আজকাল বাড়ির উঠোনে অন্ধকার একটু বেশি সময় থাকে। আকাশের গা থেকে চুঁইয়ে পড়া ভোরের অন্ধকারে মিশে থাকে হালকা কুয়াশার পরত। সেই পরত অবশ্য মাটিতে পড়তে না পড়তেই ছুমন্তর হয়ে যায়। তা বলে ভোরের বাতাসে হিমটুকু হারিয়ে যায় না মোটেও।
এসবের কোনোকিছুই ঠাকুমাকে বিছানা থেকে উঠতে বাধা দেয় না। ভোরের ওমটুকু আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে ঠাকুমা বিছানা ছাড়ে,
ও ঠাকুমা, ভোরের আজান হয়ে গেল? শুনতে পেলাম না তো।
বড়ঘরের লাল মেঝেতে ঠাকুমার পা পড়তেই সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে ভেসে আসে ভোরের আজান।
ব্যস, দিন শুরু হয়ে গেল এ বাড়ির। বড়ঘরের দরজা আওসে ঠাকুমা উঠোনে নামতেই ফটকে পূর্ণির মায়ের হাঁক। মানুষটি শুধু রাতটুকু কোনোরকমে নিজের ঘরে কাটায়। নয়তো এ বাড়ির গোবর ছড়াজল থেকে শুরু করে সন্ধ্যায় তুলসীতলায় এঁটেল মাটির পোঁচ দিয়ে তবেই মানুষটি ঘরে ফিরে। আর এ বাড়িও সেই মানুষটিতে এতই অভ্যস্ত, যে পার্বণের প্রথম আঁচ পড়া থেকে শুরু করে অবেলায় কাঁথা ফোঁড়ের সুতা ছাড়ানো—সবকিছুতেই তাকেই চায়। তাই পূর্ণির মাকে এ বাড়ির আপন মানুষ না বলে বাড়ির অভিন্ন অংশ বলা যায় নির্দ্বিধায়।
ও পূর্ণির মা, আজ ছড়া দিয়ে খোলা উনুন না লেপে দিও…
ঠাকুমার কথাটুকু কানে আসতেই আমি বুঝে যাই—আজ এ বাড়ি পরবের বাড়ি। শুরু হয়ে যায় আমার উশখুশ। কাঠের দোতলা থেকে মনিপিসি পাথরের যাতি নিয়ে নেমে আসে,
মনি, এত ভোরে উঠছিস কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
আমি ঠাকুমার নস্যি রঙের চাদরখানা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে বলি,
ও মনিপিসি, আজ কী হবে বাড়িতে?
আমার দিকে মনিপিসির মনোযোগ এখন থাকলে তো। লাল বারান্দায় যাঁতি নামিয়ে মনিপিসি আবার উঠে গেল কাঠের দোতলায়। নামিয়ে আনল ঝোলা গুড়ের হাঁড়ি।
ও ঠাকুমা, আজ ফুল তুলতে যাবে না?
সারাদিনের মধ্যে এই ফুলতোলার সময়টুকুতেই তো ঠাকুমাকে আমি আমার মতো করে পাই। এ-কথা ও-কথায় আমরা দু-জনকে বারবার জানাই—আর কেউ না, তুমিই আমার সব আবদারের জায়গা। তবে শহরে যাবার পর অবশ্য ঠাকুমার আবদার আমার থেকেও বেড়ে গেছে। ফুলের সাজি হাতে বাইরবাড়িতে যেতে যেতেই ঠাকুমার আবদার,
ও দিদি, এবার বার্ষিক পরীক্ষায় খুব ভালো করতে হবে কিন্তু তোমার। শহরে বাবা নিয়ে গেছে তো ভালো করে পড়াতে। বাবার কথা মানতে হবে দিদি।
শহরের কথা ভালো লাগে না আমার। হাতে ফুলের সাজি ঝুলিয়ে ঠাকুমার সাথে জোলা পাড়ার পথ ধরতে ধরতে আমি বললাম,
আমার পড়া শেষ হলে আমি আর শহরে থাকব না ঠাকুমা।
ভোরের গা থেকে অন্ধকার মুছে গিয়ে সাদাটে আলো দিনের দিকে যেতে শুরু করেছে। সে আলোয় ঠাকুমার মুখের ম্লান হাসিটুকু আমার চোখে ঠিকই ধরা পড়ে,
পড়া শেষ হলে আরোও বড় শহরে যেতে হয় দিদি। দেখবে তখন আর ফিরতে মন চাইবে না।
না না, ঠিক বলছে না ঠাকুমা। ঠাকুমা জানেই না—শহর থেকে ফেরার জন্য আমারও যে আত্মায় টান দেয় বারবার। শহরের ছিমছাম নীরবতা আমার মন খারাপ করে দেয়। সেখানে তাঁতমাকুর আওয়াজ নেই, বাইরবাড়ির হৈ-হট্টগোল নেই, দেবদারু বাগানের খেলনাপাতি সময় নেই, কিচ্ছু নেই। আমি সত্যিই ফিরে আসব—তুমি দেখো ঠাকুমা।
আমার কথাগুলো শব্দ হয়ে ফোটার আগেই গোবিন্দ তাঁতির বাড়ির ফটকে আমরা। সে বাড়ির বউদের বলে ঠাকুমা শ্বেতচন্দন লতা থেকে ক-খানা ফুল নেবার অনুমতি নেয়। ফুল তোলার আগে দু-হাতে তালি দেয় ঠাকুমা,
ঘুমন্ত গাছ থেকে ফুল তুলতে নেই দিদি।
এরপর দেরি করে না ঠাকুমা, কতগুলো ফুল তুলে সাজিতে ফেলেই আমরা পথ ধরি বাড়ির।বাইরবাড়িতে আসতেই নাকে ধাক্কা দেয় শেফালী ফুলের ঘ্রাণ,
ও ঠাকুমা, শুক্লাদের বাড়িতে চল….
আমার কথা শেষ হবার আগেই শুক্লার ঠাকুমা কলাপাতায় ভরে শেফালী ফুল নিয়ে বাইরবাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়ায়,
ও বৌ, নে, সক্কাল বেলা উঠোনে পা দেবার যোগার ছিল না, রাতে ঘ্রাণেই বুঝছিলাম এ বছর গাছ ঝাপি ফুল আসবি।
শুক্লার ঠাকুমাকে বাইরবাড়িতে রেখেই আমাদের ভেতর বাড়িতে ঢুকতে হয়। রান্নাঘরের উনুনে আঁচ পড়ে গেছে। বেশি কিছু না ঘি ভাত আর আলু সেদ্ধ পড়বে আজ সকালের পাতে। মনিপিসি লাল বারান্দায় কেরোসিনের স্টোভে চা বসিয়ে দিয়েছে।
ঠাকুমা দেরি না করে কলঘরে চলে গেল, আর ঠিক তখনই বাইরবাড়িতে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে গরুরগাড়ি এসে দাঁড়াল।
এই শব্দ আমার খুব চেনা। এই শব্দ মানেই তো আমার আর মনিপিসির জন্য খুশির প্যান্ডোরা খুলে যাওয়া,
ও মনিপিসি, তাড়াতাড়ি আসো, আইনুল চাচা এসেছে।
তবে ওই বলা পর্যন্তই। মনিপিসির জন্য দাঁড়ানোর তর সয় না আমার।
ও আইনুল চাচা, আমার জন্য চাচী…..
আমার কথা শেষ হবার আগেই এলুমিনিয়ামের টিফিনবাক্স আমার হাতে চলে আসে। পান খাওয়া দাঁতগুলো বের করে আইনুল চাচার স্বগোতোক্তি,
শহর থিকি আম্মা আইছে আর চাচী পিঠা না পাঠালি হবি?
আমার আর মনিপিসির জন্য সকালের পাতে ঘি ভাতের বদলে পড়ে চাচীর পাঠানো রসে ভেজানো সাজ পিঠা আর নারিকেলের বরফি। লাল বারান্দায় আমাদের পাশেই আইনুল চাচার পাত। তাতে ঘি ভাত, আলুসেদ্ধ আর রাতের হিমে জমে থাকা কাতলের এক টুকরো।
ঠাকুমা নিত্য পূজা সেরে চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে বসে গেছে যাতির সামনে। তাতে আইনুল চাচার সাথে আসা মাদলা গ্রামের লাল তিল। ঘষে সাদা করবে ঠাকুমা।
আজ আমাদের উঠোনে বাজারের ব্যাগ পড়ল বেশ তাড়াতাড়ি। আর সেই ব্যাগ থেকে অনেকদিন পর তরবর করে বেরিয়ে এল নদীর খলবলে মাগুর। দাদুর আর্জিতে আজ ঠাকুমা আদা মাগুর রান্না করবে।
তবে রান্নাঘরের উনুনে আঁচ পড়ার আগে আঁচ পড়ল উঠোনের খোলা উনুনে।পূর্ণির মা গুড়ের কড়াই বসালো তাতে। ঠাকুমা এরমধ্যেই বেশ খানিক লাল তিল যাতায় ঘষে সাদা করে ফেলেছে।
আর ওদিকে মাগুর মাছে ছাই মেখে কেটে নিচ্ছে বড় বৌমা।আজ দুপুরের জন্য রান্না হবে পাঁচমিশালি ডাল, মুগের ডাল ছেটানো সবজি, আলুর ঝুরি ভাজা, আদা মাগুর আর শুকনো বরইয়ের টক।
খোলা উনুনে গুড়ের কড়াইয়ে পাক এল। ঠাকুমা ছোটো ধামায় ভরা সাদাতিল তাতে ঢেলে দিল। উলু যোগার দিয়ে উঠল পূর্ণির মা। এই তিলের চাকতি কাল পাল দাদুর হাতে পড়বে সবার আগে। এরপর একে একে খৈ এর মোয়া আর চিড়ার মোয়া বানাল ঠাকুমা।
রান্নাঘরের উনুন এখন অপেক্ষায় ঠাকুমার। এ বাড়িতে ঠাকুমার মতো আদা মাগুর আর কেউ রান্না করতে পারে না যে।
বেলার গায়ে রোদ থেকে তাপ উবে গেল খানিক। বারবেলার বাতাসে জমল আলটপকা হিম।
রান্নাঘরের উনুনে উঠল লোহার কড়াই। তাতে বেশ খানিক সর্ষের তেল। সেই তেল তেতে উঠলেই আদার রস মাখানো মাগুর মাছের টুকরো ঠাকুমা দিয়ে দিলো কড়াইয়ে। খানিক সাঁতলেই নামিয়ে দিল মাছের টুকরোগুলো। এবার কড়াইয়ে পড়ল আদা বাটা আর কাঁচামরিচ বাটা। তাতে নামমাত্র হলুদ। ঠাকুমার কথায়,
মাছের পদে হলুদ না দিয়ে খেতে নেই।
কড়াইয়ের মশলায় একটু জল আর লবণ দিয়ে ঠাকুমা কষাল খানিক সময়। এরপর তেল ভেসে উঠলে ঠাকুমা আদার রস মেশানো জল দিয়ে দিলো তাতে। ফুটে উঠল সেই আদার ঝোল বাড়ির উঠোন ঘ্রাণে ভাসিয়ে। আর দেরি করার সময় নেই। ঠাকুমা সাতলে রাখা মাছের টুকরোগুলো দিয়ে খানিক সর্ষের তেল ছড়িয়ে নামিয়ে নিল আদা মাগুর।
আজ দুপুরের পাত উঠে যেতেই দাদু আর আইনুল চাচা গিয়ে দাঁড়ালো মন্দিরের সামনে। পাল দাদুর জন্য মাদলা গ্রাম থেকে আনা খড়ের পালা পড়ল মন্দিরের সামনে। এই খড় দিয়েই বড়পূজার কাঠাম বাঁধা হবে।
তাঁতঘরের মাকুর আওয়াজ একটু একটু করে কমে আসছে। দেবদারু বাগানের মাথায় পড়ে আসা বেলায় ধ্যানমগ্ন কমলা রোদ। সাহাপাড়ার মসজিদ থেকে বিকেলের আজান ভেসে আসতেই ঠাকুমার হাঁক,
ও দিদি এদিকে আসো, খোলা চুলে অবেলায় বাইরবাড়িতে থাকতে নেই।
আমি মন্দির, কাঠাম, খড়ের পালা সব ফেলে দৌড়ে আসি ঠাকুমার কাছে। গা ঘেঁষে দাঁড়াই ঠাকুমার। হাকিমপুরি জর্দার চেনা ঘ্রাণটুকু শ্বাসে পুরে আবদার করি,
ও ঠাকুমা, এবার বড়পূজায় আমার কিন্তু ফুলতোলা জামা চাই।