সিলিং ফ্যাশনের ঘটাং ঘটাং শব্দ এখন শেষ রাত এলেই বন্ধ হয়ে যায়। কাঠের বাক্স থেকে ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ-মাখা কাঁথাগুলো ভাদুরে রোদের ওম নিয়ে আর ফিরে যায়নি বাক্সের অন্ধকারে। আগ-রাতে যতই পা দিয়ে ঠেলেঠুলে কাঁথা সরিয়ে দেই না কেন, শেষ-রাতে হাতড়ে হাতড়ে কাঁথা খুঁজি ঠিকই। আর ফজরের আজানের পর যেটুকু অন্ধকার থাকে, তাতে হুট করে মিশে যায় একটা শিনশিনে ভাব। তবে তার দৈর্ঘ্য—ওই বেলা ওঠা পর্যন্ত। দিনের আলো উঠোনে পড়তে না পড়তেই সেই শিনশিনে ভাব উধাও। বারবেলায় তো গা চিটচিটে গরমে এমন অসহ্য লাগে, যে সিলিং ফ্যানের বাতাসের সাথে তালপাতার পাখাও দোলাতে হয়। তবে দিন মিইয়ে সন্ধ্যায় গিয়ে ঠেকলে সেই গরম ভাবটা আবার উধাও হয়ে যায় হুট করে। আর এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় অসময়ের বৃষ্টি, তাহলে তো আগ-রাতেও ঠাকুমা সিলিং ফ্যানের সুইচ নামিয়ে দেয়।
এই ঠান্ডা তো এই গরম—ও দিদি, এই চিরতা-ভেজানো জলটুকু খেয়ে নাও; ও দিদি, শেফালি পাতার রসে সর্দি সারে; ও দিদি, এইটুকুন কাঁচা হলুদও ফেলে দুড় দিয়ে খেয়ে নাও।
সকাল হতে না হতেও আমার বায়নাক্কা শুরু হয়ে যাও। “একটা গুড়ের কদমা দিতে হবে চিরতার রস খেলে” কিংবা “কাঁচা হলুদ খেলে আমায় আদা-গুড়ের চা দেবে?” এমনিতেই আমার এ্যালার্জির ধাত, তার উপর ঋতু পাল্টানোর এই সময় একটু ঠান্ডা জলে বেশি সময় স্নান করলেই গলাব্যথা বা সর্দি হয়। তাই তো ঠাকুমা সূর্যের নরম রোদ উঠোনে পড়তে না পড়তেই নানারকম টোটকা তুলে ধরে আমার মুখের সামনে। সবরকম বায়নাক্কা মেনে পুরো টোটকা খাইয়ে তবেই ঠাকুমা উনুনে আঁচ দেয়।
আজ অবশ্য ঠাকুমা পূজোর ফুল আনতে অন্য পাড়ায় দৌড়াল না। বাইরবাড়ি থেকেই সাজি ভরল কাঠটগরে। এরপর স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে ছুটল নদীর ঘাটে। নদীর ঘাট কি এখানে? সেই তো মখদুম শাহের মাজার ছেড়ে আরও কয়েক পা। তবুও ঠাকুমা কারো বারণ শুনবে না,
করোতোয়ার মাটি না হলে কাঠাম পূজার নিয়মভঙ্গ হবে।
শঙ্কর জ্যাঠার মা নাকি আজীবন কাঠাম পুজোর দিন এক ডুবে করতোয়ার তল থেকে কালো মাটি এনে দিত। সেই মাটি পরে মেশানো হত মূর্তি গড়ায়। আমাদের বাড়ির পূজা তো আদতে শঙ্কর জ্যাঠাদের পূজা। ও বাড়ির সবাই হুট করে একদিন দেশ ছেড়ে চলে গেলে, পূজা উঠে এল আমাদের বাইরবাড়িতে। তাই ঠাকুমা এই পূজার সব নিয়ম শঙ্কর জ্যাঠার মায়ের নিয়ম অনুসারেই পালন করে।
শঙ্কর জ্যাঠার কথা খুব বেশি মনে পড়ে না আমার এখন। আর বিধান দাদার কথাও প্রায় ভুলে গেছি। শুধু ওদের বন্ধ দোকানখানার সামনে এলেই কাঠি লজেন্সের কথা পড়ে খুব। আর কাগজের ঠোঙায় ঝুরিভাজা যতই অন্য দোকানে পাই না কেন, শঙ্কর জ্যাঠার দোকানের সেই কুরকুরে ঝুরিভাজার স্বাদ আর খুঁজে পাই না।
তবে এ বাড়ির আর কেউ শঙ্কর জ্যাঠার কথা না বললেও, আমাদের বাইরবাড়ির পূজার সংকল্পে কিন্তু দাদু ‘শঙ্কর সাহা’ নামটি জুড়ে দিতে ভোলে না।
তাই তো আজও সকালে ঠাকুমা যখন ভেজা কাপড়ে নদীঘাটে যেতে উদ্যত, দাদুই তখন রিক্সা ডেকে ঠাকুমাকে তাতে তুলে দিল,
নিয়ম তো এমনই, মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায়।
আর করোতোয়ার কালো মাটি নিয়ে ঠাকুমা বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে উঠোনের রোদের ঝাঁজ বাড়ল। বাড়ির উনুনে আঁচও পড়ে গেল ঠাকুমা ফেরার আগেই। তা বলে কাঁচা হলুদ আর গুড়ের দলা থেকে রেহাই মিলল না আমার। আর বায়না অনুযায়ী আদা-গুড়ের চা-ও স্টোভে চড়ল একটু বেলা করেই।
সেই চাপড়া ষষ্ঠীর দিন ঠাকুরমশাই একটা ভালো দিন বেছে দিয়ে গেছে। কাঠাম পূজার দিন।
সকালের পাতে আজ ঘি-ভাত আর কুমড়ো বেশ্বরী। তবে ঠাকুমার উপোস, ঘটে ফুল না পড়া পর্যন্ত। আজ ভেতর উঠোনে নয়, ঘট বসল বাইরবাড়িতে। আমাদের বাড়িতে একচালা কাঠাম। মন্দিরের সামনে সেই কাঠামে তেল-সিঁদুর পরানো হল। ঘটে পড়ল আমের পল্লব আর গোটা নারিকেল।
ঠাকুরমশাই এসে গেল পেয়ারা গাছের পাতায় রোদের তাপ জাঁকিয়ে বসতেই। পালবাড়ি থেকে রতন পাল দাদুও এসে দাঁড়িয়েছে বাইরবাড়িতে। হাতে ক’গাছা খড়। ঠকুরমশাই সেই খড়ের ছোট্ট পুতুল বানালো। বেঁধে দিল কাঠামোর সাথে।
পাল দাদু যখন প্রতিমা বানাবে তখন এই খড় মিশিয়ে দেবে। খড়ের প্রতিমায় একমেটে, দোমেটে আর খড়িলেপার পর তবেই পড়বে নানারঙের প্রলেপ। তবে সে আরও পরের কথা।
এখন ঠাকুমার সাথে উলু যোকার দিয়ে উঠল পিসি ঠাকুমা, জ্যেঠি ঠাকুমা, ও বাড়ির বড়মা আর মা-রা।
অক্ষত পান, গোলেনূর দাদীর দেওয়া কমলা রঙের গাছপাকা গোটা সুপারি, তেল-সিঁদুরে হয়ে গেল কাঠাম পূজা। এখন থেকে কড়ে দিন গুণে বলা বড়পূজার আবাহনের কথা।
কাঠাম পূজার প্রসাদ হাতে নিতে না নিতেই দাদু বেরিয়ে গেল বাজারে। আজ পিসি ঠাকুমা দুপুরে খেয়ে যাবে। তাই ঠাকুমা উনুনে আঁচ দিয়ে দিল তাড়াতাড়ি। ভিজিয়ে রাখা মটর ডালের বড়া হবে, পুকুর ধার থেকে তুলে আনা শান্তির শাক হবে, মেটে আলুর রসা হবে, জালি কুমড়ার চাক ভাজি হবে।
কদম ফুলের ছাঁট পিসি ঠাকুমার সাদা পাকা চুলে। সাদা শাড়ি আর পান খাওয়া লাল ঠোঁটে সবসময় ঝুলিয়ে রাখা হাসিতে মানুষটিকে দেখলেই আনন্দ জাগে। আর এ-গল্প, ও-গল্প বলে যখন খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে, তখন কে বলবে মানুষটি কিশোরী বয়সে বিধবা হয়েছে? দাদুর একমাত্র দিদি, তাই বলতে গেলে এ বাড়ির সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত অতিথি সে। দুঃখ যতই থাকুক তাঁর জীবনে, এ বাড়ি সবসময় আপ্যায়ন দিয়ে, আদর দিয়ে সেই দুঃখ ভুলিয়ে দিতে চায়।
আর ঠিক এ কারণেই, দাদু আজ বাজারের ব্যাগ ভরে পাঠাল তাঁর দিদির প্রিয় মাছ। ও হ্যাঁ, দাদুর জোড়াজুড়িতেই মাছপ্রিয় বিধবা এই দিদির পাতে শুরু থেকেই মাছ পড়ে। কেউ কিছু বললে সেই এক উত্তর,
দিদি মাছ না খেলে আমরাও খেতে পারব না, এতগুলো মানুষ আত্মায় কষ্ট পেলে ভগবানও রুষ্ট হবেন।
আজ উঠোনে বাজারের ব্যাগ পড়তেই পিসি ঠাকুমা স্বয়ং বসে গেল মাছ কুটতে। সবই যে তাঁর প্রিয় মাছ। নদীর বড় চিংড়ি, গুজার কাটা মাছ আর চকচকে পুঁটি।
চিংড়ি দেখেই ঠাকুমা উপরতলার মাটির ডোলা থেকে নামিয়ে আনল মাসকলাই ডাল। ছালায় ঘঁষে সবুজ প্রলেপ তুলে নিল। এরপর খোলায় ভেজে হামান দিস্তায় গুঁড়িয়ে নিল ডাল। আর কিছু গোটা রাখল।
উনুনে ফুটতে বসল মাসকলাই ডালের গুঁড়া আর গোটা ডাল। পিসি ঠাকুমার কুটে দেওয়া চিংড়িমাছে হলুদ লবণ মাখানো হল। মা শিলপাটায় মৌরি আর আদা বেটে দিল।
ডাল ফুটে উঠতেই ঠাকুমা তাতে লবণ আর হলুদ গুঁড়ো দিয়ে দিল। আবার ঢাকনা পড়ল। কিছু সময় অপেক্ষা।
আজ গুজার কাটা মাছের রসা হবে। আর হবে পুঁটি মাছের জ্বালের ঝোল।
ডালে এবার কাটা পড়ল, তা ঘুরানো হল নরম হাতে। যেন কিছু ডাল আস্ত থেকে যায়। জলে ভালোভাবে সেদ্ধ ডাল মিশে যেতেই তাতে পড়ল কতগুলো বুক-চেরা কাঁচামরিচ। কাঁচামরিচ আর ডাল ফুঁটে হাওয়ায় মিশতে শুরু করল ঘ্রাণ। রান্নাঘরের কালো ঝুল কালি মাখা কালো জানালা পেরিয়ে সেই ঘ্রাণ গিয়ে দাঁড়াল উঠোনে। উঠোনে তখন বারবেলার রোদ সবে গা মেলেছে। সেই রোদে পেয়ারা গাছের ডাল দুলে দুলে ছায়ার আল্পনা আঁকতে।
আরও কিছুক্ষণ ফুটিয়ে ডালের জল শুকিয়ে নিল অনেকটা ঠাকুমা।
এবার উনুন থেকে সেদ্ধ ডালের কড়াই নামল।
আঁচে উঠল আরেকটি কড়াই। তাতে তেল তেতিয়ে ঠাকুমা ছেড়ে দিল হলুদ, লবণ মাখানো নদীর বড় চিংড়ি। এপাশ-ওপাশ করে ভেজে নিল। চিংড়ি মাছের লালরঙ খুলতেই কড়াই থেকে মাছগুলো তুলে নিল ঠাকুমা।
মাছ-ভাজা তেলে ঠাকুমা আরও খানিক তেল ঢেলে দিল। তাতে পড়ল তেজপাতা আর চারফোড়ন। হ্যাঁ, চারফোড়ন। ঠাকুমা ডালের রসজে কালোজিরে, সাদা জিরে, মেথি আর মৌরি ফোড়ন দেয়। ফোড়ন পুড়ে উঠতেইম তাতে সেদ্ধ ঘন ডাল আর ভেজে রাখা চিংড়ি পড়ল। একটু সময় ফুটিয়ে, তাতে বেটে রাখা আদা আর মৌরিবাটা মেশাল ঠাকুমা। নামানোর আগে ছিটিয়ে দিল লবণ।
এরপর একে একে গুজার কাটা মাছের রসা আর পুঁটি মাছের জ্বালের ঝোল।
লাল বারান্দায় দাদুর পাশে আজ পিসি ঠাকুমা বসল তালপাতার পাখা হাতে নিয়ে। দাদুর পাতের গরম, ধোঁয়া-ওঠা আমন চালের ভাত, তালপাতার বাতাসে জুড়িয়ে দিতে দিতে পিসিঠাকুমা গল্প জুড়ল,
ও ভাই, মেটে আলুর রসা মা কত ভালো বানাত, তাই না রে?
ও ভাই, পুঁটি মাছ ছোটবেলায় কিন্তু তুই একটুও পছন্দ করতি’ না।
ও ভাই, আরেকটু ভাত নে, তোর খাওয়া যে একদম কমে গেছে।
ভাইবোনের এই নির্ভেজাল সময়ে আমার পাতে পড়ল ডালচিংড়ির রসজ। ওখান থেকে একটা চিংড়ি বেছে আমি মুখে পুরি।
উঠোনে পেয়ারা গাছের ছায়ায় এখন ডালিম গাছের ছায়া এসে মিশেছে। সেই ছায়ায় আলগোছে বেলা ফুরিয়ে আসছে।
তাঁতমাকুর আওয়াজে মিশে যাচ্ছে সাহাপাড় মসজিদের আজান,
আল্লাহু আকবার আশহাদু-আল লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ…