বাড়ি থেকে শহরে ফিরতে এবারে আর স্টিমারের অপেক্ষা করতে হল না। নদীর বুকে এর মাঝেই দাঁড়িয়ে গেছে কংক্রিটের বড় বড় থামওয়ালা সেতু। সেই আমাদের প্রাচীন বটগাছের তলা থেকে বাসে উঠলেই হয়। এরপর নলকা ঘাটে বাস ছেড়ে স্টিমার, স্টিমার ছেড়ে আবার বাস – এসবের কোনো দরকার নেই আর। এতে নাকি সময়ও বাঁচে খুব।
তবে সময় যতই কম লাগুক না কেন, পথটা কেমন যেন অচেনা লাগছে আমার। সেই যে নদীতে জাল ফেলে বসে থাকা জেলেদের গান কানে এল না, স্রোতে ভেসে যাওয়া একটা দুটো কচুরিপানা সরিয়ে কারো টুপ করে ডুব দেওয়া দেখা হল না, বারবেলায় কলসি ভরে নদীর পাড় ধরে লাইন ধরে বৌ ঝি’দের হেঁটে যাওয়া দেখা হল না।
এখন নলকা সেতুতে বাস উঠতে না উঠতেই নদী ফুরিয়ে যায়।
কিছু একটা হারিয়ে ফেলার কষ্ট কেমন যেন আমাকে জেঁকে বসে।
মনি, ঘুম পাচ্ছে?
বাসের খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস আসছে। সে বাতাসে আস্তে আস্তে ফুরিয়ে যাচ্ছে কাঁচা রঙের ঘ্রাণ। যত এগুচ্ছি ততই পেছনে ফেলছি আমার বাড়ি।
আমি মাথা দু’পাশে নাড়াই। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ বাঁচিয়ে মা’র খুব কাছে গিয়ে বলি,
আবার কবে বাড়ি ফিরব মা?
উত্তরে মা আমাকে কাছে টেনে নেয়। বাসের জানালা একটু টেনে দিয়ে বলে,
পুজোর ছুটিতে।
শহরে পৌঁছানোর আগেই আমি দিন গুণতে বসি বাড়ি ফেরার।
শহরে আমাদের দু’কামরার বাড়িটাকে মা-বাবা বাসা বলে। হ্যাঁ তাই তো, চিলতে উঠোনের নিরিবিলি ছোট্ট এই বাড়িটা কীভাবে আমাদের বাড়ি হবে? বাইরবাড়ি নেই, দুপুরের ভাতঘুম ফাঁকি দিয়ে জেঠি ঠাকুমাদের আড্ডা নেই, আমার খেলার কোনো সঙ্গী নেই আর নেই কোনো হৈ-হুল্লোড়। তাঁতঘর থেকে তাঁতিদের গানের মত ভেসে আসা সুর দূরে থাক, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে একটু আধটু কারো কথার আওয়াজও পাওয়া যায় না।
আর তা যাবেই বা কী করে? এখানে সব বাড়িই প্রাচীর ঘেরা যে।
বিছিন্ন পাড়াটা সারাসময় কেমন যেন ঝিমিয়ে থাকে।
শুধু পাশের মসজিদটা থেকে ভেসে আসা আজানের শব্দে পুরো পাড়া একটু গমগম করে ওঠে – এই যা।
আজ দুপুরে আজানের পরপরই আমরা শহরে পৌঁছালাম। শহরের বাসস্ট্যান্ড থেকে আমলাপাড়া – রিক্সাতে সে বেশ দূরের পথ। কোর্টপাড়ার রাস্তা পেরিয়ে গোধূলি সিনেমা হলকে পেছনে ফেলে কড়ইতলার ভেতর দিয়ে কালীবাড়ি পেরোলে তবেই আমলাপাড়া।
একদম শহরের শেষপ্রান্তে, নদীঘেঁষা নিরিবিলি এই আমলাপাড়া।
আর এই আমলাপাড়ার তালুকদার বাড়ির পেছনের দিকটাই হল আমাদের বাসা। মূল বাড়ির বর্ধিত অংশ বলা যায় এটাকে। পেছনদিকে দুটো ইটের ঘর, এক চিলতে উঠোন আর প্রকাণ্ড দুটো জাম-জামরুল ছাওয়া কলঘর। জাম আর জামরুল গাছ দুটো ডালপালা মেলে একে অন্যকে এভাবে জড়িয়ে রেখেছে, যে পাতার ফাঁকফোকর গলে একফোঁটা রোদও কলঘরের চালে পড়ে না। তাই কলঘরের চৌবাচ্চার জল প্রচণ্ড গরমেও কেমন শীতল হয়ে থাকে।
বাসায় ফিরে ব্যাগপত্তর রেখেই মা আমার মাথায় খানিকটা সর্ষের তেল ঢেলে কলঘরে ঢুকল। সকালে টাইমকলের ধরে রাখা জলে চৌবাচ্চাটি এখনও টুইটম্বুর। সেখানে ঘটি ডুবিয়ে জল তুলে মা আমার গায়ে ঢালতেই গা শীনশীন করে উঠল। কসকো সাবানের ঘ্রাণে আমার গা থেকে কেমন মুছে যেতে লাগল বাড়ির ঘ্রাণ।
আমি চুল মুছতে মুছতে মাকে জিজ্ঞাসা করি, “পুজোর ছুটি আসতে আর কত দেরি মা?”
মা’র কি এখন দিন গোনার সময় আছে? স্নান সেরে কেরোসিনের স্টোভে আগুন দেবে মা। ভাত, আলুসেদ্ধ, ডিমভাজি আর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হরিপদ ঘোষের ঘি হবে দুপুরের খাবারে। তা খেয়েই সঞ্জীবকাকু বেরিয়ে যাবে দিনের শেষ বাস ধরতে।
তবে স্নান সেরে বারান্দায় স্টোভের সাদা সলতায় আগুন দিয়ে মা আমার দিকে একটা বাটি এগিয়ে দিল। ক’খানা খইয়ের বড়া। নাকে হঠাৎ ধাক্কা দিল বাড়ির ঘ্রাণ। কিছুক্ষণ আগে কলঘরে গা থেকে ধুয়ে আসা বাড়ির গন্ধ আমি আবার বুক ভরে নিই।
ঠাকুমা, মনিপিসি, দাদু, গোলেনূর দাদি – সবার জন্য বুকের মধ্যে কেমন করে ওঠে। আচ্ছা, বাড়ির উনুনে আজ কী উঠল? তাঁতঘরে আজ কোন তাঁতি গান ধরল? মনিপিসি কি কলেজ থেকে ফিরল এখন? ইতু, শুক্লা কি এখন দেবদারু বাগানের ভেতর খেলে বেড়াচ্ছে?
আনমনা আমি বিষম খেয়ে উঠি। জলের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে মা,
তোমার ঠাকুমা মনে হয় তোমার কথা ভাবছে, নাহলে এমন বিষম খাবে কেন?
মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় মা,
এখন খেলতে যাও, রান্না শেষ হতে আরেকটু সময় লাগবে।
কোথায় যাব আমি খেলতে? কাদের সাথেই বা খেলব?
খইয়ের বড়ার বাটিটা মেঝেতে রেখে আমি ঘরের ভেতর চলে আসি। এই বাসার কোনো বড় ঘর নেই। দু’খানা ঘরই একইরকম। একটা ঘরে শোওয়ার খাট, দু’খানা বেতের চেয়ার আর একটা স্টিলের আলমারি। অন্যঘরে বসার ক’খানা চেয়ার, একটা ছোট্ট টেবিল আর কাঠের একখানা শোকেস। এইঘরই বসার ঘর আবার আমার পড়ার ঘরও।
আমি বইখাতা নাড়তে থাকি।
কাল সকালে রহিম চাচার রিক্সায় চেপে আবার আমাকে স্কুলে যেতে হবে। আমলাপাড়ার এই বাসা থেকে স্কুল খুব কাছে নয় কিন্তু। সেই বাবার অফিস পেরিয়ে কালীবাড়ির সীমানায় দাঁড়ানো সে স্কুল ‘গৌরী আরবান প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
স্কুলঘরের জানালা দিয়ে কালীবাড়ির নাটমন্দিরের পুরোটা দেখা যায়। তবে নাটমন্দির নয়, ওখানে দাঁড়ানো হলুদ করবী ফুল গাছের প্রতিই আমার সবসময় মনোযোগ। লম্বাটে সবুজ পাতার গাছটি কেমন যেন গৌরমন্দিরের চূড়ায় নুয়ে থাকে। আর সুযোগ পেলেই টুপটাপ ঝরে পড়ে হলুদ ফুলগুলো খোলা নাটমন্দিরের মেঝে ভরে দেয়।
ফুলগুলোর রঙ বাড়ি যাবার আগে ঠিক কতটা হলুদ দেখেছিলাম ভাবতেই যাব – হঠাৎ বাইরে থেকে ভেসে এল,
মা, তোরা কখন ফিরলি?
তালুকদার চাচির শাশুড়ির গলা। সবগুলো সাদা চুল আর সাদা রঙের শাড়িতে প্রাণখোলা মানুষটিকে সবসময় কেমন আপন মনে হয়। তালুকদার বাড়ির কর্ত্রী তিনি। তাঁর বাড়িতেই ভাড়া থাকি আমরা। মানুষটিকে আপন মনে হবার আরেকটি কারণ হাকিমপুরী জর্দা। মানুষটি কাছে আসলেই আমার ঠাকুমার কথা মনে পড়ে।
তাই প্রথমদিন থেকেই মানুষটি আমার বড়দাদি। আমলাপাড়ার সবার কাছে মানুষটি হল বড় আম্মা।
নাতিন কই?
আমি বারান্দায় এসে দাঁড়াই। কেরোসিন স্টোভের নীলচে আঁচে মা এখন ডিম ভাজছে।
দেশে গিয়ে খুব ঘুরেছিস রোদে রোদে। মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে।
উত্তরহীন আমি ঠাকুমার গায়ের ঘ্রাণের লোভে বড়দাদির কাছে গিয়ে দাঁড়াই।
স্টোভ থেকে সর্ষের তেলে ভেনা ওঠা ভাজা ডিম মা কড়াইয়ের কয়েক টুকরো করে নিল। সঞ্জীব কাকুর হাতে বেশি সময় নেই। মা বারান্দায় নকশি-তোলা চটের আসন পেতে দিল।
ও নাতিন, মুখটা এমন হয়ে আছে কেন? এসে কিছু খেয়েছিস? তাড়াতাড়ি খেতে বস তো? মা, নাতিনের সামনে আগে ভাত দে – একদমে সব কথা বলে বড়দাদি।
ভাতে ঘি মিশিয়ে ভাজা ডিম ভেঙে মুখের কাছে নিতেই আবার বড় দাদির গলা,
তাড়াতাড়ি খেয়ে আমার বাড়ি আসিস নাতিন, তোর জন্য চালকুমড়ার মোরব্বা রেখে দিয়েছি।
আজ কেন যেন চালকুমড়োর মোরব্বাও আমার মন ভাল করতে পারল না। ফেলেছেড়ে ভাত খেতে খেতে আমার আত্মা পুড়তে থাকে বাড়ির জন্য।
বাড়ির জন্য যতই আমার মন খারাপ হোক না কেন, সেই পুজোর ছুটির আগে আমার তো আর বাড়ি ফেরা হবে না। তাই সঞ্জীবকাকু রিক্সাতে ওঠার আগে আমার হাত হাত বুলিয়ে দেয়,
ভালমত পড়াশুনা করিস মনি। ষান্মাসিক পরীক্ষায় ভাল করলে পুজোর সময় বাড়ি গিয়ে অনেকদিন থাকতে পারবি।
পুজো তো সেই আশ্বিনে, সবে তো বৈশাখ মাস। আমি কড়ে দিন গুনতে শুরু করতেই দিনের শেষ বাস ধরতে সঞ্জীব কাকুর রিক্সা বেরিয়ে গেল।
শহরের এই পাড়াটা এমনিতেই নিরিবিলি। আর বৈশাখ মাসের তেতে ওঠা বারবেলায় ভাতঘুমে পাড়াটা আরও চুপচাপ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে মসজিদের মাঠের খেজুর গাছ বাসা বাঁধা বাবুইপাখির ডাক ভেসে আসছে।
শোওয়ার ঘরের সিমেন্ট চটে যাওয়া মেঝেতে মা শীতলপাটি মেলেছে। তাতে ঠাকুমার ফুলতোলা দুটো সাদা কভারের বালিশ। মা’র পাশে শুতেই একটানা ঘুরে চলা সিলিং ফ্যানটার দিকে চোখ পড়লো। বড়ঘরের সিলিং ফ্যানের সেই ঘটাং ঘটাং আওয়াজটা এখানে নেই। সেদিকে তাকিয়ে কেমন আনমনা হয়ে যাই। ঠাকুমা কি এখন হাতপাখাটা হাতে ধরে আছে? দাদুর রেডিওটা কি এখন কুনকুন করে বেজে যাচ্ছে? আর মনিপিসি কী করছে? চটের আসনে ফুল তুলছে, নাকি কোহিনূর ফুফুর সাথে বাইরবাড়িতে গল্প করছে? শুক্লা, ইতু – ওরা কী করছে এখন?
সবার জন্য আমার মন কেমন করে বারবার। তাঁতমাকুর আওয়াজহীন এই পাড়া, চারপাশের নীরবতা আমাকে কেমন অস্হির করে তুলল। আমি উঠে পড়লাম। পাশে ক্লান্ত মা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি শব্দ বাঁচিয়ে শোওয়ার ঘরের দরজা খুলে বাইরে আসি।
এ বাসার বারান্দা বাড়ির মত লাল বারান্দা নয়। ছাইরঙের মেঝে, তাও আবার কোথাও কোথাও চলটা ওঠা। আমি তিনখানা সিঁড়ি পেরিয়ে উঠোনে নামলাম। জাম-জামরুলের ছায়ায় আগবেলা যাওবা একটু আধটু রোদ ছিল, এখন তা মোটেও নেই।
বড়দাদির বাড়ি আর আমাদের বাসার মাঝে শ্যাওলা ধরা একটা প্রাচীর। সেই প্রাচীরের পাশে গিয়ে কান পাতি। না, ও বাড়িও এখন নিস্তব্ধ। নিজেকে কেমন একলা মনে হতেই চোখ পড়ল একখণ্ড ভাঙা ইটের খোয়ার দিকে। আগপাছ না ভেবে তা হাতে নিয়ে প্রাচীরে ‘অ’ ‘আ’ লেখা শুরু করতেই স্কুলের ঊষাদি’র কথা মনে হল। হ্যাঁ, ঊষাদি তো এমন করেই স্কুলের বোর্ডে লেখে।
নিজেকে ঊষাদি ভেবে, পেছনে ছাত্রছাত্রী কল্পনা করে আমি পড়াতে শুরু করলাম। হঠাৎ বড়দাদির গলা,
ও নাতিন, মাস্টার হইছিস, তাই না। তা ছাত্র তো নাই। আমার বাড়ি আয় আমারে একটু ‘অ’ ‘আ’ শিখিয়ে দিবি।
আমি লজ্জা পেয়ে হাতের ভাঙা ইট ফেলে দিলাম। হাতের মাটি জামাতে মুছে বড়দাদির পেছন পেছন ও বাড়িতে ঢুকলাম।
বড়দাদিদের বাড়িটা অনেক বড়। সার সারি অনেকগুলো ঘর। এ বাড়ির উঠোনও পাকা। পাকা উঠোনের এক কোণায় ছাদঘরে যাবার সিঁড়ি। আর সেই ছাদঘরের কার্নিশে পায়রার ঘর বাঁধা। দেশি-বিদেশি কত রকমের পায়রা যে সেখানে আছে। এ বাড়িতে আমি সবসময় আসি সেই পায়রা দেখার লোভে।
তবে আজ তা হল না।
বড়দাদি রান্নাঘরের সামনে বেতের মোড়াতে আমাকে বসিয়ে চিনেমাটির একটা বাটি ধরিয়ে দিল। তাতে চালকুমড়োর মোরব্বা আর সেমাইয়ের বরফি,
খেয়ে নে নাতিন, ঈদের দিন তোর কথা খুব মনে হচ্ছিল।
আমি মোরব্বা ভেঙে মুখে দিতেই এ বাড়ির বড় ফটকের ছোট দরজাটা খুলে গেল। অমল ঘোষ ঢুকছে। এ বাড়ির বাঁধা ঘোষ। আর শহরে আসার পর বড়দাদি আমাদের জন্যও তাকে ঠিক করে দিয়েছে। আমাদের জন্য তিনপোয়া দুধ বড়দাদির কাছেই রেখে যায় অমল ঘোষ। তবে আজ শুধু দুধ নয়, লাল কাপড়ে বেঁধে অনেকটা ছানাও নিয়ে এসেছে,
ও ঘোষদাদু, ছানা কি মিষ্টির দোকানের জন্য এনেছ?
লাল কাপড় চুঁইয়ে তখনও ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ছে ছানার জল। সেদিক সামলাতে সামলাতে ঘোষদাদু মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে না বলল। ঘোষদাদু খুব কম কথা বলে। অমিশুক এই মানুষটি কিন্তু এই পাড়ার সবার খুব প্রিয়। কার বাড়িতে কবে মাসের ঘি লাগবে, কার বাড়ির নারায়ণ পুজোয় কাঁচা দুধ লাগবে, কার বাড়িতে নিত্যদিন টক দই লাগবে – সব ঘোষদাদু নিজে মনে করে দিয়ে আসে। আর মোড়ের ছানামিষ্টির দোকানে প্রতিদিন বিকেলে লাল কাপড়ে বেঁধে ছানা পৌঁছে দেওয়া তো ঘোষদাদুর বাঁধা কাজ।
ঘোষদাদুর হাত থেকে ছানার পুটুলিটা বড়দাদি নিল,
একটু ছানার পায়েস করবো।
সারাদিন রান্নাঘরমুখো না হলেও বড়দাদি সুযোগ পেলেই শখের রান্না করেন।
বড়দাদির রান্নাঘরের উনুনে আঁচ দিল মুসা’র মা। এ বাড়িতে মুসা’র মা সেই সকালে আসে আর রাতের খাবার নিয়ে বাড়িতে ফেরে।
উনুনে পেতলের কড়াই উঠল। তাতে ঘোষদাদুর দেওয়া রোজের বাড়তি দুধ। কয়েকটা সাদা এলাচ ফেলে দিল তাতে বড়দাদি। বেশ অনেকক্ষণ নাড়াচাড়ার সাদা দুধ ঘন হয়ে ঘিয়ে রঙ হয়ে এল। এবার বড়দাদি অনেকটা চিনির সিরা মিশিয়ে দিল তাতে। ঘন দুধে বলক এল আবার খানিক সময় পর। লাল পুটুলির ছানা হাত দিয়ে চিপে সব ঝড়িয়ে নিল মুসা’র মা। ঝরঝরে ছানা বড় একটা স্টিলের থালে ঢেলে দিল। হাতের তালুদিয়ে সেই ছানা বেশ ভাল করে ময়ান দিতে দিতে বড়দাদি বলল,
এই ময়ান ভাল না হলে ছানার পায়েস দাঁড়ায় না।
এবার ময়ান দেয়া ছানা ঘন মিষ্টি দুধে ফেলে নাড়তে লাগল বড় দাদি।
বড় দাদির উঠোন থেকে দিনের শেষ রোদটুকু বিদায় নিয়েছে বেশ আগেই। তবে পাকা উঠোন তেতে এখনো গরম ছড়াচ্ছে।ছাদঘরের মাথায় কার্ণিশে একে একে ফিরছে সব পায়রা। গুটুরগুটুর শব্দে বাড়িটা কেমন গমগম করছে।
উনুনের তাপে বড়দাদির ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে উঠেছে। ছানার পায়েস দরায়ে আসতেই অল্প একটু গোলাপজল পড়ল তাতে।
আর দেরি করল না বড়দাদি, উনুন থেকে নামিয়ে নিল ছানার পায়েস।
এই পায়েস সারারাত জুড়াবে। কাল সকালে ঠান্ডা ছানার পায়েস আর ডালডায় ভাজা পরোটা সকালের খাবারে এ বাড়ির সবার পাতে পড়বে।
ছাদঘরের মাথায় আলগোছে পড়ে থাকা রোদটুকুও ফুরিয়ে গেল। মসজিদের মাইক থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। মা ভাতঘুম শেষ করে উঠে পড়েছে আগেই। বিকেলে গা ধুয়ে সিঁদুর পরে নিয়েছে,
মনি আস, সন্ধ্যা লেগে গেছে।
বড়দাদি ওযু করতে কলঘরে চলে গেল। আমি মা’র পেছন পেছন বাসায় এলাম। এ বাসায় তুলসীমঞ্চ নেই। মা ধূপদানিতে ধূপ নিয়ে সারা উঠোন ঘোরে। আর ঘরের দেয়ালে টাঙানো ঠাকুরের ছবিগুলোর সামনে প্রদীপ দেখায়।
কাল সকালে স্কুলে যেতে হবে। টিনের স্কুলবাক্সে মা খাতা, পেন্সিল ভরে দিতে দিতে বলে,
স্কুলে মন দিয়ে পড়বে।
আগপাছ না ভেবে আমি মা’কে প্রশ্ন করি,
ও মা, স্কুলে ভাল করলে আমরা বাড়ি ফিরে যাব? স্কুল শেষ করতে কতদিন লাগবে?
বাইরের উঠোন থেকে আচমকা আওয়াজ এল,
শহরে এলে আর ফেরা যায়?
বড়দাদি নামাজ পড়ে একবাটি ছানার পায়েস হাতে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে,
মা, কাল সকালে স্কুলে যাবার আগে নাতিনরে দিস।
আমি ছানার পায়েসের গোলাপজলের ঘ্রাণ ভুলে আবার কড় গুনতে বসি,
বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়…
আশ্বিন আসতে এখনো অনেক সময় বাকি।