আগবেলার ভ্যাপসা গরম বারবেলা এসে আরও অসহ্য হয়ে ওঠে। চৌবাচ্চার ঠান্ডা জলে যতই গা ভেজানো হোক না কেন, খানিক পরেই ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে যায় শরীর। আর সারাদিনের তাপ শুষে রাখা মাটি কেন যেন সূর্য ডুবতে না ডুবতেই সব তাপ ছড়িয়ে চারপাশ আরও গুমোট করে তোলে। জাম-জামরুলের নিশ্চল ছায়া সেই গুমোট ভাবকে আরও প্রকট করে তোলে।
আর ঠিক এই গুমোট সময়েই জামরুল গাছের মাথার কাছে একটু একটু করে জড়ো হতে থাকে মেঘ, জলভরা কালচে মেঘ। জাম-জামরুলের নিশ্চল ছায়াটা বাতাসে একটু কেঁপে উঠতে না উঠতেই ছায়া ভাসিয়ে নামে ঢল, শ্রাবণের ঢল।
“ও ঠাকুমা, কী বৃষ্টি হচ্ছে দেখেছ? এ বৃষ্টি ক’দিনে ফুরাবে কে জানে।”
আমার কথায় ঠাকুমা হেসে ওঠে, “আমার দিদি তো পাক্কা বুড়ি হয়ে গেছে শহরে এসে। তা বৃষ্টি হচ্ছে হোক না, শ্রাবণ মাসে যত বৃষ্টি হবে তত ভাল।”
ঠাকুমা তো জানে না – এই শহরে বৃষ্টি আসা মানেই বান ডাকা। এই তো সেবার ক’দিনের একটানা বৃষ্টিতে এই পাড়ার সব বাড়িতে হাঁটুজল জমে গিয়েছিল। আর শিল্পী আপাদের বাড়িতে তো প্রায় কোমর-জল। সে’সময় ওদের বানানো কলাগাছের ভেলায় যতই ঘুরে বেড়াই না কেন, জমে থাকা জলে বিপদও কম হয়নি। টাইমকলের জল আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সারা পাড়ার খাবার জলের যোগান বলতে ঐ মসজিদের মাঠে দাঁড়ানো টিউবওয়েলটাই ভরসা ছিল। স্কুল যাওয়া বন্ধ, জল সেঁচে জামাকাপড় ভিজিয়ে বাবার অফিসে যাওয়া, কেরোসিনের স্টোভে একবেলা কোনোরকম চালেডালে নামিয়ে নেওয়া — সে খুব বিশ্রী সময়।
শহরের বাসায় ঠাকুমা এসেছে, আর যদি এসেই জলবন্দি হয়ে যায় তাহলে হবে? তাই ঠাকুমার কথাটুকু কথা দিয়েই কাটি আমি,
“ও ঠাকুমা, এত বৃষ্টি হলে আমরা নদীর পাড়ে কখন যাব? কখন গৌর আঙিনায় পাঠ শুনতে যাব? আর ওই যে কালীবাড়ি, সেখানে হলুদ করবী ফুলের প্রকাণ্ড গাছটাই বা কীভাবে দেখাব?”
ঠাকুমার হাত পাখা এখানে নেই। তাই আঁচল নাড়িয়ে আমায় বাতাস করছে। সেই বাতাসের জোর কমে আসে হঠাৎই।
ঠাকুমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, “ও দিদি, শহরের সবকিছু কেমন চিনে ফেলেছ দেখেছ? শহর এখন তোমার খুব ভাল লাগে, তাই না দিদি?”
কীভাবে ঠাকুমাকে বলি – আমি যতই শহর চিনি না কেন, আমার গ্রাম কখনোই আমার অচেনা হবে না। শহরে সব আছে কিন্তু মইনুল চাচার গুড়ের নই নেই, মাদলা গ্রামের সর্ষে-ক্ষেত নেই, চেয়ারম্যান চাচার পুঁথিপাঠ নেই আর নেই আমার বাড়ি।
আমি ঠাকুমার কাছ ঘেঁষে বসি। তিব্বত স্নো’র ঘ্রাণ এসে নাকে ধাক্কা দেয়।
গলার স্বর নামিয়ে বলি, “ও ঠাকুমা, পুজোর ছুটি পর্যন্ত থাকবে তো? আমার সবাই ছুটিতে একসঙ্গে বাড়ি যাব।”
ঘেমে যাওয়া মুখখানা আঁচলে মুছল ঠাকুমা, “ও দিদি, পুজো আসতে তো মেলা দিন বাকি। আর এবার পুজোয় কাজও আছে অনেক। বাড়ির পুজো বলে কথা।”
হ্যাঁ, শঙ্কর জ্যাঠার মাঠের সেই মন্দিরটা আমাদের বাইরবাড়িতে উঠে এসেছে বেশ আগেই। দশখানা তাঁত বেঁচে দেওয়ায় তাঁতঘরটা আরও ছোট হয়ে গিয়েছে। দেবদারু বাগানের তলায় দাঁড়ানো মন্দিরটা এখন বেশ খোলামেলা জায়গা পেয়েছে। আর এই মন্দিরের পুজো যতই বারোয়ারি হোক না কেন, সব জোগাড়-যন্তর নিজে হাতে করে ঠাকুমা আসলে বাড়ির পুজোর আশ মেটায়।
বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই মুসা’র মা চলে এসেছে।
হাতে দু’খানা কচি তাল, “বড় আম্মা পাঠায় দিল, এই তালের শাঁস খুব মিঠা।”
বারান্দায় কঁচি তাল দু’টো রেখে পাতা পরিষ্কার করতে লেগে গেল মুসা’র মা।
আজ দুপুরে ঠাকুমাই চালেডালে রান্না করেছে। সাথে ছিল বেগুন ভাজা আর আলুর রসা।
বৃষ্টির তোড় কমেছে, কিন্তু আকাশ থেকে কালচে জলভরা মেঘ এখনো মুছে যায়নি। আর কিছু সময় যেতে না যেতেই সেই মেঘে আরেক পোঁচ কালো মেঘ জমল।
বেলাও ফুরিয়ে আসছে।
মা কেরোসিনের স্টোভ জ্বালাল। সন্ধ্যার চা করে রাতের জন্য রুটি তরকারি হবে। মুসা’র মা উঠোনের পাতা পরিষ্কার করে বড়দাদির কলঘরে চলে যায় গা ধুতে।
স্টোভের আঁচে চা ফুটছে। ঠাকুমার আনা গুঁড়ো চা আর দুধ। একটু পরে ঝোলা গুড় মিশিয়ে নামানো হবে।
ঠাকুমা সব নিয়ে এসেছে, হোক তা গুঁড়ো চা কিংবা আলোচাল। আর তিল, সর্ষে, রাইদানার কথা নাহয় বাদই দিলাম। এনেছে বাগানের ডাঁটা, মাঁচায় ঝোলা কুমড়ো, গাছের বারোমাসি আম আর জমিয়ে রাখা ঢ্যাঁপের মোয়া।
তাই এই শহরের বাসাটায় ক‘দিন হল কেমন বাড়ি বাড়ি ঘ্রাণ ছুটেছে। স্নান করে ঘরে এলে তিব্বত স্নো’র ঘ্রাণ, সকাল বা সন্ধ্যায় গুঁড়ো চায়ের ঘ্রাণ, ঘরের ভেতর হাকিমপুরী জর্দার ঘ্রাণ—-সবমিলিয়ে শহরের বাসাটা বাড়ি হয়ে উঠেছে।
আর আমিও বুঝে গেলাম বাড়ি বা শহরের বাসায় আসলে কোনো ভেদ নেই, শুধু ওই মানুষগুলো ছাড়া।
বৃষ্টি একদম থেমে গেছে। গুমোট ভাবটাও সাথে সাথে বেড়েছে।
গা ধুয়ে ধোয়া শাড়ি পরে বারান্দায় এসে বসল মুসা’র মা। কাপে সবার চা পড়লো। সাথে মুড়ি মাখানো। মনিপিসি মাখিয়েছে মুড়ি। মুসা’র মা’র মুড়ির বাটি আর চা এগিয়ে দিল মা।
“তালশাঁসগুলান কাটি দিব? খান ক’খান চাচি খুব মিঠা।”
ঠাকুমা মুখে হাসি ঝুলিয়ে মাথা দু’দিকে নাড়ায়, “আজ থাক, কাল সকালে এসে কেটে দিও।”
চায়ের পর্ব ফুরায় মুসা’র মা বেরিয়ে যেতেই। রাতের রুটি-তরকারি বানানো শেষ হতে না হতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এল। সাথে দুড়ুম দুড়ুম মেঘের ডাকও।
রাতের খাবার খেয়ে ঠাকুমার পেট জড়িয়ে শুক্লা, ইতু আর গোলেনূর দাদির নতুন পোষা হাঁসের গল্প শুনতে শুনতে চোখ লেগে এল। বাইরে তখন ঝমঝম বৃষ্টিতে একটা দু’টো করে খুলে পড়ছে জামপাতা।
ভাদুরে বৃষ্টির কাছে রাত জমা রেখে আমি তলিয়ে যাই ঘুমে।
আর ঘুম ভাঙল ঠাকুমার অষ্টোত্তর শতনাম শুনে,
“জয় জয় গোবিন্দ গোপাল গদাধর
কৃষ্ণচন্দ্র করো কৃপা…”
উঠোনের এখন আর অন্ধকার নেই। যেটুকু আলোর অভাব তা ওই আকাশজুড়ে উড়ে বেড়ানো মেঘের জন্য। ঠাকুমার এখানে ফুল তোলা নেই, নিত্যপূজা নেই – তবুও সূর্য ওঠার আগে উঠে বসে থাকে।
“ও ঠাকুমা, এত তাড়াতাড়ি উঠেছ কেন? উঠোনে কেমন জল জমে আছে দেখেছ?”
ঠাকুমা শতনাম শেষ করে কপালে হাত দু’হাত ঠেকায়, “ও দিদি, আজ ক’টা ফুল জোগাড় করতে হবে যে। নিয়ে যাবে আমাকে?”
ব্যস্, আমি লাফঝাঁপ দিয়ে উঠোনে নেমে পড়ি। ঠাকুমার হাত ধরে ফটক পেরিয়ে কালো কুচকুচে পিচের রাস্তায় উঠি।
“ও ঠাকুমা, ওই যে বাড়িগুলো দেখছ, ওটা বসাকপাড়া। কাঠটগর ফুলগাছ দেখেছি ও পাড়ায়। যাবে?”
আমি কতদিন পর ফুল তুলতে বেরিয়েছি। আমি হাঁটছি, আমি ছুটছি, আমি উড়ছি...
“ও ঠাকুমা, বসাকপাড়া পার হলেই চক্ষু হাসপাতাল। ওখানে পদ্মজবা গাছ আছে। যাবে?”
ছুটতে থাকা আমাকে ঠাকুমা হাত টেনে থামায়, “ও দিদি, শহরে এসে তুমি আরও চঞ্চল হয়েছ। এভাবে ছুটতে নেই দিদি, পড়ে গেলে ব্যথা পাবে।”
কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমি ছুটতে ছুটতে বসাকপাড়া পেরিয়ে চক্ষু হাসপাতালের বাউন্ডারির সামনে থামি, “আমাকে উঁচু করে ধরো ঠাকুমা, ওই যে কমলা রঙের পদ্মজবা।”
ফুলের সাজিবিহীন আমরা দু’হাত ভরে ফুল তুলি।
“ও ঠাকুমা, সামনেই নদী, যাবে?”
“না দিদি, আজ কাজ আছে ঘরে চল।”
ঠাকুমার কথামতো দু’হাত ভরে ফুল নিয়ে আমরা বাসায় ফিরি।
আজ ঠাকুমা আগবেলা উপোস থাকবে। বারবেলায় ঠাকুরের সামনে পুজো দিয়ে প্রসাদ নেবে।
“ও ঠাকুমা, এখানে তো ঠাকুরঘর নেই। তুমি কীভাবে পুজো দেবে?”
ঠাকুমা হাসে, “গোবিন্দ সব জায়গাছেই আছে দিদি।”
আজ সকালের খাবারে তিনকোনা পরোটা আর দুধ সেমাই হল। মনিপিসি খুব ভাল দুধ সেমাই রান্না করা শিখেছে।
সকালের পাত উঠে যেতেই ঠাকুমা স্নান সেরে কেরোসিনের স্টোভ ধুয়ে মুছে নিল।
“ও ঠাকুমা, এই স্টোভে ঠাকুরের প্রসাদ রান্না করবে?”
অবাক আমাকে আশ্বস্ত করে ঠাকুমা, “আগুনে দোষ নেই দিদি, আগুনে সবকিছু শুদ্ধ হয়…”
ঠাকুমার কথা ফুরোবার আগেই ঘোষদাদুর হাঁক, “দুধ নেন গো…”
আজ পোয়া তিনেক দুধ বেশি পড়ল দুধের হাড়িতে।
ঠাকুমা আর দেরি করল না। সকালে ভেজানো সাবুদানা পরিষ্কার জলে ধুয়ে নিল। মনিপিসি বাড়ি থেকে আনা একটা ঝুনো নারিকেল কোরাতে বসে গেছে।
মুসা’র মা ঠাকুমার কথা অনুযায়ী সকালে এসেই তালশাঁস কেটে দিয়েছে।
ঠাকুমা বাড়ি থেকে আনা খাবড়ি স্টোভের আঁচে বসাল। তাতে দুধ। দুধ ফুটে উঠতেই তাতে পড়লে জলে ভেজানো ফুলে ওঠা সাবুদানা। ঠাকুমা নাড়তে থাকে সেটা অনবরত।
“ও ঠাকুমা উথলে পড়ে যাবে তো…”
আমার কথায় কিনা জানি না, ঠাকুমা স্টোভের আঁচ কমিয়ে দেয়। কম আঁচে ফুটতে ফুটতে দুধসাবু ঘন হয়ে আসছে। সাবু সেদ্ধ হয়ে রঙ বদলে জলের মত হয়।
ঠাকুমা এবার মিছরি গুঁড়ো করে দিল। ঘন দুধে মিছরি গলে একটু পাতলা হল।
মনিপিসি কোরানো নারিকেল এগিয়ে দিল।
আকাশে কালচে মেঘ উড়ে গিয়ে এখন সাদাটে তুলো মেঘ এখন। তার ফাঁক দিয়ে একটু আধটু রোদ উঠোনে পড়ছে। সেই রোদে আগের দিনের আধা শুকনো কাপড় মেলে দেয় মা।
বাতাসে এখন ভেজা কাপড়ের সোঁদা গন্ধ।
সাবুধানার দুধে এবার পড়ল ছোট করে কেটে রাখা বড়দাদির গাছের কচি তালশাঁস। আবার অনবরত নাড়া পড়ে দুধ-সাবুতে।
তালশাঁসগুলো একটু জল ছেড়ে ছোট হয়ে আসতেই ঠাকুমা কোরানো নারিকেল ছড়িয়ে খাবড়ি নামিয়ে ফেলে।
তাঁলশাসের পায়েস পাথরের বাটিতে ঢেলে ঠাকুমা নিবেদন করে দেয়ালে ঝুলানো রাধাকৃষ্ণের ছবির সামনে। কমলা রঙের পদ্মজবা পড়ে সেখানে। ঠাকুমা দু’হাতে তালি দিয়ে গেয়ে ওঠে,
“হে কৃষ্ণ করুণা সিন্ধু দীনবন্ধু জগৎপথে। গোপেশ গোপীকা কান্ত রাধা কান্ত নমহস্তুতে…”
জাম গাছ থেকে বাবুই পাখিটার ডাক শুনতে আমি কান পাতি। উঠোন মেলে রাখা কাপড়গুলো থেকে বৃষ্টিমাখা রোদ একটু একটু করে শুষে নিচ্ছে সোঁদা গন্ধ। ঠাকুমার ধূপের ঘ্রাণ বাতাসে মিশে ছড়িয়ে পড়ছে পুরো বাসায়।
আমি নিষ্পলক তাকিয়ে আছি ঠাকুমার দিকে। চোখবন্ধ ঠাকুমার তিরতিরে নাকের ডগায় একটু একটু ঘাম জমছে। আমি ঠাকুমার আঁচল টেনে সেই ঘাম মুছে দিতেই ভাদুড়ি বাড়ির বাগান থেকে ঘুঘু পাখিটা ডেকে ওঠে,
“ক্রুরু ক্রু ক্রু… ক্রু ক্রুরু রু…”