ভোরের গায়ে একটু একটু জমতে শুরু করেছে হিম। ধান-কাটা ন্যাড়া মাঠে একটু একটু করে ভাসতে শুরু করেছে নিহার। আর টুপ করে হারিয়ে যাওয়া বিকেলের দুয়ারে আলটপকা উড়ে আসতে শুরু করে উত্তরে হাওয়া। সে হাওয়াই আমাকে ওম এনে দেয় ঠাকুমার সেই নস্যি রঙের চাদর। চাদরের অছিলায় আমি বারবার ঠাকুমার আদরের ওম নেই।
ও দিদি, চাদরটুকু জড়িয়ে নাও…
কিংবা
ও দিদি, জার মাথায় পড়লে ঠান্ডা লাগবে তো…
ঠাকুমার শরীরের শীর্ণ ভাব এখনো সেভাবে যায়নি। হুটহাট জ্বরও আসাও বন্ধ হয়নি। তাই আমাদের আপাতত শহরে ফেরা স্থগিত। শুধু বাবা ফিরে গেছে। আমার স্কুল বাদ পড়লেও বাবার অফিস তো বাদ দেওয়া যাবে না। এজন্য বাবা প্রতি সপ্তাহের শেষে বাড়ি আসে। এসেই করে আমার পড়াশোনার খোঁজখবর। এমনিতেই ফাঁকিবাজ, তার ওপর স্কুলের কড়াকড়ি নেই—তাহলে কেন পড়বো আমি? তাই আমার না পড়ার অজুহাত মেটানোর দায়িত্ব পড়লো কোহিনূর ফুফুর উপর। প্রতিদিন সকালে বাইরবাড়ির বারান্দায় পড়াশোনার পাট ঠিকঠাক না চুকালে আমার সঙ্গে সুমি, শুক্লার খেলা বারণ।
এটা হয় নাকি? শহরে তো আমি খেলার কাউকে পাই না। তাই বাড়ি এসেও যদি সাধ মিটিয়ে না খেলি—তাহলে কি আমার ভালো লাগবে? বলতে গেলে, শুধু ওদের সঙ্গে খেলার লোভে আমি কোহিনূর ফুফুর দেওয়া সব পড়া ঠিকঠাক করে ফেলি। তবে সবসময় যে এমন হয় তা নয়। এই তো কাল সন্ধ্যায় মামী-ঠাকুমা এসেছিলো। সন্ধ্যার চা-মুড়ির আড্ডা শেষ হয়েছিলো রাতের কালোজিরা বাটা মাছের ঝোলে। সেই আড্ডা ফাঁকি দিয়ে কি পড়াশোনা করা যায়?
তাই আজ আমাকে কাঁথার ওম ফেলে বিছানা ছাড়তে হয়েছে পূর্ণির মা ফটক ঠেলে বাড়ির উঠোনে আসার খানিক পরেই। বাসি উঠোনে ছড়া পড়ার পর আকাশের আলো আসতেই এ বাড়ির সবার দিন শুরু হয়ে যায়। তবে ঠাকুমার সকালে ওঠা বারণ। তাই আমাদের বাড়ির নিত্যপূজা সাজি ফুলে ভরার দায়িত্ব নিয়েছে জেঠি ঠাকুমা। প্রতিদিন সকালে কীর্তন গাইতে গাইতে জেঠি ঠাকুমা ফুলে সাজি ভরে। আজও তার ব্যত্যয় হয়নি,
সব সঙ্গিনী ঘিরি বৈঠলি
গাওত হরি-নামে
যৈখনে শুনে তৈখনে উঠে
নবরাগিণী গানে…
এই সুরেই ঘুম ভেঙে গেলো আমার। কাঠের ঘরের ফাঁক ফোকর পেরিয়ে আসা আবছা আলোয় ঠাকুমার মুখটা খুব উজ্জ্বল লাগছে আজ। ঘুমন্ত ঠাকুমার পাশ থেকে উঠে পড়তে হবে আমায়। আমি কাঁথার ওম ভুলে আরেকটু সরা আসি ঠাকুমার কোলের কাছে। ব্যস্, ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম ঠাকুমার। হাত বাড়িয়ে ঠাকুমা আমাকে ওমে জড়ায়,
ও দিদি, উঠি চলো…
তা বললে হয় নাকি? ঠাকুমার এখন ওঠা হবে না। দাদুর কড়া আদেশ,
অনিয়ম করলে শরীর কীভাবে ভালো হবে…
তাই ঠাকুমার গায়ে কাঁথা ভালো করে টেনে দিয়ে আমি বিছানা ছাড়লাম। মনিপিসিও উঠে গেছে। সকালে স্নান সেরে নিত্যপূজা যে এখন মনিপিসিকেই দিতে হয়। এরপর লাল বারান্দায় কেরোসিনের স্টোভে আঁচ জ্বালানোর কাজটাও মনিপিসির। তাতে চায়ের জল ফোটে। আর রান্নাঘরের উনুনে সকালের পাট সামলায় মা আর বৌমারা। সেখানে কোনোদিন ঘি-ভাত হয় আবার কোনোদিন লাল গমের রুটি। তবে ঠাকুমার জন্য প্রতিদিন সকালে সে সবের সাথে যুক্ত হয় মাঠা দেওয়া কাঁসার বড় গ্লাস ভরা ঘোল। সে ঘোল মাটির হাঁড়ির ভেতর লাল কাপড়ে ঢেকে প্রতিদিন আসে ঘোষবাড়ি থেকে। ঘোষ কাকার ডাক শোনা যায় সাহাপাড়া ছাড়িয়ে আমাদের পাড়ায় ঢোকার মুখ থেকেই,
ঘোল… ঘোল… মাঠা দেওয়া ঘোল…
এই ডাকে আমার পড়াশোনা লাটে ওঠে। আমি দাদুর কাছে উশখুশ শুরু করি,
ও দাদু, ঘোষ কাকা আসছে ঘটি লাগবে তো ঘোল নেবার…
আসলে ঠাকুমার নয়, ঘোলের প্রতি আমার আগ্রহই মূলত বেশি। সকালের কাঁচা রোদে পিঠ এলিয়ে জামবাটির মুড়িতে ঘোল ঢেলে খাওয়া আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আর তাতে ঠাকুমার সায়ে আমার তো আরও পোয়াবারো,
ও দিদি, মাঠাটুকু মুড়িতে মাখিও না, এমনিই খাও…
প্রায় প্রতিদিনই চুরি করে নিজের ভাগের মাঠা থেকে বেশিরভাগই ঠাকুমা আমাকে খাইয়ে দেয়। তবে মাঠাতে ভাগযোগ হলেও, লাল ডালিমদানায় কিন্তু কারো ভাগ নেই। দাদু নিয়ম করে ঠাকুমাকে সামনে বসিয়ে ডালিমদানা খাওয়ায়। আজ সকালেও এই নিয়মের অন্যথা হয়নি। আমি ঘোলে মুড়ি ভিজিয়ে বসেছি বাইরবাড়ির রোদে আর ঠাকুমা একটা দুটো ডালিম দানা মুখে তুলছে দাদুর বাধ্য ছাত্রীর মতো।
সকালের চা এর পালা শেষ হয়েছে। উনুনে উঠেছে কাদম্বিনী চালের ঘি-ভাত। সাথে নতুন আলু-বেগুন সেদ্ধ হবে। আর হবে মুগডালের বড়া। রাতে ভিজিয়ে রাখা মুগডালে আদা আর কাঁচামরিচ মিশিয়ে বেটে নিচ্ছে বড় বৌমা। তাতে কালোজিরা আর লবণ ছিটিয়ে ভেজে তুলবে মা। কড়কড়ে বড়ার ঘ্রাণে সকালের পাত পড়ার আগেই আমি গিয়ে হাত পাতবো লোভী-লোভী চোখ নিয়ে।
তবে লোভ জাগার আগেই চোখ পড়লো নীরব তাঁতঘরের সামনে। সাদাপাকা কদম ছাট চুলে, সাদা থান পড়ে একটু কুঁজো হয়ে আসছে মানুষটি,
ভাই… ও ভাই… ও বৌ…
পিসি ঠাকুমার ডাকে শুধু আমাদের বাড়ি নয়, পুরো পাড়াই জেগে ওঠে। পিসি ঠাকুমা লাঙ্গলবন্দে তীর্থে গিয়েছিলো। আর পোঁটলা ভরে পাড়ার কারো জন্য সিঁদুর, কারো জন্য পূজার বাসন, কারো জন্য পেতলের ঘট নিয়ে এসেছে। সেসব ভাগাভাগি শেষে আমাদের বাড়ির জন্য বের হলো পেতলের গৌর-নিতাই। ঠাকুরের আসনে তা প্রতিষ্ঠা করার আদেশও এলো পিসিঠাকুমার। আর সবশেষে বের হলো কালো সুতোয় বাঁধা একটা রুপার তাবিজ। সাহাপাড়ার মসজিদের হুজুরের দেওয়া এই তাবিজে নাকি ঠাকুমা পনেরো দিনেই সুস্থ হয়ে যাবে।
কালো সূতায় সেই তাবিজ ঠাকুমার ডানহাতে বেঁধে দিলো জেঠি ঠাকুমা। আর গোলেনূর দাদীর দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিতেই ঠাকুমার চোখের পাতা কি একটু কেঁপে উঠল?
তা দেখার সময় অবশ্য এখন নেই। পিসি ঠাকুমা আসা মানেই তো পানের বাটা নিয়ে দাদুর পাশে বসে দুনিয়ার গল্প করা। সেই গল্পের ভাগিদার তো আমাকেও হতে হবে,
ও পিসি ঠাকুমা, লাঙলবন্দ কি অনেকদূর? কীভাবে গেলে অতদূর?
আমার প্রশ্ন ফুরায়ই না। তবে পিসি ঠাকুমার তাতে আপত্তি নেই। গল্পে গল্পে নিজের আনন্দটুকু সবার মাঝে ছড়িয়ে এই মানুষটির কোনো কার্পণ্য নেই,
ওরে বাবা সে কত লম্বা পথ! তবে যাবার পথে কতকিছু দেখলাম! জীবন তো আমার ওই ঘরেই কাটলো তাই শেষ বয়সে একটু ঘুরেফিরে বেড়াই আর কি…
তা যতই ঘুরে বেড়াক পিসি ঠাকুমা, দিনশেষে কিন্তু সেই তাঁর এই ভাইয়ে এসে সব আটকে যায়,
ভাই জানিস সেখানে মন্দিরের দুয়ারে এক হিন্দু হোটেল ছিল। নিরামিষের এক নতুন পদ খেতে গিয়ে কতবার যে তোর কথা মনে হয়েছে….
এ আসলে আর কিছুই নয়, অনেকদিন পর ভাইকে নিজে হাতে কিছু রান্না করে খাওয়াতে চায় পিসি ঠাকুমা। তাই আগেরদিন মাঠে গিয়ে বেছে বেছে কচি পটল তুলে এনেছে পিসি ঠাকুমা। পিসি ঠাকুমার আদি শ্বশুরবাড়ি ছিল বাদলবাড়ি। করোতোয়ার জলে হারিয়ে গেছে সে বাড়ি। তবে কিছু মাঠের জমি এখনো আছে। সেই জমিতে পিসি ঠাকুমা বর্গা দিয়ে চাষ করে। সেখান থেকেই এসেছে আজ এই কচি পটল।
তা সেই পদে আর কী লাগবে?
কদম-ছাঁট চুলের পিসি ঠাকুমা আরেকটা পান সাজিয়ে দাদুর হাতে দেয়,
জানিস ভাই পটলের এমন টক আমি আগে কোনোদিন খাইনি। শেষ পাতে খাবার জন্য দিয়েছিলো আমপটল। আমি অবশ্য সব ভাত ওই দিয়েই খেয়েছিলাম…
পূর্ণির মা বাঁশের মাথায় লগি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলো উঠোনের বারোমাসি আম গাছের তলায়। সেখান থেকেই জোগাড় হবে টক তরকারির টক।
পিসি ঠাকুমা এ বাড়িতে এলে সারাক্ষণ বাইরবাড়ির বারান্দায় দাদুর সাথে বসে থাকতে দেখেছি এতদিন। কিন্তু আজ সেটারও ভাগাভাগি হলো ঠাকুমার সাথে,
ও বৌ, তেলের বোতলটা নিয়ে আয় মাথায় একটু দিয়ে দিই…
কিংবা
ও বৌ, গন্ধ ভাদালির পাতার বড়া খাবি আজ?
আসলে ঠাকুমার সাথে পিসি ঠাকুমার সম্পর্কটা খুব অদ্ভুত। মাঝখানে দাদুকে রেখেও এরা দু-জন পরম বন্ধু। তাই শুধু ভাইয়ের জন্য নতুন পদ নয়, পিসি ঠাকুমা আজ নিজে হাতে গন্ধ ভাদালির বড়াও বানাবে ঠাকুমার জন্য। নিজে গিয়ে গোলেনূর দাদীর পেছন বাড়ির জঙ্গল থেকে পেড়ে নিয়ে এলো পাতা।
সকালের পাত উঠে গেছে এরই মধ্যে। দুপুরের জন্য উনুনে আঁচ পড়বে আর একটু পরেই। তুলসীমালা চালের আতপ মটর ডালের সাথে ভিজিয়ে দিয়েছে বড় বৌমা। মিহি করে বাটা এই চালডালের সাথে লবণ, হলুদ আর গন্ধ ভাদালির পাতা মিশিয়ে বড়া বানানো হবে।
বড় ঘরের লাল বারান্দায় স্নান সেরে এসে বসলো ঠাকুমা। এই বারান্দায় কাঠের থামের সাথে টাঙানো রাশিয়ান গোল আয়না। ঠাকুমা সেই আয়নায় দেখে চিরুনি দিয়ে সিঁথি কাঁটে। তিব্বত স্নো আঙুলের ডগায় লাগিয়ে মুখে বিন্দু বিন্দু করে লাগায়। এরপর তা মুখে মিশিয়ে দিতেই আমার নাকে ধাক্কা দেয় ঠাকুমার সেই চির-চেনা ঘ্রাণ। এরপর ঠাকুমা চিরুনি দিয়েই সিঁথিতে সিঁদুর দেবে আর সবশেষে মধ্যমা আঙ্গুল সিঁদুরের কৌটায় ডুবিয়ে তা ছুঁইয়ে দেবে কপালের ঠিক মাঝখানে।
এমন সময়গুলোতে আমি একমনে ঠাকুমাকে দেখি। কপালের টিপ থেকে খানিক সিঁদুর ঠাকুমার নাকে গড়িয়ে পড়ে। এটা কখনই মোছে না ঠাকুমা। নাকে কপালে সিঁদুর পড়া ঠাকুমাকে আমার ঠিক মন্দিরের প্রতিমার মতো মনে হয়।
রান্নাঘরে উনুনে এখন উঠেছে মাসকলাই ডালের কড়াই। আদা বাটায় কলাগাছের থোড় দিয়ে রান্না হবে আজ ডাল। উনুনের ধোঁয়ায় এখন মিশে আছে ভাজা মাসকলাই ডালের ঘ্রাণ। সেই ধোঁয়া রান্নাঘর পেরিয়ে উঠোনের রোদে আসন গাড়ছে। আজকাল তাঁত-মাকুর খটাসখটাস শব্দের জায়গা দখল করেছে রিক্সার টুংটাং শব্দ, নয়তো মাইকে ভেসে আসা সিনেমার বিজ্ঞাপনের গান।
পিসি ঠাকুমা রান্নাঘরে ঢোকার আগে আরেকটা পান মুখে পুরে নিলো,
কাঁচা আমের ফালি করিস পূর্ণির মা, ডুমু না। তুই আবার যের’ম সের’ম করেই তরকারি বানিয়ে ফেলিস…
পূর্ণির মায়ের আধিপত্য এই পিসি ঠাকুমা এলেই একটু কমে, নতুবা সে ঠাকুমার প্রশ্রয়ে এই বাড়িকে সেই শুরুর দিন থেকেই নিজের বাড়ি বলেই ভাবে।
উনুন থেকে ডালের কড়াই নেমেছে। এখন বসেছে টকের কড়াই। সর্ষের তেল কড়াইতে দিয়েই খোঁজ পড়লো কালোজিরার। তবে এখনই ফোড়ন পড়বে না। সবার আগে বুক চেরা পটলগুলো লবণ হলুদ মাখিয়ে হালকা করে ভেজে নেওয়া হবে। তারপর সেই ভাজা তেলে শুকনো মরিচ আর কালোজিরা ফোড়ন পড়বে,
রাই সর্ষে ভিজিয়েছিস রিতা? লবণ আর কাঁচামরিচ দিয়ে এক পেষায় বাটতে হবে, না হলে তিতকুটে হয়ে যাবে…
ভেজে রাখা পটল থেকে দুটো পটল একটু কড়া করে ভেজে রাখা হচ্ছে ঠাকুমার জন্য,
বৌ প্রথম পাতে ভাতে ঘি মেখে পটল ভাজা দিয়ে খুব ভালো খায়…
পানের রসের লাল রঙ ঠাকুমার ঠোঁটে রাঙিয়ে দিচ্ছে। গা থেকে হাকিমপুরি জর্দার মিষ্টি ঘ্রাণ। রান্নাঘরের বারান্দায় বসে আছে ঠাকুমা। আমি তাঁর কোলের ভেতর হাত লুকিয়ে পিসি ঠাকুমার নতুন পদ রান্না দেখছি,
ও পিসি ঠাকুমা, আঁচ এত কম কেন উনুনের?
আখার জোর আঁচে কষালে সর্ষে বাটা তেতো হয়ে যায় রে বুনু…
কড়াইয়ের কালোজিরার ফোড়ন পড়া সর্ষে বাটা তেল ছাড়ছে একটু একটু করে। এবার তাতে পড়লো কাঁচা আমের ফালি। অল্প কষিয়ে তাতে একটু গরম জল দিয়ে দিলো পিসি ঠাকুমা আমের ফালিগুলো সেদ্ধ হবার জন্য। এবার পড়লো ঢাকনা।
উঠোনের রোদ বরই গাছের গা ডিঙিয়ে এসে পড়ছে রান্নাঘরের বারান্দায়। সেই রোদ চুঁইয়ে পড়ছে ঠাকুমার শরীর থেকেও। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম—পেছনে ঠাকুমার ছায়ার ভেতর মিশে গেছে আমার ছায়া। আমি একটু নড়েচড়ে উঠি। তাতে ছায়াটা নড়লো বটে, কিন্তু ঠাকুমার ছায়া থেকে বিছিন্ন হলো না।
কড়াইয়ের ঢাকনা উঠলো। নরম হয়ে এসেছে আমের ফালিগুলো। এবার তাতে পিসি ঠাকুমা ঢেলে দিলো ভেজে রাখা পটল। নেড়েচেড়ে মেশানোর পর আবার ঢাকা পড়লো কড়াইয়ে। এবার শেষ-জ্বলা খড়িটাও পিসি ঠাকুমা টেনে বের করে নিলো উনুন থেকে,
দম খাক আম-পটল, নামানোর আগে একটু চিনি ছিটিয়ে দিতে হবে।
দুপুরের পাত পড়েছে লাল বারান্দায়। দাদুর সব আহ্লাদি আহবান অস্বীকার করে বায়না ধরেছি ঠাকুমার সঙ্গে খাবার,
ও গিন্নি, তোমাকে পাতের ভাগ না দিলে তো আমার পেটই ভরবে না…
না ভরুক দাদুর পেট। আজ আমি শেষবেলায় ঠাকুমা আর পিসি ঠাকুমার সাথে খেতে বসবো। দাদুর পাত উঠে গেলেই একে একে পড়বে বড় কাকু, বাঘকাকু, মনিকাকুদের পাত। এরপর মা, বৌমা আর মনিপিসির পাতের ভাত ফুরাতেই ঠাকুমা আর পিসি ঠাকুমার পালা।
উঠোনের রোদে ততক্ষণে তেজ ফুরাবে। পেয়ারা গাছের ছায়ায় দুলুনি বাড়বে হঠাৎ উড়ে আসা উত্তুরে বাতাসে। বড়ঘরের চালে খসে পড়বে বরই গাছের একটা দুটো পাতা। সেই পাতা লাল বারান্দায় গড়িয়ে পড়ার আগেই পড়বে আমাদের পাত। পাত থেকে আম পটল আমার মুখে তুলে দিতে দিতে ঠাকুমা বলে উঠবে,
ও দিদি, খেয়ে দেখো—কত স্বাদ…
আর আমি সব ভুলে চোখ রাখবো ঠাকুমার মুখে। সেখানে যত তৃপ্তি তা এই নিজের ভাগটুকু আমাকে বিলিয়ে দেওয়ার।