আমাদের রিক্সা থামল বাইরবাড়িতে। দেবদারু বাগানের ছায়া এ’ ক’দিনে আরও ঘন হয়েছে। আর আমাদের তাঁতঘর ঘেঁষা ছোট্ট পুকুরটা আড়াল হয়েছে শ্বেতকাঞ্চনের ঝাড়ে। দেবদারুর পাতা আর বেগুনি ফল পড়ে আছে সারা বাইরবাড়ি জুড়ে।
বাইরবাড়িতে সেই পরিচিত তাঁতমাকুর ‘খটাস্, খটাস্’ শব্দ।
আমি রিক্সা থেকে নেমেই ছুটে যাই তাঁতঘরে।
ও মানিক কাকু, আজ ক’খানা শাড়ি তুললে তাঁতে? দিনের আলো আর টিমটিমে ইলেকট্রিক বাল্ব মিলেমিশেও তাঁতঘরের অন্ধকারকে খুব বেশি তাড়াতে পারছে না। তা বলে কী হয়েছে? তাঁতিদের হাত কিন্তু থেমে নেই। সঙ্গে গলাও। কোনো এক তাঁতি সুর ধরেছে,
পাবে সামান্যে কি তাঁর দেখা
বেদে নাই যার রূপরেখা
কেউ বলে পরম মিষ্টি
কারো বা হইল দৃষ্টি
দরোতে দুনিয়া সৃষ্টি
তাই নিয়ে লেখাজোকা…
সেই সুর যেন আমার বাড়ির সুর, আমাদের বাইরবাড়ির সুর।
তা নয়তো কী? শহরে তো এমন সুর শুনতে পাই না আমি।
মনি রে, এত্ত বড় হয়ে গেছিস? কত্তদিন পর মুখখান দেখতি পেলাম, মুখটা অমন শুকিয়ে গেছে…
মানিক কাকু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে অনবরত বলে চলেছে,
শহরের জল ভালো না, হাওয়া ভালো না বুঝতি পারতিছি খুব… আসিছিস ভালো হইছে রে মনি, আর শহরে যাতি হবে না...
মানিক কাকুর এ’সব কথায় আমার যতই মন কেমন করুক না কেন, আমি সেসব এড়িয়ে বলি,
ও মানিক কাকু, এবার কী নকশা তুললে তাঁতে?
এবার কলসি জরির পাড় আনিছি তাঁতে, তোর জন্যও দশ হাতের একখান শাড়ি করে দেবো নে।
গিন্নি, ও গিন্নি…
ব্যস তাঁত, শাড়ি, মানিক কাকু সবকিছু থেকে আমার মন উবে গেল সঙ্গে সঙ্গে।
দাদু এসে দাঁড়িয়েছে তাঁতঘরের সামনে। সাদা ধুতি পরা মানুষটা কি এ ক’দিনে একটু ঝুঁকে পড়েছে? একহারা মানুষটি কি একটু রোগাও হয়েছে?
আমি দৌড়ে দাদুর পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
চলো গিন্নি, বাড়ির ভেতর চলো, বাড়ির আসল মানুষ বাড়ি না থাকলে বাড়ি আর বাড়ি থাকে না গিন্নি।
আমার হাত ধরে দাদু ভেতর বাড়িতে নিয়ে চলল।
বেলার গায়ে তখন রোদের আঁচ কমে আসছে একটু একটু করে। পূর্ণির মা’র লেপে দেওয়া উঠোনে রোদের নকশায় রঙ কমছে খুব আলগোছে। ঠাকুমা, মনিপিসি আর মা এরই মধ্যে কলঘর থেকে গা ধুয়ে চলে এসেছে। বড় বৌমা, মেজো বৌমা দুপুরের পর রান্নাঘর ধুয়েমুছে আবার উনুনে নতুন আঁচ দিয়েছে।
উনুনে দুধ গুড়ে ফুটছে ঘিয়ে ভাজা সুজি। এর সঙ্গে হবে গোলারুটি। সন্ধ্যায় চায়ের সাথে এইসব জলযোগের একমাত্র কারণ হল, শহর থেকে আমাদের আসা। নয়তো অন্যদিন তেল মুড়ি আর কদাচ কুঁচো নিনির হয় এ বাড়ির সন্ধ্যার চায়ের সাথে।
মনি, কলঘরে চল।
মনিপিসি আমাকে কলঘরের নিয়ে গিয়ে ক’ঘটি জল গায়ে ঢেলে দিল। বারবেলায় টিউবওয়েলের জলে গা একটু শিনশিন করে ওঠে। তবে গা থেকে শহরের ধুলো ধুয়ে কলঘর থেকে বের হতেই উঠোনে শুক্লা আর ইতুকে দেখে আমি সব ভুলে গেলাম,
তোরা একটু দাঁড়া, আমি এখনই যাব তোদের সঙ্গে।
শহর থেকে আনা ব্যাগ হাতড়ে আমি খুঁজে বের করি নিজের ভাগ থেকে সরিয়ে রাখা ক’খানা পেন্সিল, সল্টেড বিস্কুট আর হজমি’র প্যাকেট। জিনিসগুলো খুঁজতেই যতটুকু সময়, এরপর শুক্লা আর ইতুর সাথে একছুটে সেই প্রাচীরবিহীন পাড়াখানায়,
ও জ্যাঠি ঠাকুমা, তোমার শিউলি ফুল গাছে এত ফুল এসেছে?
অথবা,
ও বড়মা, তোমার বাতাবিলেবু সব বাত্তি হয়ে গেছে?
সারা পাড়ায় ঘুরে ঘুরে সেই আগের মত এ-কথা, ও-কথা বলে আর শুনে বেড়াচ্ছি। কেউ মাথায় হাত বুলোয়, তো কেউ ঘরে ডেকে ক’খানা নাড়ু হাতে দেয়,
কতদিন পর এলি, শহর এখন ভালো লাগে তাই না? শহর কত বড় রে?
এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় কি এখন আমার আছে? এখনো তো গোলেনূর দাদির বাড়িই যাওয়া হয়নি। আর এদিকে বেলাও বুজে আসছে। আমি নাড়ুগুলো ফেলেছেড়ে খেয়ে বাইরবাড়ির দিকে ছুট লাগাই, সেখানেই তো গোলেনূর দাদির বাড়ি। কিন্তু ঠাকুমার ডাক বাইরবাড়ি এসে দাঁড়াতেই,
ও দিদি, বাড়ি আসো…
রান্নাঘর থেকে গোলারুটি, সুজির মোহনভোগ এখন বড়ঘরের লাল বারান্দায় চলে এসেছে। আর সেখানে কেরোসিনের স্টোভে বসেছে খাবড়ি ভরা চায়ের জল। তা না করে উপায় আছে? আজ কতদিন পর সন্ধ্যায় বড়ঘরে চায়ের আড্ডা বসবে। সেখানে কি আর শুধু এ বাড়ির মানুষ থাকবে? ওই তো জ্যেঠি ঠাকুমা সন্ধ্যার পূজা সেরে চলে আসবে, চলে আসবে শুক্লার ঠাকুমা আর তাঁতঘর বন্ধ করে মানিক কাকুও।
উঠোনের মরা রোদ বুজে গেল হুট করে। পেয়ারা গাছের নীচে আমাদের তুলসীতলা। ঠাকুমা জল ছিটিয়ে দিচ্ছে তুলসীমঞ্চে। এরপর ঠাকুমা বড়ঘর, আমাদের ঘর, বড় বৌমার ঘর… একে একে সবঘরের চৌকাঠে জল ছিটিয়ে দেবে। দিনের আলোয় একপোঁচ সন্ধ্যার আঁধার পড়তেই এপাড়ার প্রায় সকল বাড়ি থেকে ভেসে আসে শঙ্খ আর ঘণ্টার আওয়াজ। আর একইসঙ্গে ভেসে আসে সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান।
এখনও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
আমাদের তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে উঠল। ধূপের ধোঁয়া বাড়ির বাতাসে মিশতেই ঠাকুমা শঙ্খে ফুঁ দিল।
মনি, ভরসন্ধ্যায় খোলা চুলে উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকতে নেই।
মনিপিসি আমাকে ডেকে কাছে নিল।
মনিপিসির কোলঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমি যেন আবার সেই আগের মনি হয়ে উঠলাম। বড়ঘরের লাল মেঝেতে পাটি পাতা থেকে শুরু করে দাদুর নস্যির কৌটো এগিয়ে দেওয়া, এরপর রেডিও’র নব ঘুরিয়ে ভয়েস অফ অ্যামেরিকার স্টেশন ধরে দেওয়া — কোনোকিছুতেই কেউ বলতে পারবে না আমি বাড়িতে এলাম অনেকদিন পর।
সন্ধ্যাকাশে একে একে তারা ফুটে উঠতেই রান্নাঘরের বারান্দায় জ্বলে উঠল ইলেকট্রিক বাতি। সে বাতির আলো উঠোন পেরিয়ে বড়ঘরের লাল বারান্দাতেও পৌঁছুল। কেরোসিনের স্টোভে ফুটছে চা। গৌর-নিতাইকে শয়ন দিয়ে ফুরাল ঠাকুমার সন্ধ্যাপূজা। বড়ঘরের সিলিং ফ্যানটা ঘটাং ঘটাং করে ঘুরে উঠল। তার তলায় এ বাড়ির প্রায় সকল মানুষ। দাদুর রেডিওতে সন্ধ্যা সাতটার খবর হচ্ছে, কিন্তু সে খবরে সবার মন থাকলে তো! শহরে ঠাকুমার দিনগুলো কেমন ছিল, শহরের বাসা দেখতে কেমন? মনিপিসি কতবার নদীর ধারে গিয়েছে — এসব গল্প তো ফুরোচ্ছেই না। আর ঠাকুমার হাতের চা জুড়িয়ে যাওয়ার আগেই জ্যেঠি ঠাকুমা চলে এল,
কতদিন পাঠ শুনি না বৌ, তোমার মত কেউ পাঠ করতে পারে না।
এ গল্পে ও গল্পে সন্ধ্যা উতরে যাচ্ছে। আর জার্নির ধকল নেওয়া আমার শরীর নেতিয়ে আসছে একটু একটু করে। চায়ের সাথে গোলারুটি খেতেই শরীর যেন আরোও ছেড়ে দিল। ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে আমি মেঝের পাটিতেই শুয়ে পড়লাম। রেডিওতে কৃষি সংবাদ হচ্ছে। ঠাকুমা শহরের অষ্টপ্রহরের গল্প করছে। মা করছে রহিম চাচা আর মুসা’র মা’র গল্প। সবার গল্প থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া কথা আমার কানে আসছে,
মুসা’র মা খুব বিশ্বাসী আমার…
সুজানগর থেকে এক কীর্তনের দল এসেছিল…
এ বছর বন্যায় তোষা পাটের বেশ ক্ষতি হয়েছে….
আমার চোখ বুজে আসছে। ঠাকুমার কোলে পরম নিশ্চিন্তে আমি ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি সারাদিনের সব চঞ্চলতা দূরে ঠেলে। আমি ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি ঠাকুমার গায়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে।
আমাদের বড় ঘরে অনেকগুলো কাঠের জানালা। এরমধ্যে একটি বাদে সবগুলোই বড় জানালা। তবে সেই ছোট কাঠের জানালার ফাঁক ফোঁকর দিয়েই সবার আগে বড়ঘরের ভেতরটাতে দিনের আলো অথবা ভোরের শিনশিনে হাওয়া আসে। আজ ভোরের শিনশিনে হাওয়ার সঙ্গে সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে আজান বড়ঘরের ভেতরে ঢুকতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি ঠাকুমাকে ধরব বলে হাত বাড়াতেই হাত গিয়ে ঠেকল ফাঁকা বিছানায়।
ও ঠাকুমা…
আমি ফিসফিস করে ডাকি। আমার সে ডাক তলিয়ে যায় উঠোনের গোবরজলের ছড়ার শব্দে। পূর্ণির মা চলে এসেছে। আমি বিছানা থেকে আবছা অন্ধকার ঢাকা মেঝেয় পা রাখি। কাঠের জানালা দিয়ে এখন শিনশিনে হাওয়া আর অন্ধকার ঢুকছে।
আমি এক পা, দু’ পা করে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। আকাশে একটু একটু করে আলো ফুটছে। উঠোনের বরইগাছ থেকে কিচিরমিচির ডেকে উঠছে একটা দু’টো পাখি,
ও দিদি, ফুলের সাজিটা নিয়ে এসো তো।
ঠাকুমার হাতে কলাগাছের মাইজ পাতা। লাল বারান্দায় রেখে দিল তা ঠাকুমা।
ও ঠাকুমা, তুমি বাগানে গিয়েছিলে?
মাথা নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে ঠাকুমা হাতের ইশারায় আমায় ডাকে। ঠাকুমার পেছন পেছন আমি বেরিয়ে পড়ি সেই আগের মতন ভোরের আলোয় ফুল তুলতে। চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে কুঞ্জলতা ফুল নিয়ে সাহাপাড়ার পথ ধরতেই আকাশ সাদা হয়ে উঠল। তবে পথের সবটুকু অন্ধকার মুছে যাওয়ার আগেই কলি দিদি, পিসি ঠাকুমা, ঘোষবাড়ির বড়মা — একে একে সবার দেখা পাওয়া গেল।
কী রে মনি, কবে এলি…
কত্ত বড় হয়ে গেছিস…
এমন শুকিয়ে কাঠ হয়েছিস কেন…
ঠাকুমার পেছন আর ছাড়লি না তুই….
কথাগুলো আমার চারপাশে সোরগোল তুললেও আমার সেসব দিকে খেয়াল নেই। আমি দেখছি কোন বাড়িতে নতুন ঘর উঠল, কাদের বাড়ির উঠোন ভাগ হল, কে নদীর ওপাড় থেকে এসে আমাদের পাড়ায় নতুন বসত গড়ল – সেদিকে।
তবে শুধু এসব দেখলে তো হবে না। আজ ঠাকুমার অনেক কাজ যে। সাজি ভরে লাল ফুল নিয়ে আমরা যখন বাড়ি ফিরছি তখন আকাশের আলো উঠোন ছুঁয়েছে।
ঠাকুমা আর দেরি করে না। খুব তাড়াতাড়ি স্নান সেরে চলে এল। এখন খড়িমাটিতে বড়ঘরের দরজায় আল্পনা আঁকছে।
ও ঠাকুমা, ওটা কি পদ্ম ফুল আঁকলে? আর এটা কি ঠাকুমা? লক্ষ্মীর পা দেবে না?
ধানের শীষ, পেঁচাপেঁচি এঁকে ঠাকুমা ঘট বসায়। আমের পঞ্চপল্লব আর গোটা নারিকেলের গায়ে সিঁদুরের ফোটা পড়লো। মাইজপাতায় তিলের ধুবরী, আতপ চালের নৈবেদ্য আর ফলের প্রসাদ পড়তেই ঠাকুমা দূর্বা আর ফুল হাতে ঠাকুমা সুর করে পাঁচালী পড়ায় মন দিল সব,
এক দেশে বিধবা বামনি বাস করতেন,
তার একটি ছোট ছেলে ছিল।
তারা খুব গরিব, কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা পায়
তাই দিয়েই তাদের চলে যায়।
তাদের কুঁড়ে ঘরের সামনে একটা বটগাছ ছিল…..
এদিকে দাদুর রেডিও বাজতে শুরু করেছে সেই কখন থেকে। কুনকুন করে এতক্ষণ লালনগীতি হল। এখন হচ্ছে সকালের সংবাদ। রেডিও’তে সংবাদ শুরু হওয়া মানেই দাদুর সকালের চা মনিপিসির হাত দিয়ে দাদুর কাঠের টেবিলে পৌঁছে যাওয়া। সেই চায়ের সাথে আজ আছে ঝোলা গুড়ের মুড়কি।
গিন্নি ও গিন্নি…
সকালবেলা দাদু মুড়কি কীভাবে একা খাবে? আমার পাতা দু’-হাত ভরে উপচে পড়তে লাগল দাদুর দেওয়া মিষ্টি খৈ।
আজ এ বাড়ির উনুনে সকালের খাবারে উঠেছে ঘি ভাত আর বেগুন ভাজি। সকালের পাত পড়ল ঠাকুমার ব্রত শেষ হতেই। আজ ঠাকুমার জন্য নিরামিষ পদ বরাদ্দ। তাই সকালের ঘি ভাত কিছুটা আলাদা করে রাখা হল।
দাদু এরই মধ্যে বাজারে চলে গেছে। স্কুলে আর ক’দিন পর পুজোর ছুটি হয়ে যাবে। এজন্য স্কুল শুরু হবার আগে দাদু এক ব্যাচ ছাত্র পড়িয়ে নেয়।
বাজারের ব্যাগ আজ উঠোনে পড়ল সকাল ফুরোবার আগেই। ঠাকুমা সকালের পাত ওঠার পর কাঁথায় ফুলও তুলতে বসেনি। আজ দুপুর গড়ানোর আগেই সব পদ রান্না করে নিতে হবে। বিকেলে সাহাপাড়ায় পাঠ করতে যেতে হবে যে ঠাকুমার।
আজ দুপুরের পদে তাই ব্যঞ্জন কম। ওল সেদ্ধ, মাছের ডিম দিয়ে উচ্ছে ভাজি, পাঁচমেশানো ডাল আর মাছের টক।
আজ দাদু অনেকদিন পর কোরাল মাছ পেয়েছে। বাজারের সাথে বলে পাঠিয়েছে এই মাছের টক করতে। মনিপিসি কোটা দিয়ে বারোমাসি আমগাছ থেকে একটা আম পেড়ে নিজেই ছেঁচে দিল।
উনুনের আঁচে লোহাড় কড়াই উঠল। তাতে সর্ষের তেল। তেল থেকে ধোঁয়া ছাড়তেই ঠাকুমা খুন্তি দিয়ে তেল সারা কড়াইয়ে মাখিয়ে দিল। হলুদ লবণ মাখানো কোরাল মাছগুলো এপিঠ ওপিঠ করে সাঁতলে নিয়ে সেই তেলে সরিষা ফোড়ন পড়ল। পটপট করে ফুটে কতক সরিষা কড়াই থেকে মাটিতে ছড়িয়ে গেল।
উঠোনের রোদে ওম নিচ্ছে গেল বছরের তিসি। পূর্ণির মা খানিক সময় পর পর হাত দিয়ে তিসি এ’পাশ ও’পাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
কড়াইয়ে এবার পড়ল মিহি করে বাটা সর্ষে-কাঁচামরিচ। তাতে বাটি ধোয়া জলও। গনগনে খড়ি টেনে বের করে অল্প আঁচে কষাতে লাগল ঠাকুমা মশলা। তেল ছেড়ে আসতেই সেই মশলায় পড়লো মনিপিসির ছেঁচা আম। আম জল ছেড়ে মশলা আবার পাতলা করে তুলল। ঠাকুমা ঢাকনা দিয়ে এবার কষিয়ে চলেছে ছেঁচা আম আর সর্ষে-কাচামরিচ বাটা। খানিক সময় পর ঢাকনা তুললো ঠাকুমা। এবার খানিক হলুদ গুঁড়ো মেশাল ঠাকুমা। আরেকটু কষিয়ে সাঁতলানো মাছগুলো ঠাকুমা দিয়ে দিল মশলার ভেতর। সাথে হাত ধোয়া অল্প একটু জল। আবার ঢাকনা পড়ল।
মাখা মাখা ঝোল ফুটে উঠতেই ঠাকুমা সব জ্বলন্ত খড়ি টেনে বের করে নিল। একটু চিনি ছিটিয়ে দিল ঠাকুমা কড়াইয়ের ঢাকনা তুলে। আর সব শেষে তাতে পড়ল খানিক আমতেল।
এবার নিভু নিভু আঁচে দম নিতে শুরু করল মাছের টক।
উঠোনের তিসিতে বারবেলার রোদ পড়ার সাথে সাথেই লাল বারান্দায় সবার পাত পড়ল। আমি বসেছি দাদুর পাশে, দাদুর মাখানো ওল সেদ্ধর লোভে। তবে পাতে মাছের টক পড়তেই আমি সব ভুলে মাছ ভেঙে খেতে শুরু করলাম। টকমিষ্টি মাছের টুকরোটা শেষ হতেই দাদুর হাঁক,
কই, দেখে যাও শহরে গিয়ে আমার গিন্নি খাওয়া শিখেছে…
দাদুর পাত থেকে আরও খানিক মাছের টুকরো পড়ল আমার পাতে।
ঠাকুমা বরইগাছের তলায় দাঁড়িয়ে দাদুর কাণ্ড দেখে হাসছে। হাতে ধরা আমতেলের বয়াম।
ও দিদি, ভালমত খাও।
ঠাকুমা এগিয়ে এসে দাদুর পাতে ভাতের কোনায় আরেকটু আমতেল ঢেলে দিল। আমি টপ করে পাতের সব মাছ মুখে পুরি,
ও ঠাকুমা, সব খেয়েছি দেখো। আজ বিকেলে আমায় পাঠে নিয়ে যাবে তো?
ঠাকুমার উত্তরের আগেই বাতাসে ভেসে আসে সুর। তাঁতঘরের সুর,
আমার গলার হার খুলে নে ওগো ললিতে।
আমার হার প’রে আর কি ফল আছে গো,
প্রাণবন্ধু নাই ব্রজেতে…