারা চিনতে পারে না।
- কী গো মা! ভোরবেলা ঠান্ডায় চুপ করে বারান্দায় বসে আছ? রাতে ঘুম হয়নি নাকি? কী ভাবছ এত? মৈতনায় এলে তো তুমি এত সকালে উঠতে চাও না। সামথিং সামথিং কিছু হয়েছে। বল শিগগির।
- কিছু না, এত পাখি ডাকছে, ভোরের আলো দেখতে ইচ্ছে করল, চল, মন্দিরে যাই।
মেয়েকে নিয়ে মন্দিরের চাতালে বসে পড়ি। মনটা উথাল-পাথাল করে। আমার কুমুদিনী সিস্টার নিবেদিতার সহযোগী ছিলেন। নিবেদিতার ভারতে আসার একশ’ পঁচিশ বছর পূর্তি সমাগত প্রায়, বছর দুয়েক বাকি। গতকাল মুঠোফোনে ইস্কুলের প্রাক্তনীদের ডাক এসেছে – ঐ সময়ের বিস্মৃত নায়িকাদের নিয়ে চর্চা হবে। এ-ও কি ভবিতব্য? বিধির ইঙ্গিত? যদি হয়, তবে আমি কুমুদিনীকেই বেছে নেব। ওঁকে জানতে বড্ড ইচ্ছে করে। কিন্তু কেমন করে জানি সেই দিশাটাই যে খুঁজে পাচ্ছি না। সামনে অজানা সাগর। কী করে পার হই! হঠাৎ মেয়ের কথায় চমক ভাঙে।
- মা কালকে তো বললে না – সুদেব মামা কোন রাজার জামাই।
- এখন তো আর রাজা বলে কিছু নেই রে বাবু, বংশধরেরা আছেন। ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্রের ছোট ছেলের নাম নগেন্দ্রনাথ মিত্র। নগেন্দ্রনাথের ছেলে শৈলেন্দ্রনাথ, তস্য পুত্র আলোক মিত্র। আলোকের এক ছেলে সাত মেয়ে। ছেলের নাম অমিতাভ। অমিতাভের ছেলে অরুণাভ, তার আবার দুই মেয়ে। অমিতাভ মিত্রের সাত বোনের ছয় নম্বর বোন ইরা মিত্র, আমাদের ইরা বৌদি, সুদেবদার বৌ। তুই জন্মানোর পরে নিজে হাতে কী সুন্দর লাল সাদা কুরুশের সোয়েটার বুনে এনেছিলেন। তোর অনেক জামা কাপড় কত বাচ্চাকে দিয়ে দিলাম, কিন্তু ওটা দিইনি। যত্ন করে রেখে দিয়েছি। তোর ছেলেমেয়েদের পরাবি।
- লাল সাদা কুরুশের – মানে ঐ কুঁচি দেওয়া, মোটা উলের?
- হ্যাঁ, ওটাই।
- অরুণাভ মিত্রের দুই মেয়েই শুধু এখন রাজবাড়ির বংশধর?
- তা কেন? আরও আছে। ক্ষেত্রকৃষ্ণ মিত্রের তিন ছেলে তিন মেয়ে। মেজ ছেলে অল্প বয়সে মারা গেছেন। বড় ছেলে উপেন্দ্রনাথ মিত্রের আবার পাঁচ ছেলে চার মেয়ে। এঁরা হলেন বড় তরফ। তাঁদের বংশধরেরা সকলেই আছেন। কিছুজন আন্দুলেই বাস করেন। বাকিরা ছড়িয়ে আছে সারা পৃথিবীতে।
- আচ্ছা মা, আন্দুল রাজবাড়িতে ঠাকুর আছে?
- হুম। বিশাল অন্নপূর্ণা মন্দির, চারপাশে দ্বাদশ শিবের মন্দির, বিশাল চাতাল, খিলান, বারান্দা, সিঁড়ি মিলিয়ে দারুণ জমকালো। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকে সামনের চাতালে আছে ইংরেজ আমলের কামান। অন্নপূর্ণার পাশে গোপালও আছে।
- আমায় একদিন নিয়ে যাবে।
- অন্নপূর্ণা পুজোর দিন গেলে সবচেয়ে ভাল দেখতে পাবি।
- আচ্ছা মা, আমাদের এই গোপীনাথের মন্দিরে যে রোজ ভোগ হয়, তার কি কিছু নিয়ম আছে?
- হ্যাঁ, আছে তো।
- কেমন নিয়ম?
- গোপীনাথের কাছে রোজ পাঁচ পোয়া চালের ভাত, ডাল, আলুভাজা, দু’রকম সবজি, রঘুনাথের কাছে পাঁচশ’ আতপ চাল, আড়াইশ’ সেদ্ধ চাল আর তিন রকম ফল, বাতাসা, মিছরি, নকুলদানা ভোগ দেওয়া হয়। যেদিন কোনো বিশেষ পুজো হয়, সেদিন মাখা সন্দেশ, রসগোল্লা দেওয়া হয়। প্রতি একাদশীতে নিত্যভোগের সঙ্গে সুজির হালুয়া দেওয়া হয়। পুরো বোশেখ মাসটা ঠাকুরকে ছানা দেওয়া হয়।
- আচ্ছা!
- রোজ এই পুরো ভোগের মধ্যে রান্না করা ভোগের থেকে একজনের মত খাবার, আতপ চাল আর সেদ্ধ চাল পূজারী ব্রাহ্মণ পান। ওগুলো তিনি বাড়ি নিয়ে যান। আর বাকিটা গরীব মানুষ যারা আসে তাদের দেওয়া হয়। যদি কিছু পড়ে থাকে বাকিটা বাড়ির লোক খেয়ে নেয়।
- এই মাপটা কীভাবে ঠিক হল?
- এইরকম চলে আসছে। আসলে পাঁচ পোয়া তো নয়, পাঁচ সের চালের ভোগ হবার কথা। কিন্তু এখন এত লোক তো আর মন্দিরে খেতে আসে না। আর আমাদের পরিবারের পক্ষেও এত খরচ চালানো সম্ভব হয় না।
- পোয়া, সের এসবের মানে কী? মাপ বুঝবো কী করে? ক’জনের ভাত?
- এক পোয়া মানে আড়াইশো গ্রাম। আমাদের রান্না ঘরে যে ছোট চায়ের কাপগুলো আছে, তার দুকাপে ধরে নে এক পোয়া হয়। আমরা যা খাই, তাতে পাঁচ পোয়া চালে আট-ন’জনের হয়ে যাবে। কিন্তু গ্রামের মানুষ অন্য উপকরণের তুলনায় ভাতটা বেশি খায়, তাই চার-পাঁচজনের বেশি হবে না। চার পোয়াতে এক সের। প্রায় এক কেজির সমান, একটু কম।
- পাঁচ সের চাল দেবার নিয়ম কেন?
- এই যে দামোদর শিলা এসেছেন, তাঁর কাছে পাঁচ সের চালের নিত্যভোগ হবার প্রথা ছিল।
- দাঁড়াও দাঁড়াও মা, শিলা এসেছেন মানেটা কী?
- মানে বলব, তার আগে বল, আড়বেলে আর মৈতনা এই দুটো গ্রামের মধ্যে কী কী পার্থক্য আছে?
- উঁ – পার্থক্য হল ওখানে কাদা মাটি, এখানে বেলে মাটি। ওখানে ইছামতীর খাল, এখানে সমুদ্দুর। আর মেঠো পথ, খোড়ো চাল – এসব তো একই।
- আর কিছু চোখে পড়ে না? গাছপালা...
- হ্যাঁ হ্যাঁ, এখানে প্রচুর দেবদারু, চারিদিকে। আড়বেলেতে একটাও নেই।
- ঠিক, এই দেবদারু এখানকার স্বাভাবিক উদ্ভিদ। উপকূল এলাকার এই দেবদারু কাটার জন্য, কিছু লোক প্রতিবছর আসে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে গাছ পছন্দ করে। যার জমির গাছ, তার সঙ্গে কথা বলে গাছ কিনে, মালিককে টাকা দিয়ে চলে যায়।
- বেশ। তারপর?
- তারা যখন আসে, তখন কারোর বাড়িতে থেকে চার পাঁচটা গ্রামের দেবদারু কাটে। এই এলাকায় যখন তারা আসত, তখন আমাদের বাড়িতে থাকত।
- আমাদের বাড়িতে কেন?
- এ তল্লাটে বনেদী বাড়ি বলতে তো এই বক্সি বাড়ি। এককালে তাদের গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ ছিল, অমন তো আর কারোর বাড়িতে ছিল না। গ্রামে কোনো বাইরের লোক এলে বাড়ির পুরোনো কর্তারা তাদের গ্রামের অতিথি মনে করতেন, সে সরকারি কোনো পরিদর্শক হোন, পালাগানের শিল্পীরা হোন বা এইসব গাছকাটা লোক। সেই ঐতিহ্য তোর বুড়ো দাদা, মানে ঠাকুরদাও মেনে চলতেন। তাই ঐ গাছকাটা লোকেরা আমাদের বাড়িতেই যতদিন দরকার থাকা খাওয়া করত।
- আ-চ্ছা। এখন তো এরকম কোনো লোক থাকে না। কখনও দেখিনি।
- থাকে না, তার কারণ সেই আতিথেয়তার অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছে। তোদের জন্মের বছর দশেক আগে উনিশশ’ চুরানব্বই সালের সেপ্টেম্বর মাসে এ’বাড়িতে ঘটে গেছে এক ভয়ানক ঘটনা।
- সে কী! কী ঘটনা?
- সে সময়ে এইধরণের গাছের ইজারা নেওয়া কিছু লোক বাড়িতে ছিল, এদিকে কেউ জানে না যে তারা ভালমানুষ নয়। সরল বিশ্বাসে রাতে তোর বুড়ো দাদা আর ঠাকুমা ঘুমিয়েছিলেন। হয়তো খোলা জানলা দিয়ে সেই দুষ্টু মানুষের দল কিছু ছিটিয়ে দিয়েছিল, যাতে ওঁদের ঘুম না ভাঙে।
- সে কী? বাড়িতে আর কেউ ছিল না?
- না, তোর পিসিদের তো অনেকদিন আগেই বিয়ে হয়ে গেছে, একটি রান্নার মেয়ে রাতে থাকত, সে ছিল। তারও একই কারণে ঘুম ভাঙেনি। আর তোর বাবা আর কাকামণি তখন বাইরে থেকে পড়াশোনা করে। কাকামণি তখন কাঁথির হোস্টেলে আর বাবা বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের হোস্টেলে।
- তারপর?
- তারপর আর কী? আকাশের চাঁদ, রাতচরা পাখি আর দেবদারু বনকে সাক্ষী রেখে জোছনা ধোয়া পথ বেয়ে বিগ্রহরা পাড়ি দিলেন ভিটের মায়া ছেড়ে, জানি না কোথায়, কোন ভিনদেশে।
- মানেটা কী? এত হেঁয়ালি কোরো না মা, মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
- সেই অভিশপ্ত রাতে গাছকাটা লোকেরা মন্দির ঝেড়েপুঁছে সব কিছু ডাকাতি করে পালিয়ে যায়।
- সে কী? কী বলছ? কী কী নিয়ে গেল?
- তা নিমাইচরণ, রূপচরণের পৈতৃক সেই আড়াইশ’ তিনশ’ বছরের পুরোনো বিগ্রহ, ঠাকুরের প্রাচীন গহনা, মুকুট, রথ, বাসনকোসন – যা ছিল, ঝালি, কাঁসর...
- কী বলছ গো মা, পুরোনো কিচ্ছু নেই? কোনো স্মৃতি নেই? সব শেষ? পুলিশ আসেনি? তারা কিচ্ছু করতে পারল না? আমার যে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তাহলে এখন কোন মূর্তি পুজো হচ্ছে?
- স্মৃতি আছে মনের ভিতর, চোখের সামনে স্মারক নেই। আড়বেলেতেও ঠিক এইভাবে আমাদের সতীমার পুজোর পুরোনো বাসনকোসন সব কিছু চুরি হয়ে গেছে। গ্রামের বাড়িতে এখন লোক কমে যাচ্ছে, আগেকার মত সারাবছর সেই যৌথ গমগমে ব্যাপারটা তো আর নেই। সেই সুযোগে এমনভাবেই বাংলার গ্রামের সম্পদ বিশ্বের ধনী মানুষের বৈঠকখানার শোভা বাড়িয়ে চলেছে। এখনকার মূর্তি তোর ছোটপিসি রাজস্থানের জয়পুর থেকে করিয়ে এনেছে।
- খুব ভাল করেছে গো মা। ওটাই দামোদর শিলা?
- না রে পাগল, ঠাকুর মশাইরা একটা নারায়ণ শিলা বসিয়ে পুজো করেন, দেখিসনি? ঐ শিলা অনেকরকম হয়। এখানে দামোদর মূর্তি। আর গোপীনাথের এখনকার মূর্তিটা নিশ্চয়ই ভাল। কিন্তু তোর বাবা বলে ঐ মুখে অন্য ছাঁচ, অবাঙালি মন্দিরে যেমনটা হয়, বাবাদের ছোটবেলাকার মত সে মুখ তেমন মায়াভরা নয়।
- ঠাকুরের মুখের মায়া আসলে বাবার ছোটবেলার স্মৃতির মায়া, তাই না মা?
- হ্যাঁ, সে তো বটেই। আমাদের এখনকার নারায়ণ শিলা একজন দান করেছেন।
- দান করেছেন! কে গো মা, এমন ভালমানুষ? এমন সাসপেন্স রাখছো কেন? বল না পুরোটা।
- সাসপেন্সের কিছু নেই। অন্য আর এক গল্প।
- বল, এই বসলাম। না বললে উঠব না।
- ওয়েটল্যান্ডের অফিসে চাকরি করার সময়ে একবার তোর বাবা, বীরভূমের দেউচা পাঁচামিতে খনি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য সরকারি ক্যাম্পে গিয়েছিল।
- বেশ।
- সেখানে তোর বাবার সঙ্গে এক ভদ্রলোকের আলাপ হয়, নাম পরিমল কুমার গাঙ্গুলী। আলাপ শুধু নয়, তোর বাবা তো খুব মিশুকে। ওঁর সঙ্গে আলাপটা পারিবারিক বন্ধুত্বের দিকে গড়িয়ে যায়।
- তিনি কে?
- তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রিজিওনাল সেন্টার ফর অকুপেশনাল হেল্থের ডেপুটি ডাইরেক্টর। অফিসটা সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে।
- তারপর?
- মন্দিরে চুরির খবর শুনে উনি ওঁর মন্দিরের ঠাকুর দান করেছেন।
- ওঁর বাড়ির মন্দিরের ঠাকুর? মন্দিরটা কোথায়?
- নদীয়ার বাণপুরে, যেখানে ভবানন্দ মজুমদার শিব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই মন্দির। আজও ওখানে চাষ করার সময়ে বা অন্য কোনোরকম খোঁড়াখুঁড়ি করলে পুরোনো মুদ্রা বা কোনো উপকরণ পাওয়া যায় ইতিউতি।
- ভবানন্দ? বাবারে এক ভবানন্দ তো ফেলুদার গল্পে আছে। এখানেও ভবানন্দ? প্রাচীন মুদ্রা, উপকরণ? খুফিয়া খাজানা নাকি মা! খুল যা সিমসিম! চি-চি-ং ফাঁক! তারপর তারপর?
- ভ্যাট। খুফিয়া টুফিয়া কিছু না, এই ভবানন্দের কাহিনী আছে অন্নদামঙ্গলে।
- অন্নদামঙ্গলে আছে মানে? সেই ঈশ্বরীরে কহেন ঈশ্বরী... আর ঐ আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। সেই অন্নদামঙ্গল?
- একদম। সেই বইতেই। কেরী সাহেবের মুন্সী যে রামরাম বসু – ওঁর লেখা বই আছে – প্রতাপাদিত্য চরিত। গ্রন্থাগার ডট কমে পড়া যায়। সেখানেও এইসব কাহিনী আছে।
- তুমি পড়েছ?
- না পড়লে জানলাম কী করে। ওখানে লেখক লিখেছেন, তিনি প্রতাপাদিত্যের বংশধর। তাই অনেক ঘটনাই পারিবারিক শ্রুতি থেকে লিখেছেন। ভট্ট বংশের ভবানন্দের সহযোগিতায় মোগলেরা ভুঁইয়া প্রতাপাদিত্যকে পরাস্ত করে।
- তাই নাকি? বারো ভুঁইয়ার এক – সেই প্রতাপাদিত্য? কিন্তু এর সঙ্গে পরিমল গাঙ্গুলীর কী সম্পর্ক?
- সম্পর্ক আছে। ভবানন্দের বংশধর কৃষ্ণনগরের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। ঐ বাণপুরে কৃষ্ণনগরের রাজাদের ভদ্রাসন, বাগান, পুকুর সব ছিল। কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তর পুরুষ ক্ষৌণিশ রায়ের সময়কালে বাণপুরের এই মন্দিরে রাজপুরোহিত ছিলেন পঞ্চানন ভট্টাচার্য। তিনি হলেন পরিমল গাঙ্গুলীর দাদু।
- ক্ষৌণিশ রায় কে?
- রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে ধরে তাঁর সাত প্রজন্ম পরের রাজা ছিলেন ক্ষৌণিশ রায়। কৃষ্ণচন্দ্র, শিবচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র, গিরিশচন্দ্র, সতীশচন্দ্র, ক্ষিতীশচন্দ্র, তার পরবর্তী রাজা হলেন ক্ষৌণিশচন্দ্র রায়। এঁর কথাই বলছি।
- বুঝলাম, আর ঠাকুরের ব্যাপারটা?
- পঞ্চানন ছিলেন পণ্ডিত মানুষ। রাজপরিবারও তাঁকে সম্মান করত। ক্ষৌণিশ রায়ের ছেলে সৌরীশ রায়ের বিয়ের নিমন্ত্রণ রাখতে যখন তিনি কৃষ্ণনগর যান, তখন রানী জ্যোতির্ময়ী দেবী নিজে অন্দরমহলে আলাদা রান্না করে ওঁকে খাইয়েছিলেন।
- এসব কথা তুমি কী করে জানলে? বিয়েবাড়িতে আলাদা করে খেতে হবে কেন?
- গাঙ্গুলীদাই গল্প করেছেন। রানী আলাদা খাবার ব্যবস্থা করেছিলেন, কারণ সে যুগে ব্রাহ্মণদের আহারবিহারে অনেক বিধিনিষেধ ছিল। বিয়েবাড়িতে বিশাল ভোজের আয়োজনে সব ধরণের মানুষ যুক্ত। জাতপাতের বিধিনিষেধের কারণে যত ভাল খাবারই হোক, পূজারী ব্রাহ্মণেরা গ্রহণ করতে পারতেন না।
- সমস্যাটা কী?
- এখনকার ভাষায় বর্ণবৈষম্য বলতে পারিস। অন্য জাতির মানুষের স্পর্শ লাগা আহার গ্রহণ করার বিষয়ে শাস্ত্রীয় নিষেধাজ্ঞা। সেইজন্য হয় স্বপাক আহার বা উপবাস। কৃষ্ণনগরের রাজারা তো ব্রাহ্মণ বংশের। তাই রানী নিজে রান্না করে খাইয়েছিলেন, যাতে অন্য জাতের ছোঁয়া না লাগে।
- বাব্বা! খুব মুশকিল তো ব্রাহ্মণদের। তারপর? রাজার বিয়েতে কী কী খাওয়ানো হয়েছিল?
- হা হা হা হা। তা অনেক কিছু। ফেসবুকে ভোজ আড্ডা নামের একটা গ্রুপে সৌরীশ রায়ের আশীর্বাদের দিন ১৩৮ রকম পদ রান্না হয়েছিল তার তালিকা দেখেছি, তোদের আগে আমি বলেছিলাম, মনে করে দেখ – যে সৌরীশ রায়ের বিয়ের সঙ্গে বক্সি বাড়ির একটা যোগাযোগ আছে।
- হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, বলেছিলে বটে। ১৩৮টা পদ? কোন মানুষ খেতে পারে? সালটা কত?
- ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ১৪ই অঘ্রাণ। মানে আমাদের স্বাধীনতার বছর ১৯৪৭ সাল।
- পদগুলো বল কয়েকটা।
- সাদা ভাত ছাড়া ছয় রকমের পোলাও। বারো রকমের মাছের আর পাঁচ রকমের মাংসের পদ। আমিষ, নিরামিষ দু’রকম ডাল, ছরকমের নিরামিষ ভাজা, সতেরো রকম তরকারি, পাঁচ রকম চাটনি, আট রকম আচার, পাঁচ রকম পায়েস, তেইশরকমের ফল, ছ’রকম মোরব্বা, বত্রিশ রকম মিষ্টি, সঙ্গে অনেক রকম সরবৎ, চা, পান আর হজমি।
- বাপরে বাপ!
- ঐ বিয়ে বাড়িতে পঞ্চাননের সঙ্গে রাজবংশের নায়েব মন্মথনাথ দত্তের খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। মন্মথনাথ বয়সকালে কৃষ্ণনগর ছেড়ে নবদ্বীপে পৈতৃক ভিটেতে ফিরে যান। তবে কৃষ্ণনগর ছাড়ার সময়ে সুহৃদ এবং আস্থাভাজন পঞ্চাননকে ডেকে, তাঁর হাতে নিজের গৃহদেবতাদের অর্পণ করেন এবং পঞ্চাননও বন্ধুত্বের মান রেখে সেই বিগ্রহদের ভার নেন। কালক্রমে পঞ্চাননের ভান্ডারের সেই বিগ্রহদের এক মূর্তি আমাদের বাড়িতে এলেন।
- বুঝলাম। ঈশ্বরের কৃপাতেই এই অদ্ভুত যোগাযোগ, তাই না মা?
- হুম, সেটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই।
- এবার পঞ্চাননের সঙ্গে পরিমল জেঠুর সম্পর্কটা বল, কীরকম দাদু?
- আগে বললাম তো, নিজের দাদু রে, মায়ের বাবা। পঞ্চাননের চার সন্তান। তিন মেয়ে, এক ছেলে। বড়মেয়ে রেণুকাবালার বিয়ে হয় অমৃতলাল গাঙ্গুলীর সঙ্গে। অমৃতলাল-রেণুকাবালার সন্তান হলেন পরিমল কুমার। পঞ্চাননের আর এক কন্যা আরতি মুখোপাধ্যায়। তিনিই এখনও বাণপুরের ঐ মন্দির দেখাশোনা করেন।
- আচ্ছা মা, এই ঠাকুর আসার ঘটনা তোমার বিয়ের আগে না পরে?
- বিয়ের পরে। তখন আমরা অলরেডি লোন করে ফ্ল্যাট বুক করে ফেলেছি। আর আমাদের গৃহপ্রবেশে নারায়ণ শিলা পুজো নিয়ে, তবে বসত ভিটেতে এসেছেন।
- মা, তোমার মামার বাড়ির বংশে সতীমার বাপের বাড়ির যোগাযোগ কৃষ্ণনগরের সঙ্গে ছিল না?
- তেমন শুনেছি পারিবারিক শ্রুতিতে।
- ভাবতে অবাক লাগে, শ্বশুরবাড়িতেও কৃষ্ণনগর ঢুকে পড়ল। গতকাল আমরা ছিলাম আন্দুল আর কলকাতার দত্ত বংশে, আজ এলাম কৃষ্ণনগরে। ওখানে এইসব রাজাটাজা ছাড়া কী কী আছে?
- এই যা বললি, বললি। আর কারোর সামনে বলে ফেলিসনি যেন। এখন রাজবাড়ি আছে বটে, তালা দেওয়া থাকে। বংশধরেরা অনেকে কলকাতায় বা অন্যান্য জায়গায় থাকেন। স্বাধীন দেশে আর কোনো রাজা নেই। তোর কথা শুনে লোকে কী ভাববে, যে রঞ্জা ঘূর্ণির মাটির পুতুল জানেনা, অধরচন্দ্র দাসের সরপুরিয়া, সরভাজা জানে না।
- এ্যাঁ, ঘূর্ণি কৃষ্ণনগরে? জগদ্ধাত্রী পুজোর মেলায় সেই যে কিনলাম, মাটির সবজি বাজার, মাছের বাজার, কলসিতে কাক। দোকানদার বলল ঘূর্ণির পুতুল।
- হুম। সেই ঘূর্ণি।
- তুমি গেছ ওখানে?
- হ্যাঁ।
- অধর দাসের সরভাজা, সরপুরিয়া খেয়েছো?
- হ্যাঁ, দুটোই খেয়েছি।
- কোনটা না বল তো মা তোমার জীবনে? ভূগোলের দিদিমণি। খালি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছ। আর গল্প সংগ্রহ করে যাচ্ছ। ভাল লাইফ পেয়েছ একটা যা হোক। এখানে বা কলকাতায় সরভাজা, সরপুরিয়া পাওয়া যায় না? আমি খেতাম তবে।
- এখানে না, তবে কলকাতায় পাওয়া যায়। উত্তর কলকাতার বিখ্যাত দোকান নদীয়া সুইটস, আমার মায়ের হট ফেভারিট। সেখানে পাওয়া যায়।
- ও, তাহলে তো কলকাতাতেই খেয়ে নেব। কৃষ্ণনগর যেতে হবে না।
- আরে পাগলি, এক এক জায়গার এক এক স্পেশালিটি। অধর দাসের সরপুরিয়ার সোয়াদ কোনোদিনই অন্য দোকানে পাওয়া যাবে না।
- কেন পাওয়া যাবে না? একই তো মিষ্টি।
- না রে বাবু। কোনো জায়গার মিষ্টি সোয়াশ’ বছর ধরে জনপ্রিয় – এ কি কখনও এমনি এমনি হয়? আমরা তো সার্ভের কাজে গিয়েছিলাম। তখন এই দোকানের বিষয়ে অনেক কাহিনী শুনেছিলাম। এই দোকানটা উত্তম-সুচিত্রার সবার উপরে সিনেমাতেও আছে।
- তাহলে তো ঐতিহাসিক দোকান বলা যায়। মিষ্টিটা কেমন খেতে? কী দিয়ে তৈরি? কীভাবে বানানো হয়?
- নাম শুনে বুঝতে পারছিসনা? দুধের সর দিয়ে তৈরি। আর কেমন খেতে সে বলে বোঝানো যাবেনা। জিভে দিলে বেশ একটা আবেশ আসে। তারিয়ে তারিয়ে খেতে ইচ্ছে করে। আমার অবশ্য সরভাজার থেকে সরপুরিয়াটাই বেশি ভাল লেগেছিল। কীভাবে করে, সেটা দোকানের কারিগর ছাড়া কেউ জানেনা। ওসব মন্ত্রগুপ্তির ব্যাপার।
- কৃষ্ণনগরে ঐ একটা দোকানেই পাওয়া যায়?
- না না, অসংখ্য দোকানে পাওয়া যায়। সবাই বিখ্যাত সরপুরিয়া, সরভাজা বিক্রি করছে। তবে সেই সোয়াদ পাওয়া যায় না। আবার কৃষ্ণনগরে গিয়ে দেখি অদ্ভুত কাণ্ড। অধর দাসের নামেও দু’খানা দোকান। একটা ঝকমকে, একটা সাতপুরোনো।
- হে হে, কলকাতার লক্ষ্মীবাবুর মত। সবাই আসল। তা অধরদাসের কোন দোকানটা আসল?
- লক্ষ্মীবাবুর মত অতগুলো তো নয়। পরে হয়তো শরীকি ভাগ হয়ে আরও হবে। আমার এক কলীগের বাড়ি ওখানে। ওর কাছে যা শুনলাম, তাজ্জব ব্যাপার। ঝকমকে দোকানটাই আদি, সেটায় এক ভাই নানান আধুনিক সাজসজ্জা করেছে, আর পুরোনো দেখতে দোকানটা পরে আর একভাই করেছে।
- তার মানে পুরোনো দেখতেটাই নতুন। পুরোনো হল কীভাবে?
- ওটাই তো মজার। একই নামের এক ধরণের উত্তরাধিকার নিয়ে দোকান। তাই ঝকমকে ওল্ড গোল্ড দোকানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকার জন্য পরের দোকানটায় এমন পুরোনো লুক তৈরি করা হয়েছে। লোকজন ভাবে, এটাই আদি। তবে এসব শোনা কথা। দোকানে জিজ্ঞেস করে ভেরিফাই করিনি।
- কী বল তো মা, সাতসকালে পেটে দানাপানি পড়েনি, এসব শুনে খুব খেতে ইচ্ছে করছে।
- আন্দুলে রসে ফেলা সরভাজা পাওয়া যায়। নিয়ে আসব একদিন।
- ও তাই? সে তো খুব ভাল কথা। আন্দুলের মিষ্টি খুব ভাল খেতে।
- হ্যাঁ, আসলে রাজা জমিদারদের জায়গায়, তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় নানান কারিগরেরা এসে জড়ো হয়। তেমনভাবেই হয়তো আন্দুলের মিষ্টির কারিগরেরা এসেছিলেন। সেই উত্তরাধিকার থেকে গেছে। আন্দুলের মিষ্টির মান সত্যিই খুব ভাল।
- কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণচন্দ্র রায়, আন্দুলের রামচরণ রায় বা শোভাবাজারের নবকৃষ্ণদেব এঁদের পরিবারের কাজকর্ম অনেকটাই এক ধাঁচের, তাই না মা?
- হুম, তা বলতে পারিস। আমি যতটুকু পড়েছি, তাতে মনে হয়েছে যে হুসেন শাহের সময়টা বোসেরা মন্ত্রী, সচিব – এসব বড় বড় পদে ছিল। কিন্তু ভট্ট বংশের ভবানন্দের সাহায্যে ভুঁইয়া প্রতাপাদিত্যের পতন ঘটানোর পর থেকে, এখানে মুঘল আধিপত্য বাড়ল, আর আগের জমানার আস্থাভাজন ছিল বলে বোসেদের প্রতিপত্তি এই নতুন জমানায় কমে গেল। ভবানন্দ ভট্টাচার্য উপাধি পেয়ে হলেন মজুমদার। এঁরই বংশে পরের যুগে এলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। মুঘল জমানায় একদিকে এই ভবানন্দের বংশ আর অন্যদিকে এই দত্ত বংশের বোলবোলাও বাড়ল। আবার যখন ইংরেজ এসে সিরাজদৌল্লার পতন ঘটাল, তখন ইংরেজদের আস্থাভাজন বা সহযোগী পরিবারগুলোর ক্ষমতা বেড়ে গেল। এইভাবেই জমানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাশালী বৃত্তটাও বদলে যায়।
- বুঝলাম। টাকাপয়সা, ক্ষমতা আর সঙ্গে জাতপাত – এগুলোই আগেকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করত, তাই না মা?
- আগেকার দিন কেন, এখনও সেগুলোই নিয়ন্ত্রণ করে।
- দূর, এখন এসব বিয়েতে ভিন্ন আহার, জাতপাত আছে নাকি?
- বিয়েতে ভিন্ন আহার না হলেও, কিছু কিছু তো আছেই।
- না, আমি মানি না।
- খুব ভাল কথা, তাহলে তোদের বাড়ি দুর্গাঠাকুরকে ভাত না দিয়ে চিঁড়ে খেতে দিস কেন?
- সে তো বৈষ্ণবমতে পুজো হয় তাই।
- বৈষ্ণবরা নিরামিষ ভোগ দিতে পারে, ভাত দেবে না কেন? আমাদের আড়বেলের সতীমা বৈষ্ণব ধারার হলেও মাছে ভাতে ভোগ খান। গোপীনাথ নিজে দুর্গাপুজোয় ভাত খান। তাহলে? এ প্রথার অন্য কারণ আছে, যেটা তুই জানিস না। সমাজপতিদের বিধান – বামুন হলে তবেই মাকে অন্নভোগ দিতে পারবে। তোরা কায়েত, বামুন নোস, তাই মাকে কষ্ট করতে হয়। তোদের বাড়ি সেই হাজার বছরের পুরোনো প্রথা মেনে চলেছে স্বেচ্ছায়। তাহলে এ বাড়িতেও তো জাতপাত মানা হচ্ছে।
- সে কী? একথা তো ঘুণাক্ষরেও জানতাম না। এটা বন্ধ করা যায় না মা?
- বলেছিলাম তোর বাবাকে অনেক বার, সে প্রথা ঐতিহ্যের দোহাই দেয়। শুধু এবাড়ি বলে তো নয়, শোভাবাজার রাজবাড়ি, হাটখোলা দত্ত বাড়ি, আরও যত বনেদী কায়েতবাড়ি আছে কোথাওই অন্নভোগ হয় না। গোপীনাথের অন্নভোগ হয় বলে পুজোর ক’দিন ভাত খেতে পাস। মা দুর্গা চার চারটে দিন চিঁড়ে আর ময়দা খেয়ে থাকেন।
তোদের অবামুনের পুজো,
কেবল চিঁড়ে মোয়ার ভুজো।
ভাজা ভুজোয় না মেটে আশ,
নাই ভোগে দুটো ভাতের বাস।
সাত ব্যান্নন নাড়ু পিঠে,
আটকে গেল জাতের গিঁটে।
যতই দেব সাজিয়ে থালা,
মনে খচখচ কাঁটার জ্বালা।
(তোদের) নিজের পাতায় গোপীর ভাত,
মায়ের বেলায় শূন্য হাত।
- মা, তুমি আমায় পুরো ফালাফালা করে দিলে। কথাগুলো যেন ছুরি।
- সত্যি কথায় যে বড় ধার থাকে বাবু। কান দিয়ে বিঁধে যায়। তবে একটা কথা শুনে রাখ, আমি চাই, তোদের হাতে যেদিন পুজো পরিচালনার ভার আসবে, সেদিন তোরা এই জাতপাতের প্রথা ভেঙে মা দুর্গাকে ভাত খেতে দিবি, আর কষ্ট দিবি না।