রাতের আকাশে অন্ধকার ঠিকঠাক জেঁকে বসতে পারেনি আজ। সন্ধ্যা হতে না হতেই গোলেনূর দাদীর সুপারি বাগানের মাথায় জেগে উঠেছে চাঁদ। মধুপূর্ণিমার চাঁদ। এই পূর্ণিমায় আমাদের বাড়ির উঠোনে সন্ধ্যা হতেই পাঁচ প্রদীপ জ্বলে উঠে। তুলসী মঞ্চের তলায় আলোচাল পিটুলির আল্পনা পড়ে। সেই আল্পনায় সিঁদুরের ফোঁটা পড়তেই শঙ্খে পড়ে ফুঁ।
এই সন্ধ্যার প্রস্তুতি অবশ্য শুরু হয়েছে আজ দুপুরের পাত ওঠার সাথে সাথেই। দুপুরের পাত বারবেলার পড়তেই পড়ে গিয়েছিল আজ। নিরামিষ সে পাতে ছিল ছানার রসা, কাঁচা মুগের ডাল আম ফলসি দিয়ে, আলুর চাক ভাজা আর শুকনো বরইয়ের টক। উনুনের আঁচ নেভার আগেই ঠাকুমা চলে গিয়েছিল থানাঘাটে। সেখান থেকে স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে তুলে এনেছে কলমীলতা আর নাগচম্পা ফুল। মাদলা গ্রামের তালবাগান থেকে ক’খানা কালো তাল। সকালবেলা এক হাটুরের হাতে পাঠিয়ে দিয়েছে আইনুল চাচা। সাথে কতক পদ্মবীজও।
আজ সকালের মিঠে রোদ ডালিমগাছের মাথা ছুঁতেই কাঠের দোতলার পাটাতন খুলে গিয়েছিল। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ নেমে এসেছিল মনিপিসি ঝোলা গুড়ের হাঁড়ি আর কাদম্বিনি আলোচাল নিয়ে।
ও মনিপিসি, আলোচাল দিয়ে কী করবে?
আমার কথার উত্তর আসার আগেই মনিপিসিকে আবার সিঁড়ি বাইতে হয়েছিল দোতলার। তাল চাঁটুনি নামাতে। পেছন পেছন ঠাকুমাও উঠে গেল কাঠের দোঁতলায়। নামিয়ে আনল জাঁতা।
ততক্ষণে মিঠে রোদের গায়ে আঁচ লেগেছে। বাইরবাড়ি পেরিয়ে তাঁতমাকুর খটাস খটাস শব্দ ভেতরবাড়ির বাতাসে গুঞ্জরন তুলছে তখন। সকালের পাত উঠে যেতেই আমাদের বাড়িতে এক অদ্ভুত আলসেমি গেড়ে বসে। লালবারান্দায় ঠাকুমা চটের আসনে ফুল তুলতে বসে, মা আর বৌমারা হয় এ-ঘর ও-ঘরে বসে গল্প করে কিংবা বড়ঘরের মেঝেয় পুরোনো কাপড়ে কাঁথা পাতে। ও বাড়ির জেঠি ঠাকুমা, বড়মা, গোলেনূর দাদী বাইরবাড়ির বারান্দায় বসে যায় কার জমিতে কী ফসল উঠল তার হিসেব মেলাতে। আর দেবদারু বাগানের তলায় রঙের জলে ডুবে থাকা সুতো বাঁশের গায়ে আলগোছে পড়ে শুকোতে।
ও ঠাকুমা, আজ চটে ফুল তুলবে না? ও ঠাকুমা, তোমার সুতোর বাক্সখানা আনব?
বড়ঘরে নকশিখাটের তলায় ঠাকুমার একটা ছোটো কাঠের বাক্স আছে। সেই বাক্সের ডালা তুললেই হরেকরঙের সুতো আর উলের বল। চটের গায়ে সেই উলের বল খুলেই ঠাকুমা রঙিন ফুল তোলে। আজ অবশ্য সেই বাক্সের প্রতি ঠাকুমা কোনো আগ্রহ দেখাল না। তাই বাড়ির গায়ে আলসেমি লাগার আগেই ঠাকুমা লালবারান্দায় বসে গেল পাথরের জাঁতা নিয়ে।
লাল তিল ঘঁষে সাদা বানাতে। সেই সাদা তিলের ক্ষিরশা হলো যে আজ।
দুপুরের পাতে নিরামিষ পদ পড়বে বলে আজ বাজারের ব্যাগ উঠোনে পড়ে না। তবে হরিপদ ঘোষের বাড়ি থেকে দুধ এসেছিল। সেই দুধে ফিটকিরি মিশিয়ে করা হয়েছিল ছানা। সেই ছানার রসা শুধু যে এ বাড়ির দুপুরের পাতে পড়েছিল তা নয়, কাঁসার জামবাটি ভরা খানিক রসা গিয়েছিল পিসি ঠাকুমার বাড়িও। পিসি ঠাকুমারও আজ ছিল নিরামিষের পালা।
আজ দাদু স্কুল থেকে টিফিনে আসার সময় হাট হয়ে এসেছিল। হাতে কাগজের ঠোঙায় বাঁধা গুড়ের কদমা আর তালমিছরি।
পূর্ণির মা আজ আর দুপুরে বাড়ি যায়নি। দুপুরের রোদে একটু টান পড়তেই উঠোন ঝাড়ু দিয়ে লেপেমুছে নিল। এরপর স্নান সেরে তাল চাঁটুনি নিয়ে বসে গেল। কালো তালের খোসা ছাড়িয়ে এক একটা আঁটি ঘঁষে ছাড়িয়ে নিল ঘন রস।
ঠাকুমা ঘাট থেকে এসে উঠোনের খোলা উনুনে আঁচ দিল। আর এই উনুনে আঁচ পড়া মানেই এই বাড়িতে আজ উৎসব। খোলা উনুনের আঁচে তালের রসের ক্ষীর উঠতেই উঠোনে এসে দাঁড়াল পিসি ঠাকুমা,
ও বৌ, পেতলের খাবড়ি খান নামা। আমি তিলের ক্ষিরশা বসাই।
কদম ছাটের পিসি ঠাকুমা এ বাড়িতে এসে খুব অল্প সময়ই বসে থাকে। হয় দাদুর জন্য এটা ওটা রান্না করে, না হয় খানিক পর পর পান বানিয়ে দাদুর সামনে ধরে। আর এর সঙ্গে বাইরবাড়ি বারান্দায় বসে দাদুর সাথে এ গল্প সে গল্প তো আছেই।
তবে আজ দাদুর সাথে গল্প করার সুযোগ হয়নি পিসি ঠাকুমার। বাড়ির উঠোনে পা রেখেই বসে গিয়েছিল খোলা উনুনের পাড়ে। উনুন থেকে তালের ক্ষীর নামতেই পিসি ঠাকুমা বসে উনুনে তুলে দিয়েছিল তিলের ক্ষিরশা। পেতলের খাবড়িতে তিলের ক্ষিরশা ফুটিয়ে নামিয়ে উনুনে উঠিয়ে দিল তেলের কড়াই। ভেজে নিল গোল গোল তালের ফুলুরি।
আজ ঠাকুমার একটুও ফুরসত ছিল না আমার সাথে গল্প করার। তবে তাঁতঘরের ওদিকে যাবার আগে হাতের ইশারায় আমাকে ডেকে নিল,
ও দিদি, বাগানে যাবে?
ঠাকুমার পেছন ধরার অজুহাত খুঁজি আমি। আর এমন ডাক পেলে তো সব ভুলে ছুটে যাই,
ও ঠাকুমা, বাগানে যাবে? কী আনবে? ও ঠাকুমা, চাটাইয়ের ঝুড়িটা নেব? ও ঠাকুমা, আজ বাইরবাড়িতেও তালের কত ঘ্রাণ, দেখেছ?
সব কথায় হুঁ হাঁ করে ঠাকুমা তাঁতঘর পেরিয়ে বাগানে গিয়ে উঠল। পড়ে আসা বেলার ঢিমে রোদ তখন ঠাকুমার বাগানে। রোদের আঁচে মিইয়ে পড়া গাছের পাতায় অদ্ভুত নীরবতা। সেই নীরবতায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মাঝে মাঝে ডেকে উঠছিল ঘুঘু পাখি। আমি ঠাকুমার গা ঘেঁষে দাঁড়াই। কী ভেবে ঠাকুমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল,
ও দিদি, আর মায়া বাড়িও না, ক’দিন পরে তো শহরে ফিরে যাবে বাড়ি ফাঁকা করে।
ঠাকুমার কথাগুলোর হাহাকার কীভাবে যেন সেই নীরবতায় টুপ করে মিশে গেল।
আমাদের বাগানের এককোণে ছোট্ট পুকুর ঘেঁষে ক’খানা কলাগাছ। ঠাকুমা একটা কলাগাছ থেকে একটা বড় পাতা কেটে নিল,
দিদি, চল তাড়াতাড়ি—বেলা ডুবে এল তো।
আজ দাদুর বায়নায় পিসি ঠাকুমা প্রায় সারা বিকেল খোলা উনুনের পাশে বসেছিল। শেষবেলায় যেই উঠতে যাবে তখন এল ঠাকুমার বায়না,
ও দিদি, আমি সব গুছিয়ে দিই, তুমি ক’খানা পাতাপোড়া পিঠা বানিয়ে দাও।
উনুনে তখন আবার বসল পেতলের খাবড়ি। সেই খাবড়িতে অনেকখানি তালের রস। পিসি ঠাকুমা উনুনের ঢিমে আঁচে তালের রস খানিক সময় ফুটিয়ে নিল। সেই রস জুড়ানোর ফাঁকে ঠাকুমা কুরিয়ে দিল নারিকেল। এরপর বেটে রাখা কাদম্বিনি আতপ, ঝোলা গুড় আর কুরানো নারিকেল তালের রসে মিশিয়ে পিসি ঠাকুমা বানিয়ে নিল একটা মণ্ড।
রোদ সরে গিয়ে তখন উঠোন থেকে মুছে দিয়েছে পেয়ারা গাছের ছায়া।
ঠাকুমা তাড়াহুড়ো করে কলাগাছের বড় পাতাটার কয়েক টুকরো করে নিল। পিসি ঠাকুমা সেই পাতার টুকরো গুলোতে মণ্ড পুরে বানিয়ে নিল পুঁটুলি। উনুনের ঢিমে আঁচে এবার বসল লোহার তাওয়া। তাতে খুব যত্ন করে পুঁটুলিগুলো সাজিয়ে দিল পিসি ঠাকুমা।
বাড়ির উঠোনে তখন তালের মিঠে ঘ্রাণ। তাঁতমাকুর আওয়াজ থেমে গিয়েছে ততক্ষণে।
ঠাকুমা এরপর খোলা উনুনের পাশ ছেড়ে গিয়ে দাঁড়াল মাঝ উঠোনে। সেখানে বাটা চালের পিটুলিতে আল্পনা পড়েছে।
লোহার তাওয়াই সাজানো কলাপাতার পুটিলিগুলোর একপাশ পুড়ে উঠতেই পিসিঠাকুমা উল্টে দিয়েছিল পুঁটুলিগুলো। তখন আরেক পিঠ পোড়ার অপেক্ষা।
পেয়ারা গাছের মাথা থেকে রোদ ফুরিয়ে যেতেই গোলেনূর দাদীর সুপারি বাগানের মাথায় চাঁদটা উঁকি দিল। মধুপূর্ণিমার চাঁদ। আর ঠিক তখনি সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে ভেসে এল মাগরিবের আজান।
আজ আকাশের গায়ে অন্ধকার একটুও বসতে পারছে না। সুপারি বাগানের মাথায় বসে থাকা চাঁদটা এরইমধ্যে আরোও বড় হয়ে উঠেছে। সেই চাঁদের আলো সন্ধ্যা আকাশের গা থেকে ঠিকড়ে পড়ছে আমাদের উঠোনে। উঠোনে এবার পাঁচ প্রদীপ জ্বলে উঠল। কলার মাইজে একমুঠো ধান, একগোছা দূর্বা আর ক’খানা কড়ি রাখল ঠাকুমা। আর কলার খোলে পড়ল তালের ক্ষীর, তালের ফুলুরি, তিলের ক্ষিরশা আর পাতাপোড়া পিঠা।
মধুপূর্ণিমার চাঁদ সুপারি বাগানের মাথা থেকে এখন আলগোছে এসে বসেছে দেবদারু বাগানের মাথায়।
উঠোনের আল্পনায় তেল সিঁদুর পড়ল। পাঁচ প্রদীপের গোড়ায় পড়ল কলমীলতা আর নাগচম্পা ফুল। মা শঙ্খে ফুঁ দিল।
মধুপূর্ণিমার সব আলো এখন জড়ো হয়েছে উঠোনের পাঁচ প্রদীপে। আর উঠোনের বাতাসে তালের ঘ্রাণ। ঠাকুমা একমনে লক্ষ্মী পাঁচালী পড়ছে। আর দূর্বা হাতে সবাই শুনছে সেই ব্রতকথা।
আমি উসখুশ করে উঠতেই পিসি ঠাকুমা লাল বারান্দা থেকে আমাকে ডাক দেয়। হাতে ধরা একটা পাতাপোড়া আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
পিঠা সব নিবেদন করা হয়ে গেছে, এখন খেলে দোষ নেই।
আমি পাতাপোড়া পিঠে হাতে নিয়েই পুঁটুলি খুলে পিঠে মুখে পুরি। ওদিকে ঠাকুমা পড়ে চলেছে,
আম্র পল্লব, গোটা ফলে ঘট সাজিবে
বিবিধ পুস্প, বিল্বপত্র নৈবদ্য সকল
দিবে কলা, শর্করা আতপ তণ্ডুল…
পিসি ঠাকুমার মুখ ভরা পান। দাদু এসে বড়ঘরের চেয়ারে বসতেই পিসি ঠাকুমা মধুপূর্ণিমার আলো, উঠোনের পাঁচপ্রদীপ, পাঁচালী সব ভুলে ঘরে গিয়ে উঠল,
ও ভাই, পান খাবি একটা?
আমি লাল বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠি,
ও পিসি ঠাকুমা, ব্রতকথা শুনবে না?
বিধবাদের জইন্যি এই ব্রত না রে বুনু…
পিসি ঠাকুমার কথায় কি দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে? ভাবনাটুকু আসার আগেই দাদুর রেডিও থেকে ভেসে এল,
মূলাধার কুঠুরি নয়টা
তার উপরে চিলেকোঠা
তাহে এক পাগলা বেটা
বসে একা একেশ্বরে…