আমাদের উঠোনের ঠিক মাঝামাঝি তিনটি গাছ। বারোমাসি আমগাছ, ডালপালা ছড়ানো পেয়ারা গাছ আর প্রকাণ্ড বরইগাছ। আম আর পেয়ারা গাছের রাজত্ব বাড়ির উঠোন অবধি সীমাবদ্ধ থাকলেও বরইগাছ আমাদের কাঠের দোতলা ছাড়িয়ে ডালপালা নিয়ে পাড়ার এ-বাড়ি ও-বাড়ির চালে দিব্যি ছড়িয়ে পড়েছে। বলতে গেলে এ পাড়ায় ঢুকতে ওই বরইগাছটাকেই সবার আগে দেখতে পাওয়া যায়। আর বাইরবাড়ির দেবদারু বাগানের কথা না হয় বাদই দিলাম। বলা যায় পুরো পাড়াটা নানারকম গাছগাছালিতে ঢাকা। তাই এ পাড়ার কোনো বাড়িতেই ভাদুরে রোদের তেমন উপস্হিতি নেই।
তবুও নিয়ম বলে কথা। এ সময়টা এলেই পাড়ার সব বাড়ির মত আমাদের বাড়িও কাঠের বিশাল বাক্সখানার ডালা খুলে যায়। ন্যাপথলিনের গন্ধ মেশানো সে বাক্সের অন্ধকার থেকে একে একে বেরিয়ে আসে তুলে রাখা ঠাকুমার ক’খানা তাঁতের শাড়ি, বাড়ির সকলের শীতের কাপড়, দাদুর গরদের পাঞ্জাবি আর শীতের লেপ কাঁথা। সেসব তুলে রাখা কাপড়-কাঁথার ভাঁজে কখনো কখনো উঁকি দেয় মার্কিন কাপড়ে আধা সেলাই করা ফুল-লতা, আবার কখনো ঝালর লাগানো চটের আসন।
ও ঠাকুমা, এই আসনে তো ফুলই তোলনি!
অথবা
ও ঠাকুমা, এটা কী লিখেছ কাপড়ে?
“সময় ধায়, ক্ষণ ফুরায়
থেকে যায় স্মৃতি
দিনের শেষে সকল ফেলে
চলে যাওয়াই রীতি…”
আমার হাতে ধরা অসমাপ্ত ফুলতোলা সাদা কাপড়ে একবার চোখ দিয়েই ঠাকুমা মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
পেয়ারা গাছের ছায়া এড়িয়ে যতখানি সম্ভব কাঠের বাক্সের সবকিছু আজ ভাদুরে রোদে ওম নিচ্ছে। খানিক সময় পরপর পূর্ণির মা কাপড়গুলো উল্টেপাল্টে দিয়ে লালবারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে বসছে,
ও মনি, ওসব নিয়ে পাড়ায় যাবি না কিন্তু কলাম, কোন বাড়িত ভুল করি রাখি আসবিনি শেষকালে খুঁজতি খুঁজতি হয়রান গতি হবিনি।
পূর্ণির মা’র কথায় আমি কাপড়খানা আবার উঠোনের রোদে ফেলে দিয়ে পিছু নিই ঠাকুমার। আজ সকালের পাত পড়তে দেরি হয়ে গিয়েছিল। দাদু লাল আটার রুটি, পাঁচ তরকারি আর ঝোলা গুড় খেয়ে সবে বাজারের দিকে গেল। মনিপিসির কলেজে যাবার তাড়া ছিল, তাই চা মুড়ি খেয়েই বের হয়ে গেছে। আর মা-বৌমারা একটু আগেই বসল সকালের পাতে।
ও দিদি, সেই কখন মুড়ি খেয়েছ, এবার রুটিখানা খেয়ে নাও।
ঝোলা গুড় মাখানো প্যাঁচানো রুটি ঠাকুমার হাতে।
ও ঠাকুমা, তুমি কি খাবে?
রুটি রাখার পেতলের গামলাটা ফাঁকা হয়ে গেছে। আর পাঁচ তরকারিও কমে এসেছে বাটির।
ঠাকুমা হাসে,
কিছু একটা খেয়ে নেবো।
ঠাকুমার সেই কিছু একটা মানেই অমৃত। এটা-ওটা মেখে ঠাকুমা কিছু একটা বানিয়ে ফেলে, যার স্বাদ সবার থেকে আলাদা হয়।
ঠাকুমা আমার হাতে রুটি ধরিয়ে দিয়েই কয়েকটা কুমড়ো বড়ি ভেজে নিল। আগের রাতের বাসি ভাতে ভাজা কুমড়ো বড়ি আর মরিচ ভেঙে তাতে সর্ষের তেল, লবণ মিশিয়ে আঠা আঠা করে মাখিয়ে নিল ঠাকুমা। ঠিক যেন ভাতের মণ্ড।
আমি ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে আছি সেই ভাতের মণ্ডের দিকে।
ও দিদি, একটু খাবে আমার সাথে?
উত্তর দেবার আগেই আমি হাত পেতে দিই। আমার হাতের তালু ভরে যায় ভাতের একটা মস্ত বলে। আমার নাকে ধাক্কা দেয় সরিষার তেল আর কাঁচামরিচের ঝাঁজ।
ও দিদি, লাল বারান্দায় গিয়ে খাও।
কিন্তু আমার তর রইলে তো! রান্নাঘরের বারান্দা পেরোয়ে মাঝ উঠোনে আসতে না আসতেই আমার হাতের ভাতের বল ফুরিয়ে যায়। আমি লালবারান্দায় না উঠে কলঘরে চলে এলাম। এটা আমাদের বাড়ির পুরোনো কলঘর। এই কলঘরের ছাদ নেই। আকাশের সব আলো কলঘরের জলে পড়ে। আমি টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলে ঝুলে জল তুলি। এ আমার একটা খেলা। সুযোগ পেলেই কলঘরে ঢুকে জল তুলি আপন মনে।
আমাদের পুরোনো কলঘর লাগোয়া বলাকা পিসিদের বাড়ি। দু’পাশে লম্বা বেণী-ঝুলানো হাল্কা পিসি খুব কম কথা বলে। এমনকি তার দেখাও মেলে কম। কলেজের ইংরেজি পড়তে অসুবিধায় পড়লে মাঝেমাঝে দাদুর কাছে আসে। তখনই অল্প সময়ের জন্য দেখা মেলে বলাকা পিসির। ওদের বাড়ির পেয়ারা গাছ মেজো বৌমার ঘরের ছাদে আস্তানা গেড়েছে। তবে সে ওই আস্তানা গাড়াই সার। যদি কখনো মনিকাকু ছাদে উঠে ওদের গাছের ডালে হাত দেয়, তবে বলাকা পিসির মা রে-রে করে আসে। ঠাকুমা খুব বিরক্ত হয় মনিকাকুর এসব কাণ্ডে,
আমাদের গাছভরা সবরী, তা রেখে কেন যে প্রদীপ ওদের গাছে হাত দেয়?
তবে বলাকা পিসির বাবা – মানে সন্তোষ দাদু – মানুষটা খুব অন্যরকম। সুযোগ পেলেই গাছের এ-ফল ও-ফল এনে আমাদের বাড়ির লাল বারান্দায় রাখে,
প্রদীপের জন্যি আনলাম, ও আর আমার বিশু সমবয়সী ছিল।
বিশু কাকুকে আমি দেখিনি। গল্প শুনেছি যুদ্ধের বছর ভারতের ক্যাম্পে ম্যালেরিয়ায় মারা গেছে।
মনি, আর কতক্ষণ জল নিয়ে খেলবি?
মনিপিসি আজ এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল কলেজ থেকে? আমি তাড়াহুড়ো করে কলঘর থেকে উঠোনে চলে এলাম।
ও মনিপিসি, তোমার কলেজ শেষ?
হ্যাঁ, আজ প্র্যাকটিক্যাল ক্লোজ হবে না…
মনিপিসি কথা শেষ হবার আগেই বড় ঘরে ঢুকে গেল। আর ঠিক তখনই বাইরবাড়িতে রিক্সাওয়ালার হাঁক,
বাবু বাজার পাঠাইছে।
আমি দৌড়ে বাইরবাড়ি চলে আসি। বাইরবাড়িতে এখন শুধুই তাঁত-মাকুর খটাস্, খটাস্। এর ফাঁকে মাঝেমধ্যে দু’একটা রিক্সার ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে। তবে আমার ভালো লাগে সিনেমার পোস্টার লাগানো রিক্সা। অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছে মাইকের আওয়াজ,
আসিতেছে, আপনাদের প্রিয় প্রেক্ষাগৃহ রূপবানী সিনেমা হলে ‘চাঁপা ডাঙার বউ’, ‘চাঁপা ডাঙার বউ’…
রিক্সার দু’পাশে ঝোলানো পোষ্টারে জ্বলজ্বল করা গালের তিলে আমি চিনে ফেলি নায়িকা শাহানাকে।
মা নির্ঘাত আমাকে ফাঁকি দিয়ে মনিপিসির সাথে ম্যাটিনি শো’তে এই সিনেমা দেখতে যাবে।
রিক্সাওয়ালা আবার হাঁক দেয়,
বাবু বাজার পাঠাইছে।
আমি সিনেমার পোস্টার ছেড়ে এবার বাজারের রিক্সার কাছে আসি,
বাড়ির ভেতরে দিয়ে আসেন ব্যাগ।
এই রিক্সাওয়ালাটা নতুন। আগে দেখিনি। ছোটোখাটো মানুষটির সবকিছুতে কেমন তাড়াহুড়ো। আমি রিক্সাওয়াল পেছন পেছন ভেতর বাড়িতে ঢুকি। বাজারের ব্যাগ উঠোনে পড়ে,
তুমি হামদু তাঁতী না?
ঠাকুমা খুব অবাক চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে।
হ, আপনে মনে রাখিছেন আমাক?
আমার ঠাকুমা কাউকে ভোলে না। হামদু তাঁতী বেশ আগে আমাদের তাঁতঘরে শাড়ি বুনত। কিন্তু তাঁতঘরের তাঁত কমতে শুরু করলে হামদু তাঁতীরও কাজ চলে যায়। তাঁতমাকু ছেড়ে হামদু তাঁতী এখন রিক্সার প্যাডেল ঘোরায়,
তাঁতের থিকি বেশি পয়সা পাই সত্য, কিন্তু মনে টানে না এই কাজ। গতরে খাটনিও বাড়িছে খুব…
ঠাকুমা ক’খানা মোয়া আর জল দেয় হামদু তাঁতীকে। আর কী জানি কী মনে করে বলে বসল,
দুপুরে আমার বাড়িতে তোমার নেমন্তন্ন, বাবু যা বাজার করে দিয়েছে তাই দিয়ে খেয়ে যেও।
হামদু তাঁতীর তাড়াহুড়ো হঠাৎই কমে গেছে। এক-পা দু’পা করে তাঁতঘরে গিয়ে উঠল মানুষটি।
উঠোনে বাজারের ব্যাগ উপুড় হতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রূপোরঙা ইলিশ মাছ। অসময়ের ইলিশ মাছ।
ভাদ্দর মাসের ইলিশে সুয়াদ কম বৌ।
কোন ফাঁকে গোলেনূর দাদী এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের উঠোনে। হাতে একটা বাতাবিলেবু,
ও মনি, তোর জন্যি আনিছি, নুন-মরিচ মাখায়ে খাইস।
হাত বাড়িয়ে বাতাবিলেবু নিল ঠাকুমা,
বাগানের দিকে যাব, কচুপাতা লাগবে…
ঠাকুমা কথা শেষ করার আগেই বাইরবাড়ির দিকে পা বাড়াল। পেছন পেছন গোলেনূর দাদীও। পুকুর ঘেঁষা ঠাকুমার বাগানে আগাছার মত বাড়ে হেলেঞ্চার শাক, শান্তির শাক এ’সময়। গোলেনূর দাদী ইচ্ছে হলেই সেসব তুলে নিয়ে গিয়ে রান্না করে।
শুক্লা আর ইতু স্কুলে গেছে। সঙ্গীবিহীন আমি তাই অলস সময়ে ঠাকুমার পিছু নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর দেখি না।
ও গোলেনূর দাদী, আজ শান্তি শাক নেবে শুধু?
গোলেনূর দাদীর কোঁচড় এরই মধ্যে ভরে গেছে শাকে।
ওদিকে ঠাকুমা কচুপাতা নেবার আগে এ-গাছ ও-গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিচ্ছে। ঠাকুমার বাগানে মাচা ভরা ঝিঙে ধুন্দল ঝুলছে। আর শিউলি গাছ বেয়ে উঠে গেছে পুঁইয়ের লতা। তবে এসবে আমার মন বসে না। আমি শ্বেতকাঞ্চনের ঝাড় ঘেঁষে দাঁড়ালাম। মাটি থেকে দেবদারুর ফল কুড়িয়ে পুকুরের জলে ছুঁড়ে মারলাম। পড়ন্ত আগবেলায় রোদের তাপে ঝিমিয়ে থাকা পুকুরটায় ঢেউ উঠল, কোণায় কোণায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকা সবুজ মাথা তোলা হেলেঞ্চা শাকগুলো নড়েচড়ে উঠলো। আর ঠিক তখনি তাঁতঘর ঘেঁষা নিমগাছটা থেকে ডেকে উঠল কুটুম পাখি,
কুটুম আসুক, কুটুম আসুক…
একটানা ডেকেই চলেছে পাখিটা।
ও ঠাকুমা, আজ কুটুম আসবে বাড়িতে দেখো।
হাতে ক’খানা কচি কচুপাতা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ানো ঠাকুমা আমার কথায় থামে না,
কুটুম তো এসেছে দিদি, হামদু তাঁতী আজ আমাদের বাড়ির কুটুম।
শব্দগুলো হাওয়ায় ভাসিয়ে ঠাকুমা তাঁতঘর পেরিয়ে গেল। আমি কী বুঝলাম জানি না, তবে ঠাকুমাকে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে ভেতর বাড়িতে চলে এলাম।
উঠোনের ইলিশ এর মধ্যেই কাটা-ধোয়া শেষ। বাড়ির উনুনে ভাতের হাঁড়ি উঠে গেছে। দুপুরের পদে আজ হবে ধুন্দল দিয়ে মাসকলাইয়ের ডাল, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে মিষ্টি কুমড়োর ঘণ্ট, ঝুড়ি আলু ভাজা, কাঁচাকলার রসা আর ইলিশ কচুভাপা।
উঠোনের ফেলে রাখা বাক্সের তোলা কাপড়ে এখন ছায়া বসেছে। পেয়ারা গাছের ছায়া। পূর্ণির মা কলঘর থেকে স্নান সেরে চলে এসেছে অনেকক্ষণ। এখন রান্নাঘরের বারান্দায় বসে শিলপাটায় সর্ষে লবণ আর কাঁচামরিচ ফেলে বাটছে।
আজ দাদু টিফিনে আসবে তাড়াতাড়ি। তাই ঢেঁকিঘরের সামনে খোলা উনুনেও আঁচ পড়ল। সেখানে বসলো পেতলের খাবড়ি। তাতে জল। ঠাকুমা আলতো হাতে ইলিশ মাছের টুকরোগুলোও লবণ আর হলুদ মাখিয়ে নিল।
রান্নাঘর থেকে মৌরি ফোড়নের ঘ্রাণ আসছে। মাসকলাই ডালে ফোড়ন পড়ল।
ঠাকুমা উঠোনের উনুনে খড়ি ঠেলে আঁচ বাড়ানো। খাবড়ির জল ফুটছে এখন। চাটাইয়ের একটা ঝুড়ি বসল ফুটন্ত জলের খাবড়ির উপর। ইলিশ মাছের টুকরো কুলোয় এবার মাখানো হল সর্ষে আর কাঁচামরিচ বাটা। এর সঙ্গে বেশ খানিকটা সর্ষের তেল। খুব ভালো করে মাছের সাথে মাখিয়ে নিল ঠাকুমা। এরপর কচি কলাপাতায় একটি করে ইলিশের টুকরো আর কাঁচামরিচ দিয়ে পুটুলি বেঁধে নিল দ্রুত হাতে।
চাটাইয়ের ঝুড়ির ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ধোঁয়া উঠছে এখন। তাঁতঘরের মাকুর আওয়াজ একটু একটু করে কমছে। তাঁতীদের দুপুরের খাবার সময় হয়ে আসছে।
দাদু টিফিনে চলে এল। বাড়ির ভেতর দাদুর পেছন পেছন ঢুকল হামদু তাঁতীও।
যা থানাঘাট থেকে ডুব দিয়ে আয়…
দাদু তো বলেই খালাস। মনিপিসি কাঠের দোতলা খুঁজে একটা পুরোনো লুঙ্গি এনে দিল হামদু তাঁতীকে।
ঠাকুমা চাটাইয়ের ঝুড়ির উপর ইলিশ কচুপাতার পুটুলিগুলো বিছিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিল।
দাদু দুপুরের খাবার খেয়ে আবার বেরোবে। তাই আজ বাড়িতে দাদু এলেও রেডিও’র নব ঘুরল না।
ঠাকুমা ঢাকনা তুলল ইলিশের পুটুলির। উঠোন ভেসে গেল অসমেয় ইলিশের ঘ্রাণে। ঠাকুমা কালচে সবুজ হয়ে আসা ইলিশ কচুপাতার পুটুলিগুলো আরেকবার উল্টে দিয়ে আবার ঢাকনা দিল।
দাদু কলঘর থেকে এসে আহ্নিক করতে বসে গেছে। মা এরই ফাঁকে কলঘরে নিয়ে আমার মাথায় ক’ঘটি জল ঢেলে দিল।
লাল বারান্দায় দুপুরের পাত পড়ে গেছে। দাদুর পাশে আমার পাত। একটু দূরে বসেছে হামদু তাঁতী।
সবার পাতে লাল আউশের ভাত, আলুর ঝুড়ি ভাজা আর ইলিশ কচুভাপা। ভাপে সেদ্ধ হওয়া কালচে কচুপাতা সরাতেই বেরিয়ে পড়ল সাদাটে হলুদ ইলিশ। হাত দিয়ে মাছের টুকরো ভেঙে মুখে পুরতেই ভাদুরে ইলিশের স্বাদে আমার মুখ ভরে গেল।
হামদু তাঁতীর পাতের মাছ নিমেষেই শেষ। ঠাকুমা শেষ পাতে ঘরে পাতা টকদই আর ঝোলাগুড় দিল হামদু তাঁতীকে। পাত চেটেপুটে খেতে খেতে বলে উঠল,
মনে হইতিছে আম্মার হাতের রান্ধন খাইলাম…
এই প্রথম হামদু তাঁতীর মুখে আমি অদ্ভুত তৃপ্তি দেখলাম।
হামদু স্কুল ঘর হয়ে যাবি?
দাদুর প্রশ্নে মানুষটি হাতের ভাত চেটে খেয়ে কলঘরে পা বাড়াল। দাদুও উঠে পড়ল পাত ছেড়ে।
হামদু তাঁতী কলঘর থেকে উঠোনে আসতে দাঁড়াতেই ঠাকুমা আঁচলের গিঁট খুলে পাঁচ টাকা এগিয়ে দিল,
বাচ্চাদের জন্য হাট থেকে কদমা নিয়ে যেও।
হামদু তাঁতীর মুখটা নীচু হয়ে গেল, বিড়বিড় করে বলল,
গেদা-গেদিরা দশমী আইনেই এই বাড়ির নাড়ুমোয়া হৈচই করে।
আর দাঁড়ায় না হামদু তাঁতী। তাড়াহুড়ো করে বাইরবাড়ি চলে যায়। পেছন পেছন দাদুও।
উঠোনে এখন মেলে রাখা কাপড়ে বরইগাছের নিশ্চল ছায়া। পূর্ণির মা একে একে কাপড়গুলো ভাঁজ করছে। দেবদারু বাগানের মাথায় বারবেলার সাদাটে আকাশ চুপচাপ পড়ে আছে।
হঠাৎ সেই কুটুমপাখির ডাক,
কুটুম আসুক… কুটুম আসুক…